১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শেখার শেষ নেই, আমি শিখছি

-

শিরোনামটি বহুল ব্যবহৃত একটি প্রবাদ বাক্য। আমি মোটামুটি ভালো ছাত্রই ছিলাম। স্কুলজীবন থেকে পিএইচডি পর্যন্ত বৃত্তি পেয়ে পড়াশোনা করেছি। চাকরি জীবনেও মেরিট কোটায় পাকিস্তান সুপিরিয়র সার্ভিসে চাকরি করেছি, আঞ্চলিক কোটায় নয়। কর্মজীবনের শুরুর দিকে দু’টি বইও লিখি। ‘ইকোনমিক প্রব্লেম অ্যান্ড প্লানিং ইন পাকিস্তান’ ও ‘ইসলামিক ইকোনমিকস : থিওরি অ্যান্ড প্র্যাকটিস’। দ্বিতীয় বইটি আজো বিশ্বের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যবই।

দেশে ছাত্রজীবনে যে শিক্ষা পেয়েছি সেটি ছিল ব্রিটিশ আদলের, একাডেমিক। কিন্তু আমেরিকা গিয়ে দেখি সেখানে শিক্ষাটা প্রাগমেটিক বা বাস্তবভিত্তিক ও জীবনঘনিষ্ঠ। যেমন, অর্থনীতির ছাত্র মাত্রই ‘ন্যাশনাল ইনকাম অ্যাকাউন্টিং’ বোঝে। এখানে আমরা ছাত্ররা সংজ্ঞা, এর সুবিধা-অসুবিধা, কিভাবে অ্যাকাউন্টিং করতে হয়, এসব পরীক্ষায় খাতায় লিখেছি। কিন্তু আমেরিকায় সেটা নেই। সেখানে বাজার থেকে কিছু তথ্য-উপাত্ত এনে দিয়ে তা থেকে হিসাব করে ‘ন্যাশনাল ইনকাম’ বের করতে বলা হবে। ‘চাহিদা-সরবরাহ রেখা’র কথা এখানে কোনো শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করলে সে মুখস্থ অনেক কিছু বলে দেবে। কিন্তু আমেরিকায় সেটি নেই। সেখানে বলা হবে, তুমি মার্কেটে গিয়ে এসব তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এনে দেখ চাহিদা-সরবরাহ রেখাটি কেমন দেখতে হয়। ফলে আমেরিকা গিয়ে আমি প্রথম না জানার ধাক্কাটি খেলাম। ওখানে বাস্তববাদী শিক্ষাব্যবস্থার কারণেই বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় নোবেল পুরস্কারের বেশির ভাগ ওরাই পায়। আসলে একেক জাতি তার শিক্ষাব্যবস্থায় একেকটি বিষয়ের ওপর জোর দেয়। ব্রিটিশরা একাডেমিক, আমেরিকানরা প্রাগমেটিক, ফরাসিরা এসথেটিক, জাপানিরা বিউটি, কমিউনিস্ট দেশগুলো জনসম্পদের ওপর জোর দিয়ে থাকে।

আমি পিএইচডি করার সময় পাকিস্তান ভেঙে গেলে রাষ্ট্রহীন অবস্থায় পড়ি। ফলে একই সঙ্গে জীবন ধারণ ও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে প্রচ- সংগ্রাম করতে হয়। মনে হয়েছিল, পিএইচডি শেষ না করে দেশে ফিরে গেলে জীবন নিয়ে যে স্বপ্ন আমি দেখেছি সেটা কখনোই পূরণ হবে না। সপ্তাহান্তে সবাই যখন আনন্দ-ফুর্তিতে মশগুল হতো তখন আমি পড়াশোনা করার জন্য লাইব্রেরিতে চলে যেতাম। কমিউনিটি কলেজে পড়িয়েছি ঘণ্টায় ১২ ডলার বেতনে। এর ফলও আমি পেয়েছি। সে সময় মিশিগান ইউনিভার্সিটি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৭২-৭৩ সালের দিকে সেখানে প্রায় ৪৩ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করত। তাদের শিক্ষক ও সহায়ক স্টাফ মিলিয়ে জনসংখ্যা কত হতে পারে সেটা কল্পনাসাপেক্ষ ব্যাপার। মিশিগানকে বলা হতো ‘শিক্ষার্থীদের নগরী’। আমার একাগ্রতা শিক্ষকদের মুগ্ধ করে। তাদের সহযোগিতায় দ্রুততম সময়ে পিএইচডি ডিগ্রি হাসিলে সক্ষম হই।

মিশিগান ইউনিভার্সিটি আমাকে চাকরিও দিয়েছিল, পিএইচডি ডিগ্রি দেয়ার আগেই। এমন ইউনিভার্সিটি সাধারণত নিজের ছাত্রকে খুব কমই চাকরি দেয়। সাতজন প্রফেসার রিকমেন্ড করেছিল আমার চাকরির জন্য, কোনো ইন্টারভিউ দিতে হয়নি। ‘ইমপ্যাক্ট অব অ্যাডুকেশন’-এর ওপর গবেষণা করার জন্য পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্পে আমার চাকরি হয়। মোটামুটি উচ্চ পদ ও বেতনের চাকরি ছিল। কিন্তু সেই চাকরি করতে পারিনি জে ভিসা থাকার কারণে। যখন আমি কন্ট্রাক্ট সাইন করতে গেলাম তখনই মূলত জে ভিসার বিষয়টি সামনে আসে, আর আমাকে ‘সরি’ বলে দেয়া হয়। আমাকে আমেরিকা থেকে বের করে দেবে এমন অবস্থা দাঁড়ায়। জে ভিসাধারীকে দুই বছর পর বাধ্যতামূলকভাবে দেশে ফিরে যেতে হবে।

প্রফেসরদের হস্তক্ষেপে বের হওয়া থেকে রক্ষা পেলাম এবং পিএইচডি ডিগ্রিও ইতোমধ্যে হয়ে গেছে। কিন্তু আমি তখন দুই বছর ধরে রাষ্ট্রহীন, পাসপোর্ট নেই। ফলে তাদের সহায়তা ছাড়া কোনো চাকরি পাওয়াও সম্ভব ছিল না। তখন অস্ট্রেলিয়া থেকে মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে প্রতিনিধি আসে পাপুয়া নিউ গিনির (পিএনজি) ‘ইউনিভার্সিটি অব টেকনলজি’ লেহ’র শিক্ষক রিক্রুট করার জন্য। তখন পিএনজি ছিল অস্ট্রেলিয়ার অধীনে জাতিসঙ্ঘের একটি ট্রাস্ট টেরিটরি। পরের বছর, ১৯৭৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর দেশটি স্বাধীন হয়। তখন গোটা সাউথ প্যাসিফিকে একমাত্র প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এটি। ফলে বিভিন্ন এলাকা থেকে সেখানে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করতে আসত। বাংলাদেশের চেয়ে কয়েক গুণ বড় দ্বীপ দেশটিতে তখন জনসংখ্যা ছিল ৩০ লাখের কিছু বেশি। এখন বেড়ে ৯০ লাখের মতো হয়েছে। আমি সেখানে একটি দরখাস্ত করেছিলাম। আমাকে নিউ ইয়র্ক থেকে টেলিফোন করা হলো ইন্টারভিউয়ের জন্য। আমাকে বলল, তুমি রেডি আছ? আমি বলে দিলাম, ইয়েস। এটা মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে যোগদান করতে যাওয়ার ঠিক আগের দিনের ঘটনা। আমার স্ত্রী বলল, তুমি কালকে ওখানে জয়েন করতে যাচ্ছ। অথচ ‘হ্যাঁ’ বলে দিলে। এটা কেমন হলো? আমার অবচেতন মনের কোনো খটকা থেকে হয়তো ‘হ্যাঁ’ বলেছিলাম। মিশিগান ইউনিভার্সিটিতে যখন আমার চাকরি হলো না তখন আমি আমার শিক্ষকদের পিএনজির কথা জানালাম। তারা বললেন, ডোন্ট ওরি, আমরা বিষয়টি দেখছি। বিষয়টি এমন হয়েছিল যে, যিনি আমার ইন্টারভিউ নিতে এসেছিলেন তার সাথে আমাকে সাক্ষাৎও করতে দেননি প্রফেসররা। তারা এমনভাবে সুপারিশ করেছিলেন যে আমার চাকরি হয়ে যায়। আমাকে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলো। আমি যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি শুরু করি। অনেকে বলল তুমি যাচ্ছ, ওরা তো নরখাদক। আমি বললাম ঠিক আছে ওরা খায় খাক। আমি আর আমেরিকায় থাকছি না।

আমি ১৯৭৪ সালের শুরুর দিকে পিএনজি পৌঁছি। আমি বিজনেস স্টাডিজ ডিপার্টমেন্টে জয়েন করি। জয়েন করার পর ফ্যাকাল্টির ডিন আমাকে অর্থনীতির ওপর প্রখ্যাত দুই লেখকের কয়েকটি বই এবং কিছু প্রশ্নপত্র দিলেন। বইয়ের কয়েকটি অধ্যায় দেখিয়ে দিলেন আর প্রশ্নগুলো দেয়া হলো যেন কি ধরনের প্রশ্ন করা হয় তা যেন বুঝতে পারি। আমি বইপত্র পড়াশোনা করে প্রস্তুতি নিয়ে ক্লাস নিতে গেলাম। ক্লাস পুরোপুরি অর্থনীতির ছিল না, ছিল বিজনেস স্টাডিজের। ফলে সেখানে গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট ছিল। তাদের সাথে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্টুডেন্টও ছিল। বিজনেস স্টাডিজের স্টুডেন্টরা প্রথমবর্ষ থেকে আর ইঞ্জিনিয়রিংয়ের স্টুডেন্টরা তৃতীয়বর্ষ থেকে এই বিষয়গুলো পড়ত।

আমি মাইক্রো-ইকোনমিকস পড়ানো শুরু করি। আমি বিভিন্ন উদাহরণ দেই। কিন্তু দেখি সবাই আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করি কী হয়েছে? তারা ঠিকই উত্তর দেয়, আমার বক্তব্য রিপিট করে। কিন্তু কয়েক দিন যাওয়ার পর আমার মনে হলো তারা কিছু বুঝছে না।

তখন আমার মনে খটকা লাগে কী হলো, আমার স্টুডেন্টরা কিছু বুঝছে বলে মনে হয় না। আমি কি পড়াতে পারছি না? বিষয়টি কী? আমি কিছুটা হোঁচট খেলাম ওদের কথা শুনে। আমি দেখি যে, আমি এত দিন অর্থনীতির যে পড়া পড়েছি তার সাথে পাপুয়া নিউ গিনির সমাজব্যবস্থা মিলছে না। আমার ভাবনা ছিল যে আমি পড়াতে না পারলে তো চাকরি থাকবে না। ডিপার্টমেন্টের ডিনকে বিষয়টি বললাম। সে আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে এভাবেই পড়িয়ে যেতে বলল। কিন্তু আমি ভাবি, না, এভাবে হয় না। তখন আমি ছাত্রদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলা শুরু করি। তারা বেশ ভালো ইংরেজি বলে। আমি জিজ্ঞেস করি তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে কী করবে? তার প্রত্যাশা কী? সে কোনো কাজে যোগ দিলে কত টাকা বেতন চায়... আমাদের সমাজে আমরা যেভাবে চিন্তাভাবনা করি আরকি। কিন্তু ওদের শতকরা এক শ’ জনেরই সোজাসাপ্টা উত্তর, গ্রামে চলে যাব। আমারতো আক্কেলগুড়ুম। বলে কী? ওরা গ্রাম বা সম্প্রদায়কে বলত ‘ওয়ান-টক’ (wan-tok), ইংরেজিতে one-talk। এটা হলো একই ভাষায় কথা বলা গোষ্ঠী বা গোত্র। ওখানে কয়েক শ’ ভাষা বা ওয়ান-টক রয়েছে (এখনো দেশটিতে ৮৩২টি জীবন্ত ভাষা আছে, সূত্র : উইকিপিডিয়া)। ওরা সেখানে যাবে, ওই গ্রুপের মধ্যে থাকবে ও ওই গ্রুপের সংস্কৃতিই অনুসরণ করবে। যাকেই জিজ্ঞেস করি সে বলে, আমি গ্রামে চলে যাবো। শহরে থাকবো না।

আমরা সাধারণত দেখি লেখাপড়া শিখে সবাই শহরমুখী হয়। কিন্তু ওদের কাছে অর্থ-সম্পদের বদলে জীবনের প্রধান লক্ষ্য হলো সামাজিক অর্জন। ওদের সমাজে কারো বেশি সম্পদ হয়ে গেলে তা প্রতিবেশীদের মধ্যে বণ্টন করে দিতে হয়। কেউ না করলে তাকে জাদুটোনা করে মেরে ফেলা হয়। যে যত বেশি উৎসবের আয়োজন করে গোত্রের লোকজনকে খাওয়াতে পারবে সে তত বড় সম্মানী ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত হবে। ওদের কাছে সম্পদশালী হওয়া আকর্ষণীয় কোনো বিষয় নয় বরং সামাজিক সম্মান লাভই বড় কথা। আদি কমিউনিজম বলতে যা বোঝায় সে রকম একটি সমাজব্যবস্থা বিরাজ করছে সেখানে। আমার দেখা জগত থেকে সেখানকার মানুষের আচরণ সম্পূর্ণ আলাদা।

এটা ছিল আমার জীবনের খুবই মূল্যবান অভিজ্ঞতা। শিখলাম স্বার্থপরতা মানুষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য নয়। আমি সেখানে একটি ‘এনলাইটেনড সোস্যালিজমের’ রূপ দেখতে পেলাম। তখনই সেখানকার অর্থনীতির আসল রূপটি আমার কাছে ধরা দিলো। আমি ক্লাসিক্যাল ইকোনমিকসের ছাত্র ছিলাম। ইসলামিক ইকোনমিকস নিয়েও লেখালেখি করেছি। এখানে মূল্যবোধ নৈতিকতার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। আমি গ্রামে বড় হয়েছি। ফলে ওদের সংস্কৃতি বুঝতে আমার খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। পশ্চিম অর্থনীতি ব্যক্তিকেন্দ্রিক, স্বার্থপরতাপূর্ণ। সেখানেই আমার বুঝে আসে যে এত দিন অর্থনীতির যে পড়াশুনা করেছি এটাই সব নয়। অর্থনীতির অন্য ডাইমেনশনও আছে। কিন্তু অন্যরা এটা তেমন বুঝতে পারেনি। ইউনিভার্সিটিতে আমার আগে যেসব প্রফেসর ছিলেন তারা এসব নিয়ে ভাবেননি। ছাত্ররা বুঝুক আর না বুঝুক বই পড়িয়ে গেছেন। ছাত্ররাও মুখস্থ করে লিখে দিয়েছে।

ছাত্রদের সাথে কথা বলার পর আমার ওদের সমাজ সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার কৌতূহল আরো বেড়ে যায়। আমার স্থানীয় বাজার দেখার শখ হলো। আমার এক স্টুডেন্টকে নিয়ে গেলাম। পথের ধারে জঙ্গলে প্রচুর ফল ফলাদি জন্মে। সেগুলো কেউ ছুঁয়েও দেখে না। আমার ছাত্র আমার জন্য এমন কিছু ফল নিয়ে আসে বনের মধ্যে ঢুকে। সে আমার জন্য পেঁপে, কলা, নারকেল এগুলো নিয়ে আসে। আমি জিজ্ঞেস করি দাম কত। সে বলল, কিছু দিতে হবে না। কারণ এখানে এগুলো প্রচুর, কেউ ছুঁয়েও দেখে না। এমনিতেই নষ্ট হয়। হাটে গিয়ে দেখি ওরা ১০ সংখ্যার উপরে গুনতে পারে না। সবাই খুবই সাদাসিধা। কেউ কিছু চাইলে এমনিতেই দিয়ে দেয়। আমি আরো ঘোরাফেরা করি। দেখি ওখানকার মানুষ তখনো পাথরে-পাথরে ঠোকাঠুকি করে আগুন জ্বালায়। মনে হলো যেন পাঁচ হাজার বছর আগের কোনো সমাজে এসে পড়েছি। নৃতত্ত্ব বিষয়ে আমার ভীষণ ঝোঁক ছিল। সেই ঝোঁক থেকেও ওদের সমাজব্যবস্থাকে জানার চেষ্টা করি।

আমার ভাবনাগুলো নিয়ে তখন অস্ট্রেলিয়ার পোস্ট কুরিয়ার নামে সে সময়ের একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকায় লেখা শুরু করি। আমার কথা ছিল অস্ট্রেলিয়ানরা যে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে এসেছে সেটা ভুল। যে পরিকল্পনা করেছে সেটি এই সমাজের জন্য প্রযোজ্য নয়। এটা বাজার অর্থনীতির সমাজ নয়। অথচ বাজার অর্থনীতির শিক্ষা চাপিয়ে দিয়ে এখানে ইচ্ছাকৃতভাবে একটি সঙ্ঘাত ও সঙ্কট তৈরি করা হচ্ছে। যা এখানকার আদি সামজতন্ত্রকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। যেখান সবাই সবার সাথে সবকিছু ভাগাভাগি করছে কেন তাদেরকে স্বার্থপর করে তৈরি করা হচ্ছে? সে শেয়ার করে আনন্দ পাচ্ছে এবং সেটিই তার কাজের প্রেরণা ও প্রণোদনা। এটি বিনষ্ট করা ঠিক হচ্ছে না। এখানে স্বার্থপরতা, মুনাফা এগুলো নিয়ে আসা অন্যায়। এই সমাজে পশ্চিমা বাজার অর্থনীতি প্রযোজ্য নয়। হ্যাঁ, পশ্চিমা অর্থনীতিকে একটি প্যারাডাইম হিসেবে পড়ানো যেতে পারে। তাদের পড়ানো যেতে পারে যে এটা হলো ক্লাসিক্যাল অর্থনীতি, আর এটা হলো তোমার অর্থনীতি। আবার মার্কসবাদী অর্থনীতিও আছে। আমি জ্ঞানের দরজা বন্ধ করে দিতে বলিনি। কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাছে জ্ঞানের প্রতিটি ডাইমেনশন তুলে ধরতে বলেছি। এরপর যার যার পছন্দ মতো বেছে নেবে।

আমার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ওদের সমাজব্যবস্থাকে বিশ্লেষণের এই লেখাগুলো দেশটির শিক্ষিত মহলে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়। এরই মধ্যে আমি পাপুয়া নিউগিনির শিক্ষাব্যবস্থার সমস্যা নিয়েও একটি প্রেজেন্টেশন দিই। ফলে আমি বেশ পরিচিতি পেয়ে গেলাম এভাবে যে, আমি বিদেশ থেকে আসা একটি লোক ওদের পক্ষে লেখালেখি করছি। ওদের সমাজব্যবস্থাকে ভালো বলছি। সেখানে পশ্চিমা অর্থনীতি বিস্তার চেষ্টার সমালোচনা করছি। তখন বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিসি ছিলেন ড. স্যান্ডোবার। তার সাথে আবার বাংলাদেশের বুয়েটের এক শিক্ষকের পরিচয় ছিল। তারা একসাথে ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করেছেন। আমি বাংলাদেশী হওয়ার কারণে স্যান্ডোবারের সাথে আমারও খাতির হয়ে যায়।

এই যখন অবস্থা তখন একদিন শুনতে পেলাম দেশের প্রধানমন্ত্রী মাইকেল সুমারে বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে আসছেন। তিনি এলেন। একেবারে সাদাসিধা পোশাক ও ভঙ্গিতে। তিনি ছিলেন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। বয়সে আমার কাছাকাছি। তিনি আমাদের ডিপার্টমেন্টে এসে সরাসরি আমাকে বললেন, ড. মান্নান, আমি তো তোমাকে চিনি। তুমি তো লেখালেখি করো। আমাদের পক্ষ থেকে তুমি লেখালেখি চালিয়ে যাও। তিনি কিছুক্ষণ থেকে চলে গেলেন। এর কয়েক দিন পর স্যান্ডোবার আমাকে জানালেন যে, আমাকে পিএনজির শিক্ষা বোর্ডের সদস্য মনোনীত করা হয়েছে। আমাকে কারিকুলাম কমিটির সদস্য করা হলো। সেখানে আমি বললাম, তোমরা আর যা-ই করো পশ্চিমা অর্থনীতি মন-মগজে ঢুকিও না। ছাত্রদের এই দেশের উপযোগী শিক্ষা দাও। এই কারিকুলামটা সেভাবে তৈরির পরামর্শ দিই।

জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই যে শিক্ষা রয়েছে সেটা আমরা ভুলে যাই। জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে আমি শেখার চেষ্টা করেছি। এ জন্যই বলছি শেখার কোনো শেষ নেই। আজ ৮২ বছর বয়সে এসেও আমি দিনমজুরদের কাছ থেকে শিখছি, আমার বাড়ির যে কন্ট্রাক্টর আছে তার কাছে শিখছি। বাজারে গিয়ে দোকানির সাথে কথা বলে অনেক কিছু শিখি। রিকশাওয়ালার কাছ থেকে শিখি। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে শিখছি।

আমি বলতে চেয়েছি যে, পশ্চিমা অর্থনীতি শিক্ষার পেছনে ছুটে ছুটে ক্লান্ত হওয়ার চেয়ে জীবনধর্মী অর্থনীতির শিক্ষা দেয়া উচিত হবে। এই চেতনা আমাদের সমাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা পড়ানো হচ্ছে সেগুলো কি আমাদের উপযুক্ত? আমাদের শিক্ষকদের বলা উচিত তারা যেন গ্রামে গিয়ে আমাদের সমাজের মৌলিক ভিত্তিটি বুঝে নিয়ে তার ভিত্তিতে নতুন করে শিক্ষা কারিকুলাম তৈরি করেন। তবেই সেটি হবে জীবনভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের সমাজের উপযোগী শিক্ষা।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
hmct2004@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement