২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’

‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’ - ছবি : নয়া দিগন্ত

সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু’। তা তিনি কেন বলেছিলেন আমার উপলব্ধিতে আসেনি। যিনি একজন দার্শনিক, কবিকুলের শিরোমনি, জমিদারের দুলাল জমিদার, তার মনে কি ব্যথা ছিল, যার কারণে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন? জমিদারদের অত্যাচারের কাহিনীর পাশাপাশি নগণ্য হলেও কিছু জমিদারের বদান্যতার কথাও শোনা যায়। মীর মশাররফ হোসেন ও ফকির লালন শাহ রবীন্দ্রনাথের পিতার সাথে দেখা করে কুষ্টিয়া পরগনার গরিব কৃষকদের খাজনা বৃদ্ধি না করার জন্যও আবেদন নিবেদন করার কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়। ঠাকুরের নিজ রচিত কাদম্বরী নাটকের তথ্য মতে, পরিবার থেকে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য তাগিদ দেয়ার পরও লন্ডনগামী জাহাজ থেকে নেমে গিয়ে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন এবং ব্যাপক সফলতাও লাভ করেন। এতে বিত্ত-বৈভবের মধ্যে থেকেও কেনই বা তিনি ‘ক্লান্ত’ হয়ে প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করলেন?

প্রসঙ্গক্রমে উল্লিখিত বক্তব্যের সূত্র ধরেই বলতে চাই, বিত্ত-বৈভবের মধ্যে থেকেও মানুষ ক্লান্ত হয়। সরকারি দল তো বটেই এর চেয়ে বেশি গলা উঁচু করে সরকারি ঘরানার বুদ্দিজীবীরা বাংলাদেশকে বিশ্বের মধ্যে উন্নয়নের রোলমডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় লিপ্ত। দেশে পদ্মা সেতু হচ্ছে, এটি দেশবাসীর দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার ফসল। উন্নয়নের অনেক কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু দেশে প্রতি ক্ষেত্রে সিস্টেম লসের কারণে জাতি তো হয়রান হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রের সেবামূলক প্রতিষ্ঠান যেমন- গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি সরবরাহ, টেলিফোনসহ সরকারি অফিসে ঘুষ ছাড়া কোনো সেবা পাওয়া সম্ভবপর হয় না।

গত সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা থানাধীন পশ্চিম তল্লা বাইতুস সালাহ জামে মসজিদে এশার নামাজ আদায় করার সময় ইমাম, মোয়াজ্জিনসহ ৩৭ জন অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন। ইতোমধ্যে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩১ জন মৃত্যুবরণ করেছেন এবং শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটের (হসপিটাল) তথ্য মতে, একজন ব্যতীত সবার অবস্থাই আশঙ্কাজনক এবং মৃত্যুর জন্য দিন গুনছে (আল্লাহ তাদের বাঁচিয়ে রাখুন কামনা করি, কারণ একটি মৃত্যুর সাথে একটি পরিবার অসহায় হয়ে পড়ে)। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, জেলা প্রশাসকের বক্তব্য, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বক্তব্য মতে- মসজিদের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত পাইপের লিকেজ থেকে ক্রমাগত গ্যাস নির্গত হওয়া জমাটবদ্ধ গ্যাস থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ৩৭ জন মানুষ নির্মমভাবে দগ্ধ হয়েছেন। স্থানীয় জনসাধারণ বলছে, গত দুই মাস ধরেই গ্যাস পাইপ লিক হয়ে গ্যাস বুদবুদ আকারে বের হয়েছে এবং বিষয়টি তারা তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবিকৃত ৫০ হাজার টাকা পরিশোধ না করায় গ্যাসলাইন মেরামত করেনি। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই, মসজিদ কমিটি বা স্থানীয় জনগণ ঘুষ দাবি করার বিষয়ে মিথ্যা কথা বলছে। তারপরও কথা থাকে। গ্যাসলাইন সংযোগ দেয়া যেমন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব, ঠিক তেমনি গ্যাস পাইপলাইন বা সংযোগ যথাযথভাবে মেইনটেইন করার দায়িত্বও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ওপর অবশ্যই রয়েছে। যদি তাই না হয় তবে ঘটনার পরে তিতাস গ্যাস কোম্পানি তাদের আটজন কর্মচারীকে সাসপেন্ড করে কৈফিয়ৎ তলব করল কেন? তা ছাড়া ৫০ হাজার টাকা ঘুষদাবির অভিযোগ (মোটা দাগে) বিশ্বাস না করার কী যুক্তি রয়েছে? বাংলাদেশের কোনো সরকারি অফিসে ঘুষ ছাড়া কি প্রার্থিত ন্যায্য সেবা পাওয়া যায়?

বিবেচ্য বিষয় হলো- নামাজরত ৩৭ জন মানুষের জীবন্ত দগ্ধ হওয়ার দায় রাষ্ট্র কি এড়াতে পারে? বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ অনুচ্ছেদে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ রয়েছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হইতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’ অথচ এই ক্ষতিগ্রস্তদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের প্রশ্নে রাষ্ট্রই প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কখনো বলা হচ্ছে, গ্যাসলাইন অবৈধ, কখনো বলা হচ্ছে, মসজিদ নির্মাণ অবৈধ, কখনো বলা হচ্ছে, দ্বিতীয় বিদ্যুৎ সংযোগটি অবৈধ প্রভৃতি। বৈধ-অবৈধ বিষয় দেখাশোনার জন্য জনগণের অর্থায়নে অনেকগুলো দফতর, বিভাগ, অধিদফতর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা-স্বায়ত্তশাসিত এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার কর্মকর্তাদের রাষ্ট্র গাড়ি, বাড়ি ও মোটা অঙ্কের বেতন দিয়েই লালনপালন করে। মসজিদ যদি অবৈধভাবে নির্মিত হয়ে থাকে তবে রাজউক বিষয়টি প্রতিরোধ করল না কেন? অবৈধভাবে কোনো ভবন নির্মিত হলে তা অপসারণ করার দায়িত্ব আইনগতভাবে রাজউককে দেয়া আছে, যেহেতু সংশ্লিষ্ট এলাকা রাজউক অন্তর্ভুক্ত। বিদ্যুৎ লাইনগুলো নিয়মিত চেকআপ করার দায়িত্ব বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের, যারা প্রতি মাসে মিটার রিডিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিল আদায় করে, বিদ্যুতের কোন সংযোগ বৈধ, কোন সংযোগ অবৈধ তা দেখার দায়িত্ব কি বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষের নেই? তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের নিজস্ব তদন্ত কমিটির ভাষ্য মতে- মসজিদ সংলগ্ন গ্যাস সংযোগ পাইপে ছয়টি লিক পাওয়া গেছে (সূত্র : জাতীয় পত্রিকা, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০)। এই লিক (ছিদ্র) বন্ধ করা বা মেরামত করার দায়িত্ব কি তিতাস কর্তৃপক্ষের ছিল না? স্বীকৃত মতেই গ্যাস, বিদ্যুৎ বা ওয়াসার পানির অনেক অবৈধ সংযোগ রয়েছে, যা থেকে রাষ্ট্র কোনো প্রকার রাজস্ব পায় না, কিন্তু সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মচারীদের ঘুষ নামক বাড়তি অর্থ না দিয়ে কেউ অবৈধ সংযোগ চালাতে পারে না। আমার জানা মতে, গ্যাসের ব্যাপক অবৈধ সংযোগ রয়েছে, যা সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারেই লেনদেনের বিনিময়ে হচ্ছে।

রেল কর্তৃপক্ষের সৃষ্ট গর্তে পড়ে শিশু মৃত্যু, সরকারি রাস্তার গর্তে পড়ে পথচারী পঙ্গু বা মৃত্যু, ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু, ডাক্তারি সার্টিফিকেট না থাকলেও ডাক্তারি পেশায় নিয়োজিত থাকার অমানবিক ও পৈশাচিক ঘটনার কাহিনী এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। অধিকন্তু সড়ক ও জলপথের দুর্ঘটনার মহামারী তো রয়েছেই। জীবিকার সন্ধানে কাঠের নৌকায় চোরাপথে সমুদ্রে ডুবে মরছে শত শত নর-নারী। তারপরও রাষ্ট্রযন্ত্রের এ মর্মে কোনো হুঁশ হচ্ছে না।

একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি মূল্যবান সম্পদ, হোক সে হতদরিদ্র বা রাজাধিরাজ। বাংলাদেশে ভিআইপি (Very Important Person), ভিভিআইপি (Very Very Important Person) নামক দুইটি শ্রেণী সৃষ্টি হয়েছে, তারাই এখন রাষ্ট্রের সব সেবা পাচ্ছে, আর যারা হতদরিদ্র অকাতরে মৃত্যুই যেন তাদের প্রাপ্য। চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভিআইপি ও ভিভিআইপিদের জন্য হেলিকাপ্টারে সেবা পাওয়ায় আমার আপত্তি না থাকলেও হতদরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্য বিত্তরা রাষ্ট্র থেকে কাক্সিক্ষত সেবা পাচ্ছে কোথায়? সরকারি আমলারা মনে করে, তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর সরকারি দলের আশীর্বাদপুষ্ট হলে তো কথাই নেই। এ জন্য কোনো প্রকার বাছবিচার ব্যতিরেকেই প্রজাতন্ত্রের সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী এখন সরকারি দলভুক্ত। ফলে তাদের কোনো লোকসান হচ্ছে না, বরং জনগণের গলা কেটে অবৈধ পন্থা তথা এ ধরনের অবৈধ সংযোগ থেকে প্রচুর অর্থ রুজি করছে।

সরকারি আমলারা ধরাছোঁয়ার বাইরে, তারপরও সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সরকারের অনুমতি ব্যতীত সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা নেয়া যাবে না। গত ৯ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আইন ও বিচার বিভাগের সচিব বরাবর পাঠানো চিঠিতে সরকারের অনুমতি ব্যতীত কোনো আমলার বিরুদ্ধে মামলা না নেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। চিঠিতে আরো বলা হয়, অপরাধ প্রতিরোধ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কার্যক্রম অধিকতর

কার্যকর ও গতিশীলতার সাথে সম্পাদনের জন্য পরিচালিত মোবাইল কোর্টের কার্যক্রমের বিষয়ে মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ এর ১৪ ধারায় বিধান রয়েছে, এই আইন বা তদ্দিন প্রণীত বিধির অধীন সরল বিশ্বাসে কৃত বা কৃত বলে বিবেচিত কোনো কাজের জন্য কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে, তিনি মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকারী এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বা মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে কোনো দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো প্রকার আইনগত কার্যধারা রুজু করতে পারবেন না।’

মহামান্য হাইকোর্ট হস্তক্ষেপ করায় নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের বিচার হয়েছে, অন্যথায় আশঙ্কা ছিল সন্ত্রাসী বা জঙ্গিদের ক্রসফায়ার বলে চালিয়ে দেয়া হতো। কারণ সাত খুনে যাদের ফাঁসি হয়েছে তাদের দ্বারা বাংলাদেশে আরো খুন হয়েছে, কিন্তু কোনো বিচার হয়নি, বলা হয়েছে ‘এনকাউন্টার’। পুলিশ হেফাজতে পল্লবী থানায় জনিকে পিটিয়ে হত্যা মামলায় তিন পুলিশের যাবজ্জীযন কারাদণ্ড হয়েছে। আদালত হস্তক্ষেপ করেছে বলেই জনি হত্যার বিচার হয়েছে। টেকনাফের ওসি প্রদীপ নিজেও একজন সরকারি আমলা, মিডিয়ার ভাষ্য মতে, যার হাতে ১৩৪ জন ক্রসফায়ার নামান্তর খুন হয়েছে। এ ধরনের প্রদীপ দাস বাংলাদেশের সব জেলা, থানা ও দফতরে রয়েছে। তাদেরকে রক্ষা করার জন্যই কি সরকার জনগণের আদালতে যাওয়ার দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে?

বাংলাদেশে অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু, অবহেলাজনিত মৃত্যু, দুুর্ঘটনায় মৃত্যু, সমুদ্রে সলিল সমাধি, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে মৃত্যু, হতদরিদ্র, নিম্ন মধ্যবিত্তদের ও মধ্যবিত্তদের রাষ্ট্রীয় চিকিৎসাসেবা না পেয়ে প্যারাসিটামল দুই বেলা খেয়েই রোগ নিবারণের সান্ত্বনা পেতে হচ্ছে, এক সংস্থা রাস্তা নির্মাণ সমাপ্ত হওয়ার পরই অন্য সংস্থা খোঁড়াখুঁড়ি শুরু করে, পরীক্ষার শেসনজটে গরিব মা-বাবার নাভিশ্বাস, সামাজিক নিরাপত্তার অভাবে সাধারণ মানুষের সন্ত্রাসী ও প্রভাবশালীদের কাছে আত্মসমর্পণ তদুপরি বাংলাদেশের টাকা বিদেশে পাচার হওয়ার মহোৎসব জাতিকে ক্লান্ত করে ফেলে, তাই জাতি আজ বলতে চায়, ‘ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো, হে প্রভু’।
লেখক : রাজনীতিক ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)

E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement