১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শিক্ষাঙ্গন খুলে দেয়া হোক

শিক্ষাঙ্গন খুলে দেয়া হোক - ছবি : নয়া দিগন্ত

শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। এ কথাটি শুনে আসছি শিশুকাল থেকে। ব্রিটিশ আমলে শিক্ষা কঠিন ছিল। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় তাই ছিল বাস্তব। পাকিস্তান আমলে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয়েছে ২৩ বছর। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে শিক্ষা হবে যথার্থ; তাই ছিল আশা। সে আশা নিরাশায় পরিণত হয়েছে। ড. মুজাফফর আহমেদ চৌধুরীর মতো প্রজ্ঞাবান শিক্ষাবিদের পরামর্শ উপেক্ষা করে অটোপাস এবং নকলের যে মহোৎসব ঘটিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের শাসকরা এই জাতির প্রাথমিক সময়ে, তা নজিরবিহীন। ‘নকল’ শব্দটা বোধহয় ভুল করে বললাম। আসলে সেদিন শিক্ষার্থীরা পুস্তক দেখে লিখেছিলেন। তারা কেউ ‘নকল’ করেননি। ১৯৭২-৭৩ সালের এসএসসি/এইচএসসি পরীক্ষায় ৬২ বছরের বৃদ্ধ থেকে ১৪ বছরের কিশোর সবাই পাইকারি পরীক্ষা দিয়েছে। খুচরা দেয়নি। সেই যে জাতির শিক্ষা মেরুদণ্ড বাঁকা হয়েছিল তা আর সোজা হয়নি। সামরিক শাসন আমলে গণতন্ত্র ছিল না বটে, তবে গণটোকাটুকিও ছিল না। কোনো ব্যবস্থায় সবসময় সবকিছু ভালো-মন্দ থাকে না; মিশ্রণ-মিথস্ক্রিয়া ঘটে। বিএনপি আমলে শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিকতা দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। নকল ধরতে গিয়ে তৎকালীন শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে গেলেন। গত এক যুগ ধরে আবার ফিরে আসলাম গোড়ায়। ওয়ানস অ্যাগেইন অ্যাট দ্য স্টার্টিং পয়েন্ট।

আবার সেই দল। আবার সেই নকল। পাইকারি এবং খুচরা। তারা নির্বাচনে নকল করেছেন। সেই নকল এখন শিক্ষাঙ্গনেও চালু হয়েছে। তবে ১৯৭২ সালের পাইকারি নকল আর এবারের নকলের মধ্যে পার্থক্য আছে। সেটা ছিল অ্যানালগ। এখন তা ‘ডিজিটাল’। পরীক্ষার হলগুলোতে দেখা যায় ‘উপরে ফিটফাট-ভিতরে সদরঘাট’। ভিতরে পুস্তক দেখে লেখার বিষয়টি শিক্ষকমণ্ডলী নিশ্চিত করছেন। ডিজিটালের আরেকটি উপহার- প্রশ্ন ফাঁস। এতেও তারা ওয়ার্ল্ড রেকর্ড দাবি করতে পারেন। পঞ্চম শ্রেণী থেকে বিসিএস পরীক্ষা পর্যন্ত অনেকবার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এমবিবিএস-ডাক্তার হওয়ার পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে বারবার। পাঁচ বছর পর তা ধরা পড়েছে এবার। ‘সকলই নকল ভেল’। ছাত্ররা প্রশ্ন করে ‘যদি হয় প্রশ্ন ফাঁস, পড়ব কেন বারো মাস?’ অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। নির্বাচনের পর আড়ালে আবডালে তারা বলেছে, নির্বাচনে নকল হলে পরীক্ষায় দোষ কী?

ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গিনিপিগের পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করে দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। তারা শিক্ষাকে শক্তপোক্ত করার উদ্যোগ নেন। পরীক্ষা ছাড়া কি লেখাপড়া মানসম্মত হয়? শুরু হয়ে গেল ছয় বছরে তিন পরীক্ষা। পঞ্চম-অষ্টম-দশম। অপূর্ব মান অর্জন করতে চান তারা। গোটা পৃথিবীকে তারা দেখাতে চান, কিভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশ শনৈ শনৈ এগিয়ে চলেছে। পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যমতে, ২০১০ সালে শিক্ষার হার ছিল ৫৮.৬ শতাংশ। ১০ বছরে বেড়েছে ১৫ শতাংশ। রীতিমতো ‘হাইজাম্প’। অথচ এই সময়ে চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশ দীর্ঘ সময় পরে শতভাগ শিক্ষার হারে পৌঁছেছে। ওইসব দেশে শিক্ষার মান নিশ্চিত করা হয়েছে। সেসব দেশের কচ্ছপ গতি মনে ধরেনি আমাদের শিক্ষা অধিকর্তাদের। এখন খরগোশের মতো লাফ দিতে গিয়ে মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়ার উপক্রম। অবশেষে সংখ্যার পরে মানে উত্তীর্ণ হতে চাইছেন শিক্ষামন্ত্রী। এখন তিনি মানগত নয়, গুণগত শ্রীবৃদ্ধি চান। একসময় নির্দেশ ছিল ঘোড়া-গরু-ছাগল যাই হোক পাস করিয়ে দিতে হবে। এবার মন্ত্রীর আবদার, এসব ঘোড়া-গরু-ছাগলকে ‘মনুষ্যে পরিণত করিতে হইবে’। কিন্তু সবাইতো জানে, গাধা পিটিয়ে ঘোড়া করা যায়, মানুষ করা যায় না। আরো কথা আছে, ছাগল দিয়ে হাল চাষ হয় না। এ কথাগুলোর মর্মার্থ হলো- যেভাবে সংখ্যায় বেড়ে গেছে শিক্ষার হার, আসলে মানে তা পৌঁছে গেছে তলানিতে। উদ্ভট সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির প্রবর্তন হয়েছে কোনো রকম বাছ-বিচার না করেই। শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না দিয়ে এ পদ্ধতির প্রয়োগ হলো, ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার মতো। এতসব করছেন তারা উন্নয়নের দিশায়, অপূর্ব সুন্দরের নেশায়। হিন্দু পুরানে আছে, একবার বিশ্বকর্মা এক অপূর্ব সৃষ্টির নেশায় মেতে উঠলেন। মূর্তি গড়ায় শিল্পায়নে হলেন মনোযোগী। এক দিকে চুন দেন অপর দিকে ‘কুন’। এপাশ কাটেন তো ওপাশ ছাঁটেন। এভাবে বেশি করতে গিয়ে হয়ে গেল ছুঁচো। মানে ইঁদুরের ক্ষুদ্র সংস্করণ। আওয়ামী লীগ সরকারও এভাবে শিক্ষার্থীদের ছুঁচো বানিয়ে ফেলেছে।

এতে মৌলিক শিক্ষার কোনো উন্নতি হয়নি। মৌলিক শিক্ষা বলতে থ্রি ‘আর’- রিডিং, রাইটিং ও অ্যারিথমেটিককে বোঝানো হয়। একটি ছাত্র যেন ভালো করে পড়তে পারে, লিখতে পারে এবং হিসাব-নিকাশ করতে পারে। স্কুলে পরীক্ষার পর পরীক্ষা নিয়ে পরিণত করা হয়েছে পরীক্ষাকেন্দ্রে। তদুপরি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের-সরকারি কাজ ও অকাজে এত ব্যস্ত রাখা হয় যে তাদের দম ফেলবার সময় নেই। আর সিলেবাস? এর গুরুত্ব মাহাত্ম্য বর্ণনা করলে কয়েক দিস্তা কাগজ লাগবে। আমি কিছু দিন আমার কাজের মেয়েটার দুটো শিশুপুত্রকে পড়াবার কোশেশ করেছি। ওদের ইংরেজি পড়াতে ছাত্রকে হতে হবে ইংরেজিতে হাফেজ আর শিক্ষককে হতে হবে ইংরেজিতে গ্রেট স্কলার। যে কেউ তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণীর বই হাতে নিয়ে দেখতে পারেন। তবে হতে পারে আমি এমন গো গর্দভ যে, ডিজিটালের মহিমা বুঝতে অক্ষম। আমরা এমন সব বড় বড় ডিগ্রিধারী নাগরিক তৈরি করছি যারা অ্যাকাডেমিকভাবে এবং ব্যবহারিকভাবে অনুপযুক্ত। একটি এমএ পাস করা ছেলে যদি একটি দরখাস্ত শুদ্ধভাবে লিখতে না পারে সে শিক্ষা দিয়ে কী লাভ? আবার এমএ পাস ছেলেটি যদি চাকরি-বাকরি ও জগৎ সংসারে অচল বলে প্রমাণিত হয় তাহলে সে সমাজের গতি নয়, দুর্গতি ডেকে আনবে। এ কথার দ্বারা আমি এই বোঝাতে চাচ্ছি, যে যতটুকুই শিক্ষা লাভ করুক সে যেন ততটুকু ভালোভাবে শেখে। এই দেশের শিক্ষা এতটাই অচল, অপরিপক্ব ও পরিকল্পিত যে, শিক্ষা ভবিষ্যতে আমাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। এই দেশ ও সমাজের একটা অযাচিত প্রবণতা হলো ফুটানি দেখানো।

পারে না এসএসসির পাঠ অথচ হতে চায় এমএ পাস। জানে না কিছুই, চাকরি চায় ফার্স্ট ক্লাস। গোটা পৃথিবীতে ইন্টারমিডিয়েট ডিগ্রিটা হচ্ছে বেসিক। এরপর যে যার মেধা অনুযায়ী বিশেষ জ্ঞানে মনোযোগী হবে। এখন যেমন ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ছেলেরা ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বা কৃষিবিদ হচ্ছে ঠিক তদ্রূপভাবে ইন্টারমিডিয়েটকে চাকরির ভিত্তি হিসেবে ধরতে হবে। যদি কেউ প্রথম শ্রেণীর চাকরি পায় সে ইনসার্ভিস হিসেবে সে বিষয়ক ডিগ্রি অর্জন করতে পারে যেমন করে সেনাবাহিনীর লোকেরা। অতিসম্প্রতি কয়েকজন বিজ্ঞ ব্যক্তি প্রশাসন বা উঁচু চাকরিতে ঢুকতে ইন্টারমিডিয়েটকে ভিত্তি করার পরামর্শ দিয়েছেন। আমার মনে হয় প্রস্তাবটি যৌক্তিক। যে হারে আমরা লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার তৈরি করছি তা সময়, শ্রম ও মেধার অপচয় মাত্র।

আওয়ামী লীগ সরকার যতবারই ক্ষমতায় এসেছে ততবারই জাতির ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য নানা ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পরে সবাই ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু গোটা জাতিকে ত্যাগের পরিবর্তে ভোগের দিকে ঠেলে দেয়া হয়। পরীক্ষার সর্বনাশের কথা আগেই বলেছি। এখন ’৭১ সালের মতোই একটি জাতীয় দুর্যোগ আমরা অতিক্রম করছি। অনিবার্য প্রয়োজনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখতে হয়েছে। ক্লাস হয়নি। পরীক্ষা হয়নি। এখন কানাঘুষা চলছে যে, এইচএসসি পরীক্ষা বা অনার্স ও মাস্টার্স লেভেলের পরীক্ষাগুলোতে অটো প্রমোশন দেয়া যায় কিনা। সংক্ষিপ্ত পরীক্ষা নিলে জ্ঞানটিও সংক্ষিপ্ত হবে। নীতিগতভাবে আমাদের সবাইকে মেনে নিতে হবে যে, পাস করতে হবে পরীক্ষা দিয়ে। করোনাভাইরাস সবার জন্যই সর্বনাশ ডেকে এনেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনলাইন ক্লাস নিয়ে ক্ষতি পূরণের চেষ্টা হয়েছে। এতে দেশের পিছিয়ে পড়া মধ্যবিত্ত ও গরিব মানুষের সন্তানদের কোনো উপকার হয়নি। শহুরে বিত্তবান ও গ্রামীণ কারিগরী সমৃদ্ধ পরিবারগুলোই লাভবান হয়েছে। যে ব্যবস্থাটি সব মানুষের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করে না তা জাতীয় নীতিমালা হিসেবে গৃহীত হতে পারে না। আমাদের তেলা মাথায় তেল দেয়ার নীতি পরিত্যাগ করতে হবে। সবার ক্ষতি সমভাবে ভাগ করে নিতে হবে। আমার প্রস্তাব হচ্ছে, প্রয়োজনে সব স্তরে এক বছরের একাডেমিক লস মেনে নিয়ে নতুন করে ভাইরাস- পরবর্তীকালে পুনরায় পড়াশোনা শুরু করা। কিন্তু পুঁজিশাসিত স্বার্থবাদী এই সমাজে এটি গ্রহণ ও প্রয়োগ দুটোই কঠিন। সে ক্ষেত্রে সরকারের কাঠিন্যই জবাব। সস্তা জনপ্রিয়তার দিকে না তাকিয়ে, সংক্ষিপ্ত পদ্ধতি গ্রহণ না করে পরীক্ষার মধ্যেই সার্থকতা খুঁজতে হবে।

করোনাকালীন শর্তসাপেক্ষে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। হয়তো মাধ্যমিক স্কুলগুলোও খুলে দেয়া হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে সাড়াশব্দ নেই। এখন বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি অস্থিতিশীল। কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না, কখন কী অবস্থার সৃষ্টি হয়। তবে এটা সবার উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয় যে, এভাবে কতকাল আর অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকবে শিক্ষাঙ্গন। ছাত্ররা প্রতিদিনই ফোন করছে, কখন তারা ফিরে যেতে পারবে ক্লাসে। গণমাধ্যমে তাদের আহাজারি শোনা যায়। শুনা যায়, কোথাও কোথাও শিক্ষাঙ্গন খুলে দেয়ার জন্য তাদের সমবেত আবেদনের প্রকাশ ঘটেছে। করোনাভাইরাসের এই দেশে এখন বের হলে এটা বোঝার কোনো উপায় নেই যে, দেশটি স্বাভাবিক নয়। আসলে মানুষের সহ্যপ্রবণতা ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লকডাউনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভও হয়েছে। ভাবখানা এই যে, ‘অনলে পুড়িয়া মরিতে চায়’, আগুন দেখেও ঝাঁপ দিতে চায়। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের আর্তিও ভিন্ন কিছু নয়। সমাজে যেভাবে ‘স্বাভাবিকতা’ সৃষ্টি করা হয়েছে ধাপে ধাপে, ক্রমান্বয়ে কিছু কিছু বিধি-নিষেধের বেড়াজালে ঠিক তেমনি দেশে সব শিক্ষাঙ্গন বাধ্যবাধকতার মধ্যেই খুলে দেয়া হোক। আমরা করোনার অন্ধকারে আছি। শিক্ষার আলো হয়তো ভরিয়ে দিতে পারবে আমাদের হৃদয়-মন।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com

 


আরো সংবাদ



premium cement