২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শিক্ষাব্যবস্থায় কাঠামোগত সংস্কারের এখনই উপযুক্ত সময়

-

করোনাভাইরাস বিস্তারের আশঙ্কায় উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা গ্রহণ না করার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। এটা সঠিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু পরীক্ষা না নিয়ে আগের পারফরম্যান্সের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের প্রক্রিয়া নিয়ে দ্বিমত পোষণ করি। বিকল্প কোনো প্রক্রিয়া তালাশ করা হয়েছে কি না জানা নেই। তবে আমরা কোনোভাবেই মান্ধাতা আমলের শিক্ষাপদ্ধতি থেকে বেরুতে পারছি না। বিকল্প চিন্তা কোনোভাবেই যেন আমাদের মাথায় আসে না। করোনার মতো বৈশ্বিক দুর্যোগের সময় বিশ্বের সবকিছু যখন বদলে যাচ্ছে এবং বদলে যেতে বাধ্য তখনো আমরা বিকল্প কিছু ভাবতে পারছি না। অথচ এটা ছিল শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোগত সংস্কারের উত্তম সময়। আমরা এ সময় সামাজিক দূরত্ব, আইসোলেশনে থাকা এসব কথা বলে পরীক্ষা না হয় বাতিল করলাম। কিন্তু এর পরিণতি কী হবে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মৌলিক সমস্যাগুলো দূর করার উপায় কী সেসব ভাবছি না। চলমান বৈশ্বিক মহামারী কর্মসংস্থানের ওপর নির্ঘাত চাপ সৃষ্টি করবে। পরীক্ষা বাদ দিয়ে পাস করিয়ে দিলেই কি এসব শিক্ষার্থীর সমস্যার সমাধান হবে? এরা যখন শ্রমবাজারে প্রবেশ করবে তখন কোন যোগ্যতার বলে লড়াই করবে? এই সমস্যার সমাধান তখনই হবে যখন আমরা কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে নন-স্ট্রাকচারাল শিক্ষাব্যবস্থার দিকে ধাবিত হতে পারব।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা ফরমাল এডুকেশনের ওপর এতটাই জোর দেয়া হয় যে তা এখন ‘ওভার-স্কুলিং’ হয়ে গেছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে জনবল তৈরি করছে তার সাথে উন্নয়নচাহিদার যোগ নেই। এমন জনবল তৈরি করা হচ্ছে যারা সমাজের প্রয়োজন পূরণে অক্ষম। যুগের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সামর্থ্য তাদের নেই। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ওপর অতি নির্ভরতার কারণে কোনোভাবে একটি ভবন ভাড়া নিয়েই ইউনিভার্সিটি খুলে ফেলা যাচ্ছে। কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা না হয় বাদই দিলাম।

আমাদের স্কুলিং সিস্টেম যে পণ্যটি তৈরি করছে তা বাস্তবতার নিরিখে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, গত এক বছরে আমার অফিস থেকে পাঁচজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট, বলব যে পালিয়ে বেঁচেছে। জীবনবৃত্তান্তে অনেক ফিরিস্তি থাকে। কিন্তু সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে দেখি ‘রয়্যালটি’ হিসাব করতে পারে না। অর্থাৎ আমরা এমন জনবল তৈরি করছি যারা সমাজের কোনো কাজে আসছে না। এদের প্রাসঙ্গিক করতে হলে ‘অন দ্য জব ট্রেনিং’ দরকার। আমাদের যে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা আছে সেটা থাকতে পারে। এর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এতে কোনো ‘মেরামত সুবিধা’ বা ‘সার্ভিসিং সিস্টেম’ নেই। বিষয়টি সহজে বোঝার জন্য বলছি : আমরা সামান্য একটি ইলেকট্রনিক অ্যাপ্লায়েন্সও কিনতে গিয়ে যদি শুনি এর কোনো সার্ভিসিং পাওয়া যাবে না, এর কোনো ওয়ারেন্টি নেই বা খারাপ হয়ে গেলে এর মেশিন পাওয়া যাবে না, তাহলে কি কেউ সেই পণ্য কিনব? কিনব না? ঠিক এ ঘটনাটি ঘটছে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত জনবলের বেলায়। তারা দ্রুত অচল হয়ে পড়ছে। আর ‘সার্ভিসিং’ না থাকায় অচলই থেকে যাচ্ছে।

স্কুলিং সিস্টেম তিন ধরনের : ফরমাল এডুকেশন (করপোরেট সেক্টর স্ট্রাকচারাল এডুকেশন), নন-ফরমাল এডুকেশন ও ইনফরমাল এডুকেশন (রিলিজিয়াস অ্যান্ড সোস্যাল এডুকেশন)। আমাদের দেশে নন-ফরমাল এডুকেশনকে তেমন পাত্তা দেয়া হয় না। ইনফরমাল এডুকেশনের তো কথাই নেই। অন্য দিকে, ফরমাল এডুকেশনের ওপর এতটাই চাপ দেয়া হয় যে এতে শিশুর মানসিকতার অপমৃত্যু ঘটছে। ক্লাস ওয়ানের ছেলেমেয়েরাও ক্লাস পরীক্ষা নিয়ে পেরেশান।

নন-ফরলমাল এডুকেশন মানে হলো ‘অন দ্য জব ট্রেনিং’ বা কর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ। উন্নয়ন অর্থনীতি বা গতিশীল অর্থনীতিতে আমরা দেখি নতুন নতুন চাকরি সৃষ্টি হচ্ছে। আর অনেক চাকরি হারিয়ে যাচ্ছে। এই কিছু দিন আগেও আমাদের দেশে টাইপরাইটার ব্যবহার করা হতো, আমরা জরুরি খবর দেয়ার জন্য টেলিগ্রাম করতাম। সেগুলো কি আছে? এখন তো কম্পিউটারেরও কয়েক প্রজন্ম চলে গেছে। এখন নতুন যে কর্ম হাজির হচ্ছে তার জন্য ওই টাইপরাইটার কি আবার ফরমাল এডুকেশনে ফিরে যাবে? তার কর্মসংস্থানের জন্য নন-ফরমাল এডুকেশন দরকার। ছোট ছোট কর্মমুখী প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা বের হচ্ছে তাদের শিক্ষা তো বের হওয়ার আগেই বাতিল (আউটডেটেড) হয়ে যাচ্ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ও এই ট্রেনিং অন দ্য জব-এর ব্যবস্থা করতে পারে। হাতেগোনা দু’একটি বিষয়ে হয়তো এটা আছে, যাকে আমরা ইন্টার্নশিপ বলি। পশ্চিমা বিশ্বে জনবলকে ক্রমাগতভাবে জব ট্রেনিং দেয়া হয়। যেটা আমাদের সিস্টেমের মধ্যে নেই।

এবার ইনফরমাল এডুকেশন প্রসঙ্গে আসছি। আমাদের শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ধর্মীয় শিক্ষার বই পড়ে। কিন্তু আমরা দেখছি না ওই শিক্ষার্থী ধর্মীয় শিক্ষার অনুশীলন করছে কি না; মসজিদে, মন্দিরে বা গির্জায় যাচ্ছে কিনা। সবাই যার যার ধর্ম পালন করলে আজ মানবতার জন্য এত হাহাকার সৃষ্টি হতো না। কোনো ধর্মেই মিথ্যা কথা বলতে বলেনি বা প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার করতে নিষেধ করেনি। কোনো ধর্মেই পিতা-মাতা, শিক্ষক গুরুজনকে অসম্মান-অশ্রদ্ধা করতে বলা হয়নি। ধর্মীয় শিক্ষা দেয়ার সাথে সাথে শিক্ষার্থীকে ধর্ম অনুশীলনের কেন্দ্রগুলোতে নিয়ে গেলে তাদের শিক্ষাটি পরিপূর্ণ হতো। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সেটা নেই। আমি দেখেছি, যে ছেলেটি কখনো মসজিদে যায়নি সে মসজিদের ওপর নিবন্ধ লিখছে। কিন্তু সে যদি মসজিদে যেত, সেখানকার বাস্তব পরিস্থিতি দেখত, বুঝত। অন্যদের সাথে ইন্টারঅ্যাকশন হলে তখন ধর্মীয় মূল্যবোধগুলোর যে ইন্টারনালাইজেশন হবে সেটাই প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষা।

সরকার উচ্চশিক্ষা খাতে যে ভর্তুকি দিচ্ছে তার অনেকটাই অপচয় মনে করি। উচ্চশিক্ষা হওয়া উচিত মূলত সবচেয়ে মেধাবীদের জন্য। আমরা পশ্চিমা বিশ্বের কথাই ধরি না কেন। যেমন ব্রিটেন। সেখানে এ লেভেল হলো কাটিং পয়েন্ট। এই ধাপ যারা উতরাতে পারে তারা খুবই মেধাবী এবং স্মার্ট। যারা পার হতে পারে না তাদের বলা হয়, বাবা তুমি অন্য ট্রেডে যাও। উচ্চশিক্ষা তোমার জন্য নয়। আমাদের দেশেও উচ্চশিক্ষার জন্য এমন একটি ‘বাধা’ সৃষ্টির কথা বলব। যে এই বাধা পেরুতে পারবে না তার জন্য আলাদা সুনির্দিষ্ট ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তুমি এমএ-তে থার্ড ক্লাস পেয়ে পিএইচডি করবে, তাহলে তো সমাজের জন্য বোঝায় পরিণত হবে। নির্বিচারে ভর্তুকির টাকার একটি অংশ শিক্ষার্থীদের কর্মভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজে ব্যয় করা যেতে পারে।

এ জন্য সরকারের খুবই সচেতন ও সুনির্দিষ্ট নীতি গ্রহণ করা দরকার। দুনিয়াতে যেমন গৃহকর্মীর প্রয়োজন আছে, তেমনি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা একজন আইনস্টাইনেরও প্রয়োজন আছে। একজন ডাক্তারের সাথে নার্স এবং ওয়ার্ডবয়ও লাগে। একজন ওয়ার্ডবয় ডাক্তারের কাজ করতে পারে না। এটা একটি প্যাকেজের মতো। সবাই যার যার দায়িত্ব পালন করবে। এই শ্রেণী বিভাগ ইসলাম সমর্থন করে। ইসলাম বলেছে ন্যায্যতার (equitable) কথা। ইসলাম সম্পদের ন্যায্য বণ্টনের কথা বলেছে। সবার জন্য সমান সুযোগের কথা বলেছে। এর মানে এটা নয় যে সবাইকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করতে হবে। তেমনি সমান পারিতোষিকও হতে পারে না। ডাক্তার ও নার্সের বেতন সমান হতে পারে না। সমাজের বৈচিত্র্য আল্লাহরই একান্ত পরিকল্পনার আওতাভুক্ত। এটা সমাজে চলার জন্য দরকার আছে। শুধু যার যা দায়িত্ব সেটা সে পালন করে যাবে।

আমি জব ট্রেনিংয়ের কথা বলছি, কিন্তু কোথায় সেই ট্রেনিং করবে? এর জন্য আমাদের শেয়ারবাজারে লিস্টেড যেসব কোম্পানি আছে সেগুলোকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে। সেখানে শিক্ষার্থীদেরকে তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা অনুযায়ী ট্রেনিংয়ে কাজে লাগানো যায়। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নিজস্ব এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম, ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম নিতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রত্যেক বিভাগের জন্য এটা থাকতে হবে। কেউ ইংরেজির ছাত্র। তার কি এটা দরকার নেই? আছে। একটা কারখানা চালানোর জন্য ইংরেজি জানা লোকের কি দরকার নেই? সেখানে সব ধরনের লোক দরকার। যেমন দক্ষ মেকানিক দরকার, অ্যাকাউন্ট্যান্ট দরকার, তেমনি বিদেশে রফতানির জন্য করেসপন্ডেন্স করতে পারে তেমনি দক্ষ ইংরেজি জানা লোক দরকার। একইভাবে মাদরাসাগুলো থেকে যেসব শিক্ষার্থী বের হচ্ছে তাদের বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত করে ইন্টার্নশিপের মতো ব্যবস্থা করা যেতে পারে। উদ্দেশ্য একটিই, তাদের শিক্ষাটিকেও বাস্তব কর্মের সাথে যুক্ত করা। মাদরাসাগুলোও ইন্টার্নশিপ/এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম নিতে পারে। যদি আমরা শিক্ষাব্যবস্থায় এই নন-ফরমাল এডুকেশন ব্যাপক আকারে চালু করতে পারি তাহলে দেশের চেহারাটাই আমূল বদলে যাবে। আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা নতুনরূপে সাজবে। আমাদের শ্রমবাজারে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এই জনশক্তি বৈদেশিক শ্রমবাজারে গিয়েও কিন্তু ভালো করতে পারবে।

আমাদের দেশে যত ‘হোয়াইট কালার জব’ আছে সেগুলোর প্রায় সব ভারতীয় বা চীনা বা অন্য কোনো দেশের নাগরিকের দখলে। ইন্টারন্যাশনাল করপোরেশনে কয়জন বাংলাদেশী কাজ করে। ২০১৮ সালে সংবাদপত্রে খবর হয়েছিল যে ভারতের রেমিট্যান্স আয়ের চতুর্থ বৃহত্তম উৎস হলো বাংলাদেশ। আমরা বিদেশী অদক্ষ শ্রমিক পাঠানোর জন্য মরিয়া হয়ে যাই। কিন্তু এদের কাজ শেখানোর কথা ভাবি না। আমি অনেক শিক্ষিত বাংলাদেশীকে বিদেশে গিয়ে এমন কাজ করতে দেখেছি যার জন্য স্কুল কলেজে পড়াশুনা করতে হয় না। এদের জন্য যদি কোনো জব ট্রেনিং থাকত তাহলে অনেক সম্মানজনক কাজ তারা পেত বিদেশে।

তাই আমি নন-ফরমাল ও ইনফরমাল এডুকেশনের ওপর জোর দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাব। এখন ওভার-স্কুলিংয়ের প্রবণতা থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের ডিস্কুলিং করতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ভলান্টারি সার্ভিসে কাজে লাগানো যেতে পারে।

আসলে আমরা শিক্ষাকে রাজনীতিকীকরণ করে জাতির সর্বনাশ করেছি। আমি রাজনীতিবিদদের অনুরোধ করব তারা যেন এ কাজটি না করেন। বলব, শিক্ষাকে শোষণ করা বন্ধ করুন। দেশের নেতৃবৃন্দকে আহ্বান জানাব, এই বিষয়গুলো নিয়ে তারা যেন ভাবেন। করোনার সময়ে শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা অনেক সহজ হবে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
hmct2004@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement