২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মাদকবিরোধী যুদ্ধ বনাম বিচারবহির্ভূত হত্যা

মাদকবিরোধী যুদ্ধ বনাম বিচারবহির্ভূত হত্যা - ছবি : নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশে মাদকবিরোধী অভিযানে বিনা বিচারে হত্যার অভিযোগ নিয়ে তীব্র সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করেছে অনেক আগেই। ২০১৮ সালে যখন ‘মাদকবিরোধী যুদ্ধ’ শুরু হয়, জনগণের মাঝে আশার সঞ্চার হয়েছিল। তাদের প্রত্যাশা ছিল যে, মাদক চোরাচালান, পরিবহন ও বিপণন একেবারে বন্ধ না হলেও সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে এবং মাদক কারবারি ও গডফাদাররা আইনের আওতায় বিচারের সম্মুখীন হবে।

ইতোমধ্যে বিপুলসংখ্যক ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে এবং অনেক মাদক কারবারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতারও হয়েছে। কিন্তু ইয়াবা ব্যবসা নির্মূল করা যায়নি। বাহক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা কারবারি ধরা পড়লেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত গডফাদার ও সিন্ডিকেট সদস্যরা রয়েছে ‘ধরাছোঁয়ার বাইরে’। মেজর (অব:) সিনহা রাশেদ খানের হত্যার তদন্ত নিয়ে যখন স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যতিব্যস্ত, তখন ৬০ কোটি টাকা মূল্যের ১৩ লাখ ইয়াবার একটি বড় চালান কক্সবাজারের বাঁকখালি নদী থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। নৌকা থেকে খালাসের সময় এক কোটি টাকার ইয়াবা লুটও হয়ে যায়। এতে বুঝা যায় মাদকসংশ্লিষ্ট রাঘববোয়ালরা কত শক্তিশালী।

বিগত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে পেশাজীবী এবং নানা বয়সী মানুষ বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে ‘ইয়াবা’ আসক্তি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন মতে, ২০১৭ সালে বিভিন্ন সংস্থা উদ্ধারই করেছে চার কোটি ইয়াবা, যা ২০১৫ সালের দ্বিগুণ। এ থেকেই দেশে ইয়াবাসেবীদের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৪ মাসে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব ও কোস্টগার্ড মিলে উদ্ধার করেছে তিন কোটি ৫৩ লাখ ২৫ হাজার ৬১০ পিস ইয়াবা। জানা গেছে, মিয়ানমারে প্রতি পিস ইয়াবার দাম পড়ে গড়ে ৩০ টাকা। এই হিসাবে উদ্ধার হওয়া ও উদ্ধারের বাইরে থাকা সব মিলিয়ে ৩০ কোটি ইয়াবার মূল্য বাবদ ৯০০ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে মিয়ানমারে (ডয়চে ভেলে, ১৯ জুন, ২০১৮; কালের কণ্ঠ, ২৬ আগস্ট, ২০২০)
মাদকবিরোধী যুদ্ধাভিযান শুরুর পরপরই দেখা গেল, মিয়ানমার-কক্সবাজার সীমান্তে ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘এনকাউন্টার’ বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ১৫ মে থেকে ২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট পর্যন্ত মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ৪২৪ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে র‌্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত ১১৯ জন, পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে ২১৫ জন, গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাথে বন্দুকযুদ্ধে ৪৮ জন, বিজিবি ও র‌্যাবের যৌথ অভিযানে ৩ জন এবং বিজিবির সাথে বন্দুকযুদ্ধে ৩৯ জন নিহত হয়। এর বাইরে ৩২ জনের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বিবিসির মতে, মাদকবিরোধী যুদ্ধে প্রতিদিন একজন করে মানুষ ক্রসফায়ারে মারা যাচ্ছে।

২০১৯ সালের ২৬ মে টেকনাফে কথিত বন্দুকযুদ্ধে সেখানকার পৌর কাউন্সিলর ও স্থানীয় যুবলীগের সাবেক সভাপতি মো. একরামুল হকের নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে রেকর্ড করা অডিও কিছু সংবাদমাধ্যমে বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছিল। তাকে বাসা থেকে র‌্যাব এবং ডিজিএফআই এর স্থানীয় দু’জন কর্মকর্তা ডেকে নেয়ার পর হত্যা করা হয় বলে তার পরিবার অভিযোগ করেছে। কিন্তু, র‌্যাব বলেছে, প্রকাশ হওয়া অডিও খতিয়ে দেখছে তাদের সদর দফতর। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বিবিসি বাংলাকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিবর্ষণের অন্যান্য ঘটনার মতো এ ঘটনাও তদন্ত করা হবে। বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ঐ অডিও আমি শুনিনি। না দেখে তো বলতে পারব না যে, কী অডিও বের হয়েছে। এটা আমরা সবসময় বলছি, কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে বা অন্যায়ভাবে কিছু করে থাকে, তারতো একটা ম্যাজিস্ট্রারিয়াল ইনকোয়ারি হচ্ছে এবং হবে। সেখানে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তারও বিচার হবে। সেটা আমরা সবসময় বলে আসছি। কিন্তু এটা অডিও না দেখে আমি বলতে পারব না’ (বিবিসি, বাংলা, ২ জুন,২০১৮)।
জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার সংস্থাসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধসহ একরামের মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের আহ্বান জানিয়েছে। সরকারের মাদকবিরোধী অভিযানের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ম্যাজিসটারিয়াল ইনকোয়ারির মাধ্যমে যুবলীগ নেতা একরাম হত্যার যদি সুষ্ঠু তদন্ত হতো এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনা যেত তাহলে মেজর (অব:) সিনহার হত্যা রোধ করা যেত।

গত দুই বছরে প্রদীপ কুমার ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীর হাতেই ১৪৪টি কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’-এ নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া দুই দফায় ১২৩ ইয়াবা কারবারিকে আত্মসমর্পণও করান ওসি প্রদীপ কুমার। কিন্তু এতকিছুর পরও থামেনি ইয়াবা পাচার। এর মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা নিহত হওয়ার পর ওসি প্রদীপের ওইসব গর্হিতকর্ম নিয়েও নানা প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। ইয়াবা নির্মূলের নামে টেকনাফ পুলিশের কথিত ক্রসফায়ার ও আসামি বাণিজ্যের বিষয়ও জোরালোভাবে আলোচিত হচ্ছে (http://www.ukhiyanews.com/HYPERLINK "http://www.ukhiyanews.com/10"10June, 2020)। তদন্তে সব বিষয় বেরিয়ে আসবে এবং অপরাধীরা শাস্তি পাবে- এমনটা আশা করছেন টেকনাফ-কক্সবাজারের জনগণ।

২০১৮ সালের ৪ মে থেকে সারা দেশে মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু করে সরকার। এতে অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায় ক্রসফায়ারের পরিসংখ্যান। গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত শুধু কক্সবাজার জেলায় পুলিশ, বিজিবি ও র‌্যাবের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় নিহত ২৮৭ জন। এর মধ্যে পুলিশের সাথে ১৭৪, বিজিবির সাথে ৬২ ও র‌্যাবের সাথে ৫১ জন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। আর টেকনাফে পুলিশের সাথে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত ১৬১ জন। এমন অভিযানের পরও কমেনি মাদকের চোরাচালান বরং কিছু ক্ষেত্রে মাদকের সরবরাহ বাড়ার তথ্য মিলছে। এমন বাস্তবতায় মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানের নামে কথিত ক্রসফায়ারের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে। পৃথিবীর কোনো দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড চালিয়ে মাদকব্যবসা বন্ধ করা যায়নি। মাদকাসক্তির কবল থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মেক্সিকো, ব্রাজিল এবং কলম্বিয়াসহ এশিয়া ও ল্যাটিন অ্যামেরিকার বেশ কয়েকটি দেশ ‘ক্রসফায়ার’ সংস্কৃতি চালু করেও কিন্তু সরকারের সব প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। সামাজিক পরিসরে ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়, সরকারের পরিবর্তন ঘটে, এমনকি গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বিনষ্ট হয়েছে। মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে ২০০৩ সালে ‘বন্দুকযুদ্ধ সংস্কৃতি’ চালু করেন থাইল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা। সেদেশে ২,৮১৯ জনের মৃত্যু হয় মাত্র তিন মাসে। থাকসিনের সে অভিযান সফল হয়নি, দেশকে মাদকমুক্ত করতে পারেননি। প্রথম দিকে কিছুটা জনসমর্থন থাকলেও পরে দেশে অস্থিরতা ও নৈরাজ্য তৈরি হয় এবং সে সুযোগে ২০০৬ সালে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নেয়।

২০১৬ সালে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে মাদকের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান ঘোষণা করেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে জানা যায়, পুলিশ এবং তাদের অ্যাজেন্টরা আত্মরক্ষার মিথ্যে অজুহাতে এই হত্যায় অংশ নেয়। ২০১৬ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত মাদকবিরোধী যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ২০ হাজার ৩২২। গড়ে প্রতিদিন ৩৯.৪৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এতদসত্ত্বেও মাদকসমস্যা নির্মূল হয়নি। মেক্সিকো, ব্রাজিল এবং কলম্বিয়াও বিচারবহির্ভূত হত্যা চালিয়ে মাদক সমস্যা মোকাবেলায় ব্যর্থ হয়েছে। ১৯৯০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত কলম্বিয়ায় মাদকসংশ্লিষ্ট হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা সাড়ে চার লাখ। মেক্সিকোতে ২০১৩ সালে নিহতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে এক লাখ ২০ হাজার। আর গুম হয়েছেন ২৭ হাজার। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, ব্রাজিলে মাদকবিরোধী যুদ্ধে পুলিশের অভিযান মানে মৃত্যু। সরকারি তথ্য অনুসারে, ২০১৪ সালেই ব্রাজিল পুলিশ তিন হাজার মানুষকে হত্যা করেছে।

এসব দেশে মাদকবিরোধী যুদ্ধে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটলেও এর সফলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে জাতিসঙ্ঘ। বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা। জাতিসঙ্ঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক সংস্থার প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৫ সালে অন্তত একবার মাদক গ্রহণ করেছেন এমন মানুষের সংখ্যা ২৫ কোটি। এদের মধ্যে প্রায় তিন কোটি (২৯.৫ মিলিয়ন) মানুষ মাদকসংশ্লিষ্ট রোগে আক্রান্ত (বাংলা ট্রিবিউন, ২৮ মে, ২০১৮)। মাদকনির্মূলের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার রাষ্ট্রীয় অনুমোদন থাকায় এক শ্রেণীর পুলিশ ও র‌্যাব সদস্যের কাছে মানুষহত্যা তুচ্ছ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার সুযোগ থাকায় তাঁরা অনেকেই লোভের শিকার হচ্ছেন এবং অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। নারায়ণগঞ্জ ও টেকনাফের ঘটনা আমাদের চোখে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে দিচ্ছে, বিচারবহির্ভূত হত্যার অপসংস্কৃতি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বন্ধ করে দিতে হবে। যে কোনো ব্যক্তির পকেটে ইয়াবার পুরিয়া ঢুকিয়ে দেয়া, চালান দেয়ার হুমকি দিয়ে অর্থ আদায় করা এবং চাহিদা মাফিক অর্থ না পেলে ক্রসফায়ারে দেয়া সম্পূর্ণ অমানবিক, অনৈতিক ও অসাংবিধানিক। এর পাশাপাশি পলিটিক্যাল কিলিং ও কন্ট্রাক্ট কিলিং এর মতো জঘন্য ও গর্হিত কাজেরও অভিযোগ উঠেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অনেকের বিরুদ্ধে। বিবিসি, ডয়চে ভেলে ও গার্ডিয়ানের মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এসব খবর গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হচ্ছে। এতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হচ্ছে। ক্রসফায়ার তথা বিচারবহির্ভূত হত্যার অপসংস্কৃতি চালু হয়েছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সিরাজ শিকদার হত্যার মাধ্যমে। বিএনপি সরকার র‌্যাব তৈরি করে সেই সংস্কৃতিকে বেগবান করে তোলে। বর্তমান সরকার শতভাগ সেই ‘উত্তরাধিকার সংস্কৃতি’কে লালন করে আসছে। নির্বাচন প্রক্রিয়া বা কে ক্ষমতায় থাকবে এটা নিয়ে দ্বন্দ্ব ও বিতর্ক থাকলেও বিচারবহির্ভূত হত্যার ব্যাপারে তৎকালীন বিএনপি ও বর্তমান আওয়ামী লীগের আইনমন্ত্রীর বক্তব্য একই। নিউজ আর্কাইভে সব তথ্যের রেকর্ড রয়েছে। আসলে এই দু’দলের শ্রেণীচরিত্রে মৌলিক ফারাক বেশি নেই।

বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরা আমাদেরই ভাই ও সন্তান। জনগণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তৎকালীন ইপিআর ও পুলিশ বুকের রক্ত দিয়ে আমাদের দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। সীমান্ত রক্ষা, আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা, চোরাকারবার, মাদক পাচার, অপরাধ ও সন্ত্রাস নির্মূলে তাদের ভূমিকা গৌরবোজ্জ্বল। সাম্প্রতিক করোনা পরিস্থিতিতে পুলিশ সদস্যরা আর্তমানবতার সেবায় যে অবদান রেখেছেন তা গর্ব করার মতো। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাদের আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে গড়ে তোলার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশ বাহিনীর মধ্যে বিপুল সংখ্যক সদস্য সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন। সড়কে দায়িত্বপালনকারী পুলিশের একহাতে লাঠি অপর হাতে তাসবিহ দেখা যায়; তখন মানুষ আশাবাদী হয়ে ওঠে।
সেনাসমর্থিত সরকারের আমলে পুলিশ বাহিনীর সংস্কার নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এর পর এটা ধামাচাপা পড়ে যায়। সংস্কার সময়ের দাবি। পুরনো আইন ও বিধি বেশি দিন চলতে পারে না। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে কমবেশি প্রতিটি সরকারের আমলে রাজনৈতিক ও দলীয় স্বার্থে পুলিশের অপব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বিরোধী দলের কর্মী ও নেতাদের দমনে পুলিশের ব্যবহারের ফলে পেশাদারিত্বের অপরিহার্য গুণ লোপ পেতে থাকে ধীরে ধীরে। ফলে পুলিশ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’ এই ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে হবে। র‌্যাব বা পুলিশ বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা নয়, তারা আমাদের সমাজের অংশ। সমাজকে পরিশুদ্ধ করা না গেলে, তাদের কাছ থেকে শতভাগ শুদ্ধাচার আশা করা যায় না। ব্যক্তি বিশেষের অপরাধ ব্যক্তির অপরাধ হিসেবে গণ্য করা উচিৎ। এর জন্য নির্দিষ্ট বাহিনী বা সংস্থা দায়ী হতে পারে না। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ বছরে ১ লাখ ২০ হাজার ১৯১টি ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তারা সবাই কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার। মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ঘুষ, নানাভাবে হয়রানি, স্ত্রীকে ভরণ-পোষণ না দেয়া ও যৌতুকের জন্য নির্যাতন, ভুক্তভোগীর মামলা দায়েরের পর পদক্ষেপ না নেয়া এবং জমিজমা-সংক্রান্তসহ নানা অভিযোগে তাদের বিভাগীয় শাস্তি দেয়া হয়। ২০১৭ সালে ১৪ হাজার ৬৫৮ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ১১ হাজার সদস্যই কনস্টেবল থেকে সাব ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার। এই বছর এএসপি থেকে তদূর্ধ্ব মাত্র ৮ জন কর্মকর্তাকে লঘুদণ্ড (তিরস্কার, দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি) দেয়া হয়েছে। ২০১৭ সালে এএসপি থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের কেউ গুরুদণ্ড পাননি। ২০১৬ সালে এএসপি থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে দু’জনকে শাস্তি দেয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে একজনকে লঘুদণ্ড, অন্যজনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছে। এই গুরুদণ্ড পাওয়া ব্যক্তি হলেন স্ত্রী মিতু খুন হওয়ার ঘটনায় আলোচিত এসপি বাবুল আক্তার (বাংলা ট্রিবিউন, ঢাকা, ৭ অক্টোবর, ২০১৯)।

২০১৯ সালে এ পর্যন্ত দু’জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। তারা হচ্ছেন ডিআইজি মিজানুর রহমান এবং এসপি পদমর্যাদার উপ-কমিশনার (ডিসি) ইব্রাহিম খান। ডিআইজি মিজানকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলায় কারাগারে পাঠানোর পর তাকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। একইভাবে পুরান ঢাকায় এক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি দখলে সহযোগিতার অভিযোগে লালবাগ জোনের সাবেক ডিসি মো. ইব্রাহিম খানকে গত আগস্ট সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পিআরবি-১৮৬১ (পুলিশ প্রবিধান) অনুযায়ী, কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ালে তার বিরুদ্ধে দুই ধরনের বিভাগীয় শাস্তির (লঘু ও গুরু) বিধান আছে। গুরুদণ্ডের আওতায় চাকরি থেকে বরখাস্ত, পদাবনতি, পদোন্নতি স্থগিত, বেতনবৃদ্ধি স্থগিত ও বিভাগীয় মামলা হয়। মামলায় অপরাধ প্রমাণিত হলে বরখাস্ত করা হয়। গুরুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ আছে। ছোট অনিয়ম বা অপরাধের জন্য দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার, অপারেশনাল ইউনিট থেকে পুলিশ লাইনস বা রেঞ্জে সংযুক্ত করে লঘুদণ্ড দেয়া হয়। বিসিএস ক্যাডারের পুলিশ কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও সরকারি চাকরি আইন-২০১৮ (শৃঙ্খলা ও আপিল) অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। এএসপি থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ খতিয়ে দেখতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনপ্রশাসন বিভাগে একজন যুগ্ম সচিবের অধীনে একটি সেল রয়েছে (প্রাগুক্ত)। বিচারবহির্ভূত হত্যার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে বিদ্যমান বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি হবে। বিচারের দীর্ঘপ্রক্রিয়াকে সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখে না। ক্রসফায়ারে কোনো মাদকব্যবসায়ী বা গডফাদারের মৃত্যু হলে মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে স্বাগত জানায়। কিন্তু এর পরিণতি যে কত ভয়াবহ হয় তা জানতে ও বুঝতে বেশি দিন সময় লাগে না। প্রয়োজনে সিভিল ও ফৌজদারি দণ্ডবিধি ও আইনের ধারা সংশোধন করে বিচারব্যবস্থাকে সহজলভ্য করা একান্ত জরুরি। আইন কমিশন গঠন করে বছরের পর বছর মামলা ঝুলে থাকা বা রাখার যে ‘নিয়ম’ চালু হয়েছে তা ভাঙতে হবে। বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ করা না গেলে আইনের শাসন ভেঙে পড়বে এবং বিচারব্যবস্থা মুখ থুবড়ে পড়বে। সব নাগরিকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তার অধিকার রক্ষায় সহযোগিতা করতে পুলিশের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। দেশের প্রত্যেক নাগরিকের বিচারপ্রার্থী এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার নিশ্চিত হওয়ার সুযোগ না থাকলে উন্নয়নের চাকা আটকে যাবে। ইতিহাস প্রমাণ করে, কালো আইন অথবা এক্স্ট্রা জুডিশিয়াল কিলিং বুমেরাং হয়েছে অথবা ফ্র্যাংকেনস্টাইনের রূপ ধারণ করে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সংহার করেছে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ওমর গণি এমইএস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।

 


আরো সংবাদ



premium cement
চায়ের সাথে চেতনানাশক খাইয়ে স্বর্ণালঙ্কার চুরি ঈশ্বরগঞ্জে সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি ব্যারিস্টার ফারজানাকে সংবর্ধনা যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে‘ভিত্তিহীন' তথ্য ব্যবহারের অভিযোগ বাংলাদেশ সরকারের মোদির মুসলিমবিরোধী মন্তব্যের প্রতিবাদ করায় সংখ্যালঘু নেতাকে বহিষ্কার ফ্লোরিডায় বাংলাদেশ কনস্যুলেটের নতুন কনসাল জেনারেল সেহেলী সাবরীন চান্দিনায় পানিতে ডুবে একই পরিবারের দুই শিশু মৃত্যু কেএনএফ সম্পৃক্ততা : গ্রেফতার ছাত্রলীগ নেতা সম্পর্কে যা জানা গেছে দেশে টিআইএনধারীর সংখ্যা ১ কোটি ২ লাখ শ্রমজীবি মানুষের মাঝে ক্যাপ, পানি ও স্যালাইন বিতরণ করেছে ছাত্রশিবির ঢাকা মহানগর পশ্চিম নোয়াখালীতে হিট স্ট্রোকে শিক্ষার্থীর মৃত্যু বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ায় স্ত্রীর ২৭ স্থানে স্বামীর ধারালো অস্ত্রের আঘাত

সকল