১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আরব লিগের চরম দুরবস্থা

-

আমিরাত-ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ নিয়ে আরব লিগের শক্তিধর সদস্য রাষ্ট্রগুলো আমিরাতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে বা বৈঠকে কোনো প্রস্তাব নেবে তেমনটি আরব বিশ্ব সম্পর্কে যারা জ্ঞান রাখেন তারা মনে করেন না। চুক্তিটি প্রত্যাখ্যান ও নিন্দা জানিয়ে ফিলিস্তিনিরা যে প্রস্তাব নিয়েছে, আরব লিগ সেটি বাতিল করার পর ধরে নিতে হবে সংস্থাটি ইন্তেকাল করেছে এবং দাফনের কাজও সম্পন্ন হয়েছে। ২০০২ সালে বৈরুত সম্মেলনে আরবরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তার সাথে কাজের কোনো মিল নেই, কৈফিয়ত নেয়ার মতোও কেউ নেই, প্রশ্ন তোলারও কেউ নেই। কেনই বা হবে? আরব লিগ পরিচালনা করে আমিরাত ও সৌদি আরব। ইসরাইল প্রীতিতে কেউ কম যায় না।

একসময় আরব বিশ্বের চাপে ইসরাইল-যুক্তরাষ্ট্র টু-স্টেটের বিপক্ষে অবস্থান নিতে পারেনি। এখন ইসরাইল এই বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করছে না। এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে নয়া দিগন্তে আমার লেখা ‘টু স্টেটস, ওয়ান স্টেট, নো স্টেট’ নিবন্ধে। কয়েক মাস আগে নেতানিয়াহু বলেছেন, “মধ্যপ্রাচ্যে বড় একটা কিছু ঘটবে। আরব বিশ্বের মনমস্তিষ্কে পরিবর্তন আসছে। ‘জিহাদি ইসলামের’ বিরুদ্ধে আমরা জোট করতে পারছি।”

দেড় হাজার বছর আগে আরব লোকদের মনমস্তিষ্ক পরিবর্তিত হয়েছিল ইসলামের আগমনের কারণে। এখন কি তার পরিবর্তন হচ্ছে? কিন্তু অনেক আরব শেখ এই পরিবর্তন চান না, যেখানে মুসলমানের পরিবর্তে ইহুদি অকৃত্রিম বন্ধু হবে। এটি নিয়ে ইসরাইলও শঙ্কিত। এ জন্য ইসরাইলের পৃথক কর্মসূচি রয়েছে। জেরুসালেমের ব্যাপারে তো সবাই হাত-পা ছেড়ে দিয়েছেন। শুধু এরদোগান বলেছেন, ‘জেরুসালেম আমার বাড়ি। আমি তাকে কিভাবে ভুলব?’

কিভাবে আরব শান্তি প্রচেষ্টা ভেস্তে গিয়ে রাজ-জামাতা ইহুদি কুশনারের হাতে পড়ল এসব তো অল্প ক’দিন আগের কথা। আরব লিগের কাছে ইসরাইল এখন শত্রু নয়। এটি ফিলিস্তিনি আরবরা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরে আরব লিগের সভাপতির পদ গ্রহণ করতে চায়নি। মিসর যখন আরব লিগ চালিয়েছিল তখন জামাল আবদুল নাসেরও ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে এরকম মনে করতেন না। যখনই কোনো বিরোধী কার্যক্রম নিতে চেয়েছে তখন ইসরাইলের সাথে পেরে ওঠেনি। তার পরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত সুয়েজ যুদ্ধ করেও ইসরাইলি আমন্ত্রণ নিয়ে সংসদে ভাষণ দিয়েছিলেন। আমিরাত-অক্ষ আরবদের কমন শত্রু ইসরাইলকে বন্ধু বানিয়েছে। সম্পর্কের কম্পাস-কাঁটা উল্টে গেছে। এখন এটাই বাস্তবতা।

এখন তুরস্কই কমন শত্রুতে পরিণত হয়েছে তুর্কি পণ্য বর্জনের ডাক দেয়া হয়েছে। তুরস্কের বিরুদ্ধে সবখানে অবস্থান নেয়া হচ্ছে। লিবিয়ায়, ভূমধ্যসাগরে, ব্ল্যাক সি-তে, সিরিয়ায়, পিকেকে ইস্যুতে, ইরান ইস্যুতে, ফেটো আন্দোলনে, রোহিঙ্গা ইস্যুতে, কাশ্মির ইস্যুতে, কুয়ালালামপুর জোট ও সম্প্রতি আজারবাইজানে, এসব এক লম্বা তালিকা।

এখন তুরস্ককে আরবদের নিরাপত্তার শত্রু হিসেবে বিবেচনার জন্য আরব রাষ্ট্রগুলোতে মতবিনিময় হচ্ছে। আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনোয়ার গারগাশ বলেছেন, ‘তুরস্ক আরব দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে।’ মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও একই ধরনের কথা বলেছেন। তিনি জানান, ‘তুরস্কের আকাশছোঁয়া উচ্চাকাক্সক্ষার কারণে মিসর চুপচাপ বসে থাকবে না।’ এ ধরনের কথাবার্তা একটি দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার মতো। তুরস্ক স্বাধীনচেতা, রয়েছে শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও অস্ত্রভাণ্ডার। অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে প্রচণ্ড পরিশ্রম করছে। পক্ষান্তরে আরব দেশগুলোর নিয়ন্ত্রক পশ্চিমারা, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, কানাডা। ইটালি ও রাশিয়ার কোম্পানিগুলো সব তেল কূপ পরিচালনা করছে। আরামকো সৌদি আরবের হলেও বোর্ড অব ডাইরেকটরের মধ্যে রয়েছে চারটি বিদেশী মেগা প্রতিষ্ঠান।

অনেক আরব মুসলমান মুসলিম উম্মাহর পুনরুত্থানের জন্য এরদোগানের দূরদর্শিতা ও কাজের প্রশংসা করেছেন। এটি আরব বিশ্বের মাথাব্যথার কারণ। ইহুদি লবি এই মুসলিম উম্মাহর জাগরণকে নাম দিয়েছে, ‘নব্য মুসলিম সাম্রাজ্যবাদ’। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রঁ কারাবাখ যুদ্ধ বন্ধ করতে গিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের চেতনাকে এভাবেই ব্যাখ্যা দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছেন। ব্রিটেন, ফ্রান্স একসময় আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে কলোনি বানিয়ে সেখানকার সম্পদ চুষে নিয়ে নিজের দেশকে সাজিয়েছে। সেটি আর হচ্ছে না বিধায় সাম্রাজ্যবাদীরাই শোষিতদের নব্য সাম্রাজ্যবাদী বলে তৃপ্তি পেতে চাইছে।

আসলে আরব লিগ অনেক বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। এটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতে চায় না। কুয়েতও লিগের সভাপতি হতে অপারগতা জানিয়েছে। এবার ফিলিস্তিনের পরিবর্তে আরব লিগের পর্যায়ক্রমিক সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে লিবিয়া। এর আগে কাতার এবং কুয়েতও এই পদ প্রত্যাখ্যান করেছে। একটি শক্তিশালী সংস্থা কতটুকু অথর্ব হয়েছে এসব তারই নমুনা। মনে হচ্ছে আরব লিগ ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’। সাদ্দাম হোসেন যখন কুয়েত আক্রমণ করেছিল তখন জর্জ বুশ আরব রাষ্ট্রগুলোকে ডাকেন। রাতারাতি সব আরব নেতা হোয়াইট হাউজে জড়ো হয়েছিল। কিন্তু ইসরাইল যখন ১৯৮২ সালে এবং ২০০৬ সালে লেবানন আক্রমণ করল, আর যখন গাজায় অহরহ বোমা হামলা করা হচ্ছে, তখন আরব দেশগুলো কোথাও জড়ো হয়েছে? গত সপ্তাহে পূর্ব জেরুসালেমে ইসরাইলি বাহিনী ফিলিস্তিনির ঘর ভেঙে দিয়ে খরচস্বরূপ ৩০ হাজার ডলার দাবি করেছে! অবস্থা দেখে মনে হয় আরবদের গুলি করে মারলে এখন থেকে গুলির খরচও উসুল করা হবে। মুসলমানদের কোনো ঘরবাড়ি বানাতে পারমিট লাগছে। কিন্তু সে পারমিটতো আর পাওয়া যায় না। জেরুসালেমকে ইহুদিকরণ, আল আকসা মসজিদের নিচে টানেল তৈরি করা এসব নিয়ে আরব লিগের কোনো বক্তব্য নেই।

আরব লিগ ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত ইরাক যুদ্ধ প্রতিরোধ করতে পারেনি, এমনকি যুদ্ধকে চ্যালেঞ্জও জানাতে পারেনি। তাদের চোখের সামনে ইরাক আস্তে আস্তে শেষ হয়ে গেল। আরব লিগ সুদানেও কোনো কাজ করতে পারেনি। সুদানি সমস্যায় কোনো প্রকার সহায়তা দিতে পারেনি। আজ সেই সুদান ইসরাইলি সহায়তা নিচ্ছে এবং রাষ্ট্রধর্ম থেকে ইসলাম বাদ দিয়েছে। আরব রাষ্ট্রগুলোকেই তো এর ফলাফল ভোগ করতে হবে। এসব করুণ ইতিহাস আরো আরব রাষ্ট্রগুলোকে গ্রাস করে নিঃশেষ করার উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। আরব লিগের সদস্য দেশগুলোতে সমস্যার তালিকা অতি দীর্ঘ। ইয়েমেনে যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষের মহামারীতে অসহায় আরবদের মৃত্যুর জন্য সৌদি আরব ও আমিরাত কি দায়ী নয়?

এখন ইয়েমেনের সক্রোট্রা দ্বীপ দখল করে ইসরাইলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে সামরিক ঘাঁটি ও গোয়েন্দা নগর বানানোর জন্য। কাতারের অবরোধ এখনো শেষ হয়নি। দুই দেশের আত্মীয়স্বজনরাও বহুদিন ধরে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারছে না।
ইতিহাস আলোচনা করে দেখা যায়, আরবদের ইস্যুগুলো আরব লিগের হাতে সুরাহা হয়নি বরং জটিল আকার ধারণ করেছে এর জ্বলন্ত উদাহরণ ইয়েমেন ক্রাইসিস। তাই এখন মুসলমানদের শত্রু মুসলমান, বন্ধু হয়েছে ইহুদি, জিওনবাদী গোষ্ঠী ও পশ্চিমারা, আরবদের ঘরে ঘরে যেন কামাল আতাতুর্ক! আরব লিগ কখনো আরব জনগণের ছিল না এটি আরব শাসকদের উদ্দেশ্য পূরণের কাজই করেছে।

ব্যালফোর ঘোষণা ইসরাইলি রাষ্ট্র কায়েমে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে আর ইডেন আরবদের মুসলিম পরিচয় থেকে দূরে নিতে সহায়তা করেছে যাতে মুসলিম উম্মাহ সৃষ্টি হতে না পারে। শুধু আরবরা নয়, মুসলিম বিশ্বের সবাই জানে ইসরাইল সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী। পশ্চিমারা মধ্যপ্রাচ্যে কী চায় এবং কী করণীয়। জেরুসালেমকে ঘিরে আরেকটি ক্রুসেডের কাজ চলছে। কারা কোন শিবিরে যাবে তার কাজও অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে। আরব বিশ্ব এখন দর্শকের ভূমিকায়, তারা শান্তি চায়। ক্রুসেডের নায়করা শান্তির জন্য যুদ্ধ চায়। দিনে দিনে ব্রিটেন বিভেদ ও ধ্বংসের যে বীজ বুনেছে তার ফসল আরবদের ঘরে তুলতে হবে। এমন একটি সময়ে কয়েকটি দেশ ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করল যখন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন। যাতে ইভানজালিকেল ইহুদিদের ভোট ফস্কে না যায়। ব্রিটিশ ও আমেরিকানরা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে কাজ করে, সেসব উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলে বাসি খাবারের মতো এরা পরিত্যক্ত হবে।

কোনো শর্ত বা পূর্ব চুক্তিতে না গিয়েই, ফিলিস্তিনিদের কোনো স্বার্থ রক্ষার ঘোষণা না দিয়েই ইসরাইল আরব দেশগুলোর সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করল। ২০১৮ সালে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে রেকর্ড সংখ্যক ইহুদি বসত নির্মাণ করা হয়। পশ্চিম তীরে বসত পাঁচ লাখে পৌঁছে। ১৯৬৭ সালের পর এটাই সর্বোচ্চ রেকর্ড। তখনই সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়া দ্রুতগতি পেতে থাকে। ফাতাহ কেন্দ্রীয় কমিটির সেক্রেটারি জেনারেল জিবরিল আল-রাজুব, আল খালিজ পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে জানান, ‘আরব আমিরাত ২০১০ সাল থেকে ফিলিস্তিনিদের এড়িয়ে চলছে। কোনো সরকারি সভায়ও কোনো প্রতিনিধিকে ডাকা হয় না। আরব লিগ ফিলিস্তিনিদের অর্থ প্রদান থেকেও দীর্ঘদিন বিরত। তিনি অভিযোগ করেন যে, কুশনার আরব দেশগুলো সফর করে এই বার্তাই দিয়েছে।

আরব লিগ আঞ্চলিক দুটি বড় সংগঠনের মুখোমুখি। জিসিসি বা গাল্ফ কো-অপারেশন কাউন্সিল এবং মাগরিব ইউনিয়ন। অনেকে মনে করেন, এই দুটির কারণেও লিগের কার্যকারিতা শূন্যের দিকে ধাবিত হতে থাকে। সদস্য দেশের মতানৈক্যের কারণে মাগরিব ইউনিয়ন কোনো কাজ করতে পারেনি তবে ভিন্ন মতামত সত্ত্বেও জিসিসি এখনো কাজ করছে। যদিও জিসিসিতেও প্রচণ্ড মতবিরোধ রয়েছে। এখন দেশগুলো দুটি শিবিরে বিভক্ত। একটি দলে রয়েছে সৌদি আরব, আমিরাত ও বাহরাইন। অপর দলে কাতার, ওমান ও কুয়েত।

জিসিসির স্বাস্থ্যও যেকোনো সময় আরব লিগের মতো ভেঙে পড়তে পারে। এসব প্রমাণ করে যে, আরবরা মিলেমিশে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় আরব বিশ্বের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বলা হচ্ছে, ধর্মীয় বলয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ফলস্বরূপ এই পরিণতি। সাইক পিকট মিথ, বাথ পার্টি, লরেন্স অব আরাবিয়া, ব্যালফোর ঘোষণা, ইহুদিদের আরববিরোধী জিওনবাদী চক্রান্ত, সুন্নি খেলাফত বনাম শিয়া খেলাফত, অতি সম্প্রতি আরব মহিলাদের স্বাধীন করে দেয়া এবং হালাল নাইট ক্লাব চালু এসব এক দিনে হয়নি। শত বছরের সাধনা। ঘুরে দাঁড়াতে হলে আরো ১০০ বছর দরকার। অত সময় আরব বিশ্ব বা প্রকারান্তরে মুসলিম বিশ্ব পাবে না।

ওসমানী খেলাফত ধ্বংস হওয়ার পর ব্রিটেন ও ফ্রান্সের যোগসাজশে প্রচুর সম্পদের অধিকারী আরব রাষ্ট্রগুলোতে বিভেদের বীজ পুঁতে দেয়া হয়। অঙ্কুরিত চারাগাছ আস্তে আস্তে মহীরুহে পরিণত হয়েছে। অথচ আরব বিশ্ব ব্যস্ত অপ্রয়োজনীয় ইস্যুতে। তারা ভুলে যাচ্ছে তাদের চ্যালেঞ্জ কী, করণীয়ই বা কী।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement