২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাষ্ট্র বনাম ক্রাইম অ্যান্ড ভিকটিম

রাষ্ট্র বনাম ক্রাইম অ্যান্ড ভিকটিম - ছবি : নয়া দিগন্ত

১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত এবং একই বছরের ১৬ ডিসেম্বর কার্যকর হওয়া বাংলাদেশের সংবিধান মোতাবেক মূলত তিনটি বিভাগ আইন, নির্বাহী ও বিচার বিভাগের সমন্বয়ে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো গঠিত। সংবিধানের তৃতীয় ভাগে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার (অনুচ্ছেদ ২৬ থেকে ৪৭ক), চতুর্থ ভাগে নির্বাহী বিভাগ (অনুচ্ছেদ ৪৮ থেকে ৬৪), পঞ্চম ভাগে জাতীয় সংসদ, আইন প্রণয়ন ও অর্থসংক্রান্ত পদ্ধতি, অধ্যাদেশ প্রণয়ন ক্ষমতা (অনুচ্ছেদ ৬৫ থেকে ৯৩) এবং ষষ্ঠ ভাগে বিচার বিভাগ, অধস্তন আদালত এবং প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালগুলো (অনুচ্ছেদ ৯৪-১১৭) লিপিবদ্ধ রয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় সব অবকাঠামো অর্থাৎ পরিচালনা শক্তি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিয়োগকৃত ও দায়বদ্ধ থাকবে। সংবিধান মোতাবেক আপিল ও হাইকোর্ট সমন্বয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট গঠিত এবং প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারপতিরা বিচারিক কার্য পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকবেন।

সম্প্রতি গণধর্ষণ, পাবলিক প্রকিউরমেন্টে অর্থাৎ সরকারি কেনাকাটায় চুরি, সরকারি টেন্ডারের দখলদারিত্ব এবং আমলাতন্ত্রের ক্ষমতা অপব্যবহারের মহোৎসব বিগত সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। মাদক ও কিশোর গ্যাংসহ অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়ে বিশিষ্ট অভিজ্ঞজনরা বিভিন্ন প্রশ্ন উপস্থাপনের পাশাপাশি, বিচারে দীর্ঘসূত্রতার দিকে আঙুল তুলেছেন। যথা শিগগিরই বিচার হওয়া যেমন জরুরি, ঠিক তেমনি মামলার জট কেন সৃষ্টি হচ্ছে তাও পর্যালোচনা করা দরকার এবং এটাও আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়া দরকার যে, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলতে পারছে না। অন্য দিকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইন ও আইন প্রয়োগকারীদের দ্বারাও মানুষ ভিকটিম হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতির চেয়ে বেশি শাস্তি বা ক্ষতিপূরণ আদায় করে আসামি বা অভিযুক্তকে ভিকটিম করা হচ্ছে। যার যা প্রাপ্য তাকে তার চেয়ে বেশি শাস্তি দিলে সেখানে আসামি ভিকটিম হয়, অন্য দিকে প্রাপ্যের কম শাস্তি দিলেও ‘ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি’ আইন ও বিচার দিয়ে ভিকটিম হয়। উভয় দিক বিবেচনায় ‘আইন’কে হতে হবে গণমুখী এবং বিচার বিভাগকে হতে হবে বিবেকের প্রশ্নে স্বাধীন ও উন্মুক্ত; যাকে বলা যাবে, Court for Public Interst.

রাষ্ট্র গঠন ও আইন প্রণয়ন পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। তবে রাষ্ট্রের জন্মের পর জন্ম হয় আইনের। রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার আগে ‘প্রতিশোধ’ই ছিল বিচারব্যবস্থার মাপকাঠি। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকেই নিজের হাতে নিতে হতো বিচারের দায়িত্বভার। নাকের বদলে নাক, চক্ষুর বদলে চক্ষু, রক্তের বদলে রক্ত প্রভৃতি ছিল তখন বিচারব্যবস্থার পদ্ধতি। রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর রাষ্ট্রের যিনি ‘মালিক মোক্তার’ অর্থাৎ রাজা, বাদশাহ; তাদের ইচ্ছাটাই ছিল আইন, যা চ্যালেঞ্জ করার এখতিয়ার কারো ছিল না। আজকের যে বিচারব্যবস্থা কাজে যা-ই হোক, তাকে নামে বলা হয় ‘স্বাধীন বিচারব্যবস্থা’; বিচারব্যবস্থাকে স্বাধীন রাখার জন্য আইনবিশারদ, বিচারক, বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাশীল ব্যক্তিদের আন্দোলন-সংগ্রামের অনেক অবদান রয়েছে। কিন্তু বিবেকের দিক থেকে অনেক বিচারক ‘স্বাধীন’ কি না- এ প্রশ্ন বারবার উঁকি মারে, বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে।

সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণা, প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিটি মানুষের জীবন বেড়ে ওঠে। যেমন- পরিবার, শিক্ষালয়, ধর্মীয় অনুশাসন, সামাজিক বিধিনিষেধ, দায়িত্ব ও কর্তব্যের বেড়াজাল এবং রাষ্ট্র। ‘রাষ্ট্র’ নিজেও একটি প্রতিষ্ঠান, যা সংশ্লিষ্ট ভূখণ্ডের সর্বময় কর্মকাণ্ডের অধিকারী। এ কারণেই সামাজিকতার জন্য মানুষকে এক দিকে ‘সামাজিক জীব’, অন্য দিকে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডসংবলিত একটি রাষ্ট্রের ‘নাগরিক’ বলা হয়। এ দুটো কারণেই একজন মানুষের অনেক দায়বদ্ধতা থাকে। ওই দায়বদ্ধতাকে পদদলিত করে যদি কেউ নিজ স্বার্থচরিতার্থ করার জন্য নিজ ইচ্ছামতো চলে সেখানেই সৃষ্টি হয় ক্রাইম ও ভিকটিম। রাষ্ট্র, ক্রাইম (অপরাধ) ও ভিকটিম (ক্ষতিগ্রস্ত) পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে, রাষ্ট্র নিজেও ক্রাইমকে (অপরাধ) জেনারেট করে, অর্থাৎ অপরাধ সংঘটনে উদ্বুদ্ধ করে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো যখন ভারসাম্যহীন হয় তখনই অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়।

রাষ্ট্র অনেক ক্ষেত্রে ‘ডবল স্টান্ডার্ড রুল’ অনুসরণ করে। রাষ্ট্রকে যারা পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ করেন; ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য সেই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রকদের প্রায়ই আপস করতে হয়। রাষ্ট্রের কর্ণধাররা প্রায়ই বলে থাকেন যে, অপরাধ করলে কাউকে ‘ছাড়’ দেয়া হবে না। কিন্তু এসব উক্তি বাস্তবতার পরিপন্থী, লোকদেখানো মুখরোচক বক্তব্য। রাষ্ট্র অপরাধীর সাথে বিভিন্ন কারণে আপস করে বিধায়ই অপরাধের প্রবণতা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায়। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, সমাজে বঞ্চনা-গঞ্জনার মধ্যেই অপরাধের বীজ লুকায়িত থাকে। সমাজে বঞ্চিতের সংখ্যা অনেক বেশি। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে বঞ্চিতরা বঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি মেনে নিয়েছে। কিন্তু বর্তমান আধুনিক বিশ্বে উচ্চ শ্রেণী বা ধনিক শ্রেণীর মধ্যেই অপরাধী ও অপরাধের সংখ্যা অনেক বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে, যার ভিকটিম সমাজের বঞ্চিত মানুষগুলো। যার যার পাওনা তাকে বুঝিয়ে দিলেই সঙ্কটের সৃষ্টি হয় না। অনেক ক্ষেত্রে ‘সঙ্কটকে’ পুঁজি করে ‘ক্রাইসিস ক্যাপিটাল ইনভেস্ট’ করা হয়। সঙ্কটটিই কোনো কোনো ক্ষেত্রে মূলধন হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং এটিই জনগণের জন্য ট্র্যাজিডি।

১. জন্মগত অপরাধী এবং ২. পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে অপরাধী এক হতে পারে না। অপরাধীকে শাস্তি দিলেই অপরাধ বন্ধ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। অপরাধের বিপরীতে শাস্তি অনেক দেয়া হচ্ছে। কিন্তু অপরাধের প্রসার বৃদ্ধি রোধ হচ্ছে না। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, ‘শাস্তি দেয়া সহজ, কিন্তু সংশোধন করা সহজ নয়’। নৈতিকতা বোধ ও জীবনের মূল্যায়ন সম্পর্কে গণমানুষকে সচেতন করতে না পারলে অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনা কোনো মতেই সম্ভব নয়।

আধুনিক চলচ্চিত্র, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়া বিজ্ঞানের উন্নয়নের একটি ধাপ হলেও নৈতিকতা ও জীবন মূল্যায়নের প্রশ্নের বিপরীতধর্মী শিক্ষা দিচ্ছে, যার প্রতিফলন ঘটছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এবং এর পরিধি এতই বিস্তার লাভ করছে যে, দেশের চিন্তাশীল মানুষেরা এর প্রতিকারের দরজা খুঁজে পাচ্ছেন না।

সমাজ ও সামাজিক নিরাপত্তা এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। পত্রিকা খুললেই মনে হয়, দেশে যেন যৌনতার উৎসব চলছে। ধর্ষণের আগ্রাসন থেকে কেউই যেন মুক্ত নয়। ধর্ষণ থেকে মুক্ত থাকার জন্য সবাই এখন চিন্তিত। এ অবস্থায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, কোন দেশে ধর্ষণ নেই? এটি কি তার আক্ষেপ, না নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকা দেয়ার জন্য সাফাই গেয়েছেন? সমাজের কিছু কিছু সমস্যা রয়েছে, যা সমাধানের জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে নিজেকে সফল ও প্রতিপক্ষকে দায়ী করলে ক্ষমতায় ডাঁটবাট দেখানো যাবে, কিন্তু সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া যাবে না।

অপরাধপ্রবণতাকে রোধ করার জন্য ১, অপরাধের উৎপত্তিস্থল এবং ২. অপরাধীর অপরাধমূলক আচরণকে চিহ্নিত করা, ৩. অপরাধকে প্রতিরোধ করার উদ্যোগ নেয়া আবশ্যক। পুরনো সেই কথা ‘Prevention is better then cure.’ এখন শিরোধার্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

ধর্মীয় উন্মাদনা ও ধর্মহীনতা উভয়ই সমাজের জন্য অকল্যাণকর। তবে ধর্মীয় অনুশাসন মানুষকে শিষ্টাচার ও নৈতিকতা শিক্ষা দেয় এবং একজন মানুষের নিজের কর্মকাণ্ডের প্রতি জবাবদিহি নিশ্চিত করে তোলে। যে ব্যক্তি নিজের কর্মের জন্য নিজের কাছে জবাবদিহি করতে পারে, তার পক্ষে অত্যাচার, নির্যাতন বা অযাচিতভাবে কারো ক্ষতি করা সম্ভব নয়। কিন্তু ধর্মীয় অনুশাসন থেকে মানুষকে সরিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছে ‘বকধর্মী’ বুদ্ধিজীবীরা, ধর্মীয় অনুশাসনকে তারা ব্যাকডেটেড মনে করেন এবং ধর্মীয় অনুশাসন মতে কেউ চলতে চাইলে তাকে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত কিছু বকধার্মিক নিজেদের কুৎসিত নোংরামির সাথে জড়িত করে ধর্মীয় অনুশাসনকে বিতর্কিত করলেও যে পরিবার ধর্মীয় অনুশাসনে চলে তারা সুখে শান্তিতে রয়েছে এবং দেশের মানুষ তাদের হাতে নিরাপদ। ফলে একজন শিশু-কিশোরকে জবাবদিহিমূলক মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট ‘পরিবার’ই বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যে শিশু বা কিশোর বুঝতে পারে বা মনে করে যে, তার পরিবারের কোনো সদস্য মাদকাসক্ত, তখন সে নিজেও মাদক ও অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ে, পরিবার শিশুকে তখন আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না এবং বড় হওয়ার পাশাপাশি সে বিপথে পা বাড়ায়।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন গ্রামগঞ্জ থেকে অলিগলি পর্যন্ত পৌঁছেছে। ক্ষমতাসীন কর্তৃক ক্ষমতাহীনদের নির্যাতন, তাদের ব্যবসায় বাণিজ্য জমি দখল করা নিয়েও দুর্বলরা প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে; সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় থাকে এবং সুযোগমতো আইনকে নিজের হাতে তুলে নেয়। আইনের যারা রক্ষক অর্থাৎ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরপেক্ষ পেশাদার ভূমিকার পরিবর্তে যখন ক্ষমতাসীনদের তোষণ করে তখনো ভুক্তভোগীদের মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে এবং সে আগুনের লেলিহান থেকেও সৃষ্টি হয় আইনশৃঙ্খলার অবনতি, যা দেশে বিদ্যমান।

ন্যায়বিচার ও মানুষের অধিকার নিশ্চিত করাই বিচার বিভাগের দায়িত্ব। অধিকন্তু রয়েছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানকে প্রটেকশন দেয়ার পাশাপাশি সংবিধানে প্রদত্ত ও নির্ধারিত মৌলিক অধিকার থেকে নাগরিকরা যাতে বঞ্চিত না হয়, তা নিশ্চিত করা। রাষ্ট্র সংবিধানের অধীন নিয়ন্ত্রিত একটি সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান। এ সংবিধানকে সমুন্নত রাখার জন্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, বিচারপতি, মন্ত্রী, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা- সবাই নিজ নিজ বিবেককে দায়বদ্ধ রেখে শপথবাক্য পাঠ করেছেন। তার পরও সংবিধান পদদলিত হচ্ছে, মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের জনগণ যারা সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ মোতাবেক বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের মালিক।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন):

taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement