১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ন্যানো চিপের নিগড়ে বন্দী সভ্যতার স্বাধীনতা

ন্যানো চিপের নিগড়ে বন্দী সভ্যতার স্বাধীনতা - ছবি সংগৃহীত

"Every once in a while, a revolutionary product comes along that changes everything."-২০০৭ সালে প্রথম আইফোন উদ্বোধনকালে অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস বলেছিলেন এ কথা।

বিশ্বের সবচেয়ে দামি কোম্পানি ও ব্র্যান্ড অ্যাপল অক্টোবর মাসের ১৩ তারিখে আইফোন ১২ সিরিজ ঘোষণা করেছে। এই স্মার্টফোনগুলোয় ব্যবহার করা হয়েছে এ১৪ বায়োনিক চিপ। এর আগে অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বা কমিউনিকেশন সামগ্রীতে এ ধরনের অত্যাশ্চর্যজনক চিপ ব্যবহার করা হয়নি। আইফোন ১২-এর সাথে আইপ্যাড এয়ারের সর্বশেষ মডেলেও এই চিপ ব্যবহার করা হয়েছে। এটি একটিমাত্র পাঁচ ন্যানোমিটার চিপ যাতে রয়েছে ১১.৮ বিলিয়ন ট্রানজিস্টর। কিভাবে মাত্র পাঁচ এনএম চিপে এই বিশাল ট্রানজিস্টর সংযোজন করা সম্ভব হয়েছে, তা হয়তো আজ থেকে মাত্র পাঁচ বছর আগেও অবিশ্বাস্য বলে মনে হতো। টেলিকমিউনিকেশন, স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, কম্পিউটার ইত্যাদিতে যে বিস্ময়কর অগ্রগতি হয়েছে ও প্রতিনিয়ত হচ্ছে তাতে মাত্র এক বছরের ব্যবধানে আরো সীমাহীন অগ্রগতি হওয়া এখন ‘ডালভাত’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুপার কম্পিউটার হয়ে আজ বিশ্বের উন্নত কয়েকটি দেশের হাতে চলে এসেছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। মূলত এই কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জন্যই করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকার ফর্মুলা তৈরি ও আনুষঙ্গিক বিশ্লেষণ এত দ্রুত সম্পন্ন করা গেছে। তাই বিজ্ঞানীরা এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে একটি মারাত্মক ভাইরাস প্রতিরোধী কার্যকর টিকা পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। অথচ যদি এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার না থাকত তা হলে আট-দশ বছরেও হয়তো এসব কাজ সম্পন্ন করা মানুষের পক্ষে সম্ভব হতো না। স্মার্টফোনের কথায় যদি আসি তা হলে দেখা যায়, পৃথিবীতে প্রথম স্মার্টফোন তৈরি করে ফিনল্যান্ডের কোম্পানি ‘নকিয়া-এন ৮০’ নামে। ওটিতে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া যেত এবং অবস্থান পরিবর্তন করা হলে স্থান অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে সময় পরিবর্তন হতো। প্রথম অ্যাপ বেসড স্মার্টফোন বাজারে নিয়ে আসে অ্যাপল ২০০৭ সালে। স্টিভ জবস ওই প্রথম আইফোনের উদ্বোধন করার পরপরই পুরো বিশ্বে মানুষ ভোর রাত থেকে অ্যাপল স্টোরের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে যায় অদ্ভুত এক ডিভাইস কেনার জন্য। অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে পৃথকভাবে ই-মেইল, আবহাওয়া, ম্যাপ ইত্যাদির ব্যবস্থা সবাইকে অবাক করে দেয়। আজ হয়তো অজপাড়াগাঁয়ের এক কৃষকও স্মার্টফোন ব্যবহার করে, কেউ আর অবাক হয় না। বরং অপেক্ষা করে কখন আরো অ্যাডভান্সড স্মার্টফোন আসবে। অর্থাৎ বিস্ময়গুলো হারিয়ে যাচ্ছে বা গেছে। কিন্তু মাত্র ১৩ বছরের মধ্যে এই খাতে এমন অবিশ্বাস্য উন্নয়ন হয়েছে যে, তা মানব সভ্যতায় আর কখনো হয়নি।

২০০৪ সালের ব্যক্তিগত একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। তখন দৈনিক ইনকিলাবে বিশেষ সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করার সময় এর উপদেষ্টা সম্পাদক ও প্রখ্যাত সাংবাদিক মরহুম আনোয়ার জাহিদের সাথে এক সফরে পাকিস্তান যেতে হয়েছিল। সেখানে একদিন অভিজাত ইসলামাবাদ ক্লাবে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সম্মানে একটি চা-চক্র ও মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। ওতে প্রধান অতিথি ছিলেন পাকিস্তানের তৎকালীন তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ড. আতাউর রেহমান। জাহিদ ভাই অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে আমাকে বললেন, ড. রেহমান শুধু মন্ত্রীই নন, তিনি একজন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক। পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা তৈরির সাথে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। যেন অনুষ্ঠান শেষে চা-চক্রের সময় যেভাবে হোক তার একটা মিনি সাক্ষাৎকার নিয়ে নেই। আগ্রহের সাথে ড. রেহমানের সাথে যতটুকু পারি কথা বলার চেষ্টা করেছি। স্বল্প সময়ের মধ্যে তিনি অন্য সব কথার শেষে একটি ভবিষ্যদ্বাণী করেন বেশ গুরুত্ব দিয়ে। তিনি আমার কাছে জানতে চান, আমি কোনো মোবাইল ফোন ব্যবহার করি কি না। পকেট থেকে বেশ স্লিম একটি নকিয়া ফোন বের করে তাকে দেখাই। আমার মোবাইল ফোনটি ছিল তখনকার সময়ের অন্যতম রঙিন ডিসপ্লের সব ফোনের মধ্যে একটি আকর্ষণীয় মডেল। তিনি ফোনটি তার হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে বলেন, মাত্র সাত-আট বছর অর্থাৎ ১৯৯৬-৯৭ সালেও মোবাইল ফোন মানে ছিল ইয়া ঢাউস সাইজের ওয়াকিটকির মতো দেখতে এক বস্তু! আর দেখো এখন এটা কত ছোট হয়ে এসেছে, রঙিন ডিসপ্লে যুক্ত করা হয়েছে, সাথে রেডিও পর্যন্ত আছে। তার পর তিনি সেই অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণীটি করলেন।

বললেন- মনে রেখো, মানবসভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত (২০০৪ সালের অক্টোবর) মানুষ যত জ্ঞান আহরণ করেছে, যত প্রযুক্তি তার হাতে এসেছে, ২০০৭ সালে গিয়ে তা অকস্মাৎ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। মানে পৃথিবীতে মানুষ পা দেয়ার পর থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আহরিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের মানদণ্ড যদি হয় ১০০, তা হলে ২০০৭ সালে তা একলাফে ২০০ হয়ে যাবে! বিস্মিত হওয়ার মতো কথা। ড. রেহমান কিন্তু দৃঢ়ভাবেই বললেন, “তুমি দেখো, সব দ্বিগুণ হয় কিভাবে। সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি হবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে, যা এখন বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। তার অবয়ব কেমন হবে তাও কেউ এখনই বলতেও পারে না। আমি শুধু ধারণা করতে পারি- তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিকমিউনিকেশনের অগ্রগতি সব পাল্টে দেবে। ব্যক্তিজীবন তো পাল্টাবেই, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ইস্যুগুলোও সম্পূর্ণ বদলে যাবে। জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ উপন্যাসের মতো অবস্থা হবে নাগরিকদের।” চমকিত হওয়ার মতো ভবিষ্যদ্বাণী বৈকি।

তাই আগ্রহ নিয়ে আরো জানতে চাইলাম- তার পর কী হতে পারে? ড. আতাউর রেহমানের উত্তর- তা জানি না। তবে জ্ঞান-বিজ্ঞান লাফিয়ে লাফিয়ে মাল্টিপ্লাই হবে। আমি বলে বসলাম, তা হলে তো পৃথিবী আশা করতে পারে যে, তখন ক্যান্সার, এইডসের মতো রোগের মহৌষধও বেরিয়ে যাবে। তিনি অবলীলায় বললেন, ‘না। উন্নতিটা ঘটবে তথ্যপ্রযুক্তিতে ও টেলিকমিউনিকেশনে। কেউ চিকিৎসা ও মানবসেবায় কোনো জ্ঞান ঠিকমতো কাজে লাগাবে না। বরং মানুষ, বিশেষ করে রাষ্ট্রযন্ত্র পাগল হয়ে যাবে ওই সব সেক্টরের অগ্রগতি দিয়ে নাগরিকদের ওপর নজরদারি বাড়িয়ে দিতে, মনিটর করতে, গুপ্তচর ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে মনস্টারে পরিণত করতে। সামরিক খাতেও যথেচ্ছ ব্যবহার করা হবে ওই সব জ্ঞানের অগ্রগতিকে। কিন্তু মনে রেখো, মানুষের জীবন রক্ষায় ওসবের খুব একটা ব্যবহার করা হবে না।’ তার কথায় যারপরনাই চমৎকৃত হয়েছিলাম। ওই দিন রাতেই ফ্যাক্সে ঢাকার অফিসে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলাম এবং তা ছাপাও হয়েছিল।

এরপর ড. রেহমানের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা বহুবার ভেবেছি। কোনো কূলকিনারা করতে পারিনি। বিজ্ঞানীদের অনেকেই মনভোলা, বিক্ষিপ্ত স্বভাবের হয়ে থাকেন। আইনস্টাইনও মনভোলা টাইপের মানুষ ছিলেন। তাই একসময় ড. রেহমানের কথাকেও অমন কোনো বিক্ষিপ্ত কথা ভেবে ভাবনা দূর করতে চেয়েছি। কিন্তু যেই ২০০৭ সালে অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস প্রথম অ্যাপ-বেসড আইফোন বাজারে ছাড়লেন তখন মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। ইলেকট্রনিক সামগ্রী নিয়ে আমার বরাবরই উৎসাহ। তাই খুঁজে আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধুকে পেলাম- যে বিদেশ থেকে বহু কষ্টে একটি আনলকড আইফোন নিয়ে এসেছিল। তার অফিসে গিয়ে সেই ফোনটি নেড়েচেড়ে দেখলাম। বিস্মিত হলাম। কিভাবে এটা সম্ভব? সোজা মনে পড়ল ড. আতাউর রেহমানের কথা। স্টিভ জবসও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একই সুরে বললেন, ‘আইফোন হচ্ছে এক রেভ্যুলিউশনারি প্রডাক্ট যা সব কিছু পাল্টে দেবে!’ অদ্ভুত! ড. রেহমানের প্রেডিকশন এমনভাবে ফলে গেল?

কোনো সন্দেহ নেই, ২০০৭ সালের ওই আইফোন তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিপ্লবের সূচনা করে, নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। আজ চোখ বুজে ভাবুন, এখন যে স্মার্টফোন, আইপ্যাড, স্মার্ট টেলিভিশন, ইন্টারনেট ব্যবহার করেন তা কি ওই আইফোন বের হওয়ার আগে চিন্তা করতে পেরেছিলেন? প্রযুক্তি এতটাই অগ্রসর হয়েছে যে, আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স মানুষের জীবন অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। গুগল অ্যাসিস্ট্যান্ট বা অ্যাপলের সিরি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার রুটিন, ট্রাফিক নেটওয়ার্কের অবস্থা, বিমান যাত্রার সময়, বিমানবন্দরের বোর্ডিং গেট সব আগাম জানিয়ে দিচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে আবার এসবের অগ্রগতি হচ্ছে আমাদের অজান্তে। আজ এই স্মার্টফোন দেখে হতবাক হচ্ছে মানুষ, দুই মাস পর আরেকটি দেখে মনে করছে, আগেরটা তো কিছুই না! এসব অগ্রগতির ঢেউ লেগেছে বিমান যোগাযোগ, নতুন প্রযুক্তির বিমান তৈরি, টেলিকমিউনিকেশন, ইন্টারনেট ব্যবস্থার উন্নয়ন, মহাকাশ গবেষণা খাতে। তবে তথ্যপ্রযুক্তির এ-জাতীয় উন্নয়নকে সবচেয়ে গভীরভাবে কাজে লাগাচ্ছে পৃথিবীর সব সশস্ত্রবাহিনী, গোয়েন্দা ও গুপ্তচর সংস্থা এবং সর্বোপরি রাষ্ট্র। মানবকল্যাণে কতটুকু ব্যবহার করা হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নকে, তা বিতর্কের বিষয়। আবার এই খাতে বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে অস্বাভাবিক পরিমাণ বাজেট। অন্যসব খাত বিবেচনায় এই বাজেট লক্ষণীয়ভাবে অনেক অনেক বেশি। কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই এই খাতে বছরে চার ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি খরচ করা হচ্ছে। চীন, রাশিয়াসহ অন্য সব দেশের কথা বিবেচনা করলে আমাদের মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার অবস্থা হবে বৈকি। তুলনামূলকভাবে স্বাস্থ্য, বাসস্থান খাতে ব্যয় হচ্ছে এর চেয়ে দৃষ্টিকটু পর্যায়ে অনেক কম অর্থ যা কয়েক বিলিয়নের ঘর হয়তো পার হবে না।

অস্বীকার করার উপায় নেই, এসব প্রযুক্তির হঠাৎ উল্লম্ফন মানবজাতির বিজ্ঞান গবেষণার বিস্ময়। এটি মানুষ নামের প্রাণীর মেধার অবিশ্বাস্য ক্ষমতার প্রমাণ। মানবকল্যাণেই এর ব্যবহার হওয়ার কথা যুক্তি বিবেচনায় সবচেয়ে বেশি। মানুষের জীবনমান উন্নয়নে এর যে অবিশ্বাস্য অবদান ইতোমধ্যে লক্ষ করা গেছে তা অস্বীকার করা যাবে না। তবে শুনতে খারাপ লাগলেও, এসব প্রযুক্তির বেশির ভাগই ব্যবহার করা হয়েছে ও হচ্ছে মানুষেরই বিরুদ্ধে। লক্ষণীয় হলো- রাষ্ট্র ও এর অ্যাপারেটাসগুলো আগে যা করার কথা ভাবতে পারত না এখন তাদের হাতে চলে এসেছে নাগরিকদের খবরাখবর রাখার সব প্রযুক্তি। আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই রাষ্ট্রকে এমনভাবে নজরদারি করার সুযোগ করে দিয়েছে যে, যারা রাষ্ট্র চালায় ও বিভিন্ন সংস্থায় বসে আছে তারা মনে করছে, আর কী চাই? আমার হাতেই তো সব! আমি তো সব জানি। সব জানতে পারি। একটি মানুষ বাসা থেকে বেরিয়ে হেঁটে কোথায় যাচ্ছে, কোন বাস বা ট্রেন স্টেশন থেকে সে কোন গন্তব্যে গিয়ে নামছে, সারাদিন কী করছে, কোন কোন স্থানে গেছে- সব থাকছে সিস্টেমে। কোটি কোটি মানুষের ওপর চলছে স্বয়ংক্রিয় নজরদারি। বলা হচ্ছে, নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থে করা হচ্ছে এসব।

হ্যাঁ, ওটাই ছিল এআই তৈরির মূল লক্ষ্য। কিন্তু রাষ্ট্র দেখল, আরে কী মজা! সব তো পেয়ে যাচ্ছি! যে বিরোধিতা করছে, যে রাষ্ট্রের স্বৈর মানসিকতার প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে, কে মিডিয়ায় লিখে বা কথা বলে প্রতিবাদ করছে ও রাষ্ট্রের অনিয়মকে তুলে ধরছে তাদের সবার ওপর রাউন্ড দ্য ক্লক নজর রাখায় এখন কতই না সহজ কোনো বিরোধী দল সমাবেশ করবে, আন্দোলন করবে বলে যখনি ঠিক করছে তখনই রাষ্ট্র এআইয়ের মাধ্যমে জানতে চেষ্টা করছে তাদের কে কে সামনে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তারা কারা ও কোথায় তাদের পাওয়া যাবে? কোনো কিছুই গোপন থাকছে না। ইচ্ছা হলেই ওই সব নেতা, পাতি নেতাদের টু দ্য পয়েন্ট থেকে ঘাড় ধরে নিয়ে আসছে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থায় প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা মোহগ্রস্ত মানুষ নামের নতুন রোবটিক শ্রেণী। মিছিল করছে তরুণ, যুবকরা! স্বপ্ন-সুন্দর একটি সমাজের। রাষ্ট্রের পছন্দ নয় এটি। রাস্তায় সারি ধরে বসানো ক্যামেরা থেকে নেতৃত্ব দেয়া কয়েকজনের ছবি নিয়ে সেকেন্ডের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যাবে তাদের আইডি ও ঠিকানা। তার পর সিরিয়া, ভেনিজুয়েলার মতো দেশগুলোর গোয়েন্দা সংস্থা যেমন করেছে- তেমনি হুট করে রাতের আঁধারে বাসায় গিয়ে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বাসায় না থাকলে স্মার্টফোনের লোকেশন ট্রেস করে কোথায় লুকিয়ে আছে, বা কোথা থেকে কথা বলেছে বা ইন্টারনেট ব্যবহার করে সোশ্যাল মিডিয়ায় আন্দোলনের কী পোস্ট দিয়েছে তা সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম বের করে ফেলছে। ব্যাস, গপাগপ সবাই সরকারের জালে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব এআই কিন্তু কথিত কাউন্টার টেররিজম নিয়ন্ত্রণের নামে নিবর্তনবাদী সরকারগুলো সংগ্রহ করে থাকে। উন্নত, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোয় সরকার কখনোই এসব কোনো নাগরিকের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহে বা নজরদারিতে ব্যবহার করতে পারে না ও করেও না। কিন্তু বিপদ হয়েছে অন্য সব দেশে। এ জন্যই এখন বহু দেশে চাইলেই আর গণতান্ত্রিক কোনো আন্দোলন সফল হয় না। সব কঠিন হাতে দমন করা হয় শুরুতেই। মিসরে যদিও সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে হোসনি মোবারকবিরোধী আন্দোলন সফল হয়েছিল, কিন্তু ওই আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স, সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম দিয়েই পরে মিসরীয় সেনা গোয়েন্দারা সব তছনছ করে দেয়। ভেনিজুয়েলায় হাজার হাজার মানুষ শুধু এভাবেই গুম হয়ে গেছে। সিরিয়ার সঙ্কট সৃষ্টির অন্যতম মূল কারণ এ-জাতীয় সিস্টেম ব্যবহার করে গুম, নির্যাতন সীমাহীন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। এসবই এখন বলতে গেলে ‘কতিপয়ের’ জন্য এক ধরনের খেলা ও মনোজাগতিক অবসেশন। সার্ভেইল্যান্স যন্ত্রাদির সামনে বসে এসব ‘কতিপয়’ নিজেদের সেমি গড ভাবতে শুরু করেন। তারা দেখতে পান- আরে! আমি তো টার্গেটেড মানুষগুলো, রাজনীতিবিদদের সব জানতে পারছি। তারা মোবাইলে কী কথা বলছে, কোথায় যাচ্ছে, কোন পথে যাচ্ছে, কার সাথে যোগাযোগ করছে, সবই মুহূর্তে পেয়ে যাচ্ছি! ব্যাটা যাবে কোথায়? ওকে সাইজ করো, সরকারের রথী-মহারথীদের গিয়ে পূর্ণ রিপোর্টটি দিয়ে চমকে দাও, বিনিময়ে পাও পুরস্কার, প্রমোশন ও অবাধ ক্ষমতা যা আজ থেকে ১২-১৩ বছর আগেও ওই সব ‘কতিপয়’ কল্পনা করতে পারত না। আবার প্রতিদিনই প্রযুক্তির উন্নয়নের কল্যাণে বাড়ছে এসব ক্ষমতা। বাড়ছে ‘কতিপয়ের’ সেমি গড থেকে সুপার গড হয়ে যাওয়ার খায়েশ।

পৃথিবী বেশ কয়েক বছর আগে চেচনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রবাদপ্রতিম নেতা জওহর দুদায়েভের হঠাৎ মিসাইল দিয়ে হত্যার কাহিনী মিডিয়ায় পড়েছিল। চমকে গিয়েছিল, কিভাবে এত নিখুঁতভাবে টার্গেটেড একজন মানুষকে পিনপয়েন্ট লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করা যায়? জওহর দুদায়েভ ছিলেন সোভিয়েত রাশিয়ার বিমান বাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল। তাই তিনি রাশিয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে জানতেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে, তার অবসর গ্রহণের পর জিপিএস ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে বহু কিছু করাই সম্ভব হয়ে উঠেছিল। রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা তার ব্যবহৃত স্যাটেলাইট ফোনটিকে ট্র্যাক করা শুরু করে। তিনি একদিন গহিন অরণ্যে তার লুকিয়ে থাকার স্থানে ক্ষণিকের জন্য স্যাটেলাইট টেলিফোনটি ব্যবহার করার জন্য অন করেছিলেন। কথা বলা অবস্থাতেই রাশিয়ার মিসাইল তাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দেয়। আজ তো দুনিয়া কোথায় চলে গেছে। এখন শুধু মোবাইল কমিউনিকেশন নয়, বিভিন্ন অ্যাপস যেমন- ভাইবার, হোয়াটস অ্যাপ, স্কাইপি, মেসেঞ্জারসহ প্রায় সবই আধুনিক সার্ভেইল্যান্স যন্ত্রপাতি দিয়ে অতি সহজে ট্র্যাক করা যায়; প্রতিটি কনভারসেশন, মেসেজ, ছবি, ভিডিও গোয়েন্দা সিস্টেমে রেকর্ড করা যায়। চলতি বছর ইরানের আইআরজিসির জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে রাতের আঁধারে অকস্মাৎ হত্যার ঘটনা এসব টেকনোলজির অবদান বৈ কিছুই নয়।

এ দিকে চীনে আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স ধারণাতীত গতিতে এগিয়ে গেছে। যেহেতু চীন একটি সমাজতান্ত্রিক ও রেজিমেন্টেড রাষ্ট্রব্যবস্থা, তাই সে দেশের সরকার সব নাগরিককে সহজেই এআইয়ের মাধ্যমে নজরদারি করে থাকে। তাদের সব কিছুই প্রতি মুহূর্তে সরকারের কেন্দ্রীয় ডাটা সেন্টারে জমা হচ্ছে। সেখানে এ বছর করোনা মহামারীর সময় এই এআই অভূতপূর্ব সহায়ক ভূমিকা রেখেছে ট্রেসিং ও আইসোলেশনের জন্য। অন্য সব উন্নত দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের প্রাইভেসি বিবেচনায় এই প্রযুক্তি ঠিক ততটা ব্যবহার করা যায়নি।

টেলিকমিউনিকেশন, তথ্যপ্রযুক্তি যত উন্নতিই করুক না কেন পৃথিবী এসব উন্নতির জন্যই যেন ভিন্ন এক ঘেরাটোপে জড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, স্বাধীনতা, রাজনৈতিক অধিকার সব ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেও সাম্প্রতিক মহামারী মোকাবেলায় চীনের ব্যর্থতার বিবেচনায় আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্সকে ঢেলে সাজানো হবে। আইনকানুন পরিবর্তন করা হবে জনস্বার্থের কথা বলে। তার পর একসময় ওই সব দেশেও হয়তো ‘কতিপয়ের’ মধ্যে অবসেশন গেড়ে বসবে! এ ক্ষেত্রে চীনের অগ্রগতি ও কার্যকর ব্যবহারের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে পশ্চিমা শক্তিগুলো করোনা-পরবর্তীকালে তাদের যাবতীয় প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও ক্ষমতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। সামরিক ও স্ট্র্যাটেজিক খাতে বাড়িয়ে দেবে প্রযুক্তির অকল্পনীয় ব্যবহার। তার পর কী হবে, তা ভবিষ্যৎই বলতে পারে। তবে মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে এসবের ব্যবহার ও উন্নয়ন। এ জন্য কত দেশকে যে গণতান্ত্রিক অধিকার বিসর্জন দিয়ে নিবর্তনবাদের নিগড়ে বছরের পর বছর চলতে হয় তা কেবল সৃষ্টিকর্তাই জানেন। আর যদি এটা ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মতো এর স্রষ্টার গলাই টিপে ধরে একসময়, তা হলে সেটিও খুব অস্বাভাবিক ব্যাপার হবে না। ন্যানো চিপ ও এর ভবিষ্যৎ বংশধররা হয়তো একদিন তৈরি করবে সভ্যতার ভয়াবহ সঙ্কট!

লেখক: সাবেক সেনা কর্মকর্তা, সাংবাদিক, বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নালের সম্পাদক


আরো সংবাদ



premium cement