২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মার্কিন নির্বাচন ও ফিলিস্তিন সমস্যা

মার্কিন নির্বাচন ও ফিলিস্তিন সমস্যা - ছবি : নয়া দিগন্ত

আগামী ৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ট্রাম্প ১৯৯৯ সালে রিপাবলিকান পার্টি ছেড়ে রিফর্ম পার্টির ভোটার হিসেবে নাম নিবন্ধন করেন। এর পরপরই ২০০০ সালে তিনি লিখেছেন ‘দ্য অ্যামেরিকা উই ডিজার্ভ’ নামের একটি বই। এই বইতে তিনি তার উদার সামাজিক ও সংরক্ষণবাদী অথনৈতিক মতবাদ তুলে ধরেন। তিনি ২০০৯ সালে ফিরে আসেন রিপাবলিকান পার্টিতে। ২০১৬ সালে এ পার্টি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ২০১২ সালে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন না, তবু তিনি মিথ্যা অভিযোগ তুলে বলেছিলেন : ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের ‘ন্যাচারাল-বর্ন সিটিজেন’ নন। রাজনৈতিক দিক থেকে ট্রাম্প বিবেচিত একজন জাতীয়তাবাদী হিসেবে। জো বাইডেন তার নির্বাচনী বক্তব্যে বলেছেন, ট্রাম্প সবচেয়ে বড় বর্ণবাদী। প্রতি উত্তরে ট্রাম্প দাবি করেন, তিনি সবচেয়ে কম বর্ণবাদী।

তার ভাষায় ‘লিস্ট রেসিস্ট’। কারো কারো মতে, তিনি রিপাবলিকান পার্টিকে পরিণত করতে চান অধিকতর পপুলিস্ট, ন্যাটিভিস্ট, প্রটেকশনিস্ট ও সেমি-আইসোল্যানিস্ট পার্টিতে। অভিবাসনের ব্যাপারে তিনি সংশয়বাদী, উন্মুক্ত বাণিজ্য ও সামরিক হস্তক্ষেপবাদের ব্যাপারে আছে তার আগ্রাসী মনোভাব। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রবলভাবে ইহুদি তথা ইসরাইলপ্রেমী, অন্য কথায় ইসরাইলের বেপরোয়া সমর্থক। তার বিগত চার বছরের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র জেরুসালেমকে এককভাবে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি জানায় এবং সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস স্থাপন করেছে। বর্তমানে ট্রাম্প নির্বাচনে প্রচার করছেন, এটি যুক্তরাষ্ট্রের ইভানজেলিক্যাল ক্রিস্টানদের একটি বড় বিজয় হিসেবে। ফিলিস্তিনি অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনে ছিল তার সক্রিয় সমর্থন।

চার বছরের শাসনামলে তিনি ও তার জামাতা জ্যারেড কুশনার নানা কলকাঠি নাড়াচাড়া আর ক্রিয়া-প্রক্রিয়ার পর শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চলতি বছরের জানুযারির শেষ দিকে ঘোষণা করেন তার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ও বহুল আলোচিত ‘মিডল ইস্ট পিস প্ল্যান’। এই পরিকল্পনায় প্রস্তাব করা হয় অবিভক্ত জেরুসালেম হবে এককভাবে ইসরাইলের রাজধানী। ফিলিস্তিন বা প্যালেস্টাইন হবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র; তবে পশ্চিম তীরের বিতর্কিত অবৈধ বসতিগুলোর ওপর ইসরাইলের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিতে হবে ফিলিস্তিনকে। হোয়াইট হাউজে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে এই পরিকল্পনা ঘোষণার সময় ট্রাম্প বলেন, তার এই প্রস্তাব ‘হতে পারে ফিলিস্তিনিদের জন্য সর্বশেষ সুযোগ।’

ফিলিস্তিনি জনগণ যথার্থ কারণেই প্রতিবাদ বিক্ষোভ করে ট্রাম্পের এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস এই পরিকল্পনাকে একটি ‘ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করে তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, ‘আমি ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুকে বলছি : জেরুসালেম ও আমাদের যাবতীয় অধিকার বিক্রি করার কোনো বিষয় নয়। এগুলো দরকষাকষির বিষয়ও নয়। আপনাদের এ প্রস্তাব ও ষড়যন্ত্র কখনোই মেনে নেয়া হবে না।’

অন্য দিকে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন ওবামা প্রশাসনের আমলে ছিলেন দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট। ১৯৭৩-২০০৯ সময়ে ছিলেন বিশিষ্ট একজন সিনেটর। সে সময় তিনি বিদেশনীতি বিশেষজ্ঞ হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। বেশ কয়েক বছর ছিলেন বিদেশনীতি-সম্পর্কিত কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি সফল কূটনীতি চালিয়েছেন- রাশিয়ার সাথে কৌশলগত অস্ত্র সীমিতকরণ, বলকান অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার উন্নয়ন, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে অন্তর্ভুক্ত করে ন্যাটোর সম্প্রসারণ, সুদানের দারফুরে গণহত্যা বন্ধে আমেরিকা হস্তক্ষেপের পক্ষে অবস্থান, প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের বিরোধিতা, জর্জ বুশের ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বিশেষ করে ইরাকে ২০০৭ সালে মার্কিন সৈন্য বাড়ানোর বিরোধিতা করা ইত্যাদি ক্ষেত্রে। বিদেশনীতির বাইরে দেশের ভেতরে তিনি বেশ কিছু অনৈতিক আইন প্রণয়নেরও বিরোধিতা করেছে। সার্বিক বিবেচনায়, ট্রাম্পের মতো তিনি ফিলিস্তিন বিরোধিতায় ততটা আগ্রাসী নন।

অনেকের ধারণা, এবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী জো বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই যারা ফিলিস্তিনে ইসরাইলের দখলদারিত্ব ও ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের অবসান চান এবং ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের প্রত্যাশা করেন, তারা মনে করেন জো বাইডেন ড্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে, ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। নইলে আগ্রাসী ট্রাম্প তার অন্ধ ইসরাইল সমর্থনের মাধ্যমে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান ও সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার পথকে আরো জটিল করে তুলবেন, সেই সাথে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলের অন্যায়-অত্যাচার আরো বেড়ে যাবে। রুদ্ধ হবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ও শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ। এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত মুসলমানরা তুলনামূলক ডেমোক্র্যাটিক দলকে বেশি সমর্থন করে থাকে। ট্রাম্পের আমলে ইসরাইলের প্রতি তার অতিপ্রেম ও বিশেষ করে জেরুসালেমকে এককভাবে ইসরাইলের রাজধানী করা ও অভিবাসনবিরোধী ভূমিকায় ট্রাম্পের প্রতি এসব ভোটার এখন আরো বেশি ক্ষুব্ধ।

অনেকে আশাবাদী, বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে তার নেতৃত্বাধীন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ‘প্রগ্রেসিভ মুভমেন্ট’ যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে এমন সব নাটকীয় পরিবর্তন আনবে, যা দেশটির সরকার, সমাজ, সংস্কৃতি, বিদেশনীতি, সর্বজনীন স্বাস্থ্যনীতি ও সর্বোপরি আমেরিকান জনগণের কল্যাণের জন্য অতীব জরুরি। কারণ বিশ্বসমাজে যুক্তরাষ্ট্রের নানা নীতি-কৌশল নিয়ে দীর্ঘ দিন থেকে আছে হাজারো প্রশ্ন। কিছু প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে বারবার, বহুবার। অনেক ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টকে এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। কিন্তু তারা কি এসব প্রশ্নের ন্যায়ভিত্তিক সমাধানে কোনো নৈতিক ও আন্তরিক ভূমিকা পালন করে গেছেন?

বিতর্কহীনভাবে এ প্রশ্নের জবাব নেতিবাচক। নইলে এসব প্রশ্নের সমাধান অনেক আগেই হয়ে যেত। বরং আমরা রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় দলীয় প্রেসিডেন্টকেই দেখেছি, বিদ্যমান ধারাবাহিক বর্ণবাদী ব্যবস্থা ও আমেরিকান সমাজকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার নীতি অবলম্বন করে চলতে। সেই বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আমরা আশাবাদী হতে পারি না, জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলেও ফিলিস্তিনিদের ভাগ্যে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন ঘটবে; যার সূত্রে ফিলিস্তিনে ঘটবে ইসরাইলি দখলদারিত্বের অবসান এবং তারা পাবে তাদের স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। পূর্ব জেরুসালেম পাবে ফিলিস্তিনের রাজধানীর মর্যাদা। এ ধরনের আশঙ্কার কারণ- ফিলিস্তিনের অবস্থার কোনো পরিবর্তন আমরা দেখতে পাইনি বারাক ওবামার আমলে, যখন জো বাইডেন ছিলেন তার সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট। এবার বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলে তিনি রাতারাতি ফিলিস্তিনে নাটকীয় কোনো পরিবর্তন নিয়ে আসবেন, তেমনটি ভাবা কঠিন। তবু আমরা আশাবাদী হতে চাই তার ব্যাপারে।

ইহুদি নেতা, জিউইশ অ্যাজেন্সির প্রধান বেন গুরিয়ান ১৯৪৮ সালের ১৪ মে আরব ভূখণ্ডে কৃত্রিম ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি এস ট্রুম্যান সেদিনেই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিলেন। সেদিন থেকে শুরু হলো আমেরিকার প্রেসিডেন্টদের ইসরাইলের ফিলিস্তিনবিরোধী বৈধ-অবৈধ কর্মকাণ্ডের প্রতি প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য ও কৌশলী সমর্থন দান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে একই ধরনের স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন সমর্থন প্রতিটি মার্কিন প্রশাসন ও আমেরিকান প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে পেয়ে আসছে ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরাইলের বর্ণবাদী নীতি। দক্ষিণ আফ্রিকার শ্বেতাঙ্গ শাসকরা যে ধরনের বর্ণবাদী আচরণ অবলম্বন করতেন, সেখানকার আদিবাসী কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর, ফিলিস্তিনে ইসরাইলিদের বর্ণবাদের তীব্রতা আরো শতগুণ বেশি। আজকের ‘বিডিএস’ নামের আন্দোলন যেভাবে নানা পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনে ইসরাইলি বর্ণবাদের অবসান ঘটানোর চেষ্টা করছে, এ ধরনের পদক্ষেপের মধ্য দিয়েই নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের কবর রচনা করে গেছেন।

বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রধানত আমেরিকার প্রতিটি প্রেসিডেন্ট ও তার প্রশাসনের কম-বেশি ফিলিস্তিনবিরোধী ভূমিকার কারণেই ইসরাইল নামের কৃত্রিম রাষ্ট্রটি আজ দম্ভভরে অস্তিত্বশীল, অন্য দিকে দশকের পর দশক ধরে ইসরাইল দখল করে রেখেছে জাতিসঙ্ঘের ১৯৩টি সার্বভৌম রাষ্ট্রের মধ্যে ১৩৯টি দেশের স্বীকৃতি পাওয়া ফিলিস্তিন নামের দেশটিকে। সেখানে ধারাবাহিক গণহত্যা চলছে ফিলিস্তিনি জাতিনিধনের লক্ষ্য নিয়ে। অথচ এ দেশটিতে বরাবর সক্রিয় সহযোগিতা করে চলেছে আমেরিকার প্রত্যেক প্রেসিডেন্টের প্রশাসন। আমেরিকার জনগণের করের অর্থ থেকে আমেরিকান ভোটারদের অজান্তেই প্রতি বছর ৩৮ বিলিয়ন ডলার দেয়া হচ্ছে ইসরাইলের মানবতাবিরোধী সরকারকে। এমন কোনো রেকর্ডপত্রও নেই, যা থেকে সাধারণ মানুষ জানতে পারে যে, যুক্তরাষ্ট্র বর্ণবাদী ইসরাইলের পেছনে প্রতি বছর খরচ করছে। ইসরাইল এসব অর্থ ব্যয় করছে ফিলিস্তিনে দখলদারিত্ব বজায় রাখা ও ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখল করে নতুন নতুন অবৈধ ইহুদি বসতি গড়ে তোলার পেছনে এবং তাদের ওপর নির্যাতন চালানোর কাজে। বিগত সাত দশক ধরে ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রের কাছে থেকে যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা পেয়েছে, তা পেয়েছে ওই রিপাবলিকান বা ডেমোক্র্যাট দলীয় রাজনীতিকদের কাছ থেকেই; যারা প্রতিনিধিত্ব করেছেন বা করছেন আমেরিকান ভোটারদের। তাই ডেমোক্র্যাট বলি আর রিপাবলিকানই বলি, উভয়ই সমভাবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও ব্যাপকভাবে আমেরিকান সমাজের ভেতরের ‘ইহুদি ফিফথ কলাম’। বিষয়টি বোঝার জন্য পড়ে দেখা যেতে পারে গুগল আর্টিকল : ‘ইসরাইল অ্যান্ড ইটস সাপোর্টারস আর অ্যা ফিফথ কলাম ইন অ্যামেরিকান পলিটিক্স’।

এই ২০২০ সালে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ‘ন্যাশনাল কমিটি’ (ডিএনসি) ও ‘ডেমোক্র্যাটিক মেজোরিটি ফর ইসরাইলস পিএসি’ (ডিএমআইপিএসি) এখন জো বাইডেনের পক্ষে ভোট চাইছে। তারা ভোটারদের বলছেন- প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তার রিপাবলিকান পার্টির তৈরি করা ‘মিডল ইস্ট পিস প্ল্যান’ নামের পরিকল্পনা আসলে একটি মেকি পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনা মধ্যপ্রাচ্যে আরো কলহের ও সন্ত্রাসের জন্ম দেবে। নির্বাচিত হলে জো বাইডেন ও তার ডেমোক্র্যাটিক পার্টি আরো উল্লেখযোগ্য ভিন্ন পদক্ষেপ নেবে, যেখানে তারা হবে ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বন্দ্ব নিরসনে এবং প্রতিবেশী আরব দেশগুলোতে শান্তি প্রতিষ্ঠা প্রক্রিয়ায় এক ‘অনেস্ট ব্রোকার’।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘এফআইডিএফ’ (ফ্রেন্ডস অব ইসরাইল’স ডিফেন্স ফান্ড)-এর একটি ‘পাঁচ লাখ ডলার পার পারসন ডিনার অ্যান্ড গালা ইভেন্ট’। জো বাইডেন এই ডিনার পার্টি ও আনন্দ উৎসবে যোগ দেন। উপস্থিত ছিলেন ইসরাইলি-অ্যামেরিকান মিডিয়া মোগল হায়াম সাবান, যিনি ফর্বস ম্যাগাজিনের র‌্যাংকিংয়ে আমেরিকার ২৩২তম ধনী ব্যক্তিত্ব। এর আগে তিনি সমর্থন জানিয়েছিলেন বাইডেনের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে। হায়াম সাবানের ঘনিষ্ঠতা আছে ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারের সাথেও; তিনি সহযোগিতা করেছেন ট্রাম্পের তথাকথিত ‘আরব আমিরাত-ইসরাইল শান্তি পরিকল্পনা’ তৈরিতে। সাবান নিজেকে বর্ণনা করেন একজন ‘issue guy’ হিসেবে এবং বলেন : ‘মাই ইস্যু ইজ ইসরাইল’। দীর্ঘ দিনের ইসরাইল সমর্থক হায়াম সাবান বাইডেন সম্পর্কে বলেছেন : ‘ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্র’ মৈত্রীর বন্ধন অটুট রাখতে বাইডেন হচ্ছেন ‘সঠিক প্রার্থী’। আর এই জোট বহু বছর ধরে ছিল অপরিবর্তনীয়। রেকর্ড থেকে দেখা যায়, এই জোট আমেরিকার স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এটি জো বাইডেন যথার্থই চিহ্নিত করেছেন তার বক্তব্যে, যখন বাইডেন বলেন- ‘যদি ইসরাইল না থাকত, তবে আমাদের স্বার্থরক্ষা নিশ্চিত করতে তেমন একটি দেশ আমাদের উদ্ভাবন করতে হতো।’

এসব কিছুর শেষ ফল হচ্ছে- তথাকথিত প্রো-ইসরাইল, প্রো-আমেরিকা, প্রো-পিস প্ল্যান ইত্যাদি, ফিলিস্তিনের প্রেক্ষাপটে একটি অক্সিমোরোন তথা বাক্যালঙ্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ ইসরাইলের ‘ম্যানিফেস্ট ডেস্টিনি’ ডিক্লারেশনে দাবি করা হয়েছে : এদের নিজেদের সম্পূর্ণ ‘হলি ল্যান্ড’ কখনোই একই সাথে হতে পারে না প্রো-ইসরাইল, প্রো-আমেরিকান ও প্রো-প্যালেস্টাইন। অন্য কথায় বলা যায়- এটি এমন ব্যাপার যে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড, বিজয়, দখল ও চুরির ক্ষেত্রে ইসরাইলের নির্লজ্জ-প্রকাশ্য আগ্রাসন সমস্যার কোনো ‘কনসিলেশন’-এর (মীমাংসার) আগেই ‘রিকনসিলেশন’ (নতুন মীমাংসা) নিয়ে কথা বলা।

সব কিছু বাদ দিয়েও ট্রাম্প ও বাইডেন উভয়েই নিজেদের অতীত কর্ম ও কথা দিয়ে আমাদের বুঝতে দেননি, ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য কোনটা ন্যায্য আর কোনটা অন্যায্য। বিশেষ করে কেউ যদি ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও এর ডিএনসির অনুমোদিত, ডিএমআইপিএসির সম্প্রচারিত আধঘণ্টার রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনটি দেখেন, তবে দেখা যাবে- এ বিজ্ঞাপনটি বিশেষত ডিজাইন করা হয়েছে ফ্লোরিডাসহ দেশটির অন্যান্য মুখ্য ব্যাটল গ্রাউন্ড স্টেটগুলোর কনজারভেটিভ প্রো-ইসরাইলি ভোটারদের টার্গেট করে। ডিএনসি এর আগে এসব ‘ব্যাটল গ্রাউন্ড’ স্টেটে একই ধরনের রাজনৈতিক বিজ্ঞাপন ছেড়েছিল বিশেষত অধিকতর প্রগ্রেসিভ প্রো-প্যালেস্টাইন ভোটার টার্গেট করে। তাই প্রশ্ন হচ্ছে, ভারসাম্যটা কোথায়?

যা-ই হোক, বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে আমেরিকার জনগণ দেখতে পাবে- দেশটিতে রিপাবলিকানদের চেয়ে উন্নততর গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চা। এই মূল্যবোধ আর গণতন্ত্রের চর্চা সীমাবদ্ধ থাকবে না শুধু আমেরিকার কালো ও বাদামি জনগণের মধ্যেই, তা সম্প্রসারিত হবে স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিসহ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের ক্ষেত্রেও- এমনটি আশা করা যেতে পারে। চূড়ান্ত বিশ্লেষণে বলা দরকার- ট্রাম্প বা বাইডেন, যিনিই প্রেসিডেন্ট হন, দুনিয়ার মানুষ চায়, তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে আমেরিকা ও বাকি দুনিয়ায় যাবতীয় অমানবিকতা, যুদ্ধবিগ্রহ আর বিবাদ-কলহের অবসান ঘটবে : আমেরিকাসহ বাকি দুনিয়ায় শান্তির সুবাতাস অবিরাম বয়ে চলুক, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান হোক, পৃথিবী থেকে বর্ণবাদসহ যাবতীয় অমানবিকতা, আর অন্যায়-জুলুমের অবসান হোক।


আরো সংবাদ



premium cement