২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ইসরাইল-আমিরাত ‘শান্তিচুক্তি’

ইসরাইল-আমিরাত ‘শান্তিচুক্তি’ - ছবি : সংগৃহীত

গত ১৩ আগস্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপস্থিতিতে হোয়াইট হাউজে আরব আমিরাতের সাথে ইসরাইলের যে ‘শান্তিচুক্তি’ সম্পাদিত হয়েছে তার তাৎপর্য বহুমাত্রিক। এতে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির সুবাতাস বইবে, না নতুন করে সঙ্ঘাত সৃষ্টি করবে এ বিষয়ে শেষ কথা বলার সময় হয়নি। এই চুক্তির মাধ্যমে দু’দেশ ফ্লাইট পরিচালনা, নিরাপত্তা, টেলিযোগাযোগ, প্রযুক্তি, বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি ও দূতাবাস বিনিময়ে আর কোনো বাধা রইল না।

১৯৪৮ সাল থেকে কমবেশি সবসময় ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের সঙ্ঘাত অব্যাহত রয়েছে। এ চুক্তির আগে ও পরে হামলা ও পাল্টা হামলা চলে। গত ১২ ও ১৫ আগস্ট ইসরাইল বাহিনী গাজা ভূখণ্ডে হামলা চালিয়ে ক্ষতিসাধন করে। তাদের অভিযোগ, ‘হামাস’ বেলুনভর্তি বিস্ফোরক পাঠিয়েছে ইসরাইলি ভূখণ্ডে এবং এতে দক্ষিণ ইসরাইলের বিস্তৃত ক্ষেতের ফসলে আগুন ধরে যায়।

আলোচ্য চুক্তির অন্যতম শর্ত হলো ‘ইসরাইল জর্দান নদীর পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ করবে না।’ কিন্তু চুক্তির পরপরই ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ঘোষণা করেন, মার্কিন প্রেসিডেন্টের অনুরোধ রক্ষার্থে বসতি স্থাপন তারা সাময়িক স্থগিত রাখবেন। তবে এর সম্প্রসারণের মূল পরিকল্পনা থেকে সরে আসবেন না। ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনকারীদের মধ্যে মিসর ও জর্দানের পর আমিরাত তৃতীয় আরব রাষ্ট্র। তারা কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার মাধ্যমে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা সুসংহত করতে চান। তারা মনে করেন, আরব-ইসরাইল সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। স্মর্তব্য, ১৯৭৯ সালে মিসর আর ১৯৯৪ সালে জর্দানের সাথে ইসরাইলের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। মিসর ও জর্দানের সাথে শান্তিচুক্তি সম্পাদনের পরও ইসরাইল জোরপূর্বক ফিলিস্তিনি ভূমি অধিগ্রহণ অব্যাহত রাখে।

এবারের এই চুক্তি বিশ্বজুড়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বাহরাইন, মিসর, ওমান, জর্দান, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জাতিসঙ্ঘ চুক্তিকে স্বাগত জানায়। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী এ চুক্তিকে ‘অতুলনীয় আনন্দ ও ঐতিহাসিক মুহূর্ত’ বললেও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এটাকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে অভিহিত করেছেন। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, আমিরাতের এই ‘ভণ্ডামিপূর্ণ আচরণ’ ইতিহাস ও মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ কখনো ক্ষমা করবে না। ইরানের কাছে এই চুক্তি ‘বিপজ্জনক ও অবৈধ’। সৌদি আরব সরকারিভাবে কোনো মন্তব্য করেনি। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, রিয়াদ-তেলআবিব সম্পর্ক ইতিবাচক হলেও জনরোষের ভয়ে সৌদি আরব মুখ খুলছে না চুক্তির ব্যাপারে। বিজ্ঞজনরা মনে করেন, ইহুদি আগ্রাসন ও নৃশংসতার বিরুদ্ধে যখন বিশ্বের মানবতাবাদীরা বিশেষত মুসলিম দুনিয়া সোচ্চার, ঠিক সে মুহূর্তে ইসরাইল-আমিরাত চুক্তি উম্মাহর চেতনায় ছুরিকাঘাতের শামিল। নিউইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট টমাস এল ফ্রিডম্যানের মতে, এই চুক্তি ‘মধ্যপ্রাচ্যে ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকম্পের আঘাত। ১৯৭৯ সালে ইসরাইল-মিসর চুক্তির ফলে প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে প্রাণ দিতে হয়েছিল’ (নয়া দিগন্ত, ১৬ আগস্ট ২০২০)।

১. এই চুক্তি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ইতিবাচক কোনো ভূমিকা রাখবে না এবং আরবদের দুর্দশাও লাঘব করবে না। ফিলিস্তিন-ইসরাইল সঙ্ঘাত হ্রাস পাবে বলেও মনে হয় না। একমাত্র ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বিপক্ষীয় সম্মানজনক ও ফলপ্রসূ আলোচনা বা সমঝোতা চুক্তি সুফল বয়ে আনতে পারে।

২. এই চুক্তির মাধ্যমে ইসরাইলের সব অবৈধ কর্মকাণ্ড বিশেষত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড অধিগ্রহণ, পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ, মসজিদে আকসা দখল, জেরুসালেমকে ইসরাইলি রাজধানী ঘোষণা ও মসজিদে আকসার স্থলে ‘হায়কলে সোলায়মানি’ প্রতিষ্ঠাকে আমিরাত বৈধতা দিলো।

৩. ইসরাইলের সাথে আমিরাতের কূটনৈতিক, আর্থ-বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদার হলে যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় অঞ্চলে অস্ত্র বিক্রির সুযোগ আরো বৃদ্ধি করতে পারবে। চলতি বছর ৫৫৬ মিলিয়ন ডলার মূল্যের চার হাজার ৫৬৯টি মাইন রেসিস্ট্যান্ট অ্যাম্বুশ প্রটেকটেড যান আমিরাতের কাছে বিক্রির জন্য মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিয়েছে। এটা এখন কার্যকর হতে বাধা নেই।

৪. যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে নিশ্চয়তা দিয়েছে, লকহিড মার্টিনের তৈরি করা এফ-৩৫ জঙ্গিবিমানের মতো অত্যাধুনিক অস্ত্র তারা পেতে থাকবে। আরব দেশগুলোর হাতে এত উন্নত অস্ত্র নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনার বাইরে যাওয়ার সক্ষমতা ইসরাইলের নেই। তার নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আর্থ-সামরিক সহযোগিতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন ও রাজনৈতিক মোড়লিপনা অব্যাহত রাখার জন্য ইসরাইলের সহায়তাও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অতীব জরুরি।

৫. আমিরাত-ইসরাইল চুক্তির ব্যাপারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আগ্রহটা বেশি। কারণ করোনাকালে দেশের অভ্যন্তরে তিনি জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ১০০ বছরের ইতিহাসে স্বাস্থ্য খাতে এত নাজুক পরিস্থিতি আগে কখনো সৃষ্টি হয়নি। কোভিড-১৯ এ পৌনে দুই লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং আক্রান্তের সংখ্যা ৫৫ লাখ ছাড়িয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে লাখ লাখ মানুষ হয়েছে কর্মহীন। এহেন পরিস্থিতিতে ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় তার কৃতিত্ব হিসেবে এ চুক্তিকে দেখাতে চান। আগামী নভেম্বরের ভোটে এটা প্রভাব ফেলতে পারে। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণির সাথে তালেবানদের ‘যুদ্ধনিরোধ চুক্তি’র পেছনেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একই পরিকল্পনা কাজ করেছে।

৬. আরব দেশগুলোতে জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার নেই। সেখানে শাসকরা বংশপরম্পরায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ভোগ করে আসছেন। রাজা বাদশাহরা তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। একেকটি দেশ একেকটি পরিবারের কাছে ‘জিম্মি’। মানবাধিকার, সুষ্ঠু নির্বাচন, মত প্রকাশের অধিকার ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এসব দেশে নিষিদ্ধ। যেহেতু শাসকদের জনগণের ম্যান্ডেট নেই, ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখার জন্য বৈদেশিক পরাশক্তির সহায়তা প্রয়োজন। হোক সেটা যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়া বা ইসরাইল। জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া শুধু মসনদের স্বার্থে ভিনদেশী সামরিক শক্তির সহায়তা নিতে গেলে গলায় বিদ্ধ হয় কাঁটা।

৭. মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইরান এক বিরাট ফ্যাক্টর। বিভিন্ন আরব দেশে শিয়া মতবাদের বিকাশ ঘটছে দ্রুত। সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চল, ইয়েমেন, বাহরাইন, ওমান, লেবানন, সিরিয়া ও ইরাকে বিপুল জনগোষ্ঠী শিয়া মতাবলম্বী। তারা ঐক্যবদ্ধ। আরব শিয়াদের ওপর রয়েছে ইরানের অপ্রতিহত প্রভাব। বাহরাইন থেকে মার্কিন সেনা ঘাঁটি প্রত্যাহার করা হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই শিয়ারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে ফেলতে পারে। তাই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কিছুদিন আগে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আমেরিকাকে সামরিক খাতে নির্ধারিত অর্থ না দিলে সৌদি আরবের প্রতি প্রদত্ত মার্কিন সমর্থন প্রত্যাহার করা হবে এবং সে ক্ষেত্রে এক সপ্তাহও সৌদি শাসকরা ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবেন না।’ একটি স্বাধীন দেশের জন্য এ রকম হুমকি কতই না বেদনাদায়ক।

মনে রাখা দরকার, ইরান-মার্কিন সম্পর্কে যতই টানাপড়েন চলুক, ইসরাইল নিয়ে ইরান যতই হুমকি-ধমকি দিক, ইরান দুর্বল হোক বা ধ্বংস হোক- সেটা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল চাইবে না। কারণ তখন আরব দেশগুলোকে ‘শিয়া জুজু’র ভয় দেখিয়ে অস্ত্র বিক্রি করার এবং ঘাঁটি স্থাপন করে সংশ্লিষ্ট দেশ থেকে কোটি কোটি ডলারের তেল, বেতন-ভাতা ও উপঢৌকন নেয়ার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।

৮. ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর জন্য আমিরাতের সাথে এই চুক্তির প্রয়োজন ছিল। বেশ কিছুদিন যাবত ইসরাইলের বিভিন্ন শহরে নেতানিয়াহুবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। এটি ইসরাইলি জনগণের দৃষ্টি ফেরানোর অস্থায়ী পদক্ষেপ। তবে পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণ অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে নেতানিয়াহুর জনপ্রিয়তায় ধস নামতে পারে। পশ্চিম তীরের এক-তৃতীয়াংশ ভূমি দখল করা ছিল নেতানিয়াহুর সাম্প্রতিক নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি।

৯. এই চুক্তির ফলে আমিরাতের বিশাল বাজারে ইসরাইলের অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তৃত হবে। ইহুদিরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনকুবের। তাই হাজার হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগে কোনো বাধা থাকবে না। গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদ’ দুবাইতে দফতর স্থাপন করে পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলোর নাড়ি নক্ষত্রের খবর জোগাড় করে নিজেদের থিংক ট্যাংকে সরবরাহ করার সুযোগ অবারিত হবে।

১০. এই চুক্তির মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনিদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়া হয়েছে। আলজাজিরার রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা মনে করেন, ‘আরব আমিরাত বলছে, তারা ফিলিস্তিনি জনগণের মর্যাদা, অধিকার এবং তাদের নিজস্ব সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য লড়াইকে সমর্থন দেয়া অব্যাহত রাখবে; কিন্তু এ নিয়ে সংশয় রয়েছে। ইসরাইলের সাথে গোপন সুরক্ষা সহযোগিতার বিষয়টি আমিরাত দীর্ঘ দিন ফিলিস্তিনিদের কাছে গোপন রেখেছে। ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার সময় বা শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের বিষয়ে তারা ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের সাথে কোনো পরামর্শ বা সমন্বয় করেনি। প্রকৃতপক্ষে, তারা দীর্ঘ দিন ধরেই ফিলিস্তিনের দুর্দশা থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল এবং দলত্যাগী ফিলিস্তিনি নেতা মোহাম্মদ দাহলানকে প্রশ্রয় ও সমর্থন দিয়ে ফিলিস্তিনি ঐক্যকে দুর্বল করেছে। ফিলিস্তিনিদের আশঙ্কা, ইসরাইল তার এলাকা সম্প্রসারণ এবং ফিলিস্তিনি জনগণকে দমনের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সম্ভাব্য অন্যান্য আরব উদ্যোগকে কাজে লাগাবে’ (প্রথম আলো, ১৬ আগস্ট ২০২০)।

১১. মার্কিন রাজনীতি ও প্রশাসনে ইহুদি লবি বেশ শক্তিশালী। ডেমোক্র্যাটিক অথবা রিপাবলিকান দলের যিনিই প্রেসিডেন্ট হন না কেন, সে দেশের ইহুদি প্রেসার গ্রুপের বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। এটা থেকে ইসরাইল শতভাগ সুবিধা পেয়ে আসছে এবং আগামীতেও নেবে।

১৯১৭ সালে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোর ফিলিস্তিনকে ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ হিসেবে ঘোষণা দেন। এটা ইতিহাসে ‘বেলফোর ডিক্লারেশন’ নামে পরিচিত। ১৯৪৮ সালে ইহুদিদের ইসরাইল রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় দেশগুলো তড়িঘড়ি করে ইসরাইলের স্বীকৃতি দিতে থাকে। মূলত ১৮৮২ সাল থেকে ইহুদিদের অভিবাসন প্রক্রিয়া শুরু হলেও হিটলারের নিধনযজ্ঞ থেকে বাঁচার জন্য হাজার হাজার ইহুদি ফিলিস্তিনে এসে বসতি স্থাপন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে হিটলার ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করে বলে জানা যায়। যে ভূমিতে ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হয় সেখান থেকে সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি নাগরিক পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তারা আর কখনো ফিরে আসতে পারেননি। ইসরাইলের অস্তিত্ব রক্ষায় ইহুদিরা অনেক ক্ষেত্রে খ্রিষ্টানদের সাথে অতীতের তিক্ততা ভুলে এক মঞ্চে আসতে পারলেও মুসলমানরা একতাবদ্ধ হতে পারেনি। ওআইসি এবং আরব লিগ শ্বেতহস্তীর ন্যায় স্থাণু ও নির্বীর্য প্রতিষ্ঠানে পর্যবসিত হয়েছে।

ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৪৮, ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে তাদের সাথে আরবদের যুদ্ধ হয়েছে চারবার। প্রতিটি যুদ্ধেই আরবরা পরাজিত হয়েছে। ইসরাইল প্রতিটি যুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা পেয়েছে ব্যাপকহারে। বিলাসপ্রিয়তা, স্বৈরশাসন, সামরিক শক্তির ঘাটতি, খিলাফতের অবসান এবং উম্মাহ চেতনার বিলুপ্তি আরবদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ। আরবদের সাথে সঙ্ঘাতের ইতিহাসে ২০০৬ সালে ইসরাইলি সেনাসদস্যরা লেবাননের হিজবুল্লাহ গেরিলাদের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হয়। এর পেছনে ছিল ইরানের প্রত্যক্ষ সহায়তা। ৩৪ দিনের এই লড়াই জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় শেষ হয়। এতে দেড় হাজার লেবাননি নাগরিক প্রাণ হারান এবং ১০ লাখ বাস্তুচ্যুত হন।

লেবানন, ইরাক, সিরিয়া, মিসর ও সৌদি আরব নিয়ে ‘বৃহত্তর ইসরাইল’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই হলো ইহুদিদের লালিত স্বপ্ন। তারা দাজ্জালের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। নতুন নতুন বৈশ্বিক ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। এসব কথা The Protocols of Learned Elder Zion গ্রন্থে সবিস্তারে উল্লেখ করা হয়েছে। আরব দেশগুলো ইসরাইলের আগ্রাসী থাবা রোধ করতে পারবে বলে মনে হয় না। ধীরে ধীরে আরব দেশগুলো ইঙ্গ-মার্কিন-ইসরাইল জোট ও বলয়ে চলে যাচ্ছে।

মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা:-এর শিক্ষা, সতর্কবাণী ও কালজয়ী আদর্শ থেকে তারা সরে যাচ্ছে। মূলত ১২৫৮ সালে মোঙ্গল নেতা হালাকু খানের হাতে বাগদাদের পতনের পর আরবরা শিরদাড়া সোজা করতে পারেনি। শৌর্য বীর্য, ঐতিহ্য ও অমিত বিক্রম হারিয়ে ফেলেছে। আশঙ্কা হচ্ছে, মুসলমানদের নেতৃত্ব অনারবদের হাতে চলে যাবে। অনারব কোনো মুসলিম দেশ অথবা জোট ইসরাইলের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাকে দুঃস্বপ্নে পরিণত করতে এগিয়ে আসতে পারে। এ দেশ বা জোটকে কেন্দ্র করে মুসলমানরা হয়তো একতাবদ্ধ হবে। চূড়ান্ত লড়াই হবে এবং মুসলমানদের তখন বিজয় সূচিত হবে। তাহলে ফিলিস্তিনিরা হারানো ভূমি উদ্ধার করে স্বাধীন রাষ্ট্রের অধিকার ফিরে পাবে। নতুন নামে গাজী সালাহউদ্দিন আইয়ুবির মতো অকুতোভয় বীরের জন্ম হতে পারে। পরিবেশ, পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ যৌক্তিক পরিণতির দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে। আগেভাগে দিনক্ষণ বলা মুশকিল; তবে এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এমন ইঙ্গিতের উল্লেখ রয়েছে। আকাশে ঘন মেঘ দেখলে বৃষ্টির আন্দাজ ও প্রত্যাশা করা যায়।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ওমর গণি এমইএস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।


আরো সংবাদ



premium cement