২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মিডিয়ায় শব্দচর্চা ও বাংলা একাডেমি

মিডিয়ায় শব্দচর্চা ও বাংলা একাডেমি - ছবি : নয়া দিগন্ত

উন্নতমানের প্রতিশব্দ থাকা সত্ত্বে¡ও মিডিয়ায় কিছু শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে যা শুনতে না শ্রুতিমধুর, না উন্নতমানের। যেমন- পুত্রের স্থলে ‘ছেলে’ লিখা বা বলা হচ্ছে। পিতার স্থলে ‘বাবা’ শব্দটি ব্যবহৃত হচ্ছে। কেউ মৃত্যুবরণ করলে ‘ইন্তেকাল’ বা ‘শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ’ বা ‘মৃত্যুবরণ’ করেছেন এর পরিবর্তে প্রয়োগ হচ্ছে ‘মারা’ গেছেন। ‘মারা’ যাওয়ার পরিবর্তে ‘ইন্তেকাল’ বা ‘শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ’ বা ‘মৃত্যুবরণ’ শব্দগুলো নিশ্চয়ই অনেক উন্নতমানের, সুশোভন ও শ্রুতিমধুর। ‘ইন্তেকাল’ শব্দটি ব্যবহারে বাতিকগ্রস্ত বুদ্ধিজীবীদের আঁতে ঘা লাগতে পারে এ জন্য যে তারা ‘ইন্তেকাল’ শব্দে হয়তো সাম্প্রদায়িকতার অহেতুক গন্ধ খুঁজে পাবেন। সে ক্ষেত্রে ‘মারা যাওয়া’ শব্দটি ব্যবহার না করে ‘মৃত্যুবরণ’ বা ‘শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ’ শব্দগুলো ব্যবহার বেশি অর্থপূর্ণ ও শ্রুতিমধুর। শাব্দিক ব্যবহার সম্পর্কেও কোনো কোনো সময় মিডিয়াকে উদাসীন মনে হয়। যেমন- একটি বহুল প্রচারিত ইলেকট্রনিক মিডিয়ার স্ক্রলের ফুট নোটে লেখা দেখলাম “মেজর সিনহার ‘মারা’ যাওয়ার ঘটনায় তিনজন গ্রেফতার”। মিডিয়ার শাব্দিক প্রয়োগ অর্থপূর্ণ হতে হবে। কেউ যদি খুন হয় সেখানে ‘নিহত’ শব্দটি প্রয়োগ করতে হবে, নিছক ‘মরা’ শব্দটি সে ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অর্থহীন এবং যথাযথ শব্দ প্রয়োগে উদাসীনতার পরিচায়ক। মিডিয়া এক অর্থে গোটা পৃথিবীকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রভাবিত করার এখতিয়ার অর্জন করেছে। সে ক্ষেত্রে ‘শব্দ’ প্রয়োগে মিডিয়া যদি উদাসীন হয়, তবে ভাষা সমৃদ্ধিশালী হতে বাধাগ্রস্ত হবে। এ ধরনের আরো অনেক দৃষ্টান্ত দেয়া যাবে যেখানে উন্নতমানের প্রতিশব্দ থাকা সত্ত্বেও নিম্নমানের শব্দ অহরহ ব্যবহৃত হচ্ছে।

শব্দ শ্রুতিমধুর হওয়ার তাৎপর্য অনেক। যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম শ্রুতিমধুর নয়, সেগুলো পরিবর্তনের জন্য সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নেত্রকোনা জেলাধীন পূর্বধলা উপজেলার একটি স্কুলের নাম ‘চোরের ভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। ইতোমধ্যেই নীলফামারী সদর উপজেলার ‘মানুষমারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এর নাম পরিবর্তন করে ‘মানুষ গড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামকরণ করা হয়েছে। দীর্ঘ দিন পর হলেও সরকার শ্রুতিমধুর নাম রাখার যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা যথোপযুক্ত সিদ্ধান্ত বটে। উল্লেখ্য, ‘মানুষমারা’ নামের চেয়ে ‘মানুষ গড়া’ শব্দটি অনেক শ্রুতিমধুর, তাৎপর্যপূর্ণ ও শোভন। অন্য দিকে ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ‘মরা’ টাইপের শব্দ সুশোভন নয় জেনেও মিডিয়া অনেক ক্ষেত্রেই এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করছে। এটি কি সঠিক ভাষা প্রয়োগে অলসতা, নাকি ভাষাজ্ঞানের ঘাটতি? উল্লেখ্য, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) এক সার্কুলারে যেসব প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম শ্রুতিমধুর নয়, তা আগামী ৩০ আগস্ট ২০২০-এর মধ্যে পরিবর্তনের জন্য নির্দেশনা জারি করেছেন। এ ধরনের প্রস্তাব এর আগেই বাংলা একাডেমি থেকে দেয়া উচিত ছিল, কিন্তু কর্তৃপক্ষ যেখানে সরকারকে খুশি রাখার জন্য ব্যতিব্যস্ত, সেখানে এ ধরনের সংস্কারমূলক কাজ করার সময় কোথায়?

বাংলা ভাষা আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে রক্ত ঝরাতে হয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্র্রভাষা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেলেও ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বাংলা ভাষা এখনো রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পরিপূর্ণতা লাভ করেনি। অথচ বাঙালির ভাষা আন্দোলনের প্রতি বিশ্ব স্বীকৃতি দিয়েছে। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে।

আসামে ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে গণ-আন্দোলন হয়েছে। পৃথিবীর অন্যান্য স্থানেও নিজ মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার জন্য আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু বাঙালির ভাষা আন্দোলনই আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ফলে বলাবাহুল্য, বাংলা এখন অন্যতম আন্তর্জাতিক ভাষা। এ কারণেই ভাষাটির মর্যাদা বৃদ্ধি, সুশোভিত করে প্রসারিত করা প্রতিটি বাঙালির দায়িত্ব; মিডিয়ার দায়িত্ব এখানে আরো বেশি।

ভাষার উন্নয়ন ও প্রয়োগ যথাযথ হচ্ছে কি না তা দেখার দায়িত্ব যে প্রতিষ্ঠানটির তার নাম বাংলা একাডেমি। বায়ান্নর মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর চুয়ান্ন সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর ফ্রন্টের ২১ দফার ষষ্ঠদশ দফার বাস্তবায়ন হিসেবে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা-বিকাশের লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বর্ধমান হাউজে বাংলা একাডেমির আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় বর্ধমান হাউজে মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের বাসভবন ছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অসমাপ্ত বিচারকার্য এ ভবনেই হয়েছিল। জনতার রোষানলে বিচারক এম এ রহমান তখন পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক দিক থেকেও ভবনটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দলমত নির্বিশেষে জাতীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়া বা সব পথ ও মতের মানুষ যেন একটি জায়গায় বসতে পারে এ ধরনের একটি ‘প্লাটফর্ম’ থাকা দরকার, যা অন্যান্য রাষ্ট্র্রেও রয়েছে। ‘বাংলা একাডেমি’ সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হতে পারত, যা বাংলাদেশের সব পথ ও মতের কবি, সাহিত্যিক, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের গ্রহণযোগ্য একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা যেত।

কিন্তু দিনে দিনে ‘বাংলা একাডেমি’ দলীয় একটি প্লাটফর্মে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের অফিসের মতোই বাংলা একাডেমি সরকারের একটি রাজনৈতিক অফিস হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে। একাডেমি পরিচালনার জন্য একাডেমি সদস্যদের নির্বাচিত কোনো কমিটি নেই। সরকারি ঘরানার একজন বুদ্ধিজীবী একাডেমির সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন আমৃত্যু। কমিটির অন্য সদস্যরাও একই ঘরানা থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত। ফলে ভিন্ন মতাবলম্বীদের এখানে প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। একাডেমি অনেক বই প্রকাশ করেছে, কিন্তু ভিন্ন মতাবলম্বীদের বই প্রকাশ করে না। লেখক হিসেবে পুরস্কার কিংবা স্বীকৃতি দেয়া বা ফেলোশিপ দেয়ার ক্ষেত্রেও শুধু সরকারি ঘরানার লেখকদের গুরুত্ব দেয়া হয়। ভিন্ন মতাবলম্বীরা উন্নতমানের বই লিখলে বা গবেষণা করলেও স্বীকৃতি নেই, সহযোগিতা করা তো অনেক দূরের কথা।

একটি দেশের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে পারলেই জাতিটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। তখন যুদ্ধ করে পতন ঘটানোর প্রয়োজন হয় না। ফলে একটি জাতিসত্তাকে পরিপূর্ণ করার জন্য জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে প্রটেকশন দিতে হবে। নতুবা অপসংস্কৃতি বা পশ্চিমা সংস্কৃতি প্রবেশ করে জাতীয় সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করবে, যা ইতোমধ্যে অনেকটাই দখল করে ফেলেছে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে লালন পালনের চেয়ে ওয়েস্টার্ন সংস্কৃতির প্রতি সমাজের উচ্চ শ্রেণীর মানুষ ঝুঁকে পড়েছে। বাংলা নববর্ষ যথাযথ মর্যাদায় উদযাপনের চেয়ে টাকাওয়ালা লোকেরা ও তাদের উঠতি বয়সের সন্তানরা থার্টিফার্স্ট নাইট বেশি ঘটা করে পালন করে থাকে। পশ্চিমা সংস্কৃতি যাতে জাতিগতভাবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি অঙ্গনের অংশ হতে না পারে; এ জন্য বাংলা একাডেমির যতটুকু গুরুদায়িত্ব পালন করার কথা ছিল ততটুকু তারা করেন না। তারা শুধু নিজেদের পছন্দনীয় ঘরানার লোকদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।

গ্রামগঞ্জে এখনো অনেক বাউল; মুর্শিদিসহ নানা ধরনের উৎসব পালন করা হচ্ছে, কোথাও বা পৃষ্ঠপোষকতা তথা অভাবের কারণে হারিয়ে গেছে। সেগুলো জাতীয়ভাবে সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে সংগ্রহ করা হচ্ছে কি না বা কতটুকু সংগ্রহ করা হচ্ছে তা-ও জাতি জানতে পারে না। কারণ বাংলা একাডেমি তাদের কার্যক্রম দেশব্যাপী বিস্তৃত করতে পারেনি।

স্বাধীনতার পর দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করার জন্য সরকারিভাবে একটি উদ্যোগের কথা বলা হলেও, পরবর্তীকালে ক্ষমতাসীন সব সরকারের ম্যানিফেস্টুুতে ‘দেশ নিরক্ষরমুক্ত’ করার ঘোষণা থাকলেও তা আর বাস্তবায়িত হয় না। সরকারের ‘গণশিক্ষা’ কার্যক্রম নামে একটি দফতর থাকলেও এর কোনো ভূমিকা জনগণ দেখতে পায় না। একটি রাষ্ট্র তথা জাতিকে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে মাথা উঁচু করে টিকে থাকার জন্যই সব স্তরে মানসিক প্রস্তুতি ও সেভাবে অগ্রগামী হওয়া দরকার।

অনেক রাষ্ট্র্র যেখানে চাঁদে তাদের জাতীয় পতাকা রেখেছে, অন্যান্য গ্রহে যাওয়ার পদক্ষেপ নিচ্ছে; সেখানে আমরা বালিশ ক্রয়ের খরচ বহু গুণ বাড়িয়ে কিভাবে টাকা আত্মসাৎ করা যায়, কিভাবে গরিবের ত্রাণের চাল কালোবাজারে বিক্রি করা যায়, কিভাবে জাল টাকা বানানো যায়, পুলিশে চাকরিরত অবস্থায়ও কিভাবে মানুষ খুন ও চাঁদাবাজি করা যায়, করোনার ভুয়া সার্টিফিকেট দিয়ে অজস্র্র অর্থ উপার্জন করা যায়, ক্ষমতাসীনদের নেতা হয়ে কিভাবে জাতিকে শোষণ শাসন করা যায় প্রভৃতি অপকর্ম ও অপরাধে লিপ্ত। এসব যা করা হচ্ছে রাষ্ট্র্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে। রাষ্ট্র্র নিজেও দলবাজিতে নিমগ্ন থাকায় চোরেরা মহাচোরে; বাটপাররা মহাবাটপারে পরিণত হয়েছে। যেহেতু আমাদের জাতিসত্তা এখনো গড়ে ওঠেনি, তথা দেশপ্রেমে পুরো জাতি উদ্বুদ্ধ হয়নি তাই জাতি আজ আপসকামিতায় লিপ্ত। ফলে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়, অপব্যবহার ও রাষ্ট্র্রীয় সম্পদের সুষম বণ্টনের নীতিমালাবহির্ভূত ও পরিপন্থী কর্মকাণ্ড অবাধে হচ্ছে। সব বন্ধ করার জন্য দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ একটি জাতিসত্তা দরকার।

লেখক : জীবন সদস্য, বাংলা একাডেমি
সাবেক সিনেটর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীকে বক্তব্য প্রত্যাহার করে ক্ষমা চাইতে বললেন এমপি জয় পঞ্চপল্লীর ঘটনায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে যা দরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে করার নির্দেশ সরকার ভিন্ন মত ও পথের মানুষদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চালাচ্ছে : মির্জা ফখরুল ধুনটে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে বৃদ্ধের মৃত্যু বাকৃবির এক্স রোটারেক্টরর্স ফোরামের বৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠিত পাবনায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড, হিট স্ট্রোকে মৃত্যু ১ দাগনভুঞায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটুক্তির ঘটনায় আ’লীগ নেতাকে শোকজ দখলে থাকা ৪ গ্রাম আজারবাইজানকে ফিরিয়ে দেবে আর্মেনিয়া স্বামীর পুরুষাঙ্গ কেটে স্ত্রীর আত্মহত্যা! কুলাউড়ায় ট্রেনে কাটা পড়ে নারীর মৃত্যু যেসব এলাকায় রোববার ১২ ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকবে

সকল