২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘একই অঙ্গে এত রূপ!’

‘একই অঙ্গে এত রূপ!’ - ছবি : নয়া দিগন্ত

আগেভাগেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জানানো হয়েছিল করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার মহাবিপদের ব্যাপারে। তিনি এ সাবধানবাণীকে তখন পাত্তা দেননি।

এরই মর্মান্তিক পরিণাম ভোগ করছে যুক্তরাষ্ট্র এবং চরম মাশুল দিতে হচ্ছে আমেরিকান জাতিকে। ট্রাম্প কিছুদিন আগে এমন ভঙ্গিতে উক্তি করে ছিলেন যে, পত্রিকায় প্রশ্ন উঠেছিল, যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় মৃতের সংখ্যা লাখ না ছাড়ালে কি উনি খুশি থাকবেন? কথায় বলে, Man proposes, God Disposes (মানুষ ভাবে এক, আর স্রষ্টায় করেন আরেক)। এর মধ্যেই করোনায় মৃতের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় পৌনে দুই লাখ হয়ে গেছে। আর আক্রান্তের সংখ্যা ৫৭ লাখের মতো। তদুপরি মিডিয়াতে একাধিকবার প্রচারিত হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯ মহামারীতে এত বেশি মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে যে, সে দেশের কবরস্তানগুলোতে স্থান সঙ্কুলান হচ্ছে না। একপর্যায়ে মিডিয়া সচিত্র খবর দিয়েছে, নিউ ইয়র্কে কবরস্তানের কাছে অ্যাম্বুলেন্সে বহু লাশ ছিল লুকানো। এ নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড!

সর্বশেষ খবর হলো, বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন- করোনা সংক্রমণের বিষয়ে এর তিন মাস আগেই গত বছর মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান ট্রাম্প অবহিত হয়েছিলেন। তখন তিনি এ সতর্কবাণীকে গুরুত্ব দিলে মহামারী নিয়ে আজকের চরম পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না বলে তাদের অভিমত। স্বয়ং ট্রাম্পের অফিস কাম রেসিডেন্স, হোয়াইট হাউজের একজন অর্থনীতিবিদ বলেছেন, গত বছর সেপ্টেম্বরেই করোনাভাইরাস সম্পর্কে ট্র্যাম্পকে হুঁশিয়ার করে দেয়া হয়। একটি টিম এ তথ্য প্রেসিডেন্টকে তখন দিয়েছে যাতে এই অর্থনীতিবিদ নিজেও ছিলেন শামিল। ট্রাম্প সতর্ক হননি। টোডাস ফিলিপসন নামের সে ব্যক্তি ৪১ পাতার এক প্রতিবেদনে এই গুরুতর অভিযোগ এনেছেন। উল্লেখ্য, চীনের মধ্যাঞ্চলীয় হুবেই প্রদেশের ‘শিক্ষানগরী’ উহানে গত বছরের শেষ দিনেই সর্বপ্রথম করোনার সংক্রমণ ধরা পড়েছিল।

মি. ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বের বৃহত্তম বৃহৎশক্তি তথা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক ক্ষমতাবান ব্যক্তি। তিনি ২০১৭ সালে রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের দায়িত্ব নেয়ার আগে থেকেই বিতর্কিত। কখন কী বলেন, ঠিক নেই। উদ্ভট ও যুক্তিহীন কথা, স্ববিরোধী উক্তি, অসার বাগাড়ম্বর, উগ্র কথাবার্তা, উল্টাপাল্টা বক্তব্য প্রভৃতি তার স্বভাবজাত নিত্যকার বৈশিষ্ট্য যেন।

করোনার কারণে এখন বিশ্বে মহামারীর সংক্রমণ ও মৃত্যুর দিক দিয়ে সর্ব শীর্ষে রয়েছে ট্রাম্পের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অথচ তার উগ্রজাতীয়তাবাদী স্লোগান America First যে এমন মর্মান্তিকভাবে বাস্তব রূপ নেবে- এটা তিনি নিজেও ভাবেননি। ‘কোভিড-১৯’ মহামারীর শুরুতে ট্রাম্প এই ভাইরাসবাহিত ভয়াবহ ব্যাধিকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন ‘A little flu’ বলে। সেই ‘সামান্য’ ইনফ্লুয়েঞ্জা দীর্ঘদিন যাবত কেমন অসামান্য ধ্বংসতাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সবাইকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, তা বিশ্ববাসী অসহায়ভাবে প্রত্যক্ষ করেছে ও করছে। ট্রাম্পের বড় এক ভক্ত হলেন আরেক চরম ডানপন্থী নেতা এবং শ্বেতাঙ্গভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাজনীতিক, দক্ষিণ আমেরিকার বৃহত্তম রাষ্ট্র ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জায়ের বোলসোনারো। উনিও গুরু ট্রাম্পের মতো ‘Little flu’ বলে করোনা অতিমারীকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছিলেন। সেই বিশাল দেশের জন্য তা বিরাট বিপদ ও বিপর্যয় ডেকে এনেছে। সে দেশ এখন করোনায় মৃত্যু ও সংক্রমণের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পরই দুনিয়ার দ্বিতীয় অবস্থানে। এমন কি, স্বয়ং বোলসোনারো করোনা জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হয়েছেন।

বলছিলাম ট্রাম্পের কাহিনী। তিনি নিজে ডাক্তার না হলেও কয়েকজনকে করোনা মহাব্যাধির মহৌষধরূপে একটি ওষুধ প্রেসক্রাইব করেছিলেন। ‘প্রেসিডেন্টের প্রেসক্রিপশন’ বলে কথা। সে ওষুধ খেয়ে তিনজন মারা গেলেন। আসলে নাকি এটি করোনার নয়, ম্যালেরিয়ার দাওয়াই। এ দিকে ট্রাম্প গর্ব করে বলতে থাকেন, ‘আমি নিয়মিত এ ওষুধ খাই’। প্রশ্ন হলো, কোনো সুস্থ মানুষ কি বিনা কারণে কোনো ওষুধ সেবন করতে পারেন? তা হলে কি তিনি অসুস্থ হয়ে পড়বেন না? ট্রাম্প নিজে হাইড্রক্সি ক্লোরোকুইন বা ‘এইচসিকিউ’ নামের ওষুধের ভক্ত, যা কোভিড নয়, অন্য রোগের ওষুধ। এটা করোনা রোগীদের জন্য অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে এবং এ ওষুধ করোনা মহামারী নিরাময় করবে বলে প্রমাণিত হয়নি। এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার বললেও মার্কিন প্রশাসন গা করেনি। উল্টো ট্রাম্পের সাথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সম্পর্ক এখন খুব মন্দ। এ দিকে তিনি ব্রাজিল পাঠিয়েছেন বিপুল পরিমাণে এ বিতর্কিত ওষুধ।

ট্রাম্পের আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নভেম্বর মাসে। তিনি অনেক আশায় ছিলেন, এ সময়ের মধ্যে করোনার ওষুধ বা টিকা বের করে ফেলবে তার দেশ। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরও বাস্তবে তা হয়নি কিংবা এর সম্ভাবনাও দেখা যায়নি আজো। ইতোমধ্যে, যুক্তরাষ্ট্রের আগেই করোনা ভ্যাকসিন ‘উদ্ভাবন’ করার দাবি করে বসেছে তার এক প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ রাশিয়া। স্মর্তব্য, মহাশূন্যে মানুষ পাঠানোর ক্ষেত্রেও রাশিয়া (তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন) আমেরিকার ওপর টেক্কা মেরেছিল অতীতে। এ দিকে ট্রাম্পের একজন উপদেষ্টা এবং শীর্ষস্থানীয় মার্কিন জীবাণুবিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউচি জানিয়েছেন, আমেরিকা করোনা ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে সফল হলেও তা হবে আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলে। অর্থাৎ, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নয় শুধু, নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণেরও কিছু দিন পরে। তদুপরি জরিপ জানান দিচ্ছে, রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়েছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের চেয়ে।

আসুন, মাস্ক প্রসঙ্গে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে করণীয় যেমন কয়েকটি কাজ, তার মধ্যে সর্বপ্রথম হলো মাস্ক পরিধান করা। বিশেষত ঘরের বাইরে গেলেই পরিবহনে, দোকানে ও বাজারে, রাস্তাঘাটে, অফিসে কি কারখানায়, সভায় ও অনুষ্ঠানে- এক কথায়, সর্বত্র মাস্ক পরা সবার জন্যই বাধ্যতামূলক। ডাক্তাররা বলেছেন, মাস্ক পরিধান করা হলে শুধু স্বাস্থ্যবিধিই মানা হবে না। সেই সাথে, নিজের ও অন্যের সুরক্ষা হবে নিশ্চিত। স্বাভাবিকভাবেই, যুক্তরাষ্ট্রেও এখন সবাই মাস্ক পরে থাকা অবশ্য কর্তব্য। এটা কেবল নৈতিক কর্তব্য নয়, আইনগত বাধ্যবাধকতাও। মাস্ক পরলেই হাঁচি-কাশির সময়ে করোনা জীবাণুর সংক্রমণ থেকে বাঁচা যেতে পারে।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেকে মনে করলেন সবার চেয়ে আলাদা ও ঊর্ধ্বে। তিনি জোর দিলেন করোনাকালে প্রত্যেকে মাস্ক পরিধান করে চলার ওপর। সাথে সাথে বললেন, ‘এটা পরা প্রয়োজন ও কল্যাণকর। তবে আমি নিজে পরব না।’ যেখানে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনিই নিয়ম-বিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে সবার সামনে নজির সৃষ্টি করার কথা এবং বিশেষ করে, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান থেকে এটাই একান্তভাবে প্রত্যাশিত, সেখানে তিনি কেন, কোন যুক্তিতে ‘ব্যতিক্রম’ হবেন? এর কোনো জবাব দিতে পারেননি।

সচেতন ব্যক্তি মাত্রেরই মনে পড়বে জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত উপন্যাস Animal Farm-এর সে উক্তি : All are equals. But some are more equal than others (সবাই সমান। তবে কিছু লোক অন্যদের চেয়ে বেশি সমান) কিন্তু সমান তো সমানই। এর আবার কম বেশি কী? জর্জ অরওয়েল কথাটা বলেছিলেন তৎকালীন সমাজতন্ত্রী বা কমিউনিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থার সমালোচনা করে। সেটা এখন প্রযুক্ত হচ্ছে গণতান্ত্রিক বিশ্বের স্বঘোষিত হোতার বেলায়।

নিজ দেশে এক অনুষ্ঠানে গেলেন মার্কিন রাষ্ট্রপ্রধান। বিমানসংক্রান্ত সে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেও তিনি কোনো মাস্ক পরেননি। মিডিয়ার বদৌলতে ছবিটি চাউর হয়ে গেল সারা পৃথিবীতে। ঝড় ওঠে নিন্দা-সমালোচনার। কিন্তু ‘মার্কিন মোড়ল’ অনড়। উনি মাস্কের প্রশংসা করলেন আবার। তবে জানিয়ে দিলেন নিজে ও জিনিস পরবেন না। প্রশ্ন হলো, মাস্ক ভালো জিনিস বলে নিজে স্বীকার না করে পারেননি; তবু কেন তা ব্যবহার করতে চাননি? তাকে মাস্ক পরা অবস্থায় দেখতে ‘খারাপ লাগবে’- অহেতুক এটা মনে করেন কি?
এর জবাব ট্রাম্প নিজেই দিয়েছেন। বলেছেন, মাস্ক জিনিসটা মন্দ নয়। তিনি নিজে অবশ্য তা পরছেন না। তবে সেটা পরিধান করলে তাকে মন্দ লাগবে না। ‘বরং দেখাবে, আমেরিকার Wild West-এর থ্রিলার সিনেমার একজন নায়কের মতো।’ ট্রাম্প স্বভাবসুলভ রসিকতার প্রমাণ দিলেন এখানেও।

যা হোক, অবশেষে সম্প্রতি সবাই স্বস্তির শ্বাস ফেলছেন এটা দেখে যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প শেষ পর্যন্ত মাস্ক পরেছেন। তাকে কিন্তু মোটেও খারাপ দেখায়নি। একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি মাস্ক পরে নিয়ম মেনেছেন। আশা করা যায়, উনি ক্রমে অভ্যস্ত হয়ে উঠবেন মাস্ক পরিধানে এবং বন্ধ হবে তার উল্টাপাল্টা ও হাস্যকর কথাবার্তা বলার প্রবণতা। একবার জানা গেল, ট্রাম্পের একজন পরিচারক করোনা পজিটিভ। তিনি সাথে সাথে দাবি করলেন, ‘গত কয়েক মাসেও ওর সাথে আমার দেখা হয়নি।’ এটা বলে ট্রাম্প আইসোলেশন কিংবা কোয়ারেন্টিন থেকে মুক্ত থাকলেন। অবশ্য হোয়াইট হাউজের একজন গুরুত্বপূর্ণ স্টাফ করোনায় প্রাণ দিয়েছেন।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসন আগে থেকেই করোনা সংক্রমণের বিপদ সম্পর্কে অবগত ছিল এবং তারা এর সম্ভাব্য মোকাবেলায় একটা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রকল্পে হাত দিয়েছিলেন। পরে মুনাফাখোর ধনিকতন্ত্রের অপপ্রভাবে এ গবেষণা বন্ধ হয়ে যায়। এমন তথ্যই রয়েছে বিশ্বখ্যাত বুদ্ধিজীবী প্রফেসর নোয়াম চমস্কির সাম্প্রতিক দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারে। তার মতে, বর্তমান পরিস্থিতি আমেরিকার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ব্যর্থতার ফল।
সময় থাকতে খেয়াল না করে ট্রাম্প প্রশাসন এখন হাজারবার পস্তালেও লাভ নেই। ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। এর দায় হোয়াইট হাউজের ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্টরা’ এড়াতে পারেন না। অথচ এত দিন পরে মাস্ক পরে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অহঙ্কারের সাথে বলতে দ্বিধা করছেন না, ‘আমার চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক কেউ নেই।’ মনে রাখা উচিত, একজন বিখ্যাত মনীষী বলেছেন, Patriotism is the last resort of the Scoundrels এহেন অপরাজনীতি থেকে যেন দুনিয়ার সব দেশ মুক্তি পায় ও মুক্ত থাকে, তা নিশ্চিত করা না গেলে কুশাসন ও অধিকারহীনতা, তথা গণতন্ত্রের বিকৃতি ও রাজনৈতিক পৌত্তলিকতাই হবে বিপন্ন মানবজাতির নিয়তি।


আরো সংবাদ



premium cement