১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কমলাবৃত্তান্ত

কমলা হ্যারিস - ছবি : সংগ্রহ

কমলা একটি সুস্বাদু ও সহজলভ্য ফল। চোখ ধাঁধানো রঙ ও পুষ্টিগুণে ভরপুর হওয়ায় সব বয়সী মানুষের কাছে দারুণ প্রিয়। সারা বছরই পাওয়া গেলেও শীতে বেশি মেলে। দেখতে সুন্দর ফলটির উপকারিতা অনেক। নিয়মিত কমলা খেলে তা শরীরের নানা সমস্যা ও রোগ বালাই থেকে সুরক্ষা পেতে সহায়ক হয়। প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, ফ্ল্যাভনয়েড, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম ও ডায়েটারি ফাইবার থাকায় একজন মানুষের প্রতিদিন যে পরিমাণ ভিটামিন সি প্রয়োজন, এর প্রায় পুরোটাই রয়েছে একটি কমলায়। আছে বিটা ক্যারোটিন, যা সেল ড্যামেজ প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে। ভিটামিন ‘সি’র অভাবে মুখে যে ঘা হয়; সেটির ওষুধ হিসেবে কমলা ভালো কাজ করে। পর্যাপ্ত আলফা ও বেটা ক্যারোটিন ফ্ল্যাভনয়েড থাকায় ক্যান্সার প্রতিরোধী। কমলায় লিমোনয়েড নামে এক পদার্থ থাকে- যা মুখ, ত্বক, ফুসফুস, স্তন, পাকস্থলির ক্যান্সার প্রতিরোধে উপযোগী। দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখতে দরকার প্রয়োজনীয় ভিটামিন ‘এ’। কমলায় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ থাকায় এটি খেলে রাতকানা রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে। মস্তিষ্কের বিকাশে জরুরি ফলিক অ্যাসিডও যথেষ্ট পরিমাণে থাকে এ ফলে। কমলায় আরো রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা ওজন কমায়। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ত্বক ভালো রাখে। ত্বক তারুণ্যদীপ্ত করে সতেজ ও সজীব রাখতে সাহায্য করে। এটি ত্বকের ব্রণ সমস্যা দূর করে ও ত্বকের কালো দাগ সারায়। বিদ্যমান পটাশিয়াম এবং ক্যালশিয়ামের মতো খনিজ উপাদানগুলো শরীরে সোডিয়াম রক্তচাপ ঠিক রাখতে সাহায্য করে। শরীরে কোলেস্টেরল লেভেল কমাতেও কমলার জুড়ি মেলা ভার। এর চর্বিহীন আঁশ, সোডিয়ামমুক্ত এবং কোলস্টেরলমুক্ত উপাদানগুলো হৃৎপিণ্ড সুস্থ রাখে। এতে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে। কমলায় বিদ্যমান ভিটামিন সি যে কোনো ক্ষতস্থান দ্রুত শুকাতে সাহায্য করে। সর্দি ও ঠা-া প্রতিরোধে সহায়ক। এতে বিদ্যমান ক্যালসিয়াম দাঁত ও হাড়ের গঠন ও মজবুতিতে সাহায্য করে। কমলা খেলে ক্ষুধা বাড়ে। খাওয়ার রুচি বাড়াতেও সাহায্য করে।

শুধু তাই নয়, কমলার খোসাও উপকারী। খোসাতেও গুণের শেষ নেই। এর খোসা রূপচর্চায় কাজে লাগে। কমলার খোসা স্কিনে ব্ল্যাকহেডস দূর করতে সহায়ক। দাঁতের হলদে ভাব দূর করতে পারে কমলার খোসা। প্রতিদিন যদি এক গ্লাস করে কমলার রস খাওয়া যায়, তাহলে ব্রেন ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে, বিশেষত ডিমেনশিয়ার মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা একেবারে থাকে না। নানা কারণে রাতে অনেকের ঠিকমতো ঘুম হয় না। সাথে ক্লান্তিও যেন জেঁকে বসে। তাহলে আমাদের রোজকার ডায়েটে কমলার রস অন্তর্ভুক্ত করা অত্যাবশ্যকীয়! ফলটিতে যে ফ্লেবোনয়েড আছে তা বেশ কিছু নিউরোট্রান্সমিটারকে অ্যাকটিভ করে দেয়। এতে একদিকে যেমন অনিদ্রার সমস্যা দূর করে, তেমনি স্মৃতিশক্তি এবং কগনিটিভ পাওয়ার বাড়াতেও সময় লাগে না।

কমলা শব্দটি বেশ কয়েকটি ভাষায় জায়গা করে নিয়েছে। একাধিক ভাষায় শব্দটি আত্মস্থ হয়েছে। কিছু ভাষাতাত্ত্বিকের মতে, সংস্কৃত ‘নারঙ্গি’ শব্দের রূপান্তর কমলার ইংরেজি অরেঞ্জ শব্দটি। তাদের মতামত, নারঙ্গি থেকে নরেঞ্জ, পরবর্তীতে রূপান্তর হয়ে ইংরেজি অরেঞ্জ শব্দের উদ্ভব। নারঙ্গি শব্দটি বাংলা কবিতায় অসাধারণ ব্যঞ্জনায় ধরা দেয় কবি ফররুখ আহমদের সাত-সাগরের মাঝি কবিতায় এভাবে- ‘কত যে আঁধার পর্দা পারায়ে ভোর হ’ল জানি না তা’।/ নারঙ্গি বনে কাঁপছে সবুজ পাতা’। আর শামসুর রাহমানের ক্রান্তির কবিতা শিরোনামে এসেছে- ‘ভোরের আকাশ ঝকঝকে নীল: ফসলের মাঠে নারঙ্গি রোদ কাঁপে,/ কিষানির চোখ উজ্জ্বল হলো স্বপনের উত্তাপে’।

সে যাই হোক, গুণের কদরে বা দেখতে সুশ্রী যে কারণেই হোক, ফলটির নামানুসারে অনেক বাবা-মা তাদের মেয়ে সন্তানের নাম কমলা রেখে থাকেন। শুধু দেশেই নয়, বিদেশেও কমলা নামের অনেক নারীর দেখা মেলে। যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর কথাই ধরা যাক। তার নামও কমলা। তবে বাংলাদেশের প্রভাবশালী একটি পত্রিকা তার নাম লিখছে কামালা। ‘বাকাতি’ আর কী! অন্যভাবে বললে বলা যায়, নিজেদের ব্যতিক্রমীভাবে উপস্থাপন করা। কেউ কলছেন কমালা। কমলা, কামালা না কমালা এই নিয়ে আমাদের মাঝে প্যাঁচ লেগেছে। এ প্যাঁচ খুলতে আমরা তার জীবনবৃত্তান্তের দিকে একটু দৃষ্টি দিলে ক্ষীণ একটি আভাস পেয়ে যেতেই পারি। গণমাধ্যমের কল্যাণে এখন সবার জানা ডেমোক্র্যাট ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর মা একজন ভারতীয় নারী। বাবা জ্যামাইকান। ভারতে ভূরি ভূরি নারীর নাম কমলা। ভারতীয় বংশোদ্ভূত হওয়ায় তার মায়ের স্বদেশপ্রীতি থেকে মেয়ের নাম কমলা হওয়াই বেশি যুক্তিযুক্ত।

কমলালেবুর মতোই কমলা হ্যারিসের বহুবিধ গুণের বদৌলতেই আসন্ন মার্কিন নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট ভাইস প্রেসিডেন্টের পদ বাগাতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রধান দুই দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো একজন নারীকে মনোনয়ন দেয়া হলো। কমলা হ্যারিস হচ্ছেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ এবং প্রথম দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত প্রার্থী। এ মনোনয়ন ঐতিহাসিক। তবে একথাও ঠিক, অতীতে মার্কিন নির্বাচনে নারী রানিং মেট নিয়ে কোনো প্রেসিডেন্ট প্রার্থীই সুবিধা করতে পারেননি। সারাহ পলিনকে রানিং মেট করায় রিপাবলিকান প্রার্থী জন ম্যাককেইন অতিরিক্ত সুবিধা পাননি। প্রথম নারী ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হয়েছিলেন ১৯৮৪ সালে জেরালডিন ফেরারো, ডেমোক্রেটিক দলের ওয়াল্টার মন্ডেলের সাথে। তারা বিজয়ী হননি। নারী হওয়ার কারণে তারা নারী ভোটারদের অতিরিক্ত সমর্থন পেয়েছেন এমন নয়। ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরা বিশেষ কোনো বয়সের ভোটারদের আকর্ষণ করতে পারেন, এমন উদাহরণও নেই।

এরপরও জো বাইডেন কেন রানিং মেট হিসেবে বেছে নিলেন কমলাকে সেই বিশ্লেষণ মার্কিন গণমাধ্যমের প্রধান উপজীব্য হয়ে উঠেছে। ভারতীয় বংশোদ্ভূত হওয়ায় আমাদের মাঝেও এক ধরনের কৌতূহল বিরাজ করছে। হাজার হোক ভারত তো আমাদের পেয়ারের প্রতিবেশী! এদিকে মার্কিন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কমলাকে রানিং মেট হিসাবে বেছে নেয়ার পেছনে ডেমোক্রেট প্রার্থী জো বাইডেন মনে হয় বেশক’টি কৌশলের কথা মাথায় রেখেছেন। প্রথমত, কমলাকে প্রার্থী করে একজন মহিলাকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদে বাছাই করে নারী ভোটারদের সহানুভূতি পেতে চাইছেন। দ্বিতীয়ত, মিশ্র বর্ণের হলেও কৃষ্ণাঙ্গ হিসাবে পরিচিত কমলা। ফলে কালো ভোটারদের মন জয়ে এই মনোনয়ন বাইডেন-কমলাকে বাড়তি সহায়তা দিতে পারে। তৃতীয়ত, ট্রাম্পের বা হিলারি ক্লিনটনের মেয়ে জামাতার মতোই কমলার স্বামী একজন ইহুদি। কমলা নিজেও আইপ্যাকের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখেন। ফলে ইহুদি ভোটার ও ধনকুবেরদের পাশাপাশি ইসরাইলি লবির সমর্থন বাইডেন-কমলা জুটির পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। চতুর্থত, ভারতীয় মায়ের সন্তান হিসেবে কমলার ভারতের সাথে রক্তের বন্ধন। আর ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এখন কৌশলগত অংশীদারিত্ব চমৎকার। এ কারণে বাইডেন-কমলা ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের বিশেষ সহানুভূতি পেতে পারেন। বাড়তি পাওনা হচ্ছে- জনমত জরিপে এখনো রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাইডেন এগিয়ে রয়েছেন।

এত সব সত্ত্বেও, অনেক মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন, আরব আমিরাত ও ইসরাইল দ্বিপক্ষীয় চুক্তি বাইডেনের নির্বাচনী কৌশল অকার্যকর করে দিতে পারে। আগুনে পানি ঢেলে দিলে যা হয়, আর কী। কারণ, ইসরাইলের মতোই ট্রাম্পও এ চুক্তি থেকে লাভবান হয়েছেন। ট্রাম্প আমিরাতকে রাজি করিয়েছেন ইসরাইলের সাথে দ্বি-পক্ষীয় সম্পর্ক ‘স্বাভাবিক’ করতে। ইসরাইলের দাবি-দাওয়া যেভাবে ট্রাম্প মিটিয়েছেন, ধারণা করা হচ্ছে- শেষমেশ ইসরাইলি লবি, বিশেষ করে যারা মার্কিন রাজনীতির অবয়ব অঙ্কন করেন, তারা ট্রাম্পকে আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে শক্ত সমর্থন দেবেন। করোনা মোকাবেলায় ট্রাম্পের ব্যর্থতা, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে রাশিয়ার উত্থান এবং সর্বশেষ চীনের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধে বেকায়দায় থাকা ট্রাম্পের জন্য তা হবে নির্বাচনে জেতার প্রধান উপায়।

সর্বশেষ কথা হলো, ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থী নিয়ে ব্যাপক আলোচনা এবং তার ঐতিহাসিক তাৎপর্যের কথা বলা হলেও দেখা গেছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অতীতে ভাইস-প্রেসিডেন্ট মনোনয়নের বিষয়টি প্রভাব ফেলেনি। ভোটারদের মধ্যে জরিপে দেখা গেছে, মাত্র এক-পঞ্চমাংশ ভোটারের ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর প্রভাব ছিল ২০০০ সালে ২১ শতাংশ, ২০০৪ সালে ১৬ শতাংশ। ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কোনো বিশেষ বর্ণের ভোটারদের কাছে অতিরিক্ত আবেদন রাখেন কিনা, তা বোঝার সুযোগ হয়নি। কেননা, এখন পর্যন্ত ভিন্ন বর্ণের কেউ এ পদের প্রার্থী হননি। এখন দেখার বিষয়, কমলা হ্যারিস তার নিজ বর্ণের ভোটারদের সমর্থন কতটা পান।


আরো সংবাদ



premium cement