২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রাষ্ট্র, নাগরিক ও আইনশৃঙ্খলা

-

‘রাষ্ট্র’ বলতে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাসকারী জনসমষ্টিকে বোঝায়। যেখানে একটি সংগঠিত সরকার থাকে এবং নাগরিকরা সে সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। রাষ্ট্রও জনগণের জানমালের নিরাপত্তাসহ সব ধরনের অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উড্রো উইলসন রাষ্ট্রের সংজ্ঞা দিয়ে বলেন, ‘কোনো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মধ্যে আইনের মাধ্যমে সংগঠিত জনসমূহকে রাষ্ট্র বলে’। সঙ্গত কারণেই নাগরিক যেমন রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করবে, তেমনিভাবে নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তাসহ সুশাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাই রাষ্ট্রের সাথে নাগরিকের সম্পর্ক খুবই নিবিড় কিন্তু শর্তহীন নয়, বরং পারিস্পরিক স্বার্থের বৃত্তে আবদ্ধ।

রাষ্ট্র নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারছে কি না সে প্রশ্ন অন্তত আমাদের দেশে নতুন নয়। সাম্প্রতিক সময়ে সে প্রশ্নটা আরো জোরালো ভিত্তি পেয়েছে। কারণ দেশে আইনের শাসনের পারদটা বেশ নিম্নমুখী। তাই দেশে অপরাধ ও অপরাধপ্রবণতা এখন লাগামহীন। সুশাসনের অনুপস্থিতিই আমাদের এই অধঃপতনের জন্য মূলত দায়ী। এমনিতেই রাষ্ট্রের এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে দুর্নীতি, অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, লুটপাট, আত্মপ্রীতি ও স্বজনপ্রীতিমুক্ত রয়েছে। একই সাথে অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়েছে নানাবিধ অপরাধপ্রবণতাও। নারী নির্যাতন ও নারীর প্রতি সহিংসতাও বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। সম্প্রতি সিলেটের এমসি কলেজের হোস্টেলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী নিগ্রহের যেসব ঘটনা ঘটছে, তা স্মর্তব্য। নারীসমাজ এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। রাষ্ট্রযন্ত্র নারীদের যথাযথ নিরাপত্তা দিতে পারছে না। আর যতই দিন যাচ্ছে পরিস্থিতির ততই অবনতি ঘটছে।

দেশে যে নারী নির্যাতনের ঘটনা অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে তার প্রমাণ মেলে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান থেকে। সংগঠনটি সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৭৫ জন নারী। এ ছাড়া ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৩ জন এবং আত্মহত্যা করেছেন ১২ নারী।

এখানেই শেষ নয়। গত ৯ মাসে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৬১ নারী। এদের মধ্যে ১২ নারী আত্মহত্যা করেছেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিন নারী এবং ৯ পুরুষ নিহত হওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এ সময় দেশে যৌন হয়রানি ও নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ ও হত্যা, পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতন, এসিড নিক্ষেপসহ নারী নির্যাতনের অনেক ঘটনা ঘটেছে; যা রীতিমতো উদ্বেগের।

আসক জানিয়েছে, গত ৯ মাসে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৩২ নারী। এর মধ্যে হত্যার শিকার হন ২৭৯ নারী এবং পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৭৪ নারী। যৌতুকের কারণে শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৬৬ জনকে এবং নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ১৭ জন নারী। এ ছাড়া এসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ২১ নারী। গত ৯ মাসের শিশু নির্যাতন ও হত্যার পরিসংখ্যানও খুবই ভয়াবহ। এ সময়ে এক হাজার ৭৮ শিশু শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। হত্যার শিকার হয়েছে ৪৪৫ শিশু। এ ছাড়া ৬২৭ শিশু ধর্ষণ ও ২০টি বলাৎকারের ঘটনা ঘটেছে; যা আমাদের ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ব্যর্থ এমন অভিযোগ রয়েছে। একশ্রেণীর সদস্যের কারণে গোটা বাহিনীই এখন ইমেজ সঙ্কটে পড়েছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, গত ৯ মাসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে এবং তথাকথিত ‘ক্রসফায়ারে’ মোট ২১৬ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সাথে কথিত এনকাউন্টারে নিহত হন ১৮৫ জন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মারা গেছেন ২৭ জন। গত ৯ মাসে দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোয় প্রকাশিত খবরের পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ ও গুমের শিকার হন চারজন। এর মধ্যে পরবর্তী সময়ে তিনজনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনাও আগের চেয়ে অনেকটাই বেড়েছে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর বাগেরহাটে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হেফাজতে রাজা ফকির নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেছে। ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকার পল্টন থানা হেফাজতে মাসুদ রানা নামে এক যুবক মারা যায়। একই দিন রংপুরের গঙ্গাচড়া থানা হেফাজতে নির্যাতনের কারণে এক যুবকের মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। গত ১২ অক্টোবর চাঁদা না পেয়ে সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে রায়হান নামে এক যুবককে পিটিয়ে মেরে ফেলার অভিযোগে মামলা করেছেন তার স্ত্রী। এ ছাড়া মতপ্রকাশের অধিকার সঙ্কুচিত করাসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাত্রাতিরিক্ত অপব্যবহার, সাংবাদিক নিগ্রহ ও হয়রানি, সীমান্তে নির্যাতন ও হত্যার মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানা ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। এ বছরের মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সময়কালে নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা লাভের অধিকার লঙ্ঘনের পাশাপাশি চিকিৎসা অবহেলা, স্বাস্থ্য খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, সমন্বয়হীনতা, নজরদারি ও জবাবদিহিতার অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে বলে জানিয়েছে ‘আসক’। কিন্তু এসব অপরাধ প্রতিবিধানে রাষ্ট্র তেমন সাফল্যের পরিচয় দিতে পারেনি। ফলে সারা দেশেই অপরাধপ্রবণতার বিস্তৃতি ঘটছে আশঙ্কাজনকভাবে। আর এ অবস্থা থেকে উত্তরণের আশু কোনো সম্ভবনা দেখা যাচ্ছে না।

দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন অতীতের সব সময়ের চেয়ে খারাপ পর্যায়ে। সঙ্গতকারণেই ক্রমবর্ধমান ধর্ষণ ও নারী নিগ্রহের ঘটনায় জনমনে যেমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে; ঠিক তেমনিভাবে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজিও মহামারীর রূপ নিয়েছে। সম্প্রতি যশোরে টহল পুলিশের সামনে প্রকাশ্যে বোমা ফাটিয়ে ও ছুরিকাহত করে ১৭ লাখ টাকা ছিনতাই হয়েছে। অপরাধীরা যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তা এসব ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়। এখনকি খোদ রাজধানীতেও বেড়েছে অপরাধপ্রবণতা। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, অপহরণ, চাঁদাবাজি ও মাদক চোরাচালানসহ সব অপরাধই সংঘটিত হচ্ছে ঢাকা নগরীতে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এর কোন কূলকিনারা করতে পারছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যদের বিরুদ্ধে অপরাধীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার অভিযোগও রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, রাজধানীর অনেক এলাকা থেকে কিশোর অপরাধীদের সম্পর্কে ভয়াবহ তথ্য মিলেছে। কোথাও কোথাও প্রকাশ্যে মাদক সেবন চলছে। কোনো কোনো এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই সহিংস ঘটনা ঘটছে।

রাজধানীতে কিশোর অপরাধীর সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গেছে, রাজধানীর মুগদা থানার মানিকনগর একটি গলি এখন কিশোর অপরাধীদের অভয়ারণ্য। অনেক সময় পুলিশের টহলগাড়ি অথবা মোটরসাইকেলের পাশে বসেই মাদক সেবন করতে দেখা যায় বলে স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন। প্রকাশ্যেই রাজধানীর অনেক এলাকায় জুয়া খেলতে দেখা যায় শিশু-কিশোরদের। ভুক্তভোগীরা বলছেন, উঠতি বয়সী মাস্তানদের আনাগোনায় সবসময় ভয়ের মধ্যে থাকতে হয়। কিশোর অপরাধীরাও এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এসব অপরাধীর সাথে একশ্রেণীর অসাধু পুলিশ সদস্যের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে জোরালো অভিযোগ রয়েছে। ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, এরা প্রতিনিয়তই পথচারীদের কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নেয়। কেউ প্রতিবাদ করলে তাকেই ছিনতাইকারী সাজিয়ে হয়রানি করে পুলিশ। সম্প্রতি রাজধানীর ডেমরা এলাকার এক কলেজছাত্রকে এভাবে ফাঁসানোর চেষ্টা করে পুলিশ সদস্য; যা পরবর্তীতে প্রকাশ পেয়ে গেছে। আর এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।

ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরাও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। রাজধানীর পল্টন এলাকায় অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিফতরের ঢাকা বিভাগের গোয়েন্দা শাখার হেলাল উদ্দিন।

সম্প্রতি সিলেটের এমসি কলেজের নারী নিগ্রহের নারকীয় ঘটনা অতীতের সব বর্বরতা ও নির্মমতাকে হার মানিয়েছে। তা শুধু দেশেই নয়, বহির্বিশে^ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। এত বড় ঘটনার পরও সারা দেশে ধর্ষণ চলছে অবলীলায়। এমনকি এর মধ্যেই সিলেটে আবারো নতুন করে ১৩ বছরের কিশোরী নিগ্রহের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে বিবস্ত্র করে নারী নির্যাতনের ঘটনার ঘটনা ঘটেছে; যা জনগণকে বিক্ষুব্ধ ও আতঙ্কিত করে তুলেছে। একের পর এক ধর্ষণের ঘটনায় নারী সমাজ ও অভিভাবকরা খুবই শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। ফলে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হওয়া মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কারণ নাগরিকরা রাষ্ট্রের সেবা পাওয়ার বিপরীতেই রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। আর এই আনুগত্য কখনোই নিঃশর্ত নয়। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের উদাসীনতা বা ব্যর্থতা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত ও গ্রহণযোগ্য নয়।

মূলত গণমানুষের কল্যাণকামিতার ধারণা থেকেই আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। তাই অপরাধপ্রবণতা নিয়ন্ত্রণসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রেখে জনগণের সব সমস্যার সমাধানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। ম্যাক্স ওয়েবারের সংজ্ঞানুযায়ী রাষ্ট্র হচ্ছে এমন এক সংগঠন, যা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে আইনানুগ বলপ্রয়োগের সব মাধ্যমের ওপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রাখে, যাদের মধ্যে রয়েছে সশস্ত্রবাহিনী, নাগরিক, সমাজ, আমলাতন্ত্র, আদালত ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাই এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রয়োজনে জনমনে স্বস্তি ফিরে আনতে রাষ্ট্রযন্ত্রের সব কিছুকেই একযোগে ব্যবহার করতে হবে। কোনো অজুহাতেই রাষ্ট্র এ দায় এড়াতে পারে না। এ ক্ষেত্রে গণসচেতনতার বিষয়টিও উপেক্ষা করার মতো নয়। সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ যদি নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হয় তাহলে একটি স্বপ্নের সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব; অন্যথায় আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নগুলো অধরা থেকে যাবে।

smmjoy@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement