২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আমি একজন দুর্ভাগা লেখক

-

লেখক তিনিই যিনি লিখেন। এই লেখকই মানুষকে শিক্ষিত ও সভ্য করেছেন। লেখক তার লেখনীর মাধ্যমেই বিশ্বমানবকে সংগঠিত করে একে অপরকে বুঝতে ও জানতে শিখিয়েছেন। লেখক সমাজের ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়, সুন্দর-অসুন্দর সম্পর্কে সচেতন করেছেন। লেখকই অন্ধকার গুহাবাসীকে আলোয় এনে শিক্ষিত ও সুসভ্য করেছেন।

লেখকই পৃথিবীর সর্বত্র জ্ঞানের আলো ছড়াতে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তার লিখিত পত্রপত্রিকা ও গ্রন্থের মাধ্যমে অশিক্ষিত মানুষকে শিক্ষিত করেছেন ও করছেন। লেখকই অর্থনীতি, সমাজনীতি, দর্শন ও রাজনীতি বিষয়ে মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, সচেতন করেছেন। শিল্প, সংস্কৃতি ও সঙ্গীতসহ বিশ্বের সব কিছু জানার-বোঝার সুযোগ করে দিয়েছেন। অথচ এ লেখককে সমাজে খুব বেশি সম্মান দিতে দেখা যায় না। দেখা যায় না মূল্যায়ন করতে।

যে লেখকের অবদান সম্পর্কে এত কিছু বলা হলো সেই লেখকের জন্ম বা আবির্ভাব কিভাবে হয়েছে? মার্শাল ক্যাভেন্ডিস বুক লিমিটেড কর্তৃক প্রকাশিত ‘দ্য গ্রাফিক আর্টস’ নামক গ্রন্থের মতে, লেখকের আবির্ভাব ঘটে ৩০০০ খ্রিষ্টপূর্বে। এ সময় সুমেরিয়ার কোনো এক মানব সন্তান হাড়ের টুকরা কিংবা নলখাগড়ার সাহায্যে নরম মাটিতে হিজিবিজি কিছু রেখার জন্ম দিয়েছিলেন। এই রেখার মধ্যেই জন্ম নেয় পৃথিবীর ইতিহাসের বিস্ময়কর সেই অক্ষর, যা পরবর্তী পর্যায়ে লেখার কাজে ব্যবহৃত হয়। এই অক্ষর প্রথম পর্যায়ে গোঁজ বা কিউনিকর্ম হিসেবে পরিচিত হয়। এখান থেকেই লিখন ও লেখকের যাত্রা শুরু। পরবর্তী পর্যায়ে এই কিউনিকর্ম থেকেই বর্তমান লিখন পদ্ধতির সৃষ্টি, যা পৃথিবীর মাধ্যমে মনের ভাব এবং ভাবনাগুলোর প্রকাশ ঘটিয়ে চলেছে। ইতিহাস, দর্শন, সাহিত্য, গল্প, কবিতা, নাটক, গান সবই লেখকদের অবদান। ধর্মীয় সাহিত্যের গ্রন্থাদিও এর অন্তর্ভুক্ত। এসব বিষয়ে লিখে লেখকরা মানুষকে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ এবং তাঁর প্রেরিত বাণী সম্পর্কে সচেতন করে থাকেন। সচেতন করেন ন্যায়নীতি, আদর্শ ও মানবতা সম্পর্কে।

লেখক যা দেখেন, জানেন ও অনুভব করেন তাই লিখেন, এমন নয়। তিনি সৃষ্টিও করে থাকেন। অর্থাৎ লেখক ভাবসাগরে ডুব দিয়ে সাগরের অতল থেকে মানুষের অজানা, অদেখা অনেক কিছু তুলে নিয়ে আসেন যা দেখে মানুষ অভিভূত হয়; আপ্লুত হয়। আবার শঙ্কিত কিংবা দুঃখিতও হয়। লেখনীর মাধ্যমে লেখক মানুষকে যা জানান, যা বোঝান, সেসব বিষয় লেখকের কল্পনার জগতের ফসল হলেও বাস্তবে অনেক মানুষের তথা পাঠক-পাঠিকার জীবনের সাথে মিলেও যায়। এই মিলে যাওয়া বিষয় নিয়ে পাঠক কিংবা পাঠিকা কখনো আনন্দিত, আবার কখনো ব্যথিত হন; যা লেখকের বর্ণনাতেই সুস্পষ্ট হয়। লেখক তার লেখার জন্য কখনো আনন্দিত হন, আবার কখনো আসামির কাঠগড়াতেও দাঁড়ান। কারণ লেখা বা প্রবন্ধ নিবন্ধ কিংবা গল্পের নায়ক-নায়িকা ও অন্যান্য চরিত্রের মানুষরা নানা অভিযোগ নিয়ে লেখকের সামনে হাজির হন। তেমনটি ঘটেছে লেখক মনীন্দ্রলাল বসুর ক্ষেত্রে। তিনি যেসব গল্প লিখেছিলেন সেসব গল্পের চরিত্রগুলো একি দন লেখক মনীন্দ্রলালের কাছে কৈফিয়ত চাইতে বাড়িতে এসে হাজির হয়েছিলেন। লেখক সে দিন রাতে এক বন্ধুর বাড়িতে ডিনার খেয়ে, মদ্যপান করে মাতাল বেশে রাত ১২টায় বাড়ি ফিরে দেখেন তার বিশাল ড্রইং রুমে অনেক মানুষ তার জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু লেখক কাউকেই চিনেন না। লেখক ঘরে ঢুকতেই একজন বলে উঠলেন- ‘এই যে এতক্ষণে এসেছেন। খাওয়া বেশি ভালোই হয়েছে দেখছি। পান ততোধিক, আমরা এ দিকে এক ঘণ্টা বসে।’ এ কথা শুনে লেখক বললেন, ক্ষমা করবেন, কাউকে ঠিক চিনতে পারছি না, কোনো জরুরি কেস নাকি, পুলিশ কেস? কথা শুনে সোফায় বসা একজন মোটা লোক বলে উঠলেন, ‘ভারতী’তে ‘ক্লাউন’ বলে একটি গল্প লিখেছিল, মনে পড়ে?
-হ্যাঁ, তিন বছর আগে হবে।

-আমি সেই ক্লাউন, আমার কথাই তুমি লিখে নাম করেছিলে। একজন শীর্ণদেহী রমণীকে দেখিয়ে তিনি আবার বললেন, তোমার লেখা ‘মা’ গল্পটার কথা মনে পড়ে? ইনি সেই মা, তোমার গল্পে এর সাত বছরের ছেলে টাইফয়েডে মারা যায়। চার বছর ধরে ইনি মৃত ছেলের জন্য শোক করছেন। প্রতীক্ষা করছেন, এখন এসেছেন তোমার কাছে, তাঁর প্রতি কেন এ অবিচার, কেন তাঁর ছেলে মারা যাবে, তুমি তো তাঁর ছেলেকে বাঁচিয়ে দিতে পারতে। আর এরা সব তোমার গল্প উপন্যাসের নায়ক-নায়িকারাÑ ওই হচ্ছে শিশুপাগল, কোণে গুম হয়ে বসে আছে, ওই তোমার তরুণ কবি রেবন্ত, ওই মাধবী কেশে শ্বেতকরবীর মালা জড়িয়েছে, ওই চিরবিরহিনী অপরাজিতাÑ এঁরা এসেছেন তোমার বিচার করতে, তুমি তোমার খুশিমতো তাঁদের জীবন গড়েছ, ভেঙেছ, কেন তাঁরা এত দুঃখ পাবে চিরদিন, তুমি কি ওঁদের সুখী করতে পারতে না? হা, হা, এবার বড় মুশকিলে পড়েছ, লেখক।’ (প্রবাসী, শ্রাবণ, ১৩৪১, চতুর্থ সংখ্যা)

লেখক মুশকিলেই পড়েছেন। প্রকৃত অর্থে লেখককে মুশকিলে ফেলা হয়েছে। ক্ষুব্ধ প্রশ্নবাণে জর্জরিত করা হয়েছে লেখককে। লেখক বললেন, আমি লেখক মাত্র, মানব-সংসারে যদি দুঃখ, মৃত্যু, বিচ্ছেদ না থাকত আমিও সে কথা লিখতাম না, আমার কী অপরাধ? লেখকের কথা শুনে একেকজন বলতে থাকলেন- কার কী অপরাধ জানি না, বুঝি না, আমি চাই আমার ছেলেকে, আমার মানিককে ফিরিয়ে দাও। আরেকজন বললেন, আমি চাই আমার স্বামীকে, কেন তিনি আমায় ত্যাগ করে চলে যাবেন এক ঘৃণিতা নারীর সাথে। অপর একজন বললেন, আমায় বিয়ে করবে বলেছিল, তুমি কি আমার সুখমিলন কথা লিখে তোমার উপন্যাস শেষ করতে পারতে না? কেন তুমি আনলে ইন্দ্রানীকে, অজিত তার রূপ দেখে ভুলে গেল, আমাকে ত্যাগ করে চলে গেল, আমাদের প্রেম-মিলন পথে তুমি কেন আনলে ইন্দ্রানীকে? সবার অভিযোগ শেষে একজন বললেন, আর হৈমন্তীকে আমার মতো কে ভালোবাসত, কে ভালোবাসে, নিজ হাতে তাকে আমি খুন করলুম, হৈমন্তী শরৎ-শেফালির মতো পবিত্র নিষ্পাপ, তাকে আমি সন্দেহ করলুম; কেন তুমি শরতকে আনলে আমার জীবনে, সে শুধু আমার মনে সন্দেহ জাগাত, নিজ স্ত্রীকে ভাবলুম অবিশ্বাসিনী, তুমি লেখক শরতের চরিত্র এঁকে পেলে বাহবা, আমি হলুম স্ত্রী-হত্যাকারী!

লেখক শ্রীমণীন্দ্রলাল বসু অভিযোগকারীদের অভিযোগ ও ক্ষোভের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন এবং যথার্থ যৌক্তিক উত্তর দানের মাধ্যমে তাদের ক্ষোভ প্রশমিতও করেন। একজন লেখকের চিন্তা ও কল্পনাশক্তি কতদূর বিস্তৃত হতে পারে, সৃজনচিন্তা লেখককে ভাবসাগরের কতটা গভীরে নিয়ে যেতে পারে, মনীন্দ্রলাল বসু এবং তার গল্প ‘লেখকের বিচার’ তার স্পষ্ট প্রমাণ। শুধু তা-ই নয়, এ গল্প এটাও প্রমাণ করে, লেখক যে পরিমাণ ভাব ও ভাবনায় মগ্ন থাকেন তাতে তার সৃজনশীল জগতের বাইরের কোনো কিছু নিয়ে ভাববার অবকাশ থাকে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সমাজের অসঙ্গতি, অন্যায়, অপরাধ, দুর্নীতি, খুন-খারাবি, চুরি-ডাকাতি, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের কারণে কখনো কখনো তিনি ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হন। সে কারণে কোনো কোনো সময় তিনি সমাজের বিরুদ্ধে, সমাজের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে ঘৃণা কিংবা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এই ঘৃণা বা ক্ষোভ প্রকাশের পদ্ধতিও একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম। কেউ সমাজ কিংবা দেশের হর্তাকর্তা, বিধাতা কিংবা প্রতিপক্ষকে সরাসরি আক্রমণের মধ্য দিয়ে তা প্রকাশ করেন। কেউ বা আবার নিজেকেই ধিক্কার দিয়ে, নিজেকে তুচ্ছ করার মধ্য দিয়ে কাজটি করেন যেমনটি করতেন আমাদের সমাজের, আমাদের পরিবারের অতি আপনজন অত্যন্ত ভাবপ্রবণ বলিষ্ঠ ও স্পষ্টবাদী লেখক আহমদ ছফা। স্পষ্টবাদিতার জন্য আহমদ ছফা একজন শক্তিমান মৌলিক লেখক হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রের ক্ষমতাবানদের সুনজরে আসতে পারেননি। অথচ ক্ষমতাসীনদের পদলেহন নীতির কারণে, আমলা ও উপরওয়ালাদের আশীর্বাদে দুর্বল লেখক, কখনো কখনো আবার অলেখকও বড় লেখকের সম্মানে সমাদৃত হন। ভুলে ভরা বই লিখেও কেউ কেউ প্রশংসিত হন। অথচ আহমদ ছফার মতো বিজ্ঞ পণ্ডিত হলেন সমালোচিত, প্রত্যাখ্যাত।

১৯৯৬ সাল। ইংরেজি নববর্ষের ১ জানুয়ারি ঢাকায় যে গ্রন্থমেলার উদ্বোধন করা হয়, সেই মেলার উদ্বোধনী মণ্ডপের দর্শক-শ্রোতাদের জন্য বসার আসনের সামগ্রিক স্তরবিন্যাস লেখক আহমদ ছফাকে দারুণভাবে আহত করে। আমাদের সমাজে হিন্দু সম্প্রদায়ের মতো বর্ণবৈষম্য বা উচ্চ বর্ণ-নিম্ন বর্ণের বিভেদ না থাকলেও গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী মণ্ডপে বসার আসন বিন্যাসের ক্ষেত্রে সেই উঁচু-নিচু জাত-পাতের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে তার মনে হয়েছিল। কারণ যাদের লেখা গ্রন্থ নিয়ে মেলার আয়োজন সেই লেখকদের জন্য রাখা হয়েছিল টুটা-ফাটা আসনগুলো! অথচ আমলা ও মন্ত্রীদের জন্য ছিল নয়নমোহন রাজকীয় ব্যবস্থা। সুতরাং স্বাভাবিক কারণেই মণ্ডপের বর্ণবৈষম্য ব্যবস্থা পীড়াদায়ক হওয়ায় উদ্বোধনের তোয়াক্কা না করে লেখক আহমদ ছফা বাড়ি ফিরে গেছেন। যাওয়ার পথে রাস্তায় যানজটে আটকে যাওয়া বেবিতে বসে এ বিষয়ে ভাবতে গিয়ে বলেছেন, ‘ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখলাম, আমি একজন হারামজাদা লেখক। নারায়ণগঞ্জের টানবাজারের বাসিন্দাদেরও সমাজে একটা অবস্থান আছে। আমাকে এভাবেই আমার নামে করা অনুষ্ঠান থেকে সবসময় বুকের ব্যথা বুকে চেপে ফিরে এসে ঘরে বসে জখমি সিংহের মতো থাবা চাটতে হবে’ (বাংলাবাজার পত্রিকা, ৫ জানুয়ারি ’৯৬)। একজন সম্মানিত লেখকের এই খেদোক্তি প্রমাণ করে দেশে লেখকদের অবস্থান কোথায়।

‘হারামজাদা’ শব্দটি বিশেষ বিশেষ মহলে প্রায়ই ব্যবহার করতে দেখা যায়। এ বাক্যটি সাধারণত একজন অন্যজনকে ঘায়েল করার জন্যই প্রয়োগ করে থাকে। ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত হচ্ছে, লেখক আহমদ ছফা বাক্যটি নিজেই নিজের ওপর প্রয়োগ করেছেন! তিনি নিজেকে ‘হারামজাদা’ অর্থাৎ জারজ, হতভাগ্য কিংবা নীচবংশজাত লেখক ভাবতে দ্বিধাবোধ করেননি। যেসব লেখকের নিয়ে অনুষ্ঠান সেসব লেখকেই যদি অবজ্ঞা, অবহেলা করা হয় তা হলে এমনটি ভাবাই স্বাভাবিক। তবে আহমদ ছফার মতো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন সবাই নন। এ কারণে ছফার এ খেদোক্তি বা আত্মগ্লানি সবাই সমভাবে উপলব্ধি করবেন এমনটি ভাবার সঙ্গত কারণ নেই। কারণ আমাদের সমাজে উচ্ছিষ্টভোগী একশ্রেণীর মানুষ আছেন যারা টুটা-ফাটা আসন কেন, আমলা বা মন্ত্রীদের পদতলে বসার সুযোগ পেলেও আনন্দে আত্মহারা হন। জনম সার্থক, এমনটি অনুভব করেন। সে দিন লেখকদের জন্য নির্ধারিত টুটা-ফাটা আসন আহমদ ছফা ঘৃণাভরে ছেড়ে এলেও অনেক লেখকই যে সেগুলোতে জেঁকে বসেছিলেন তা বলাবাহুল্য। শুধু যে বসেছেন তাই নয়, বসে আত্মতৃপ্তিও লাভ করেছেন এবং অনেকেই মন্ত্রী, আমলা ও উদ্বোধকের সান্নিধ্যে গিয়ে ঘনিষ্ঠ হওয়ার প্রতিযোগিতাও করেছেন। উদ্দেশ্য- আখের গোছানো। তাতে নিজের মান, মর্যাদা, সম্মানহানি হলেও ক্ষতি নেই এমনটিই ভেবেছেন অনেকে। কিন্তু আহমদ ছফা ভাবতে পারেননি বলেই ঘৃণাভরে ছেড়ে এসেছিলেন আসনগুলো। এমন আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নীতিবান লেখক কদাচিৎ জন্মান। শিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা অনেকেই জানেন, তিনি ছিলেন একজন খাঁটি বাঙালি। বলা যায়, শতভাগ খাঁটি ছিলেন তিনি। তিনি বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতি এবং আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য যুদ্ধ করেছেন সারাটা জীবন। তিনি একজন খ্যাতিমান লেখকও। প্যারিসের বিশ্ববিখ্যাত ‘লুভর মিউজিয়াম’ কর্তৃপক্ষ মিউজিয়ামে সংরক্ষণের জন্য ছবি কিনতে চাইলে সেই শিল্পী ও লেখক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিক্রি করেননি। তাঁর মনে হয়েছে, দরিদ্র দেশের বাঙালি বলে তাঁকে স্বল্পমূল্য দিয়ে অবজ্ঞা করা হচ্ছে! এটা নিশ্চিত যে, অন্য কোনো শিল্পী হলে বিনামূল্যে হলেও বিশ্বখ্যাত মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষকে ছবি দিয়ে দিতেন। তার ছবি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে থাকবে বলে। স্বল্পমূল্য কিংবা সম্মানের কথা ভাবতেন না তিনি। এটাই সব দেশের সাধারণ ও স্বাভাবিক চিত্র। সব দেশের সাধারণ ও স্বাভাবিক চিত্র এমনটি হলেও বাংলাদেশের চিত্রের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। বলা যায়, এ চিত্র নির্লজ্জ ভিক্ষুকসুলভ। দাসসুলভ। ইংরেজ প্রভুদের পদসেবা করতে করতে এমনটি হয়েছে। এ অভ্যাস রাজনৈতিক ও আমলা প্রভুদের সেবায় পরিণত হয়েছে।

কী লেখক, কী শিল্পী, কী বুদ্ধিজীবী সবাই রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রভু ভজায় মত্ত এখন। লুণ্ঠন, হত্যা, ধর্ষণের মহামারীর সময়েও তারা মুখে কুলুপ এঁটে বসে থেকে প্রভুভক্তির প্রমাণ দিচ্ছেন! সমালোচনা কিংবা প্রতিবাদী হলেও প্রভু যদি ক্ষুব্ধ হন! ফেসবুক এই শ্রেণীর প্রভুভক্তদের সম্পর্কে ব্যাপক সমালোচনা স্ট্যাটাসে পূর্ণ। ফেসবুকেই বিশ্ববাসী এবং দেশবাসী (২২ জুলাই) দেখেছেন প্রভুভক্তদের সম্পর্কে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম ও অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ (২৭ জুলাই) কী ধরনের মন্তব্য করেছেন। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, ‘দেশের বুদ্ধিজীবীরা চামচাগিরি ও মীরজাফরি করছেন’। আর অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, ‘আজকাল আমাদের দেশে দেখবেন, ভালো মানুষরা বিচ্ছিন্ন। ভালো মানুষদের মধ্যে যোগাযোগ নেই। তাঁরা একা, পরস্পরকে খুঁজে পান না। কিন্তু যারা খারাপ তাঁরা খুবই সঙ্ঘবদ্ধ। এক শয়তান হুক্কাহুয়া দিলে মুহূর্তে হাজার শয়তান ক্যায় হুয়া, ক্যায়া হুয়া করতে করতে এগিয়ে আসে’।

দেশের স্বচ্ছ মনের অধিকারী সৎ ও আদর্শবান দু’জন অধ্যাপকের বক্তব্যে পূতি বা দুর্গন্ধময় আবর্জনার কত গভীরে যে দেশ তলিয়ে গেছে তার স্পষ্ট চিত্র ভেসে উঠেছে। এ চিত্র সম্পর্কে মন্তব্য করতেও গা ঘিন ঘিন করে আর শুধুই লেখক আহমদ ছফার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে, বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার এবং গ্রন্থ ক্রয়কারী সরকারি সংস্থাগুলোর কথা। এ যাবত আমার ২০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে যার বেশির ভাগই শিল্প সংস্কৃতি ও নন্দনতত্ত্ব বিষয়ক (কয়েকটি বই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য)। প্রকাশকরা আমাকে বলেছেন, সরকারের গ্রন্থ ক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলেছে, আমার বই ক্রয় করার ক্ষেত্রে তাদের অসুবিধা আছে! কী অসুবিধা সে কথা বলেন না প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তারা। এসব কিছু জেনে বুঝে আহমদ ছফার মতো আমারও মনে হয় আমিও একজন ‘হারামজাদা’ লেখক।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল