১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘শয়তানের আব্বা’র রাজনীতির মূলমন্ত্র!

‘শয়তানের আব্বা’র রাজনীতির মূলমন্ত্র! - ছবি : নয়া দিগন্ত

তিনি যখন জীবিত ছিলেন তখন লোকজন তাকে আড়ালে-আবডালে শয়তানের আব্বা বলে সম্বোধন করতেন। অবশ্য তার সামনে গিয়ে ওকথা বলার হিম্মত কারো ছিল না- কারণ, তার ছিল অগাধ ক্ষমতা। তার মৃত্যুর পরও তাকে নিয়ে আদিখ্যেতার শেষ নেই। ভক্ত অনুরাগীরা যেমন তাকে দেবতা বানানোর জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তদ্রুপ বিরোধীরা তাকে অভিশাপ দিতে দিতে রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তিনি যে নীতি ও আদর্শের কথা বলে বেড়াতেন তা রাজনীতিতে প্রয়োগ করা হলে দেশ-কাল-সমাজের জন্য যে কতবড় ভয়ঙ্কর পরিণতি বয়ে আনতে পারে, তাও তিনি জীবদ্দশায় দেখে গেছেন। তবে তার চিন্তাধারার ভয়ঙ্কর বাস্তবায়ন শুরু হয় মূলত তার মৃত্যুর কয়েক দশক পর এবং বর্তমান যুগে এসে তা ততটা বীভৎস-বিকৃত এবং পুঁতি দুর্গন্ধময় হয়ে উঠেছে, যা দেখলে তিনি হয়তো নিজেই পাগল হয়ে যেতেন।

তার হাতে যখন রাষ্ট্রক্ষমতা ছিল তখন তিনি হাতেকলমে দেখিয়ে দিয়েছেন, গুপ্তহত্যা, গুম এবং প্রকাশ্যে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে কিভাবে বড় বড় কথা বলে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা যায়। অন্য দিকে, বিরোধী রাজনৈতিক দলকে ঠেঙ্গানো, ভিন্নমতের লোকজনের জবানে তালা লাগানো এবং মানুষের বাকস্বাধীনতার ওপর নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ করার পরও কিভাবে দেবদূতের মতো পোশাক পরে উঁচু গলায় ও আঙুল উঁচিয়ে গণতন্ত্রের নীতিকথা বলা যায়, তাও তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন।

ধর্ম-কর্ম-নীতি-নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে বস্তাবন্দী করে তিনি ময়লার বাক্স অথবা কোনো খরস্রোতা নদীতে নিক্ষেপ করার পরও বহু কথিত জ্ঞানী গুণী-ধর্ম প্রচারকের কাছ থেকে আনুগত্য লাভ করেছিলেন।

তিনি প্রতারণাকে একটি শিল্পে পরিণত করার জন্য পরামর্শ দিতেন। নিরীহ জনগণকে বিভিন্ন নাটক-সিনেমা-পুতুলনাচ জাতীয় মিথ্যাচারের মাধ্যমে বিভ্রান্ত করে রাখার উপায় বলে দিতেন। কিছু লোক যেন অহেতুক আনন্দ করে চারদিকে আনন্দের ঝড় তোলে আবার একই সাথে কিছু লোক যেন গগণবিদারী আর্তচিৎকার এবং হাহাকার দিয়ে পুরো এলাকাকে বিষাদময় করে ফেলে; ফলে সমাজ-সংসারে যেন সর্বদা পরস্পরবিরোধী অবস্থা বিরাজ করে এজন্য তার সাগরেদদেরকে তিনি মূল্যবান দিকদির্নেশনা দিতেন। ইদানীং আমরা যেটিকে কন্ট্রাস্ট বলি ঠিক সেই পরিস্থিতি যখন চারদিকে শুরু হয়ে যায়, তখন মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। তারা ভালো ও মন্দকে পৃথক করতে পারে না এবং ব্যক্তিগত জীবনে লোকজন ভীষণ স্বার্থপর, এককেন্দ্রিক এবং অসামাজিক হয়ে পড়ে।

ফলে এমন পরিস্থিতিতে যেকোনো ধড়িবাজ রাজনীতিবিদ অনায়াসে এবং নিরাপদে যেকোনো অপরাধ করে পার পেয়ে যেতে পারে। মানুষকে ভয় দেখানো এবং বহু লোকের সামনে অর্থাৎ জনসভায় গড় গড় করে মিথ্যা বলার দক্ষতাকে তিনি একজন রাজনীতিবিদের প্রধান যোগ্যতা বলে বর্ণনা করতেন। তার মতে, কারণে-অকারণে ভয় দেখিয়ে জনগণকে যেভাবে বশ করা সম্ভব, তা অন্য কোনোভাবে সম্ভব নয়। যেসব রাজনীতিবিদ সিংহাসনে বসবেন তারা যদি অত্যন্ত সফলভাবে জনগণকে ভয় দেখাতে পারেন তবে তারা তাদের ক্ষমতার চেয়ারকে নিরাপদ রাখতে পারবেন। কারণ মানুষ যখন ভয় পায়, তখন তার মধ্যে সর্বদা পালানোর চিন্তা কাজ করে। যাদের শক্তি সামর্থ্য এবং সুযোগ থাকে তারা দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। যারা ‘হিজরত’ করতে পারেন না- তারা সর্বদা নিজেকে আড়াল করে রাখেন এবং নিচু গলায় ফিসফিসিয়ে কথা বলেন। ভয় পাওয়া আরেক শ্রেণী রয়েছে যারা নিজেদের চিন্তাচেতনার বাইরে গিয়ে সর্বদা ‘জি হুজুর জি হুজুর’ করেন।

অবস্থার কারণে ‘শয়তানের আব্বার দোসর’রা সর্বদা নিজেদের পাপকে আড়াল করার জন্য ভয়কে হাতিয়ার বানিয়ে জনগণের মন-মস্তিষ্ক ও শরীরে ভয়ের পেরেক মারতে থাকেন অবিরতভাবে। তারা খুব ভালো করে জানেন যে, ভয় মানুষের চিন্তাশক্তি, উদ্ভাবনী শক্তি এবং বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষা জ্যামিতিক হারে হ্রাস করে দেয়। ভীতু মানুষের শরীরে অকারণে হাজারো রোগ বাসা বাঁধে। তারা খুব দ্রুত বুড়ো হয়ে যায় এবং মরণের চিন্তায় দুনিয়ার সব কিছু বিসর্জন দিয়ে বৈরাগ্য অবলম্বন করে। তাদের বিয়েশাদী, সংসার, ধর্ম, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি লাটে ওঠে। গল্প-কবিতা-উপন্যাস, নাচ-গান, খানাপিনা ইত্যাদি সব কিছু তাদের কাছে বিষময় বলে মনে হতে থাকে। এ অবস্থায় তাদের চোখের সামনে রাজা যদি উলঙ্গ হয়ে দুনিয়ার নিকৃষ্টতম পাপাচারগুলো ক্রমাগতভাবে করতে থাকেন তবুও তারা ‘উহ্’ পর্যন্ত উচ্চারণ করতে চায় না।

ভয় দেখানোর পর ‘শয়তানের আব্বা’র দ্বিতীয় মারণাস্ত্র হলো রাজকর্মচারীদের অসৎ দুর্নীতিপরায়ণ এবং বিলাসী বানিয়ে ফেলা। বিশেষ করে সেনাবাহিনীর লোকজনকে যুদ্ধাস্ত্রের পরিবর্তে বাদ্যযন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট করা। তাদের নিয়মিতভাবে গান শোনানো এবং মাংস-চর্বি ও মদের আধিক্যে নেশাগ্রস্ত ও স্থূল বানিয়ে ফেলা। তারা যাতে যুদ্ধ ভুলে যায় এবং বিলাসিতায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ে সেজন্য নরম কাপড়, নরম বিছানা, আরামদায়ক জুতা সরবরাহ করার পাশাপাশি প্রচুর বাদ্যযন্ত্র তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়। এই সূত্রটি ধার করেছেন মহামতি হিরোডোটাসের বই থেকে। প্রাচীনকালে পারস্য সম্রাট সাইরাস যখন লিডিয়া সাম্রাজ্য আক্রমণ করলেন তখন সেখানকার ক্ষুদ্র একটি রাজ্যের দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনীর সদস্যদের তিনি কিছুতেই বশ করতে পারছিলেন না। সে দেশের রাজা সম্রাট সাইরাসের কাছে আত্মসমর্পণের পরও সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ না করে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে।

এ অবস্থায় সম্রাট সাইরাস খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়লেন। তিনি দেখলেন যে, বিদ্রোহী সেনা সদস্যরা যুদ্ধাস্ত্রকে নিজদের অলঙ্কার মনে করে। তারা খালি পায়ে থাকে এবং স্বল্প পরিমাণ রুটি আর পোড়া মাংস খায়। তাদের পেটানো শরীর, নির্লোভ মন এবং যুদ্ধ করার অদম্য ইচ্ছার কাছে বিজয়ী সম্রাটের বিপুল বাহিনী হরহামেশা নাস্তানাবুদ হতে থাকে। এ অবস্থায় সাইরাস বিজ্ঞজনদের পরামর্শসভা ডাকলেন এবং তাদের পরামর্শ মতে, ওই রাজ্যে সরকারিভাবে বিনামূল্যে আরামদায়ক জুতা, সঙ্গীতযন্ত্র, মদ, মাংস সরবরাহ করতে থাকলেন। এরপর সরকারি মদদে বড় বড় নাচগানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেন। মানুষ রাজ্য হারানোর বেদনা ভুলে গিয়ে সারা রাত আনন্দ ফুর্তি শুরু করে দিলো। এ অবস্থায় সেনাবাহিনীর সদস্যরাও যুদ্ধ ছেড়ে নাচ-গানে, আমোদে-প্রমোদে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর সুযোগ বুঝে সাইরাসের অনুগত সৈন্যরা তাদের কচুকাটা করতে থাকে।

প্রাচীন দুনিয়ার লিডিয়া ও মিডিয়া সাম্রাজ্যের এই চমকপ্রদ কাহিনীকে ‘শয়তানের আব্বা’ নিজের জন্য অপরিহার্য করে নিয়েছিলেন। ফলে তার রাজ্যের সেনাবাহিনী একটি পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত হয়েছিল, যারা কেবল নিজের দেশের নিরস্ত্র জনগণের সঙ্গে বীরত্ব দেখাত এবং বহির্শত্রুর সাথে যুদ্ধ করা দূরের কথা, শত্রুর কাছে নতজানু হয়ে আনুগত্য প্রকাশের অভিনব কৌশল আবিষ্কার করে ফেলেছিল। দেশের স্বার্থ, জনগণের স্বার্থ ইত্যাদি বিকিয়ে দিয়ে রাজা এবং তার অনুগতরা কিভাবে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে নিজেদের ভোগবিলাস চালিয়ে যেতে পারেন, যেসব মন্ত্রণাও ‘শয়তানের আব্বা’র মস্তিষ্ক থেকে অহরহ বের হতো।

তার অন্যতম প্রধান কৌশল ছিল মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে তছনছ করে দেয়া। কারণ সেই আদিকাল থেকে মানুষ যেভাবে ধর্মের ভিত্তিতে হঠাৎ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আসছে এটা প্রায়ই রাষ্ট্রশক্তিকে বিপদে ফেলে দেয়। ফলে ধর্মীয় নেতা ও ধর্মপ্রাণ মানুষ এবং রাজার মধ্যে এক ধরনের দূরত্ব থাকে। অতীতকালে অনেক রাজাই ধর্মীয় নেতাদের দ্বারা সিংহাসনচ্যুত হয়েছেন। এসব কারণে ‘শয়তানের আব্বা’র যে মূলনীতি তার অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, একটি সেকুলার রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং রাষ্ট্রীয় মদদে বিদ্যমান সব ধর্মমতের লোকজনের মধ্যে ফিতনা-ফাসাদে এমন একটি অবস্থা সৃষ্টি করা যাতে সাধারণ মানুষ ধর্মের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে এবং ধর্মীয় নেতাদের ঘৃণা করতে থাকে।

ধর্মকর্মের পর মানুষের সামাজিক সংহতি, সম্মানিত মানুষদের প্রতি সাধারণের শ্রদ্ধা ভালোবাসা ও আনুগত্য ইত্যাদির মূলে কুঠারাঘাত করে তরুণ সমাজকে বেয়াদব, উচ্ছৃঙ্খল এবং অস্থির করে তোলার অপকৌশলও ‘শয়তানের আব্বা’র মূলনীতির মধ্যে ছিল। তরুণরা যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়ে তবে প্রতিটি পরিবার এবং পাড়া-মহল্লা রীতিমতো জাহান্নাম হয়ে পড়ে। ফলে এদের আর কোনো সুযোগ থাকে না রাজ্য রাজা রাজধানী নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা করার।

আজকের নিবন্ধের নায়ক শয়তানের আব্বার নাম এবং তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় বলে প্রসঙ্গের ইতি টানব। ইতিহাস বিশ্লেষকদের বিরাট অংশ যাকে শয়তানের আব্বা বলে থাকেন তার নাম ম্যাকিয়াভেলি। পুরো নাম নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি। তার জন্ম ১৪৬৯ সালের ৩ মে, বর্তমান ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে। তিনি সেই শহরের একটি অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন এবং তৎকালীন সময়ে ফ্লোরেন্স নামক যে শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল তিনি সেখানকার রাজার একজন উপদেষ্টা বা মন্ত্রী ছিলেন পরিণত বয়সে পরিণত বয়সে।

ম্যাকিয়াভেলি তাবৎ দুনিয়ার রাজনীতিতে আলোচিত এবং সমালোচিত ব্যক্তিত্ব। তার প্রজ্ঞা, মতবাদ, মেধা এবং যোগ্যতা সেই পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে আজ অবধি দুনিয়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে আলোচিত এবং বহুজনের মাধ্যমে অনুসৃত। ‘প্রিন্স’ বা রাজকুমার নামক বইটিতে ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্র পরিচালনার যেসব কৌশলের কথা বলেছেন, সেগুলোর ভাবার্থ বা সারাংশই এতক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে আলোচনা করলাম। সম্মানিত পাঠক, একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন যে, সমসাময়িক দুনিয়াতে কে বা কারা মাকিয়াভেলি ওরফে শয়তানের আব্বার মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাজনীতি করছেন অথবা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন!

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য

 


আরো সংবাদ



premium cement
ফরিদপুরের গণপিটুনিতে নিহত ২ নির্মাণশ্রমিক জাতিসঙ্ঘে ফিলিস্তিনি সদস্যপদ লাভের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো তীব্র তাপপ্রবাহে বাড়ছে ডায়রিয়া হিটস্ট্রোক মাছ-ডাল-ভাতের অভাব নেই, মানুষের চাহিদা এখন মাংস : প্রধানমন্ত্রী মৌসুমের শুরুতেই আলু নিয়ে হুলস্থূল মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যস্ফীতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এত শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি বুঝতে পারেনি ইসরাইল রাখাইনে তুমুল যুদ্ধ : মর্টার শেলে প্রকম্পিত সীমান্ত বিএনপির কৌশল বুঝতে চায় ব্রিটেন ভারতের ১৮তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোট আজ নিষেধাজ্ঞার কারণে মিয়ানমারের সাথে সম্পৃক্ততায় ঝুঁকি রয়েছে : সেনাপ্রধান

সকল