১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বৈশ্বিক মেরুকরণ ও মুসলিম দুনিয়া

বৈশ্বিক মেরুকরণ ও মুসলিম দুনিয়া - ছবি : সংগ্রহ

চলতি শতকের শুরুর একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলা। ২০০২ সালের এ ঘটনার প্রভাব পরবর্তী দুই দশকের বৈশ্বিক পর্যায়ের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা যায়। এর সর্বশেষ দৃশ্যমান ‘উন্নয়ন’ হলো ফিলিস্তিনি ভূমিকে ইসরাইলের মানচিত্রের অন্তর্ভুক্ত করার আয়োজন এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়াই সংযুক্ত আরব আমিরাতের ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে দেশটির সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন। কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পর অল্প সময়ের মধ্যেই আরব আমিরাত প্রতিরক্ষা থেকে শুরু করে আইটি পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে ইসরাইলের সাথে অংশীদারিত্ব সৃষ্টির কাজ শুরু করে। এর মাধ্যমে কার্যত আমিরাতের আল নাহিয়ান শাসকদের ক্ষমতায় থাকার বিনিময়ে বাকি সব কিছু ইসরাইলের হাতে সমর্পণের আয়োজনই করা হচ্ছে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। আর এটি হলে ইসরাইলের সম্প্রসারিত উপস্থিতি ইরানের দোরগোড়ায় এবং তুরস্কের আরো কাছাকাছি এসে হাজির হবে।

প্রভাব সুদূরপ্রসারী
বস্তুত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অস্বাভাবিকভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠা আরব আমিরাতের ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়া ও সর্বাত্মক সহযোগিতার প্রভাব হবে অনেক সুদূরপ্রসারী। এর ফলে পুরো মধ্যপ্রাচ্য শুধু নয়, মুসলিম বিশ্বব্যাপী বড় ধরনের মেরুকরণ ও অস্থিরতা শুরু হতে পারে। ইসরাইলকে স্বীকৃতিদানের এই সিদ্ধান্ত আরব আমিরাত যে এককভাবে নেয়নি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সৌদি আরব আমিরাতের ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার চুক্তিটি স্বাক্ষরের পর বেশ ক’দিন চুপচাপ থেকে বলেছে, ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা বা ফিলিস্তিনিরা কোনো শান্তি প্রক্রিয়ায় সম্মত না হলে সৌদি আরব ইসরাইলের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করবে না। বাহরাইন ও ওমানের সর্বশেষ প্রতিক্রিয়াও অনেকটা এ রকমই। তবে এই ঘোষণা ইসরাইলের সাথে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে এসব দেশের যোগাযোগ বা সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার যে প্রক্রিয়া রয়েছে তা ব্যাহত করছে না।

বরং আমিরাত এখন প্রকাশ্যভাবে আরব দেশগুলোকে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার লাইনে নিয়ে আসতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে, সুদানের ক্ষমতাসীন সামরিক কাউন্সিলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি র‌্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের কমান্ডার মোহাম্মদ হামদান দাগালো (হেমতি) এবং ইসরাইলের মোসাদের প্রধান ইয়োসি কোহেন দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনার জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতে একটি অঘোষিত বৈঠকে বসেছেন। বৈঠকে আমিরাতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা তাহনৌন বিন জায়েদসহ উচ্চপদস্থ আমিরাতি কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সুদানের ট্রানজিশনাল সার্বভৌমত্ব কাউন্সিলের মুখপাত্র মোহাম্মদ আল-ফাকি সুলেইমান হেমতি ও কোহেনের মধ্যে বৈঠক সম্পর্কিত কোনো তথ্য সম্পর্কে জানার কথা অস্বীকার করেছেন। তবে কাউন্সিলের মুখপাত্র জানিয়েছেন, ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করে দেখার জন্য পার্লামেন্টকে নির্দেশ দিয়েছে দেশটির অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সুলেইমান বলেছেন, গত ফেব্রুয়ারিতে সুদানের মিলিটারি প্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মধ্যে বৈঠকের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এই পদক্ষেপ নেয়।

নেতানিয়াহুর সাথে ওই বৈঠকে বুরহান ইসরাইলের সাথে শান্তিচুক্তিতে সই না করলেও ইসরাইলি বিমানগুলোকে ট্রানজিট নিতে সুদানের আকাশ ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হয়। বৈঠকটি নিয়ে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর অফিস বলেছিল, ‘এটি দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রথম ধাপ’।

এ দিকে জেরুসালেম পোস্টের খবরে বলা হয়েছে, সুদানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইসরাইলের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তার দেশটির সমর্থনের বিষয়টি অস্বীকার করেছে এবং যে সরকারি মুখপাত্র এ তথ্য প্রকাশ করেছিলেন তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। সুদানের পররাষ্ট্র মন্ত্রকের মুখপাত্র হায়দার বাদাভি সাদিক স্কাই নিউজকে বলেছিলেন যে, ‘খার্তুম নিজস্ব মূল্যবোধ ত্যাগ না করে সুদানের স্বার্থ রক্ষার ভিত্তিতে ইসরাইলের সাথে একটি শান্তিচুক্তির প্রত্যাশায় রয়েছে।’

তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সিদ্ধান্তটিকে ‘দৃঢ় ও সাহসী পদক্ষেপ’ হিসেবে উল্লেখ করে এর প্রশংসা করেন যা ‘বাকি আরব দেশগুলোর জন্য সঠিক পথের রূপরেখা’ বলে মন্তব্য করেছেন। এর জবাবে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু টুইটারে মন্তব্য করেন : ‘ইসরাইল, সুদান এবং এই অঞ্চল সবাই একটি শান্তিচুক্তি থেকে উপকৃত হবে এবং এ অঞ্চলের সব জাতির একসাথে আরো ভালো ভবিষ্যৎ গড়তে সক্ষম হবে।’
এরপর ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা নিয়ে সুদানে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দিলে সুদানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কার্যরত ওমর কামারউদ্দিন ইসমাইল বলেন, সাদিকের বক্তব্যে তিনি ‘বিস্মিত’ হয়েছেন, এ কথা বলার জন্য তিনি অনুমতিপ্রাপ্ত ছিলেন না এবং মন্ত্রণালয় ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেনি।

ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আরব ও মুসলিম দেশগুলোকে সম্মত করার এই প্রচেষ্টা কেবল সুদানের মধ্যে সীমিত নেই। বাহরাইন এবং ওমানকেও একই কাতারে আনার প্রচেষ্টার ইঙ্গিত ট্রাম্প এবং নেতানিয়াহু দু’জনই দিয়েছেন। কিন্তু এই দুটি দেশও সৌদি আরবের সাথে সুর মিলিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ছাড়া ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক না করার কথাই বলেছেন। এমনকি সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে বৈঠকে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এই বৈঠকে ইসরাইলের নেতারাও থাকার কথা ছিল। এই বৈঠককে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দানের ব্যাপারে সৌদি পদক্ষেপ চূড়ান্ত করার একটি আয়োজন বলে ধারণা করা হচ্ছিল।
সৌদি নেতৃত্বাধীন দেশগুলো কেন ইসরাইলকে স্বীকৃতি দানের পদক্ষেপ থেকে পিছিয়ে গেল? ভেতরের সূত্রসমূহের তথ্য অনুসারে, সৌদি ডিপ স্টেটের বড় অংশ এবং প্রধান প্রধান গোত্র নেতা আর ধর্মীয় এস্টাবলিশমেন্ট কোনোভাবেই এই পদক্ষেপের সাথে একমত হতে পারছিলেন না। এমন বার্তাও দেয়া হয়েছে যে বর্তমান সৌদি নেতৃত্ব আমিরাতের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করলে সৌদ পরিবার রাষ্ট্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে। সৌদি জনমত আগে থেকেই ছিল ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক নির্মাণের বিপক্ষে। এই অবস্থায় সৌদি বাদশাহ সালমান রাজ পরিবার ও রাষ্ট্র্রের সিনিয়র পরামর্র্শদাতাদের মতকে গ্রহণ করে নিয়েছেন বলে মনে হয়।

দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল মুসলিম বিশ্বে সৌদি নেতৃত্ব হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছিল। ওআইসির অধিকাংশ দেশের মতের বাইরে গিয়ে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিলে অনেকখানি নিশ্চিতভাবে সৌদি আরব ইসলামী দুনিয়ার নেতৃত্ব হারাত। ইরান ও তার মিত্র দেশগুলোর সাথে আগে থেকেই রিয়াদের ছিল বৈরী সম্পর্ক। সর্বশেষ তুরস্ক ও মিত্র দেশগুলো এমনকি পাকিস্তানের সাথেও একটি দূরত্ব তৈরি হয়ে যাচ্ছিল। এই অবস্থায় সামনে অগ্রসর হওয়া মানে সৌদি আরবের একটি কোটারির নেতা হয়ে যাওয়া। আর ওআইসি ভেঙে নতুন কোনো সংগঠনের সৃষ্টি হওয়া। এই অবস্থায় সৌদি আরবের পিছিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। সৌদি অনুগামী রাষ্ট্রগুলোও সেই পথই অনুসরণ করেছে বলে মনে হয়।

বিভাজন ও মুখোমুখি করার চেষ্টা
মধ্যপ্রাচ্য এবং মুসলিম বিশ্বে এখন যা হচ্ছে তার পেছনে পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোর একাধিক গ্রুপ তৈরি করে তাদের মুখোমুখি দাঁড় করানো ছিল ইসরাইরের মূল উদ্দেশ্য। একই সাথে, মুসলমানদের এক রাষ্ট্রকে অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, এক জাতিকে অন্য জাতির বিরুদ্ধে উসকে দিয়ে সঙ্ঘাত সৃষ্টি করা আর এভাবে শক্তিশালী মুসলিম দেশগুলোকে দুর্বল ও ভাঙনের মুখোমুখি করার কৌশল ছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে স্বায়ু যুদ্ধকালে আমেরিকার সামনে প্রধান শত্রু ছিল কমিউনিজম।

কমিউনিজমের বিস্তার তথা সোভিয়েত প্রভাব ঠেকানোর জন্য একটি আদর্র্শবাদী প্রতিরোধ শক্তির প্রয়োজন ছিল। এই হিসেবে মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামের আদর্শিক পুনরুত্থানে ব্যাপকভাবে বাধা দেয়া হয়নি। শুধু এটি নিশ্চিত করা হয়েছে যে, তাদের হাতে যেন রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ চলে না যায়। বিশ্ব রাজনীতিতে কমিউনিজমের আবেদন ফুরিয়ে যাওয়ার পর পাশ্চাত্যের বিশ্ব ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রকরা আদর্শিক শক্তি হিসেবে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করে ইসলামকে। এরপর প্রফেসর হান্টিংটনের ‘সভ্যতার দ্বন্দ্ব’ তত্ত্ব দাঁড় করানো হয়। সেই সাথে টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর বাস্তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ শুরু করেন ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’। এর প্রত্যক্ষ নিশানা বানানো হয় শক্তিমান ইসলামী রাষ্ট্র ও জাতিগোষ্ঠীকে। আফগানিস্তানকে এই লড়াইয়ের ক্ষেত্র বানিয়ে একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য শক্তিধর রাষ্ট্র ইরাকের শাসক সাদ্দাম হোসেনকে উসকে দিয়ে প্রথমে ইরানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামানো হয়; পরে কুয়েত দখলে প্ররোচিত করা হয় তাকে। এরপর অব্যাহত অবরোধের পথ ধরে সাদ্দামের পতন ঘটানো এবং তাকে হত্যার পর একটি ভঙ্গুর ও অস্থির রাষ্ট্র বানানো হয়েছে ইরাককে।

‘আরব বসন্ত’ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ইসলাম বা ইসলামী আন্দোলনকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক শাসকদের ক্ষমতার সামনে হুমকি হিসেবে তুলে ধরা হয়। এর মধ্য দিয়ে একসময় উপসাগরীয় যে শাসকরা পরোক্ষভাবে সেসব দেশের ইসলামিস্টদের পৃষ্ঠপোষকতা করত অথবা কাজ করতে সুযোগ দিতেন তাদের বিরুদ্ধে নিশ্চিহ্নকরণ অভিযানে নামেন। আরব বসন্তের পথ ধরে লিবিয়ায় গাদ্দাফির মতো শক্তিমান শাসকের অবসান ঘটানো হয় কিন্তু গৃহযুদ্ধে দেশটিতে এখন এক ক্ষতবিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তিউনিশিয়ায় রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের বিচক্ষণতার কারণে সেখানে অরাজক অবস্থা সৃষ্টি করা যায়নি। তবে এমন এক অস্থির অবস্থায় দেশটিকে ফেলে দেয়া হয়েছে, যেকোনো সময় একনায়কত্ব আবার জেঁকে বসার খড়গ তৈরি হয়ে আছে। এ জন্য আমিরাত চক্র অব্যাহতভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ইয়েমেনে আলি আবদুল্লাহ সালেহর পতনের পর চার বছরের যুদ্ধ দেশটিকে নিঃশেষ করে ফেলছে। দেশটিতে অনাহারে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে।

সিরিয়ায় বাশার আল আসাদের শাসন অবসানের জন্য জনগণকে রাস্তায় নামিয়ে বিদ্রোহীদের সমর্থন যুগিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, আমিরাত আর তুরস্ক। কিন্তু বিদ্রোহীরা জয়ের দ্বারপ্রান্তে চলে গেলে হাত গুটিয়ে নেয় সৌদি-আমিরাত ও যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়ার সাথে সৌদি-মিসর-আমিরাতের গোপন সমঝোতার কথা এখন জানা যাচ্ছে। এর আওতায় মুসলিম ব্রাদারহুডের ক্ষমতাকে ধ্বংস করতে রাশিয়ার সাথে আমিরাত মিসর সৌদি ব্লকের এক গোপন সমঝোতা হয়, যার অংশ হিসেবে রাশিয়ার বিমান হামলায় তিন লাখের বেশি সিরীয়কে হত্যার মাধ্যমে বাশার আল আসাদের শাসনকে রক্ষা করা হয়েছে। ইরান-রাশিয়া এ ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করলেও নেপথ্যে ছিল ‘আমিরাত-মিসর-সৌদি’ বলয়। সিরিয়ায় তুরস্কের বিরুদ্ধে একটি কুর্দি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আয়োজনকেও অনেকদূর এগিয়ে নেয়া হয়। কিন্তু তুর্কি এস্টাবলিশমেন্টের কঠোর মনোভাবের কারণে সেটিকে এখনো সফল করে তোলা সম্ভব হয়নি। তবে তুরস্ককে সীমিত করার জন্য ‘ইসরাইল মিসর গ্রিস সাইপ্রাস ফ্রান্স’ অক্ষ তৈরি করা হয়েছে। এটি এখন লিবিয়া এবং ভূমধ্যসাগরীয় ফ্রন্টে বেশ সক্রিয়। এই অক্ষের সাথে সুবিধামতো, যুক্তরাষ্ট্র অথবা রাশিয়াকে সক্রিয় করার প্রচেষ্টা রয়েছে।

এরপর কী?
বর্তমান আয়োজনের মধ্য দিয়ে মুসলিম বিশ্বকে ত্রিধা বিভক্ত করার একটি কৌশলগত উদ্যোগ রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল মিসর সৌদি আরব আমিরাত এবং মিত্র দেশগুলোর একটি বলয়, ইরান ইরাক সিরিয়া লেবানন ইয়েমেনের হুতিদের নিয়ে একটি বলয় এবং তুরস্ক-কাতার-পাকিস্তান-আজারবাইজান-লিবিয়া নিয়ে একটি বলয় তৈরি হয়েছে। মধ্যবর্তী দেশগুলোকে এই তিন বলয়ের দিকে টানার প্রচেষ্টা রয়েছে।

ইউরোপ ও আমেরিকার মধ্যে ফ্রান্স সক্রিয়ভাবে ইসরাইল আমিরাত বলয়ের পক্ষে এবং জার্মানি, ইতালি ও ব্রিটেন মধ্যবর্তী স্থানে থেকে সঙ্ঘাতকে বাড়তে না দেয়ার চেষ্টায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইল-আমিরাত-সৌদি বলয়ের মূল সমর্থক হলেও অন্য পক্ষগুলোর সাথেও সম্পর্ক রক্ষা করে চলছে। রাশিয়ার ভূমিকা অনেকখানি দেশটির স্বার্থকেন্দ্রিক, যেখানে যে ভূমিকা নিতে হয় সেটি নিচ্ছে মস্কো।

পরবর্তী বৈশ্বিক ক্ষমতার লড়াইয়ে চীনকে সর্বাত্মক প্রতিপক্ষ বানানোর চেষ্টার মুখে নিজস্ব বলয় তৈরি করছে যুক্তরাষ্ট্র। এর বিপরীতে, রাশিয়ার সাথে চীন কৌশলগত সমঝোতায় উপনীত হয়েছে। পাকিস্তানকে সর্বাত্মকভাবে সমর্থন করছে বেইজিং। আর দেশটির প্রতি মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব গ্রহণের আহ্বান জানানোর মধ্য দিয়ে সর্বাত্মক কৌশলগত সমর্থনের বার্তাই দেয়া হয়েছে ইসলামাবাদকে। ইরানের সাথে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ সংবলিত দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মধ্য দিয়ে বেইজিং নিজের এশীয় বলয়কে সম্প্রসারণ করছে। এদিকে চীনবিরোধী ভবিষ্যৎ লড়াইয়ে আমেরিকা প্রধান সহযোগী করতে চাইছে ইসরাইল, ফ্রান্স ও ভারতকে। এর বিপরীতে ‘চীন-রাশিয়া-ইরান-পাকিস্তান’ একটি অক্ষ তৈরি করতে চাইছে বেইজিং।

করোনাভাইরাসের বিদায়ের সাথে সাথে এই মেরুকরণ অনেকখানি নির্দিষ্ট অবয়ব নিতে পারে। ইরান-চীন সমঝোতার পর চীনে সৌদি আরবের ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রস্তাব স্থগিত ঘোষণা করেছে রিয়াদ। একই সাথে, ভারতের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরির স্বার্থে কাশ্মির ইস্যুতে ওআইসিকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে সৌদি আরব। এই ধারা চলতে থাকলে পাকিস্তান-সৌদি সম্পর্ক আরো অবনতির দিকে যাবে। এমনকি, একপর্যায়ে সৌদি আরবে পাকিস্তানের সামরিক উপস্থিতিরও অবসান ঘটানো হতে পারে। ‘সৌদি-আমিরাত-ইসরাইল-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র’ বলয়ে বাংলাদেশ গেলে এই শূন্যস্থান ঢাকাকে দিয়ে পূরণ করার বার্তা সম্প্রতি দেয়ার কথা জানা যাচ্ছে। নেপথ্যের এসব ঘটনা ও মেরুকরণ নানা কারণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

কৌশলগত ব্যাকফায়ার
ইসরাইল ফিলিস্তিনি নেতাদের বাদ দিয়ে সৌদি আরব আমিরাত ও সহযোগী রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে পুরোপুরি গ্রাস করার কৌশল কি দেশটির জন্য ব্যাকফায়ার করেছে? ইসরাইলের হার্টজ পত্রিকার এক মূল্যায়নে তেমনটি বলা হয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে আমিরাতকে অনুসরণ করাতে পারেনি সৌদি আরবও উপসাগরীয় দেশগুলোকে। আর আমেরিকার একান্ত ছায়া রাষ্ট্র হিসাবে ভূমিকা পালন করতে গিয়ে চীন রাশিয়ার সাথে ইসরাইলের যে বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল তা ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। আমিরাতের স্বীকৃতির পর রাশিয়া ইরান তুরস্ক একযোগে বলেছে তারা সিরিয়ায় ইসরাইলের আর কোনো বিমান হামলাকে মেনে নেবে না। ইসরাইল কাশ্মিরে ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সহায়তাকে বেইজিং তার স্বার্থবিরোধি যুদ্ধে ইসরাইলের লাঠিয়ালের ভূমিকা হিসেবে দেখছে। এর পর ইরানের সাথে দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তির খসড়া তৈরি করেছে চীন। একইসাথে মধ্যপ্রাচ্যে নিজস্ব উপস্থিতি জোরালো করতে শুরু করেছে উদীয়মান এই বিশ্ব শক্তি। এর ফলে দুটি বৃহৎ শক্তি ইসরাইলের স্বার্থের বিরুদ্ধে নতুন এক ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।

এতদিন চীন রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিস্থিতি ছিল না। এখন সেই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হতে চলেছে বলে মনে হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এর পাল্টা মেরুকরণও ঘটতে চলেছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধ শক্তির কাতারে সক্রিয় হতে পারে চীন রাশিয়া। চীনা প্রেসিডেন্ট শি’র ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা প্রকাশ্যে বলাটা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ মনে করা হচ্ছে। ইসরাইল কাশ্মীরে যত সক্রিয় হবে ইহুদি দেশটির আশপাশে লড়াইরত শক্তিগুলোর পাশে ততটাই সক্রিয় হবে চীন। ফলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে মুছে দেবার যে স্বপ্ন উগ্রবাদি ইসরাইলী নেতারা দেখছিল তা বুমেরাং হতে পারে।

সঙ্ঘাতের সাল ২০২১!
আশা আছে, করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্বে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করবে। এরপর অবয়ব নিতে শুরু করবে পরবর্তী ‘মহাখেলা’র আয়োজন। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল-আমিরাত-মিসর-ফ্রান্স এবং মিত্রদের সহায়তায় একটি প্রতিরক্ষা বলয় তৈরি করার চেষ্টা করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। চীন সক্রিয় হয়ে উঠবে পশ্চিম এশিয়া এবং আফ্রিকার রাজনীতিতে। ইরান ছাড়াও চীন পাকিস্তানের মাধ্যমে তুরস্কের নেতৃত্বাধীন মধ্যপন্থী সুন্নি বলয়ের সাথে একটি সমীকরণ নির্মাণের চেষ্টা করতে পারে। ২০২৩ সালে লুজান চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর খোলস ছেড়ে তুরস্কের আঞ্চলিক পর্যায়ে সক্রিয় হয়ে ওঠাকে রোধ করতে ইসরাইল-আমিরাত-সৌদি বলয় নানাভাবে দাবার ঘুঁটি সাজাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যেতে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় সমর্থন দেয়ার কথা জানিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে তুরস্কের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে এমন গুণগত পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে যে, সেখানে ক্ষমতাসীন একেপিকে সরানো খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। মধ্যপ্রাচ্যে ব্রাদারহুডের মতো জনসম্পৃক্ত দল এবং সাধারণ মানুষের আরব ও উম্মাহর স্বার্থগত নীতির কারণে এরদোগানের প্রতি সমর্থন তুরস্কের সক্ষমতার শেকড়কে অনেক গভীরে নিয়ে যাচ্ছে বলে মনে হয়। এরদোগানের কৌশল হলো, প্রয়োজনে সক্ষমতার প্রদর্শন আবার প্রয়োজনে আপস সমঝোতা। এটি তুরস্কে এবং আঞ্চলিকভাবে এরদোগানের দলকে ক্রমান্বয়ে শেকড় বিস্তৃত করতে সাহায্য করেছে।

২০২০ সালের শেষ প্রান্তিকটা বিশ্ব রাজনীতির নতুন অবয়ব গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিত তৈরির সময়। এ সময়ে বৈশ্বিক ক্ষমতায় অনেক বলয় তৈরি হতে পারে। এটি শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার ক্ষেত্রেই হবে, তা নয়; অধিকন্তু ব্রেটন উডসকেন্দ্রিক যে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সেটিও পরিবর্তনের ঝুঁকিতে পড়ে যেতে পারে। পাল্টা বিশ্ব সংস্থা তৈরির একটি উদ্যোগও দানা বাঁধতে পারে সৃষ্ট, বৈশ্বিক সঙ্কটকে কেন্দ্র করে।

mrkmmb@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement