২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং দৈন্য ও গবেষণা-সংস্কৃতি

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং দৈন্য ও গবেষণা-সংস্কৃতি - ছবি : নয়া দিগন্ত

একটি আধুনিক সমাজ বিনির্মাণের বিষয়টি ব্যাপকভাবে নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের উচ্চশিক্ষার প্রকৃতি ও প্রমিত মানের ওপর। উচ্চশিক্ষা অপরিমেয় সম্ভাবনা সৃষ্টি করে একটি দেশের, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে। বিশ্বজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। এগুলোই প্রকৃতপক্ষে একটি দেশের পরিবর্তন ও উন্নয়নের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করে থাকে। সে জন্যই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গবেষণা ও উন্নয়ন’ বিভাগের গবেষণাকর্মকে যথাসাধ্য অগ্রাধিকার দেয়া হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে। এসব কমিশনে তাত্ত্বিকভাবে জোর দেয়া হয়েছে দেশে মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করার ব্যাপারে। তাই এসব কমিশনের রিপোর্টে জোর দেয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় গবেষণা ও উন্নয়নের কাজে অগ্রাধিকার দেয়ার জন্য।

এ ক্ষেত্রে প্রত্যাশা ছিল- দেশের তরুণ জনগোষ্ঠী সর্বাধুনিক ও সময়োপযোগী উচ্চশিক্ষা অর্জন করে জাতি গঠনে কাক্সিক্ষত অবদান রাখবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো তথা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুর্বলতা সীমাহীন। সমাজ পরিবর্তনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রত্যাশিত পরিবর্তন আনায় বড় দাগে ব্যর্থ হচ্ছে অব্যাহতভাবে। ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে সুসম্পর্কের অভাব, প্রয়োজনীয় বোঝাপড়ার অভাব, অত্যাধুনিক শিক্ষাদান পদ্ধতির অভাব, হালনাগাদ সিলেবাসের অভাব, শিক্ষাদানে শিক্ষকদের আন্তরিকতা ও আত্মত্যাগের অভাব, ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে শিক্ষার চেয়ে রাজনীতির প্রতি অতি আগ্রহ ও রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে বৈধ-অবৈধ ফায়দা লোটাসহ নানা ধরনের তৎপরতায় লিপ্ত থাকা, যথাযথভাবে অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার অনুসরণ না করা, শিক্ষকদের গবেষণার চেয়ে বাইরের এনজিওর কাজে ব্যস্ত থাকার ফলে সৃষ্ট গবেষণা-সংস্কৃতির দৈন্য, রাজনৈতিক কারণে বিশ্ববিদ্যালয় যখন-তখন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে পড়া, গবেষণাকর্মে অপর্যাপ্ত তহবিল বরাদ্দ দেয়া ইত্যাদি নানাবিধ কারণে আমাদের উচ্চশিক্ষায় অব্যাহতভাবে ক্রমাবনতি ঘটে চলেছে। মূলত এসব বিষয় আমাদের উচ্চশিক্ষার ক্রমাবনতির মুখ্য কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমাদের উচ্চশিক্ষার প্রধানতম ক্ষেত্র হচ্ছে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এগুলোর শিক্ষার মান কিভাবে যে ক্রমেই অধঃপতনের দিকে যাচ্ছে, তা কিছুটা আন্দাজ-অনুমান করা যায় সম্প্রতি প্রকাশিত ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং ২০২১’-এর দিকে নজর দিলে। এই র‌্যাংকিং রিপোর্ট প্রতি বছর নিয়মিত প্রকাশ করা হয়। সর্বসাম্প্রতিক রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়েছে গত মাসের শেষ সপ্তাহে। এবারের র‌্যাংকিং রিপোর্টে ৯৩টি দেশ ও অঞ্চলের ১৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের প্রধান দুটি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ডিইউ) এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাংকিং ২০২১’ রিপোর্টে ডিইউ এবং বুয়েটের অবস্থান প্রথম এক হাজারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এবারের র‌্যাংকিংয়ে বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। পরপর চারবার প্রথম হওয়ার গৌরব অর্জন করল বিশ্ববিদ্যালয়টি। অক্সফোর্ডের পর তালিকায় এসেছে যথাক্রমে- স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলি, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। এক সময় বিশ্বব্যাপী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সুনাম ছিল। তখন এটি অভিহিত হতো ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ তথা ‘অক্সফোর্ড অব দ্য ইস্ট’ নামে। আজ আমাদের গর্বের ধন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নেই বিশ্বের প্রথম এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়ও।

একইভাবে, বুয়েটের বিশ্বজুড়ে একটা আলাদা সুনাম ছিল। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এটি সম্মানজনক নানা পুরস্কার বিজয়ী হয়েছে বেশ কয়েকবার। সেই বুয়েটের অবস্থানও এক হাজার গ্রুপে। বিষয়টি সত্যিই মর্মপীড়াদায়ক। আমাদের আর সব বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানের কথা তো গণনায়ই আসে না। অথচ দেশের উন্নয়নে আমরা ‘এই দেশটি ছাড়িয়ে গেছি, ওই দেশটি পেছনে ফেলেছি’- এ ধরনের আত্মপ্রবঞ্চণামূলক কথা বলার মানুষের অভাব আমাদের নেই। এদের উপলব্ধিতে নেই, একটি দেশ বা জাতির প্রকৃত অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি আসে শিক্ষার অগ্রগতির মধ্য দিয়েই।

টাইমস হায়ার এডুকেশনের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্যমতে, এই র‌্যাংকিং প্রণয়ন করা হয়েছে পাঁচটি বিষয়ে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসাফল্য বিবেচনায় রেখে। বিষয়গুলো হচ্ছে : টিচিং, রিসার্চ, সাইটেশন, ইন্টারন্যাশনাল আউটলুক ও ইন্ডাস্ট্রি আউটকাম।

দেখা গেছে, ১০০ পয়েন্টের মধ্যে টিচিং বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছে ১৫.৩ পয়েন্ট, সাইটেশনে পেয়েছে ৩৬.৬ পয়েন্ট, আন্তর্জাতিক আউটলুকে ৪২.৪ পয়েন্ট এবং ইন্ডাস্ট্রি আউটকামে ৩৩.৯ পয়েন্ট। এসব বিষয়ের মধ্যে দুটি বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাপ্ত পয়েন্ট গত বছরের তুলনায় সামান্য বাড়লেও দু’টিতে কমেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টি গবেষণার ক্ষেত্রে দুঃখজনক অবনতি অব্যাহত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবার পেয়েছে ১০০ পয়েন্টের মধ্যে মাত্র ৭.৭, গত বছরে এ ক্ষেত্রে এর পয়েন্ট ছিল ৮.৮।
একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বিচারে সবচেয়ে গুরুত্বের সাথে প্রথমেই আসে ‘রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ তথা ‘গবেষণা ও উন্নয়ন’-এর ক্ষেত্রে এর অবদান কতটুকু, তা। এ ক্ষেত্রে আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই বলি কিংবা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই বলি, পরিস্থিতি বেদনাদায়ক। গবেষণার ক্ষেত্রে এই রিপোর্ট মতে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পারফরম্যান্স থেকে বিষয়টি সুস্পষ্ট। একটু আগেই জানলাম, এ ক্ষেত্রে এই বিশ্ববিদ্যালয় ১০০ পয়েন্টের মধ্যে পেয়েছে মাত্র ৭.৭ পয়েন্ট। এ পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর আখতারুজ্জামান বলেছেন- আমি মনে করি না, বর্তমান বিশ্ব পরিসীমায় রাতারাতি বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আনা যাবে। তবে আমরা চেষ্টা করছি আমাদের গবেষণা খাতকে এগিয়ে নিতে। আর আমরা এরই মধ্যে বেশ কিছু পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করতে। কিন্তু তার এই বক্তব্যে বাস্তবতার কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ, তাদের এরূপ কোনো চেষ্টা বা পরিকল্পনা হাতে থাকলে গত বছরের চেয়ে এবার গবেষণা খাতের পয়েন্ট না বাড়লেও অন্তত কমতে দেখা যেত না।

অস্বীকার করার উপায় নেই, উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা খাতে সরকার যে পরিমাণ অর্থ খরচ করে, তা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চাহিদামতো তহবিল সরবরাহে ব্যর্থ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যে তহবিল দেয়া হয়, এর বেশির ভাগই খরচ হয়ে যায় অনুষদের উন্নয়নে ও বেতন-ভাতার পেছনে। ইউজিসি চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য দেশের ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বাজেট বরাদ্দ করেছে আট হাজার ৪৮৫ কোটি ১২ লাখ টাকা। এর মধ্যে রাজস্ব বাজেটের পরিমাণ পাঁচ হাজার ৪৫৪ কোটি ১২ লাখ টাকা এবং ৫৩টি উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়েছে তিন হাজার ৩১ কোটি টাকা। এ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ ৮৩০ কোটি ছয় লাখ টাকা পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অধিকন্তু, মূল বাজেটে ৬৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা খাতের জন্য। এ বছর গবেষণা খাতে আগের বছরের তুলনায় বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ৩ শতাংশ। সহজেই অনুমেয়, ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার জন্য ৬৬ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বরাদ্দ মোটেও পর্যাপ্ত নয়। বলা হয়, জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয়। এরপরও উচ্চশিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ খুবই কম। এই বাজেট সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চাহিদা মেটানোর উপযোগী নয়। ফলে এমন বিশ্ববিদ্যালয়ও আছে যেগুলো গবেষণার কাজে কোনো অর্থই খরচ করতে পারছে না।

আসলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিরাজ করছে ‘গবেষণা-সংস্কৃতি’র চরম অভাব। বেশ কয়েকটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে গবেষণার প্রতি চরম অবহেলা প্রদর্শনের মধ্য দিয়েই। অথচ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার মান বিবেচনায় মুখ্য ‘বেঞ্চমার্ক’ হচ্ছে গবেষণাকর্ম। একটি রিপোর্ট মতে, দেশের ১৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৮ সালে এক টাকাও খরচ করেনি গবেষণা খাতে। আর কিছু বিশ্ববিদ্যালয় স্বল্প তহবিল খরচ করেছে নামমাত্র গবেষণার পেছনে। কিন্তু ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০’ অনুযায়ী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের বাজেটে গবেষণা খাতে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ দেয়ার তাগিদ রয়েছে।

শিক্ষাবিদদের মতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাজ তিনটি : জ্ঞান সৃষ্টি, জ্ঞান ভাণ্ডার তৈরি ও জ্ঞানের বিস্তার- creation of knowledge, storage of knowledge, dissemination of knowledge। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে এর শিক্ষাকার্যক্রমে পরিপূর্র্ণতা আনতে হলে গবেষণার মাধ্যমে নয়া জ্ঞান সৃষ্টি অবশ্যই করতে হবে, জ্ঞান উদঘাটনে চালাতে হবে অনুসন্ধানী বিশ্লেষণ। তাই গবেষণাকে বিশ্বজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বিবেচনায় প্রধানতম বিবেচ্য করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান উল্লেখ করেছেন- ‘উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টির জন্য মুখ্য কাজ হচ্ছে গবেষণা। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরিচালিত গবেষণা মোটেও পর্যাপ্ত নয়। তিনি জানিয়েছেন, কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার কাজে এক পয়সাও খরচ করে না। এক-তৃতীয়াংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এ ধরনের কাজে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়। কারণ, এসব বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা হয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে নয়।’ ইউজিসির প্রকাশিত সর্বশেষ রিপোর্টটি বের হয়েছে কয়েক মাস আগে। এই রিপোর্ট মতে, বাংলাদেশে ১০৫টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। ৯২টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৮ সালে গবেষণা খাতে এক টাকাও খরচ করেনি। ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা খরচ করেছে গবেষণাকর্মে। ১১টি খরচ করেছে পাঁচ লাখ থেকে ১০ লাখ এবং অন্য ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় এ খাতে খরচ করেছে ১০ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা। শিক্ষাবিদদের মতে, গবেষণা খাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বছরে ২০ লাখ টাকা খরচ করার অর্থ কার্যত কোনো গবেষণা না করারই শামিল। দুই-তৃতীয়াংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতের এই খরচ দেখায় নামমাত্র।

রিপোর্ট অনুসারে, যে ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৮ সালে কোনো গবেষণা চলেনি সেগুলোর বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ২০-২৫ বছর আগে। এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি চালু আছে বিগত চার-পাঁচ বছর ধরে কোনো ধরনের গবেষণা কর্মসূচি না চালিয়েই, যা আইনবহির্ভূত। অথচ তা দেখার কেউ নেই। ইউজিসির রিপোর্ট পাঠে জানা যায়- অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাদের গবেষণায় উদ্ভাবনীমূলক কোনো পদক্ষেপের ওপর আলোকপাত না করেই চালু রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয় বছরে গবেষণা খাতে খরচ করে মাত্র এক লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকা।

রিপোর্টটি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে- কিছু সুপরিচিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে ব্যয়ের পরিমাণে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। ২০১৮ সলে এ খাতে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ প্রায় ৩৯ কোটি টাকা, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যলয়ের খরচ পৌনে সাত কোটি টাকা, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা, সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ চার কোটি ৪২ লাখ টাকা, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি আট কোটি ৩৪ লাখ টাকা, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি তিন কোটি টাকা ও ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি আট কোটি ১৯ লাখ টাকা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ওই বছরে গবেষণা খাতে সর্বোচ্চ চার কোটি ৮৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয় করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এ খরচের পরিমাণ ছিল দুই কোটি ৯৩ লাখ ৫১ হাজার টাকা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ সময়ে গবেষণা খাতে খরচ করে দুই কোটি সাত লাখ। অপর দিকে, চালু থাকা ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ছয়টি গবেষণা খাতে এক টাকাও খরচ করেনি। এগুলো হচ্ছে : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ টেক্সটাইল ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি ও রবীন্দ্র ইউনিভার্সিটি। সার্বিক বিবেচনায় বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই গবেষণা-সংস্কৃতির দৈন্যই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং দৈন্যকে প্রকট করে তুলেছে।

সবশেষে বলা যায়- উচ্চশিক্ষা তথা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষায় এই পিছিয়ে থাকা অবস্থার অবসান ঘটাতে ইউজিসির অধীনে একটি মনিটরিং বোর্ড গঠন করা যেতে পারে। এই বোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্পন্ন জনবল নিয়োগ, শিক্ষক নিয়োগের দলবাজির অবসান ঘটানো, দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ লাভে বঞ্চিত হচ্ছেন কি না তার ওপর নজর রাখা, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণাকর্ম চালু আছে কি না ইত্যাদি বিষয়সহ সার্বিক উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের বিষয়টি দেখাশোনা করবে। দলমতের ঊর্ধ্বে থেকে ভালো শিক্ষকদের প্রণোদিত করার জন্য চালু করতে হবে নানা ধরনের পুরস্কার। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপের উপায় অবশ্যই উদ্ভাবন করতে হবে।

শিক্ষকদের দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করার জন্য কড়া নজরদারি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সবক্ষেত্রে দলবাজি আর লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করতে না পারলে কখনোই সুশৃঙ্খল বিশ্ববিদ্যালয় পাবো না, উচ্চশিক্ষার মানেও আমরা পিছিয়ে থাকব। মনে রাখতে হবে, বিশ্বব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই সমাজ পরিবর্তনের পথ খুলে দেয় এবং এগুলো কাজ করে পরিবর্তন আর উন্নয়নের কেন্দ্র হিসেবে। এসব উপলব্ধি মাথায় রেখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাখতে হবে নোংরা রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে। বিদ্যমান বিশৃঙ্খল পরিবেশ দূর করে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার একমাত্র পথ এটাই। যত দিন ক্ষমতাসীনরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির সংস্কৃতি থেকে বের করে আনার ব্যাপারে আন্তরিক প্রয়াস নিয়ে এগিয়ে না আসবেন, তত দিন আমাদের উচ্চশিক্ষার মানের ক্রমাবনতি ঠেকানো যাবে না। এই কাজটি করতে পারলেই শিক্ষার মানের উন্নয়ন ঘটবে, শিক্ষকরা নোংরা রাজনীতির বলয় ছেড়ে ফিরে যাবেন শ্রেণিকক্ষে আর গবেষণাকর্মে। আর সেই সূত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ফিরে পাবে হারানো গৌরব। র‌্যাংকিংয়ে উঠে আসবে সম্মানজনক অবস্থানে।

 


আরো সংবাদ



premium cement