২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

‘পরাবাস্তব তদন্ত’

‘পরাবাস্তব তদন্ত’ - ছবি সংগৃহীত

সৃজনশীল সাহিত্যে পরাবাস্তব ধারার কদর কত বেশি সেটি সমঝদার পাঠকমাত্রই জানেন। নিজস্ব চিন্তাভাবনার আলোকে কোনো কিছু সৃষ্টি করা এবং কোনো বিষয় নতুনভাবে উপস্থাপনের চিন্তাভাবনাই সৃজনশীলতা। এর প্রতিশব্দ সৃষ্টিশীলতা। সৃজন ক্রিয়াপদটির মানে সৃষ্টি করা, মৌলিক কিছুর প্রবর্তন করা, সত্যের উন্মোচন করা। সৃষ্টিশীলতার সাথে আরো কয়েকটি শব্দের যোগসূত্র রয়েছে। শব্দগুলো হচ্ছে প্রতিভা, মেধা, বুদ্ধি। প্রতিভাবানরাই সাধারণত হয়ে থাকেন মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত। প্রতিভার অন্তর্গত উপাদান হচ্ছে স্মৃতিশক্তি, কল্পনাশক্তি, সৃজনশীলতা, অর্থপূর্ণ উপলব্ধি ও ধারণা বিশ্লেষণের নৈপুণ্য, যুক্তিপ্রয়োগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। প্রতিভাবানরাই সৃষ্টিশীল। আর সৃষ্টিশীলরাই প্রতিভাবান। সাহিত্যে নানা শাখা রয়েছে, যেমন- গল্প, কবিতা উপন্যাস, নাটক ইত্যাদি। যারা সৃজনশীল লেখালেখিতে পারঙ্গম এবং যাদের লেখনী সদা সক্রিয় তারাই সৃষ্টিশীল লেখক। বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে স্বকীয়তার স্বাক্ষর রাখতে যারা সক্ষম হন তারা বৃহত্তর পাঠক সমাজে বরণীয় হযে ওঠেন। এ ধারার কবি-সাহিত্যিকরা হয়ে থাকেন প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত আর কল্পনাপ্রবণ। তীক্ষ্ণ ধীশক্তিসম্পন্ন। রচনাশৈলী হয় গতানুগতিকতার বাইরে সম্পূর্ণ আলাদা। এমন কবি-সহিত্যিকের সাহিত্যকর্ম থাকে নতুনত্বে ভরপুর। সব কালে সব যুগে তাই সৃজনশীল লেখক হন সমাদ্রিত।

এ দিকে পরাবাস্তব চিন্তা বা তত্ত্বনির্ভর সাহিত্যও আধুনিক সাহিত্যের আরেকটি জনপ্রিয় ধারা; যেখানে ঘটনাহীন বিষয়কে লেখনী শক্তি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয় বাস্তবরূপে। পরাবাস্তবতা এমন একধরনের বাস্তবতা, যার সাথে চাক্ষুষ বাস্তবতার কোনো মিল নেই। বস্তুত পরাবাস্তব চেতনার মূল ভিত্তি হলো অযুক্তি ও অবচেতন। মানুষের বাস্তব চেতনা যখন শিথিল হয় তখন তার মনে অবচেতনে বিদ্যমান বোধ প্রভাব ফেলে। পরাবাস্তবতার লক্ষ্য হলো- অবচেতনার বাস্তব চিত্র আঁকা নয়। কিংবা অবচেতনার নানা উপকরণ নিয়ে কল্পনার আলাদা এলাকা সৃষ্টি করাও নয়। এর লক্ষ্য- চেতন ও অবচেতন মনের সাথে বাইরের জগতের মনোদৈহিক ভেদরেখা মুছে দেয়া।

আবার রহস্য উপন্যাসে থাকে টান টান উত্তেজনা। ফলে স্কুল-কলেজ পড়–য়ারা গোয়েন্দা উপন্যাস পড়ে গোগ্রাসে। এতে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুঁদ হয়ে থাকে। আমাদের দেশেও মাসুদ রানা, দস্যু বনহুর কিংবা সাইমুম সিরিজ এক সময় ছিল তুমুল পাঠকপ্রিয়। তবে ইদানীং পুলিশের কিছু তদন্ত প্রতিবেদনও কম উত্তেজক আর মনকাড়া নয়। তাতেও মিলছে নাটকীয়তা। ওই সব প্রতিবেদন পড়ে প্রতিবেদকের কল্পনাশক্তির তারিফ না করে পারা যায় না। বলা যায়, কিছু প্রতিবেদন তো রহস্য উপন্যাসকেও হার মানায়! এ ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তার রিলেরেসে ক্ষেত্রবিশেষে সৃজনশীল বা পরাবাস্তব সাহিত্যকর্ম পিছিয়ে পড়লে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই! তেমন কয়েকটি পুলিশি তদন্ত প্রতিবেদন তুলে ধরলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। পাঠান্তে যে কেউ বলবেন, কল্পনার ডানা মেলে আর মনের মাধুরী মিশিয়ে ওই সব তদন্ত প্রতিবেদন রচিত। রচনাশৈলীও অতুলনীয়। সাহিত্যগুণে ঠাসা। বলা যায় তুলনারহিত। এসব এখন সাধারণের মনের খোরাক মেটাবে বৈকি! পড়লে রীতিমতো বাক রুদ্ধ হতে হবে। অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করতে হবে, উৎকৃষ্ট শিল্পকর্ম বটে!

এবার তদন্ত প্রতিবেদন তিনটি একটু পরখ করে দেখা যেতে পারে। প্রথমটির ঘটনাস্থল নারায়ণগঞ্জ। পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে ‘মৃত’ মেয়েটির জীবিত ফিরে আসা নিয়ে গণমাধ্যম সরগরম হয়ে ওঠে। ২৫ আগস্ট প্রায় সব জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, নিখোঁজের দুই দিন পর ১৫ বছরের কিশোরীকে অপহরণের অভিযোগে ৬ জুলাই নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় মামলা করেন ওই মেয়ের বাবা। মামলার পর সন্দেহভাজন তিন ব্যক্তিকে দ্রুত গ্রেফতার করে হেফাজতে নেয় পুলিশ। আসামিরা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীতে বলেন, ওই কিশোরীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে তারা লাশ শীতলক্ষ্যা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছেন। কৌতূলহের বিষয় হলো, পুলিশের খাতায় মৃত সেই মেয়েটি ৫১ দিন পর গত ২৩ আগস্ট এলাকায় ফিরে আসে। আর হাওয়া হয়ে যাওয়া দিনগুলোতে পছন্দের প্রেমিককে বিয়ে করে সুখে ঘর-সংসার করতে থাকে। আপনজনের মুখ দর্শন তখনই হয়; যখন টাকা-কড়ির টান পড়ে।

দ্বিতীয় ঘটনাটিও নারায়ণগঞ্জের। মানবজমিনের ২ অক্টোবর, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘মামুন নামে এক যুবককে অপহরণের পর বিষাক্ত শরবত পান করিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যায় ফেলে দিয়ে গুম করা হয়েছে। পুলিশের তদন্তেই এমন তথ্য বেরিয়ে আসে। পরে জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের তদন্তের একপর্যায়ে সিআইডি মামলাটি তদন্ত শেষ করে ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। কিন্তু ৬ বছর পর ৩০ সেপ্টেম্বর বুধবার দুপুরে মামুন জীবিত এবং সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।’

আদালতের বরাতে ওই প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, ২০১৪ সালের ১০ মে মামুন অপহরণ হয়েছেন অভিযোগ এনে দুই বছর পর ২০১৬ সালের ৯ মে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেন তার বাবা আবুল কালাম। মামুনকে অপহরণের পর গুমের অভিযোগ করা হয়েছিল। মামলার পর পুলিশ ছয়জনকে গ্রেফতার করে। তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে আসামিদের রিমান্ড চাওয়ার সময় আর্জিতে উল্লেখ করেন, ‘খালাতো বোন তাসলিমা ২০১৪ সালের ১০ মে মামুনকে ডেকে নিয়ে কৌশলে অপহরণ করে বিষাক্ত শরবত পান করিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ শীতলক্ষ্যায় ফেলে দিয়ে গুম করেছে।’ ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়। সাক্ষী করা হয়েছিল ২১ জনকে।

তৃতীয় ঘটনাটি আরো চিত্তাকর্ষক। চট্টগ্রামে হত্যাচেষ্টা মামলার এক আসামি পুলিশের সাথে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হওয়ায় তার নাম মামলা থেকে বাদ দেয়ার জন্য আদালতে আর্জি জানান তদন্ত কর্মকর্তা। পরবর্তী সময়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন থেকে বাদও দেয়া হয়। কিন্তু গোলবাঁধে মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিলের পর। এক বেরসিক সাংবাদিক এ নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেন। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, “নিজের ‘নিহত’ হওয়ার কথা শুনে অবাক হয়ে যান জয়নালও। বলেন, ‘আমি তো মরিনি। বেঁচে আছি। কখন বন্দুকযুদ্ধে মরলাম” (প্রথম আলো ১ সেপ্টেম্বর, ২০২০)। চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার আমিন জুট মিল এলাকার আবদুল জলিলের ছেলে জয়নাল (২০)। জয়নাল যে মামলার আসামি এটির তদন্ত শেষে ছয়জনকে আসামি করে গত বছরের ডিসেম্বরে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। এজাহারে নাম থাকা আসামি জয়নাল সম্পর্কে অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘জয়নাল পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় তাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো’।

সাম্প্রতিক সময়ের টাটকা এই তিনটি পুলিশি তদন্ত প্রতিবেদন পাঠে অনুভূতি জানতে চাওয়া হলে যে কেউ বলবেন, দেশে পুলিশ সদস্যদের কেউ কেউ কল্পরাজ্যের বাসিন্দা হতে এতটাই আনন্দ বোধ করেন যে, তদন্তকাজে তারা রহস্য উন্মোচনে সৃজনশীল কিংবা পরাবাস্তবতার অবতারণায় পারঙ্গম। যা সত্য-মিথ্যার মিশেলে হয়ে ওঠে বাস্তবতা বিবর্জিত। এ ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন, ‘কবি, তব মনোভূমি রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’ অর্থাৎ কবি যা বলবেন সেটিই বড় সত্য, এর চেয়ে বড় সত্য কিছু নেই।

সম্ভবত এ মতের ওপর ভিত্তি করেই শুধু মিথ অবলম্বনে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট পাঁচ শ’ বছরের পুরোনো বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণের অনুমতি দিয়েছেন।

তবে এ কথা তো কবুল করতেই হয়, অঘটনে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা সভ্য সমাজে অতীব জরুরি। রাষ্ট্র-সমাজ-সংসার টিকিয়ে রাখতে এর বিকল্প নেই। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনই সবার প্রত্যাশিত। সমাজে শৃঙ্খলা অটুট রাখতে রাষ্ট্রের রয়েছে পুলিশ বাহিনী। তারা যে কোনো ফৌজদারি অপরাধের তত্ত্ব-তালাশে নামেন। মানে তদন্ত করেন। পুলিশই এর প্রথম দায়িত্বশীল। তারাই তদন্ত শেষে আদালতে মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অর্থাৎ কারা কিভাবে অপরাধে জড়িত, সেই বয়ান আর কী। তার পরই বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়। ফলে ফৌজদারি অপরাধে ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে পুলিশের তদন্তকাজ অপরিহার্য। তদন্ত সঠিক পথে এগোলেই কেবল ভুক্তভোগীর ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ প্রশস্ত হয়। কিন্তু সেই তদন্তকাজ দায়সারা, মতলবি কিংবা ভুল হলে মাশুল গুনতে হয় নিরপরাধকেও। খেসারত দিতে হয় চড়া মূল্যে। সেই ক্ষতিপূরণ অন্য কিছুতে করা যায় না। এমনও দেখা গেছে, ঘটনার সাথে দূরতম সম্পর্কও নেই, এমন ব্যক্তিও বছরের পর বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দিজীবন কাটিয়েছেন। তাই বলছিলাম কী, যেসব পুলিশ তদন্তকাজে সৃষ্টিশীলতা বা পরবাস্তবতায় ভর করে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করছেন, দয়া করে তারা যেন কল্পনায় ভর না করে, শুধু তথ্য-উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে তদন্তে অগ্রসর হন। এতে মজলুমের মুশকিল আছান হবে। পুলিশকে আরো খেয়াল রাখা জরুরি, তাদের খেয়ালিপনায় কোনো নিরপরাধ যেন বিনা দোষে দুর্বিপাকে না পড়েন। তাহলেই কেবল চার পাশের চেনাজানা সমাজটা হবে বাস উপযোগী।

camirhamza@yahoo.com

 


আরো সংবাদ



premium cement
দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষ দিশেহারা : আমিনুল লিবিয়ায় নিয়ে সালথার যুবককে নির্যাতনের ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ১ মনুষ্য চামড়ায় তৈরি বইয়ের মলাট সরানো হলো হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আওয়ামী লীগকে বর্জন করতে হবে : ডা: ইরান আমরা একটা পরাধীন জাতিতে পরিণত হয়েছি : মেজর হাফিজ তরুণীর লাশ উদ্ধারের পর প্রেমিকসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা ভিয়েনায় মুসলিম বিশ্বের রাষ্ট্রদূতদের ইফতারে ইসলামিক রিলিজিয়াস অথোরিটি আমন্ত্রিত এবার বাজারে এলো শাওমির তৈরি বৈদ্যুতিক গাড়ি সকল কাজের জন্য আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতার অনুভূতি থাকতে হবে : মাওলানা হালিম বিএনপি জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি করে : ড. মঈন খান সাজেকে পাহাড়ি খাদে পড়ে মাহিন্দ্রচালক নিহত

সকল