২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ও ভূমিদস্যুদের আস্পর্ধা

-

বিজ্ঞানীদের মতে, পরিবেশ দূষিত হওয়ার কারণে বিশ্ব আজ বিপর্যয়ের মুখে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে অধিক মাত্রায় শিল্পকারখানা গড়ে ওঠায় নির্গত ধোঁয়ার কারণে বিশ্বের উত্তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ছে। বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে এবং প্লাবিত হচ্ছে পৃথিবীর নিম্নাঞ্চল। বাংলাদেশে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার প্রশ্নে বিশেষজ্ঞরা প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে দায়ী করছেন। বিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের নিঃশ্বাস থেকে যে কার্বন-ডাইঅক্সাইড নির্গত হয় তা গাছ গ্রহণ করে এবং মানুষ যে অক্সিজেন গ্রহণ করে বেঁচে থাকে তা গাছ থেকে নির্গত হয়। সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীকে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতিতে পরিচালনা করছেন। কিন্তু মানুষ অপরিকল্পিতভাবে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি করছে।

পরিবেশ ধ্বংস করার জন্য বাংলাদেশের একটি শ্রেণী ভয়ানক তৎপর। পরিবেশ রক্ষায় সরকারসহ অনেক দেশপ্রেমিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দেশব্যাপী বৃক্ষরোপণ করছে। কিন্তু একটি শ্রেণী রয়েছে যারা নিজেদের স্বার্থচরিতার্থ করার জন্য পরিবেশ ধ্বংস করে যাচ্ছে। তিন ফসলি জমি, জলাশয়, খাল-বিল, নদী-নালা, খাসজমি প্রভৃতি ভরাট করে পরিবেশের ভারসাম্য ধ্বংস করে ফেলছে।

সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন’ ২০১১ (২০১১ সনের ১৪নং আইন) এর ১২ ধারা বলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে ১৮(ক) অনুচ্ছেদ সন্নিবেশিত করে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে যে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ পরিবেশ সমুন্নত রাখার জন্য রাষ্ট্র সর্বোচ্চ পদক্ষেপ গ্রহণ করার দৃঢ়প্রত্যয়ে উক্ত অনুচ্ছেদটি সংবিধানে সন্নিবেশিত করেছে, যা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন এবং সবার জন্য অপরিহার্য।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮(৩) মোতাবেক প্রধানমন্ত্রীই রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী যার আদেশ সবার জন্য শিরোধার্য বটে। সরকারি ঘরানার লোকেরা প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও ‘রাষ্ট্রনায়ক’ হিসেবে শেখ হাসিনাকে সম্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রীর সুনজরে থাকার জন্য ব্যবসায়ী ও ব্যাংক লুটেরা বাহিনী এখন সরকারি দলের সান্নিধ্য পাওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত, এতে অনেকেই সফল হয়েছেন, বাকিরা আছেন পাইপলাইনে। দোতারা বাজিয়ে দেশের ধনিক শ্রেণী ব্যবসায়ী, ব্যাংক লুটেরা, ভূমিদস্যুরা প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করেন বটে, কিন্তু দেশের পরিবেশ রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর চাহিদার প্রতিফলন হচ্ছে না। ফলে রাষ্ট্র কাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে তা আঁচ করা যাচ্ছে না। কারণ প্রধানমন্ত্রী প্রতিনিয়তই বলে আসছেন যে, ‘তিন ফসলি জমি ভরাট করা যাবে না, জমির ব্যবহার সতর্কতার সাথে করতে হবে, শিল্পাঞ্চল করার ক্ষেত্রে ফসলি জমির অপব্যবহার করা যাবে না, নদী, খাল, জলাশয় বা জলাভূমি (বিল) প্রভৃতি জমি ভরাট করা যাবে না।’ পরিবেশ রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ওই নির্দেশনা ছাড়াও ১. বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫; ২. পরিবেশ আদালত আইন ২০০০; ৩. পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭; ৪. মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরে পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকায় খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০; ৫. বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন ২০০০; ৬. বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন ২০০০; ৭. বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন ২০০২ বলবৎ থাকাবস্থায় ভূমিদস্যুরা নদী, নালা, তিন ফসলি জমি, পুকুর, জলাশয়, বিল প্রভৃতি ড্রেজার লাগিয়ে কৃষকদের জমি ভরাট করে ফেলছে। হাইকোর্টের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও ভূমিদস্যুদের জমি ভরাট কাজ অব্যাহত রয়েছে। সংবাদপত্র, পুলিশ ও প্রশাসন সবাই ভূমিদস্যুদের পকেটস্থ। এই দস্যুরা নিজেরাই একাধিক মিডিয়ার মালিক। ফলে তাদের বেতনভুক কর্মচারীরা এখন মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে বিধায় জমিহারা মানুষের কান্না হয়তো দেশবাসী শুনতে পায় না।

সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের স্মারক নং-৪/৭/৮৭/২০০০/৫২৭ তারিখ-২৩/০৭/২০০০ মোতাবেক পরিপত্র জারি করে স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছে যে, ‘বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (১৯৯৫ সনের ১নং আইন) এর ১৯(১) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই আইন বা বিধির বিধান লঙ্ঘন এবং পরিবেশ দূষণসংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগ আদালতে দায়ের করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদেরকে নির্দেশক্রমে ক্ষমতা অর্পণ করা হলো।’ জেলা প্রশাসকদের কাছে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা বারবার ধরনা দেয়া সত্ত্বেও ভুক্তভোগী জনগণ কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, জেলা প্রশাসন ভূমিদস্যুদের পকেটস্থ হয়ে পড়েছে।

সরকার কেন ভূমিদস্যুদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে? এর কারণ উদঘাটন হওয়া দরকার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তি। পরিবেশ দূষণ বন্ধ করার প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী কি আন্তরিক নন? প্রধানমন্ত্রী যদি পরিবেশ রক্ষা তথা তিন ফসলি জমি রক্ষা, জলাভূমি রক্ষা, জলাশয়, খাল-বিল প্রভৃতি রক্ষায় সত্যিই আন্তরিক হয়ে থাকেন তবে ভূমিদস্যুরা উল্লিখিত জমিতে ড্রেজার লাগিয়ে ভরাট করে ফেলছে কিভাবে? এত বড় আস্পর্ধা ভূমিদস্যুরা পায় কোথায়? কার নির্দেশে ভূমিদস্যুদের প্রতিহত করার জন্য আইন মোতাবেক প্রদত্ত দায়িত্ব প্রশাসন পালন করছে না? এগুলো খতিয়ে দেখার দায়িত্ব কি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নেই?

রাজধানীর পার্শ্ববর্তী রূপগঞ্জ উপজেলা ভূমিদস্যুদের অভয় রাজ্যে। উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনের শিকার। রূপগঞ্জ উপজেলার দাউদপুর, বেলাবো, রূপগঞ্জ, কায়েতপাড়া ইউনিয়নগুলো ও কাঞ্চন পৌরসভার জমিতে যেখানে ধান চাষ হতো, পুকুর ও বিলের মাছ ধরে গ্রামবাসী আমিষের চাহিদা মেটাতো সেখানে এখন শুধু বালু আর বালু। রূপগঞ্জের অসহায় কৃষক জমির মালিকরা কোথাও কোনো আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছে না। জনগণকে আশ্রয় দেয়ার জন্য যারা জনদরদির পোস্টার ছাপিয়ে রাত্রিকালীন ভোটে এমপি বা মন্ত্রী হয়েছে তারাও ভূমিদস্যুদের পক্ষ নিয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানরা সরাসরি ভূমিদস্যুদের দালালি করছে, এ দেশে ভূমিদস্যুদের উপঢৌকনের বিনিময়ে সবাই বিবেক বিক্রি করেছে বিধায় জনপ্রতিনিধি, পুলিশ, প্রশাসন ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনের বিষয়ে প্রতিরোধ না করে দর্শকের ভূমিকা পালন করে নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্যকে ধর্ষণ করছে। ধর্ষণের মহামারীতে ভূমিদস্যুদের দ্বারা ধর্ষিত হচ্ছে দেশের পরিবেশ, ধর্ষিত হচ্ছে তিন ফসলি জমি, ধর্ষিত হচ্ছে পুকুর, জলাশয়, নদী-নালা, খাল-বিল প্রভৃতি। স্থানীয় চেয়ারম্যানরা শুধু দালালিই করছে না, বরং বালু ভরাটের কাজও তাদের তদারকিতে হচ্ছে।

ব্রিটিশ যখন ভারতে আগমন করে তখন এই উপমহাদেশে প্রথমে একটি দালাল শ্রেণী তৈরি করে। তার পর দালালদের মাধ্যমে ব্রিটিশরা ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য দখল করে, পরবর্তীতে দালালদের ওপর নির্ভর করে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজদৌল্লাকে পরাজিত করে ভারতের সিংহাসন দখল করে। ঠিক অনুরূপ ভূমিদস্যুরা রূপগঞ্জে প্রথমে দালাল শ্রেণী সৃষ্টি করেছে। দালাল হিসেবে ভূমিদস্যুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান/প্রাক্তন চেয়ারম্যান/মেম্বর ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কালেকশন করে তাদের ভূমিদস্যুতার কর্মকাণ্ডে অংশীদার বানিয়ে কোথাও প্রলোভন, কোথাও জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন করে জোর জবরদস্তি ড্রেজার লাগিয়ে বালু ভরাট করে ফেলছে। রূপগঞ্জবাসী ভূমিদস্যুদের প্রতিহত করে নিজেদের ভিটে বাড়ি বা জমিজমা রক্ষা করার জন্য রক্ত দিয়েছে, কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের সমর্থন পায় নেই বলে রূপগঞ্জের সন্তানদের রক্তে রূপগঞ্জের মাটি রঞ্জিত হয়েছে বটে, কিন্তু কোথাও কোথাও পৈতৃক ভিটেমাটি হারিয়ে রূপগঞ্জবাসী এখন রোহিঙ্গাদের মতো উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে।

পৈতৃক ভিটেমাটি রক্ষার দাবিতে ১৯৯৪ সালের ১১ নভেম্বর রূপগঞ্জের জনগণ মিছিল করলে গোবিন্দপুর নিবাসী ইউসুফ আলীর ছেলে সিরাজুল ইসলাম দড়ি গুতিয়াব বাজারে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়, ধামচি গ্রামের বুধাইয়ের ছেলে হামেদ আলী পুলিশের গুলিতে দুই পা হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে। এ ছাড়াও ২৩-১০-২০১০ তারিখে ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কায়েতপাড়া ইউনিয়নের জনগণ মিছিল করলে হরিনা নদীর পাড় গ্রামের মো: আ: রফিকের ছেলে মো: জামাল হোসেন পুলিশের গুলিতে ঘটনাস্থলেই নিহত হয়, মিছিলকারীদের অনেকেই গুরুতর আহত হয়েছিল। ওই ঘটনায় নিহত পরিবার বিচার বা আর্থিক ক্ষতিপূরণ পাওয়া তো দূরের কথা সরকার থেকে তাদের জমি রক্ষার আশ্বাস পর্যন্ত দেয়া হয়নি।

অতিসম্প্রতি কায়েতপাড়া ইউনিয়নের বড়ালু পাড়াগাঁও, কেরানীগঞ্জ, ছাতিয়ান, মাঝিনা, কামশাইর, কায়েতপাড়া, উলাব মৌজাগুলোয় ভূমিদস্যুরা বালু দিয়ে তিন ফসলি জমি, খাল-বিল ভরাট করার জন্য পাইপ স্থাপনের কাজ শুরু করার প্রতিবাদে গ্রামবাসী জেলা প্রশাসক, পরিবেশ অধিদফতরসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে আবেদন নিবেদন জানিয়েও কোনো প্রতিকার পাচ্ছে না। গ্রামবাসী মিছিল করলে ভূমিদস্যুদের মদদে পুলিশ তা ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ অবস্থায় এটাই কি ধরে নেবো যে, ভূমিদস্যুদের কাছে সংবিধান আজ অসহায়?

গ্রামগঞ্জে ধর্ষণের অনেক ঘটনা মিডিয়াতে প্রকাশিত হয় বলে জনগণের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। ফলে দেশবাসী পশু ধর্ষকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করার সুযোগ পাচ্ছে। কিন্তু রূপগঞ্জের তিন ফসলি জমিসহ পরিবেশ ধর্ষিত হওয়ার কাহিনী মিডিয়াতে আসে না, কারণ পরিবেশ ধর্ষকদের অনেকে নিজেরাই মিডিয়ার মালিক।

ভূমিহারা মানুষ এখন সত্যিই অসহায়।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement