২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আল কুরআনে অর্থনীতি-১

-

বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশন আল কুরআনে অর্থনীতি নামে একটি প্রজেক্ট নিয়েছিল, আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে। যেসব গবেষক এই প্রজেক্টে কাজ করেছিলেন তার মধ্যে আমি ছিলাম অন্যতম। প্রজেক্টের লক্ষ্য ছিল কুরআনের ওই সব আয়াতের ব্যাখ্যা করা, যেখানে অর্থনীতির কোনো দিক আছে। এই প্রজেক্টে প্রায় তিন শতাধিক প্রবন্ধ রচিত হয়েছিল। তার মধ্যে আমার লেখা ছিল প্রায় ৫০টির মতো। এই ৫০টি লেখা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।

আমানতের খেয়ানত প্রসঙ্গে সূরা আলে ইমরানের ৭৫-৭৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, কিতাবিদের মধ্যে এমন লোক রয়েছে, যে বিপুল সম্পদ আমানত রাখলেও ফেরত দেবে, আবার এমন লোকও আছে, যার কাছে একটি দিনারও আমানত রাখলে তার পেছনে লেগে না থাকলে সে ফেরত দেবে না, এটা এই কারণে যে, তারা বলে নিরক্ষরদের প্রতি আমাদের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই এবং তারা জেনে শুনে আল্লাহ সম্পর্কে মিথ্যা বলে। হ্যাঁ, কেউ তার অঙ্গীকার পূর্ণ করলে এবং সাবধান হয়ে চললে আল্লাহ মুত্তাকিকে ভালোবাসেন।

ভূমিকা : সূরা আলে ইমরানের ৭৫ নম্বর আয়াতে তৎকালীন ইয়াহুদিদের নৈতিক অবস্থা, অর্থনৈতিক মানসিকতা ও স্বার্থপরতার কথা বলা হয়েছে। যদিও তাদের মধ্যেও ভালো লোক ছিল, কিন্তু আয়াতে যেভাবে তাদের মানসিকতার উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে স্বতঃই প্রমাণিত হয় যে, তাদের বেশির ভাগই ছিল অত্যন্ত স্বার্থপর এবং আমানতের খেয়ানতকারী। এ আয়াত নাজিলের প্রেক্ষিতে আলোচনা প্রসঙ্গে আল্লামা জামাখশারি তার তাফসিরে কাশ্শাফে ও আল্লামা আলুসি তার তাফসির রূহুল মা‘আনিতে আমানতের খেয়ানতের ব্যাপারে তৎকালীন ইয়াহুদিদের নীচ আচরণের কথা উল্লেখ করেছেন।

উম্মি শব্দের অর্থ : আয়াতে ব্যবহৃত উম্মি শব্দের অর্থ যদিও নিরক্ষর তথাপি পরিভাষার দিক থেকে এ শব্দটি ইয়াহুদি ছাড়া অন্য সবার জন্য ইয়াহুদিরা ব্যবহার করত। অর্থনৈতিক বিষয়াদিতে বনি ইসরাইলরা ইয়াহুদিদের জন্য আইন এবং অন্যদের জন্য আইন প্রয়োগ করত (দ্রষ্টব্য : তাফহিমুল কুরআন, দ্বিতীয় খণ্ড, ৬৪ নম্বর টীকা, আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা)। এই বৈষম্যমূলক আচরণকে তারা সঠিক মনে করত বলেই তারা নিজেদের মধ্যে রক্ষিত আমানত আদায় করত এবং অন্যদের রাখা আমানত তারা আদায় করত না। এ বৈষম্যমূলক আচরণকে তারা তাদের শরিয়ত মোতাবেক বৈধ মনে করত- যেমন আয়াতে স্পষ্ট বলা হয়েছে। কিন্তু আল্লাহ স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন যে, এ ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ অথবা আমানতের খেয়ানত আল্লাহ কখনো করতে বলেননি। এ ব্যাপারে তারা যা বলে তা আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপ মাত্র। ৭৫ নম্বর আয়াতে ইয়াহুদিদের খেয়ানতের মানসিকতা উল্লেখ করার পর আল্লাহ পাক ৭৬ নম্বর আয়াতে আমানতদারি ও তাকওয়া গ্রহণ পর্যায়ে একটি সাধারণ তাৎপর্যবোধক ঘোষণা দিয়েছেন। আল্লাহ বলছেন, যে কেউ অঙ্গীকার পূর্ণ করবে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে চলবে তাকে আল্লাহ ভালোবাসেন। অর্থাৎ প্রতিশ্রুতি পূর্ণ করা, অঙ্গীকার রক্ষা করা (যার মধ্যে আমানত রক্ষা করা, খেয়ানত না করাও শামিল) আল্লাহ পছন্দ করেন। এখানে আল্লাহ কেবল অঙ্গীকার পূরণ করতে, চুক্তি রক্ষা করতে উৎসাহিত করছেন। একই বিষয়কে আল্লাহ পাক সূরা মায়িদাতে ফরজ ঘোষণা করছেন এ ভাষায়, হে ঈমানদারগণ! তোমরা তোমাদের চুক্তিগুলো মেনে চল। (সূরা মায়িদা : ১)

অর্থনৈতিক তাৎপর্য : সূরা মায়িদার এ আয়াত আলোচনার সময় চুক্তি, প্রতিশ্রুতি ও এসবের সাথে সম্পাদিত আইন-কানুন সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা করা হয়েছে। এখানে এ কথা বলাই যথেষ্ট হবে যে, অঙ্গীকার পূরণ করাকে ইসলাম অত্যন্ত জরুরি মনে করে। সব ধরনের অঙ্গীকার রক্ষা করার ওপর সমাজ ও অর্থনীতির সুস্থতা ও ভারসাম্য নির্ভর করে। অঙ্গীকার রক্ষা না হলে সমাজ ও অর্থনীতি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। কাজেই ইসলামী রাষ্ট্রে ও অর্থনীতিতে স্বাধীন ইচ্ছায় এবং শরিয়তসম্মত যেসব অঙ্গীকার করা হবে তা রক্ষা করতে সবাইকে বাধ্য করা হবে। ইসলামী রাষ্ট্রের আইন-আদালতের তা অন্যতম দায়িত্ব হবে। এ প্রসঙ্গে এ কথাও বলা দরকার যে ৭৬ নম্বর আয়াতের লক্ষ্য কেবল ইয়াহুদিরা নয় বরং সব মানুষ। এ আয়াতে সাধারণ তাৎপর্য বোধক আম পর্যায়ের। আল্লামা জামাখশারিও আয়াতটিকে আম বলেছেন। আয়াতের মধ্যকার শব্দের বিচারেও তা স্পষ্ট। কাজেই আয়াতের নির্দেশ সবার প্রতি প্রযোজ্য। মুসলমানদেরকে তা অবশ্যই মেনে চলতে হবে এবং জীবন ও সমাজে এ নির্দেশ কার্যকর করতে হবে।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement