২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

আইনের প্রয়োগ ও সিস্টেম লস

আইনের প্রয়োগ ও সিস্টেম লস - নয়া দিগন্ত

রিমান্ড একটি ইংরেজি শব্দ। বাংলা একাডেমির অভিধানে Re-mand শব্দের আভিধানিক অর্থে বলা হয়েছে, ‘আরো সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহের জন্য (অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদালত থেকে) পুলিশের হেফাজতে পাঠানো বা পুনঃ প্রেরণ করা বা তদন্ত চলাকালে কিংবা আদালত কর্তৃক সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে আইন ভঙ্গকারী শিশু ও কিশোরদের রাখার জন্য প্রতিষ্ঠান বা পুনঃ প্রেশন কেন্দ্র’ (পৃষ্ঠা ৬০৫)। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭(২) ধারায় প্রদত্ত বিধান বলে আদালত একজন অভিযুক্তকে আদালতের Custody থেকে পুলিশ Custody তে পাঠানোর আদেশ দিতে পারে। উক্ত আইনে বলা হয়েছে যে-
The Magistrate to whom an accused person is forwarded under this section may, whether he has or has not jurisdiction to try the case from time to time authorize the detention of the accused in such custody as such Magistrate thinks fit, for a term not exceeding fifteen days in the whole, If he has not jurisdiction to try the case or [send] it for trial and considers further detention unnecessary, he may order the accused to be forwarded to a Magistrate having such jurisdiction: [Provided that no Magistrate of the third class, and no Magistrate of the second class not specially empowered in this behalf by the [Government] shall authorized detention in the custody of the policeব.]

আদালতের Custody থেকে কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তিকে পুলিশের Custody তে পাঠাতে ওই আইনের বিধান বলে ম্যাজিস্ট্রেটকে নিম্নবর্ণিত তিনটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে।

১. সংশ্লিষ্ট আসামিকে গ্রেফতারপূর্বক আদালতে প্রেরণ (Forward) করা হয়েছে কি না?
২. আসামিকে ১৫ দিনের বেশি পুলিশ হেফাজতে প্রেরণ করা যাবে না।

৩. পুলিশের আবেদনের ওপর ভিত্তি করে নয়, বরং ম্যাজিস্ট্রেট যদি (as such Magistrate thinks fit) সার্বিক বিবেচনায় উপযুক্ত মনে করেন তবেই রিমান্ডের আদেশ দেবেন।
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৭(২) ধারায় ব্যাখ্যায় হাইকোর্ট নিম্নবর্ণিত মন্তব্য প্রদান করেন।

“The word ‘forward’ used in section 167 CrPC means ‘act of sending’. Unless the accused is sent to the Magistrate and the Magistrate passing the order of remand without the accused being forwarded to him, the legal requirement is not complied with for the Magistrate to assume jurisdiction to pass the order of remand. The accused must be brought before the Magistrate prior to passing of and order of remand, no matter whether the accused is in police lockup or judicial custody..” [সূত্র : ৪৫ ডিএলআর (হাইকোর্ট) পৃষ্ঠা-৫৯৩]

হাইকোর্টের ওই মন্তব্য মোতাবেক “act of sending” অর্থাৎ আসামিকে পুলিশ কর্তৃক প্রেরণ না করা হলে পুলিশ রিমান্ডে প্রেরণ করা যাবে না। অর্থাৎ কোন আসামি যদি আদালতে আত্মসমর্পণ করে তবে ওই আইনের বিধান মতে, পুলিশের প্রার্থনা মোতাবেক রিমান্ডে প্রেরণ করা যাবে না। কিন্তু এখন দেখা যায়, পুলিশি হয়রানি থেকে বাঁচার জন্য কোনো আসামি আদালতে ‘আত্মসমর্পণ’ করার পরও তাকে পুলিশের আবেদনক্রমে রিমান্ড মঞ্জুর করা হয়।

‘রিমান্ড’ বলতে জনসমাজে একটি আতঙ্ক রয়েছে। জনগণ মনে করে যে, স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য ‘রিমান্ড’ একটি বৈধ পদ্ধতি যা পুলিশের কাছে একটি ব্লাঙ্ক চেকের মতো। অত্যাচার নির্যাতনে রিমান্ডে আসামির মৃত্যুর ঘটনা অজানা নয়। পুুলিশ ‘রিমান্ড’কে একটি ক্ষমতা হিসেবে ব্যবহার করে বিধায় ‘রিমান্ড বাণিজ্য’ নামে একটি কথা ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন না করার জন্য বাণিজ্য, রিমান্ডে নির্যাতন করার জন্য প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বাণিজ্য, ক্ষমতাসীনদের রাজিখুশি রাখার জন্য বিরোধীদের নির্যাতন করার বাণিজ্য, কাঙ্ক্ষিত অর্থ পাওয়া না গেলে নির্যাতন প্রভৃতি মিলিয়ে মিডিয়ার ভাষা ‘রিমান্ড বাণিজ্য’ বেশ অর্থপূর্ণ বৈশিষ্ট্য লাভ করেছে।

অন্য দিকে ‘অপরাধ’ তৎপরতার ধরন, পরিধি ও এর ব্যাপকতা নিয়ে জাতি আজ চিন্তিত। সামাজিক অপরাধ যেমন বেড়েছে, তেমনি আইনের অপপ্রয়োগও বেড়েছে। ফলে জাতি অপরাধ দমন বা নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে কারো প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না। সাধারণ মানুষ মনে করে কঠিন আইন বা থানার সংখ্যা বৃদ্ধি করে বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংখ্যা বৃদ্ধি করে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য জাতিকে অবশ্যই একটি অবস্থানে দাঁড়াতে হবে। অপরাধীর বিচার হওয়া যেমন বাঞ্ছনীয়, অনুরূপ অভিযুক্ত ব্যক্তি যাতে ভিকটিম না হয় সে দিকেই দৃষ্টি রাখতে হবে।

কিছু অপরাধ রয়েছে যা আর্থিক দৈন্য তথা গরিবীর সাথে সম্পৃক্ত। কিছু অপরাধ রয়েছে উচ্চ বিলাসের সাথে সম্পর্কিত। কিছু অপরাধ রয়েছে উচ্ছৃঙ্খল আচরণের সাথে সম্পর্কিত। কিশোর গ্যাং বা Juvenile Delinquency বাংলাদেশে বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। অন্য দিকে রয়েছে গণধর্ষণ বা গ্যাং রেপ। কিশোর গ্যাং এবং গণধর্ষণে যারা জড়িত হওয়ার বিষয়টি অবশ্যই মানসিক বিকারগ্রস্ততা থেকে উদ্ভূত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, আকাশ সংস্কৃতির ছোবল ও পারিবারিক অনুশাসনের ব্যত্যয়ের কারণেই সমাজের একটি অংশ মানসিক রোগীতে পরিণত হয়েছে।

প্রতিকারের জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যতটুকু পদক্ষেপ নেয়া দরকার ততটুকু করা হচ্ছে না। রাষ্ট্র এখন পাঁচমিশালী ধ্যান-ধারণায় ব্যস্ত। নাগরিকদের নৈতিকতা শিক্ষা দেয়া বা নৈতিক আদর্শে দীক্ষিত করার জন্য রাষ্ট্রের উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা নেই, যা হচ্ছে গতানুগতিক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সার্টিফিকেট বিক্রির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কোনো পরীক্ষা ও পরীক্ষার ফল প্রকাশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিডিউল ঠিক রাখতে পারছে না।

আলোচ্য প্রসঙ্গ ‘আইন প্রয়োগে ব্যত্যয়’ দিয়ে শুরু করলেও প্রাসঙ্গিকভাবে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার বিষয়গুলো চলে এসেছে। দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা মাথায় রেখেই আইন প্রণয়ন হওয়া বাঞ্ছনীয় এবং এর প্রয়োগে যাতে কোনো স্বেচ্ছাচারিতা না হয় তাও নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্র পরিচালিত হয় মূলত তিনটি বিভাগকে কেন্দ্র করে যথা : ১. নির্বাহী বিভাগ, ২. বিচার বিভাগ ও ৩. আইন বিভাগ। কিন্তু নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব সর্বক্ষেত্রে বিরাজমান বিধায় শাসকদের মর্জিমতো আইন পরিচালিত হচ্ছে, আইন মোতাবেক শাসনকার্য পরিচালিত হচ্ছে না। পুলিশ নির্বাহী বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এ হাতিয়ারকে শাসক দল যেভাবে খুশি প্রয়োগ করছে বিধায়ই আইন অমান্য করার একটি সাধারণ প্রবণতা মানুষের মধ্যে পরিলক্ষিত। পুলিশ জনগণের আস্থা হারিয়েছে, যা কর্তাদের সুন্দর সুন্দর বুলি দিয়ে গণআস্থায় আনা যাচ্ছে না। ‘কোন দেশে ধর্ষণ নেই? এ কথা বলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কি বুঝাতে চেয়েছেন তাও আঁচ করা যাচ্ছে না।

তা ছাড়া দেশে এখন চলছে System Loss। সরকারের যেকোনো বিভাগ, দফতর, অধিদফতর যাই হোক না কেন সেখানে অতিরিক্ত টাকা অর্থাৎ ঘুষ ছাড়া কোনো কাজ হয়। ড্রাইভার, পিয়ন হয়ে যায় শত কোটি টাকার মালিক, সরকারি দলের চুনোপুঁটি নেতারা করছে হাজার হাজার কোটি টাকার মানিলন্ডারিং। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সার্ভিস ওরিয়েন্টেড অরগানাইজেশনগুলো যথা- বিদ্যুৎ, গ্যাস, রাজউক, ওয়াসা, টেলিফোন, আয়কর বিভাগ অতিরিক্ত টাকা অর্থাৎ ঘুষ না পেলে কোনো কাজ করে না। এমতাবস্থায়, সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সিস্টেম লস থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করা দরকার, নতুবা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটতেই থাকবে।

একটি রাষ্ট্রের রাজনীতিতে প্রতিহিংসা যখন চরমভাবে দেখা দেয়, তখন রাজনীতির বাইরে একটি গণ্ডি সৃষ্টি হয় যারা ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীনদের বিরোধিতার সুযোগে নিজেদের ভাগ্য রাতারাতি বদলে ফেলতে পারবে। একটি দল যখন পুলিশ ও আমলাদের বদৌলতে জোরপূর্বক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকে তখন ক্ষমতাসীনরা তাদের দুর্বলতা ঢাকার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই আপস করে। নানাবিধ দুর্নীতি, মানিলন্ডারিং, ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা বিদেশে পাচার হওয়া, সরকারি মালামাল ক্রয়সহ সরকারের উন্নয়নমূলক কাজে চুরির যে মহোৎসব চলছে, তা সরকারের আপসকামিতারই পরিচয় বহন করে।

দেশে সিস্টেম লসের অরাজকতা প্রকট আকার ধারণ করায় কেউই (সরকার বা বিরোধী দল) নিরাপদ নয়। পুলিশ দিয়ে প্রতিপক্ষকে নির্যাতনের ফায়দা পুলিশ যেমন নিচ্ছে, তাতে সরকারি আমলা ও দলীয় নেতাকর্মীরা পিছিয়ে নেই। পক্ষান্তরে ভোগান্তি হচ্ছে জনগণের।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement