২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

জাতীয় শক্তি ও জাতীয় স্বার্থ

জাতীয় শক্তি ও জাতীয় স্বার্থ - ছবি : নয়া দিগন্ত

জাতীয় শক্তি (National Power) পররাষ্ট্রনীতির মূল নিয়ামক। বিভিন্ন রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক নির্ধারণ মূলত জাতীয় শক্তির উপরে নির্ভরশীল। একজন ব্যক্তি যেমন শক্তিহীন হলে পথ চলতে পারে না, তেমনি রাষ্ট্রের অন্তর্নিহিত শক্তি দুর্বল হলে রাষ্ট্র মর্যাদার সাথে নিজের অবস্থান নির্ণয় করতে পারে না। রাষ্ট্রের উপাদান সম্পর্কে যারা ধারণা রাখেন তারা জানেন, ভূখণ্ড, জনসংখ্যা এবং সরকার থাকলেই রাষ্ট্র হয় না। রাষ্ট্র হতে হলে সার্বভৌমত্ব থাকতে হবে।

সার্বভৌমত্বের অপর অর্থ স্বাধীনতা। নিজের ইচ্ছা ও অনিচ্ছা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়ার একক ও অনতিক্রম্য ক্ষমতাই স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব। এই ক্ষমতারই অপর নাম জাতীয় শক্তি। ব্যক্তির শক্তি যেমন তার স্বাস্থ্য, বুদ্ধিমত্তা, পরিবেশ, উত্তরাধিকার, পদমর্যাদা, অর্থবিত্ত এবং গোষ্ঠী সমর্থন ইত্যাদি নানা রকম বিষয়ের ওপর নির্ভর করে রাষ্ট্রের শক্তিও তেমনি বিবিধ বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও জাতীয় শক্তির প্রমাণ মেলে নাগরিক সাধারণের নিরাপত্তা ও দেশের অখণ্ডতা রক্ষার সক্ষমতার ওপর। রাষ্ট্রকে শক্তি প্রয়োগের যে নৈতিক ও আইনানুগ অধিকার দেয়া হয়েছে তার উদ্দেশ্যও নাগরিক জীবন নিরাপদ করা ও রাষ্ট্রের সীমারেখা রক্ষা করা। এ অর্থ কেবল পুলিশী ব্যবস্থা বা সীমান্ত রক্ষা নয়। নাগরিকের জীবন, সম্মান ও সম্পত্তি রক্ষার মৌলিক দায়িত্বও রাষ্ট্রের। ব্যক্তি তার স্বার্থ রক্ষার জন্য যেমন অন্যকে প্রভাবিত করে তেমনি রাষ্ট্রেরও প্রয়োজন হয় স্বার্থকে সংরক্ষণের জন্য অন্য রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করার। নিজের স্বার্থ ও নীতি অনুযায়ী অন্য রাষ্ট্রের নীতিকে প্রভাবিত করার ক্ষমতাই রাষ্ট্রবিজ্ঞানে জাতীয় শক্তি বা ন্যাশনাল পাওয়ার বলা হয়।

জর্জ সোয়ারজেন বার্গার বলেন, জাতীয় শক্তি হলো: "Capacity to impose one's will on others by reliance on affective sanction in case of non-compliance". কেবলমাত্র সামরিক শক্তি প্রয়োগেই জাতীয় শক্তির পরিচায়ক এমন নয়। রাজনৈতিক সমর্থন, অর্থনৈতিক চাপ, কুশলী কূটনীতি, আন্তঃরাষ্ট্রিক সম্পর্ক, সমীকরণ ও ভৌগোলিক বাধ্যবাধকতা জাতীয় শক্তির নির্ধারক হতে পারে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদগণ প্রচার কৌশল বা প্রপাগান্ডা, অন্যকে সম্মত করানোর ক্ষমতা এবং জাতীয় নেতৃত্বকেও জাতীয় শক্তির গুরুত্বপূর্ণ উপায় উপাদান মনে করেন।

জাতীয় শক্তির উপাদান : আন্তর্জাতিক রাজনীতির ভাষ্যকর ইএইচ কার এবং অন্যদের মতামতের ভিত্তিতে জাতীয় শক্তির উপাদানকে ১০ ভাগে ভাগ করা যায়। ১. ভৌগোলিক অবস্থান ২. জনসংখ্যা ৩. প্রাকৃতিক সম্পদ ৪. শিল্পায়ন/ব্যবসা বাণিজ্য/খাদ্য ৫. কূটনীতি ৬. সামরিক শক্তি ৭. সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ৮. জন মনস্তত্ত্ব ৯. সরকার ১০. জাতীয় নেতৃত্ব।

জাতীয় স্বার্থ : সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও (পরে প্রধানমন্ত্রী) লর্ড পামার স্টোন বলেন, 'Great Britain does not have permanent friend of foe, has got permanent interest.' মূলত জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করাই পররাষ্ট্রনীতির প্রতিপাদ্য বিষয়। আর সেই প্রধান স্বার্থ হলো জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং রাষ্ট্রিক অখণ্ডতা রক্ষা করা। নিরাপত্তা সমস্যাই রাষ্ট্রের প্রধান সমস্যা। এই নিরাপত্তার জন্য সরকার যুদ্ধ করে, নাগরিকরা প্রয়োজনে প্রাণ বিসর্জন দেয়। তাহলে বোঝা যাচ্ছে রাষ্ট্রের স্বার্থ প্রথমত ও প্রধানত জাতীয় নিরাপত্তা। দ্বিতীয়ত, জনগণের অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণ। তৃতীয়ত, স্বাধীনতা, জাতীয় আদর্শ ও মূল্যবোধ সমুন্নতকরণ। বিশ্ব রাজনীতির চলমান প্রবাহে নিজের স্বার্থ সমন্বিতকরণ ও জাতির মান মর্যাদা বৃদ্ধির পদক্ষেপও জাতীয় স্বার্থের সম্পূরক।

শক্তি ও স্বার্থের সমন্বয় : জাতীয় শক্তির উপাদানগুলোকে সমন্বিত করেই কেবল জাতীয় স্বার্থের সমন্বয় সম্ভব। একটি জাতি যদি থাকে বিশাল বিস্তীর্ণ আয়তনের অধিকারী আর না থাকে পর্যাপ্ত জনসংখ্যা সে রাষ্ট্রটি জাতীয় স্বার্থকে সমন্বিত করতে পারে না। জনসংখ্যার বিপুলতা সত্ত্বেও নাগরিক সাধারণ যদি অলস, অকর্মন্য ও আমোদি চরিত্রের হয় তাহলে জাতি হিসেবে টিকে থাকাই দায় হয়ে দাঁড়ায়। চীনে এক সময়ে পাশ্চাত্য প্রভাবিত আফিমের কথা মনে করা যেতে পারে। রাষ্ট্রের অবস্থানটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তার জাতীয় শক্তি প্রদর্শনের জন্য। নগর রাষ্ট্র সিঙ্গাপুর, দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা বা মালাগাসি, এডেন-দুবাই সমুদ্রবন্দর, সুয়েজ অথবা পানামা খালের মালিকানা গুরুত্বপূর্ণ। জলপথ হিসেবে দার্দালেলিস, জিব্রাল্টার, বসফরাস সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে শুধু কৌশলগত অবস্থানের কারণে। আবার পৃথিবীর অনেক স্থলবেষ্টিত দেশ- নেপাল, ভূটান, মঙ্গোলিয়া, অস্ট্রিয়া, আফগানিস্তানের মতো দেশ তাদের ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা নিয়ে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষর করছে। সে ক্ষেত্রে জাতীয় শক্তির অন্যান্য নির্ধারকসমূহ রাষ্ট্র বিশেষে সুবিধে অথবা অসুবিধার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবকিছু অতিক্রম করে একটি রাষ্ট্র তার নেতৃত্বের কারণে যথার্থই শক্তি প্রদর্শনে সক্ষম। আফিম আক্রান্ত চীন মাওয়ের নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ায়। মাহাথিরের নেতৃত্বে মালয়েশিয়া রাইজিং টাইগার বনে যায়। লিকোয়ান ইউ এর সুশাসনের সুনামে সিঙ্গাপুর প্রতিষ্ঠিত হয় একটি নোবল রাষ্ট্ররূপে। আবার এবনরমাল লিডারশিপের কারণে নিন্দিত হয় বিশ্ব মোড়ল আমেরিকা।

ভারত-বাংলাদেশের যোগবিয়োগ : জাতীয় শক্তির উপাদানসমূহের আলোকে যদি আমরা জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে দু’দেশের বিষয়টি বিশ্লেষণ করি তাহলে দেখা যাবে বিশালত্ব এবং ক্ষুদ্রত্ব সত্ত্বেও রাষ্ট্র দুটো একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। বাধ্যবাধকতা, সীমাবদ্ধতা সমস্যা যেমন আছে তেমন আছে অপার সম্ভাবনা, কৃতজ্ঞতা এবং সদিচ্ছা। জাতীয় শক্তির সব উপাদানগুলোই যে এক্ষেত্রে ক্রিয়াশীল বা অক্রিয়াশীল এটা বলা যাবে না। উভয় ক্ষেত্রে জাতীয় নেতৃত্বের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অধ্যায়ন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। আবার এটাও সত্যি কথা যে জাতীয় নেতৃত্বকে নির্ভর করতে হয় জাতীয় শক্তির উপরে। বাংলাদেশ জাতি রাষ্ট্রের জাতীয় শক্তির বিচার বিশ্লেষণে ইতিবাচক নেতিবাচক দিকগুলোর নৈর্ব্যত্তিক পর্যালোচনা প্রয়োজন। বাংলাদেশের একরকম চার দিকে রয়েছে ভারত। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত চার হাজার ১৫৬ কিলোমিটার প্রসারিত। আবার ভারতের পূর্বাংশে সহজে যেতে প্রয়োজন বাংলাদেশের সমর্থন ও সহযোগিতা। এ দু’য়ের সমন্বয়ে ও সমীকরণে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষিত হয়নি। আমরা ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট দিয়েছি। কিন্তু শিলিগুড়ি করিডোরের ১৪ মাইল অতিক্রম করে নেপালে যাওয়ার অনুমতি মেলেনি। ভারতে মাটি ব্যবহার করে যেমন বাংলাদেশে শান্তিবাহিনী অশান্তির সৃষ্টি করেছিল তেমনি সরকারের গোচরে অথবা অগোচরে মেঘালয় আসামের বিদ্রোহীরা বাংলাদেশে আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছিল। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারত বিদ্রোহীদের ওই আশ্রয়-প্রশ্রয় নির্মূল করতে বলে। আওয়ামী লীগ সরকার কৃতজ্ঞতার সাথে সে আদেশ পালন করে। শুধু তাই নয় আন্তর্জাতিক আইন ও বিধি-বিধান লঙ্ঘন করে বাংলাদেশের আশ্রয়ে এবং জেলে যেসব বিদ্রোহী ছিল তাদের ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। আর ভারত বিশাল। তবুও পরস্পরের যে সহযোগিতা প্রয়োজন তা স্পষ্ট।

ভৌগোলিক অবস্থান : ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে ভারত যে অসম্ভব নিয়ন্ত্রণমূলক অবস্থানে রয়েছে তা স্পষ্ট হয়েছে। হিমালয় দ্বারা তার স্থল নিরাপত্তা অনেকটা নিশ্চিত। ভারত মহাসাগর দ্বারা তার জলসীমা চিহ্নিত। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহকে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করার সুযোগ তার অবারিত। অপর দিকে বাংলাদেশ ভারত দিয়েই বেষ্টিত। সীমান্তের সুদীর্ঘ মাত্রার প্রতিটি মাইলফলকই সংবেদনশীল। ১৯৭৩ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির দ্বারা সীমান্ত চুক্তি চূড়ান্ত হলেও ভারত এর সুরাহা করতে সময় নেয় ৪২ বছর।

ভারতবান্ধব আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলেই কেবল তা বাস্তবায়িত হয়। দহগ্রাম-আঙ্গরপোতায় যেতে ১৮৫ মিটার লম্বা তিনবিঘা করিডোর দিনে ছয় ঘণ্টা চালু করতে বাংলাদেশের অনুরোধ রক্ষা করতে ভারতে লেগেছে ১৮ বছর। স্থলসীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে ২০১৫ সালে। ২০২০ সালে এসেও এখনো মুহুরী নদী সীমান্ত চুক্তি সম্পাদন সম্ভব হয়নি। সীমান্ত সমস্যা সবচেয়ে সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে। কারণ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে বাংলাদেশী নাগরিকরা নির্বিচারে হত্যার শিকার হচ্ছে। এ বিষয়ে দু’দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক থেকে সীমান্ত বাহিনী প্রধান পর্যায়ে অসংখ্য বৈঠক হলেও হত্যা বন্ধ হয়নি। নির্মম বাস্তবতা এই যে, এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘বিশে^র সবচেয়ে প্রাণঘাতী সীমান্ত’। কারণ জাতীয় শক্তির অকার্যকারিতা।

একটি জাতির ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি ও অর্থনীতি যদি জাতীয় শক্তির জোগান দেয়, আর সরকার ও নেতৃত্ব যদি তা সম্পূরক না হয় তাহলে জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। অতীতে, নিকট অতীতে এবং বর্তমানে ক্ষমতাসীন নেতৃত্ব ভারতীয় নেতৃত্বের ভাষায় কথা বলেছে। বেশ কয়েক বছর আগে সরকারি দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত আশরাফুল ইসলাম কলকাতায় সীমান্ত হত্যাকে ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে বৈধতা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এরকম দীর্ঘ জটিল সীমান্তে এ ধরনের ঘটনা অস্বাভাবিক কিছু নয়। সদ্য সমাপ্ত সীমান্তের মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠকেও একই ধ্বনি শোনা গেল। যৌথ বিবৃতিটি দেখে মনে হয়নি এটি বাংলাদেশের। অবশ্য পরে একটি শব্দের প্রতিবাদ করা হয়েছে। সন্ত্রাসী শব্দের পরিবর্তে চোরাকারবারি পড়তে হবে। আশ^স্ত করা হয়েছে, সীমান্তে হত্যা বন্ধ হবে। দীর্ঘ বছরগুলোতে এরকম প্রতিশ্রুতির পর প্রতিশ্রতি দেয়া হয়েছে। হত্যা বন্ধ হয়নি। সীমান্তে ফেলানীরা ঝুলেছে। কোন প্রতিকার হয়নি। ভারতের অন্য সীমান্তে ইটটি মারলে পাটকেলটি খেতে হয়। এখানে আমাদের সংসদীয় কমিটি উষ্মা প্রকাশ করেছে। নিন্দা করারও সাহস নেই তাদের।

জনসংখ্যা : জনসংখ্যা বিপুল হলেও ভারতে আয়তনও বিশাল। আর বাংলাদেশ জনসংখ্যার চাপে নিষ্পিষ্ট একটি দেশ। বিদেশী প্রভু এবং এতদ্বেশীয় দালালদের ষড়যন্ত্রে জন্মলগ্নেই পোকায় খেয়েছে আমাদের মানচিত্র। নইলে বাড়ির পাশের আরশিনগর- ‘সপ্তকন্যা’ কি করে তাদের হয়? স্বাধীনতা আইন ১৯৪৭ অনুযায়ী হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা হিন্দুস্তান হওয়ার কথা। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা হবে পাকিস্তান। যারা হিন্দু নয় মুসলিমও নয়, উপজাতি- তারা তো সংযুক্ত হওয়ার কথা প্রতিবেশীর সাথে। দেশের আইন অনুযায়ী আপনার বাড়ির পাশের জায়গাটি আপনার। আন্তর্জাতিক আইনও তাই বলে। কিন্তু পক্ষপাতদুষ্ট রেডক্লিফ রোয়েদাদ এবং মাউন্ট বেটেনস বায়াসনেস- এ জাতির সর্বনাশ সাধন করেছে।

বাংলাদেশ আর নেপালের মাঝখানের দূরত্ব মাত্র ১৭ মাইল। নাম তার শিলিগুড়ি করিডোর। সমরকুশলীরা বলেন, ‘চিকেন নেক’। চিকেন নেক এ চাপ দিলে চিকেন কক কক করবে- ধারণা পর্যবেক্ষকদের। এছাড়া অন্যায়ভাবে বঙ্গোপসাগরের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ভারতকে দেয়া হয়। সাগরটির নাম বঙ্গোপসাগর। সুতরাং বঙ্গ দেশের অধিকার ছিল স্বাভাবিক। আর আমাদের স্বাধীনতাকামী আজীবন কারাবন্দীরা ওই বিরান বনভূমি আবাদ করেছিল। তার পরও খুলনা ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে এখনো তারা কথা বলে। এই হলো বন্ধুত্বের নমুনা। বিগত ৫০ বছর ধরে যেসব মুসলিম নাগরিক ভারতের আসাম বা অন্যত্র বসবাস করছে তাদের বহিষ্কার করার মতলব নিয়ে সম্প্রতি নাগরিকত্ব আইন-সিএএ এবং জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরি করছে। ২০ লাখ মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে দিতে চাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের সাহস নেই সরাসরি এ আইনের নিন্দা করা। তারা বলছে, এটি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশের আশঙ্কার কারণ নেই। অথচ ভারতের জাতীয় নেতৃবৃন্দ এসব লোকদেরকে পরিষ্কারভাবে ‘বাংলাদেশী বৈআইনি অনুপ্রবেশকারী’ বলছেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন। এর নেতৃত্ব সম্পর্কে অবমানকর উক্তি করছেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কয়েক মাস আগেই একটি উপসাগরীয় পত্রিকার সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে তার উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তিনি তো বাংলাদেশের মানুষের সুপ্ত ক্ষোভের খবর রাখেন।

কূটনীতি : উত্তরাধিকার সূত্রে ভারত একটি উন্নত আমলাতন্ত্র পেয়েছে। সেখানে লেখাপড়া ও গবেষণার মানও বৈশি^ক পর্যায়ের। তাই আর আমাদের উত্তরাধিকার ও শিক্ষা এই উভয়বিধ কারণে আমলাতন্ত্র বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দুর্বল। দক্ষতা, যোগ্যতা, গবেষণা ও উপস্থাপনায় আমাদের কূটনীতিক ও আমলাদের ঘাটতি আছে। এসব দুর্বলতার কথা উঠে এসেছে আমলাদের ভাষ্যে এবং স্মৃতি কথায়। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বাংলাদেশের উপস্থাপনা তাদের সমকক্ষ হয় না। তাছাড়া ভারতের আমলাতন্ত্রের স্বকীয়তা ও আধিপত্য রয়েছে। পত্র-পত্রিকায় খবর বের হয় রাজনীতিবিদ আর ‘সাউথ ব্লক’ বাংলাদেশের অনেক বিষয়ে একমত হয় না। সাম্প্রতিক পেঁয়াজ কেলেঙ্কারি এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

সামরিক ক্ষমতা : ভারতের আয়তন, সমৃদ্ধ অর্থনীতি এবং বিশাল সীমান্তের কারণে রয়েছে বিশাল সামরিক বাহিনী। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সাথে তাদের তুলনাও চলে না। অথচ যখনই এই সেনাবাহিনী সাবমেরিন কেনে বা ফ্রিগেট সংযোজিত হয় নৌবাহিনীতে তখন তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উৎকণ্ঠা আঁচ করা যায়। গুজব ছিল ১৯৭১ সালে কথিত ২৫ বছরের গোপন চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না। প্রাথমিক শাসন আমলে সেনাবাহিনীর সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়েছে। রক্ষীবাহিনী পেয়েছে তোষণ। বাকশাল গভর্নরদের অধীনে সেনাবাহিনীকে জেলায় জেলায় ভাগ করার পরিকল্পনা ছিল বলে খবর বেরিয়েছিল। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আসলে ভারতের সাথে স্বাভাবিক সামরিক মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব তৈরি হয়। ১/১১ এর সরকারের মাধ্যমে ভারতের সাথে সেনাবাহিনীর তাদের কথিত ‘সেনার্জি’ বা সখ্য সৃষ্টি হয়। তারা যখন মইন ইউ আহমেদকে ছয়টি ঘোড়া উপহার দেয় তখন লোকেরা উপহাস করে ‘অশ^মেধযজ্ঞ’ বলে। সেই ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত রয়েছে পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণে সেনাবাহিনীর যে প্রথাগত ভূমিকা থাকে তার অবসান হয়েছে।

সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ : ১৯৪৭-এর দেশ বিভাগের সময় ধর্মীয় মূল্যবোধের তীব্রতা ছিল। যার ফলে রক্তারক্তি ও দেশ ভাগ হলো। আশা করা হয়েছিল বিভাজনের মধ্য দিয়ে ক্ষোভ প্রশমিত হবে। তা হয়নি। ভারতে কার্যত ধর্মনিরপেক্ষতা পরিত্যক্ত হয়েছে। জাতীয় আদর্শ হিসেবে হিন্দুত্ববাদের পুনরুত্থান ঘটেছে। এতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশের মনস্তত্ত্বে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করা অসম্ভব নয়। বাংলাদেশের সরকার ধর্মনিরপেক্ষ সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা একটি মুসলিম দেশের প্রতিনিধিত্ব করে এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুল মোমেন সম্প্রতি ভারতের হিন্দু পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন- রামমন্দিরের নির্মাণ দু’দেশে দৃঢ় সম্পর্কে ছায়া ফেলবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন না। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি এই বাণী উচ্চারণ করেন যে, ‘ভারতেরও (এই মন্দির নিয়ে) এমন কিছু করা উচিত হবে না যাতে দু’দেশের সম্পর্কে চিড় ধরতে পারে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, ভারতে নাগরিকত্ব বিল পাস করার পর ড. মোমেনই তার নির্ধারিত দিল্লি সফর স্থগিত করেছিলেন। সে সময় ভারতে আসার কথা ছিল বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানেরও। কিন্তু আসেননি তিনিও। এই দুটো সফরের কোনোটাই আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।

ভারতে মুসলমানদের প্রতি বঞ্চনা প্রশ্নে ঢাকার যে একটা অভিমান অনুযোগ রয়েই গেছে সেটিও গোপন নেই। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মুচকুন্দ দুবে বলেছেন, ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতি ব্যবহারে ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কে অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে সবার সঙ্গে কথা বলে আমি যেটা বুঝেছি তা হলো- ভারতে কেন মুসলিমদের বীফ খাওয়ার জন্য পিটিয়ে মারা হবে এবং মুসলিম হওয়ার অপরাধে কেন একদল মানুষ বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার হবে- এটা তাদের ক্ষুব্ধ ও হতাশ করে। ভারতকে যারা ধর্মনিরপেক্ষতার আলোকবর্তিকা হিসেবে দেখতেন তাদের জন্য এই বাস্তবতা মেনে নেয়া হৃদয়বিদারক হয়ে ওঠে বলেও তার পর্যবেক্ষণ।

আসামের এনআরসি বা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি তৈরির প্রক্রিয়া এবং গত বছর পাস হওয়া ভারতের নাগরিকত্ব আইন সেই পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলেছে নিঃসন্দেহে। এরই পটভূমিতে গত ৫ আগস্ট মহাধুমধামে ভারতের অযোধ্যায় সুবিশাল রামমন্দিরের ভূমি পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন। স্মরণ করা যেতে পারে যে, সম্রাট বাবরের সময়ে নির্মিত বাবরি মসজিদটি তিন দশক আগে ভেঙে ফেলা হয়। অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এখন সেখানে রামমন্দির নির্মাণের কাজ শুরু হলো। জাতীয় শক্তির অন্য উপাদানগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। জাতির বিভিন্ন প্রেক্ষিত ও সময়ে সেগুলোর প্রকাশ ও বিকাশ ঘটে।

রাষ্ট্র একটি বাস্তব সত্তা। মানুষজন বা সরকার তার নিয়ামক। সরকার জাতীয় শক্তির জোরেই ক্ষমতা প্রয়োগ করে। জাতীয় শক্তির বিভিন্ন উপাদান ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, জাতীয় শক্তির উপাদানগুলো নীরব অথবা সরব হয়ে ওঠে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে। হেরল্ড স্পারাউট এবং মার্গারেট স্পারাউট মন্তব্য করেন যে, "A country is bound to be stronger and more powerful if its leaders have the strength of wisdom".
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

Mal55ju@yahoo.com

 


আরো সংবাদ



premium cement