২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও পুলিশি রাজত্ব

রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও পুলিশি রাজত্ব - ছবি : নয়া দিগন্ত

মিডিয়ার ভাষ্যমতে, ‘অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা প্রায় এক মাস ধরে কক্সবাজারে অবস্থান করায় সংশ্লিষ্ট সব মহলের কাছে অপরিচিত ছিলেন না। অনেকবার তিনি শামলাপুর চেকপোস্ট অতিক্রম করেছেন পুলিশের বিনা বাধায়। তিনি কক্সবাজারের প্রাকৃতিক দৃশ্যের ভিডিওচিত্র সংগ্রহের পাশাপাশি টেকনাফ পুলিশের মাদক কারবার সম্পর্কেও বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু তার এই ভূমিকায় মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ হন ওসি প্রদীপসহ তার দুর্বৃত্ত চক্র। তাই সিনহাকে শেষ করার পরিকল্পনা আগে থেকেই নিয়েছিলেন প্রদীপ। শুধু অপেক্ষা করছিলেন সুযোগের। সেই মতে, কোরবানির ঈদের সময়ে অর্থাৎ ৩১ জুলাই রাতের অন্ধকারে সিনহাকে পেয়ে পরিকল্পিতভাবে ক্রসফায়ারের নির্দেশ দেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, গুলি করার পর ওসি প্রদীপ দ্রুত থানা থেকে এসে গুলিবিদ্ধ সিনহার দেহ থেকে প্রাণ বের হচ্ছিল, এমন অবস্থায় তাকে লাথি মেরে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এরপর সিনহার সেই ভিডিও, সেই তথ্য ধ্বংস করে দেন। ওসি প্রদীপ সর্বশেষ এক ভিডিও বার্তায় ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে টেকনাফকে মাদকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ‘গায়েবি হামলা হবে বাড়িঘরে, গায়েবি অগ্নিসংযোগ হবে।’ ওই ঘোষণার পর ঈদের দিন বেশ কিছু বাড়িঘরে হামলা চালানো হয় এবং খুরেরমুখ এলাকায় সড়কের পাশে উঠিয়ে রাখা বেশ কিছু জেলে নৌকায় অগ্নিসংযোগ এবং শতাধিক বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। এ সময় চলে ব্যাপক চাঁদা আদায়। এখানে-সেখানে পাওয়া যায় গুলিবিদ্ধ লাশ। গত ২৮ দিনে ১১টি কথিত বন্দুকযুদ্ধে উখিয়ার জনপ্রিয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য বখতিয়ারসহ হত্যা করা হয় ২২ জনকে। ২৯ জুলাই হোয়াইক্যং ইউনিয়নের আমতলী এলাকার আনোয়ার হোসেন (২৩), পূর্ব মহেষখালিয়া পাড়ার আনোয়ার হোসেন (২২), নয়াবাজার এলাকায় ইসমাইল (২৪) ও খারাংখালী এলাকার নাছিরকে ধরে নিয়ে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করে রাতে মেরিন ড্রাইভ সড়কে নিয়ে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ সম্পন্ন করা হয়। ওই দিন কক্সবাজার ঝাউবাগান থেকে পাওয়া যায় গুলিবিদ্ধ অপর এক যুবকের লাশ।

ওসি প্রদীপ আগে ও পরে মাদক নির্মূলের ঘোষণা দিয়ে যতগুলো কথিত বন্দুকযুদ্ধের কথা বলেছেন, সব ক’টিতে ইয়াবা তথা মাদক, অস্ত্র ও হত্যার তিনটি মামলা এন্ট্রি করা হতো। এসব মামলায় এলাকার ধনাঢ্য ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। তার পর শুরু হয় গ্রেফতার বাণিজ্য। মামলার চার্জশিট থেকে আসামি বাদ দেয়ার কথা বলে এবং চার্জশিটে নাম দেয়ার ভয় দেখিয়ে আদায় করা হয় কোটি কোটি টাকা। মাসে শত কোটি টাকা উপার্জন করে এই ওসি। তথ্য মতে, প্রদীপের বিরুদ্ধে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে অনেকবার চাঁদাবাজি, স্বামীকে আটকে স্ত্রীকে ধর্ষণ, ইয়াবার নামে ব্যবসায়ীদের হয়রানি, মিথ্যা মাদক মামলায় ফাঁসিয়ে কোটি টাকা আদায়সহ বহু অভিযোগ গেছে, কিন্তু হেডকোয়ার্টার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি (জাতীয় পত্রিকা, ৭ আগস্ট ২০২০ )।

পুলিশ কর্তৃক মেজর (অব:) রাশেদ সিনহা নির্মমভাবে নিহত হওয়ার পর সরকার দায়সারা গোছের তদন্ত কমিটি গঠন করে, যা সচরাচর করে থাকে। কিন্তু সাধারণত তদন্ত প্রতিবেদন আর আলোর মুখ দেখে না, এটাই হলো বাংলাদেশের অপসংস্কৃতি। বড়জোর পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়, পরে সুবিধামতো পোস্টিং। সিনহার বিষয়টি নিয়ে যখন হইচই বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে রাওয়া ক্লাবে সেনাবাহিনীর সাবেক অফিসারদের বৈঠকে সুষ্ঠু বিচার দাবিতে আলটিমেটাম দেয়া হলো, জনরোষের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তদন্ত কমিটি পরিবর্তন করে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, চট্টগ্রামকে প্রধান করে সেনাবাহিনী ও পুলিশ প্রতিনিধি সমন্বয়ে আবার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। উভয় বাহিনীর প্রধান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে যৌথ বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘এ হত্যার দায় বাহিনীর নয়, বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির’। সরকারের মুখপাত্র এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বিবৃতি দিয়ে নিজেদের শিকড় ‘অনেক গভীরে’ উল্লেখ করে সরকার পরিবর্তনের বিষয়টি কারো মাথায় যেন না আসে, সে জন্য প্রচ্ছন্ন একটি হুমকি দিয়েছেন। রাজনৈতিক দলগুলো বক্তব্য দেয়ার আগে ‘ঠাকুর ঘরে কে রে? আমি কলা খাই না’ মার্কা বক্তব্য দিয়ে এ বিষয়ে সরকারের টনক নড়ার বিষয়টিই প্রকাশ করেন। এ ধরনের ঘটনায় সরকারের টনক নড়া জনগণের জন্য মঙ্গলজনক। তবে এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটার আগেই যদি সরকারের কান ও মন সজাগ থাকত তবে এ-জাতীয় ঘটনা কমে যেত।

শোনা যায়, ওসি প্রদীপ ইতঃপূর্বে ১৪৪টি ক্রসফায়ার করেছে, যা থেকে ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বারসহ অনেক ভালো মানুষ, সাংবাদিক কেউই রক্ষা পাননি। দায়িত্ব নিয়েই বলা যায়, এতগুলো হত্যার জন্য সরকার এর আগে আদৌ কি কোনো তদন্ত করেছিল? নাকি ক্রসফায়ারে দেয়ার জন্য পুলিশকে সরকার ‘ব্লাঙ্ক চেক’ দিয়েছে? মাদকের যেমন ভয়াবহ প্রসার ঘটেছে, মাদক কারবারের পুলিশের সম্পৃক্ততা নতুন কোনো ঘটনা নয়, মাদক সংশ্লিষ্ট অপরাধে ধরা পড়ে অনেক পুলিশ এখনো জেলখানায়। ‘মাদকের গডফাদার’ উপাধি পাওয়া সরকারি দলের সংসদ সদস্য বদিকে মাদক ‘ব্যবসায়’ জড়িত থাকার কারণে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে নমিনেশন না দিয়ে তার স্ত্রীকে দেয়া হয়েছে। অথচ গডফাদার বদির সাথে ওসি প্রদীপ (ফাইল ছবিতে) একজন সুবোধ বালকের মতোই সিভিল ড্রেসে পাশাপাশি বসে থাকার ছবি মিডিয়াতে প্রকাশ পেয়েছে। প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশে কি শুধু টেকনাফেই পুলিশের রাজ রাজত্ব, না দেশের অন্য কোথাও আছে? বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান বলেছিলেন, ‘মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ’। কথাটির প্রতিফলন রয়েছে দেশের প্রতিটি জেলায় এবং প্রতিটি থানায়।

পুলিশ এত ক্ষমতা পেল কোথায়? তারা এখন সরকারি দলের সাধারণ নেতাদের কোনো প্রকার পাত্তা দেয় না; পাত্তা দেয় তাদের যাদের সাথে উপর তলার সরাসরি কানেকশন রয়েছে। ওসি প্রদীপের একটি ভিডিও বার্তা ভাইরাল হয়েছে। হ্যান্ড মাইকে ওসি প্রদীপ রাজনৈতিক নেতাদের ভঙ্গিতেই ঘোষণা দিয়েছে, ‘গায়েবি হামলা হবে বাড়িঘরে, গায়েবি অগ্নিসংযোগ হবে’। ‘গায়েবি’ কথাটি বর্তমান আওয়ামী সরকারের আমলেই রাজনীতির সুবাদে পুলিশি কর্মকাণ্ডে চালু হয় ২০১৮ সালে। তখন ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ সালে বিএনপি চেয়ারপারসনকে সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানোর আগেই দেশব্যাপী যাতে আন্দোলন-সংগ্রাম না হতে পারে এ জন্য সরকারি নির্দেশে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই প্রতি থানায় বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নামে ‘গায়েবি’ মামলা শুরু হয়, যা অব্যাহত ছিল ২০১৮ জাতীয় নির্বাচনের রেশ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত। এ গায়েবি মামলা থেকে শুধু বিএনপি নেতাকর্মী নয়, বরং সরকারি দলের দৃষ্টিতে তাদের যারা সমর্থন করে না বলে মনে হয়েছে তাদেরও আসামি করা হয়েছে। এতে মৃত ব্যক্তি, পঙ্গু, ভিক্ষুক কেউই বাদ পড়েনি।

এ গায়েবি মামলা দিয়ে প্রতিপক্ষকে বাড়িঘর ছাড়া করা হয়েছে, জেলে আটক রাখা হয়েছে, পুলিশ ‘রিমান্ড বাণিজ্য’ করেছে, মিথ্যা মামলা জেনেও জেলা ও দায়রা জজ পর্যন্ত গায়েবি মামলায় জামিন দেননি, হাইকোর্ট থেকে জামিন নিতে হয়েছে, একটি মামলায় জামিন হলে আরেকটি গায়েবি মামলায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। তখন আগাম জামিন নেয়ার জন্য শত শত মানুষ কোর্টের বারান্দায় ভিড় জমাত। কত বড় লজ্জা ও দুঃখের কথা, রাষ্ট্রীয় বেতনভুক কর্মচারীরা জনগণের বেতন খেয়ে গায়েবি মামলা দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের জনগণকে জেলে ঢুকিয়েছে; ঘটনা ঘটেনি এমন গায়েবি (কাল্পনিক) ঘটনা সাজিয়ে মামলা দিয়েছে। সরকার নিজেই পুলিশকে গায়েবি মামলা করা অর্থাৎ মিথ্যা বলার লাইসেন্স দিয়েছে। সে লাইসেন্স পুলিশ এখন নিজেদের স্বার্থে অর্থ উপার্জনে ব্যবহার করছে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কী আছে?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুলিশের প্রভাব বহুমাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ ভোটারবিহীন, ২০১৮ সালের কথিত নির্বাচনে সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর পেছনে পুলিশের একক কৃতিত্ব রয়েছে বলে তাদের দাবি। কোনো কোনো পুলিশ অফিসার প্রকাশ্যেই এ ধরনের মন্তব্য করে থাকেন। পুলিশের এ ধারণা থেকেই গায়েবি মামলার পরে এখন গায়েবি হামলা ও গায়েবি অগ্নিসংযোগের প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছে, লুট করছে প্রভৃতি। পুলিশে এ ধরনের প্রদীপ, লিয়াকত শুধু টেকনাফে নয়, বরং দেশব্যাপী সর্বত্র। দুদক অনেক বড় বড় কথা বলে আসছে। কিন্তু পুলিশ প্রশ্নে নীরব নিস্তব্ধ। এখন দুদক বলছে, ২০১৮ সালে ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করা হয়েছিল। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, কার অঙ্গুলি নির্দেশে মাঝপথে দুদকের তদন্ত থেমে গিয়েছিল? কেন কেউ ধরা পড়লেই দুদক তদন্ত শুরু করে। দুদকের নিজস্ব উদ্যোগে কি তদন্ত করার বিধান নেই? বাংলাদেশের কোনো ডিপার্টমেন্টেই ঘুষ ছাড়া কাজ হয় না, বিষয়টি কি দুদক জানে না? নাকি পুলিশের মন্দ প্রভাবের কাছে দুদকও পরাস্ত? মনে রাখুন, ‘Prevention is better then cure.’
১৯৯৭ সালে ময়মনসিংহ কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকাকালে কর্মরত একজন কারারক্ষীকে রাতভর তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে দেখেছি। পুলিশে ভালো লোক একেবারে নেই, তা বলা যাবে না।

কিন্তু অনেক পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন যাদের অত্যাচারে সংশ্লিষ্ট এলাকা তটস্থ। প্রতি থানায় পুলিশের দালাল বাহিনী রয়েছে, তারা অপরাধী ধরার সোর্স হিসেবে ব্যবহৃত না হয়ে কোথা থেকে কী করলে অবৈধ অর্থ আদায় হবে সে সোর্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ইয়াবা সেবনকারীর সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, অন্য দিকে পুলিশের চক্ষুশূল হলেই ইয়াবা দিয়ে ধরিয়ে দেয়ার ঘটনাও বিরল নয়। এ ধরনের ঘটনা মিডিয়াতে যা আসে তা-ই দেশবাসী জানে। অন্যগুলো ধামাচাপা পড়ে যায়। বিনা দোষে অনেকেই জেল খাটে দিনের পর দিন।

গ্রামাঞ্চলে একটি প্রবাদ রয়েছে, ‘ঠেলার নাম বাবাজি’। সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের সংগঠন ‘রাওয়া ক্লাব’ যদি এগিয়ে না আসত তবে মেজর সিনহার ক্রসফায়ারকে বৈধতা দেয়া ছাড়াও তার সহযোগী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রীদের বিনা জামিনে কনভিকশন মাথায় নিয়েই হয়তো দীর্ঘ দিন জেল খাটতে হতো। উঠতি বয়সেই আইনি প্রক্রিয়ায় তাদের কপালে কলঙ্কের তিলক লাগিয়ে দিত, অন্ধকার হয়ে যেত সম্ভবনাময় ভবিষ্যৎ, পরিবারগুলো সমাজ কর্তৃক হতো ধিকৃত, হতাশায় তাদের বুকে চির ধরে যেত, সন্তানদের পরিচয় গৌরবের না হয়ে হতো অপমানের। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে কয়টি ঘটনার তদন্তের আলোর মুখ দেখেছে? মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার হওয়ার আগে কোনো রাষ্ট্রীয় সংস্থা কোনো দিন স্বউদ্যোগে প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি? কেন নেয়নি? বরং খুন করার পরও মিথ্যা মামলা কিভাবে সাজানো যায় টেলিফোনে তার পরামর্শ দেন সাবেক পুলিশ সুপার। দৃশ্যত মনে হবে, মিথ্যা মামলা সাজানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পুলিশ সর্বোচ্চ ট্রেনিংপ্রাপ্ত। কক্সবাজারের বর্তমান পুলিশ সুপারও একই ভূমিকা পালন করেছেন। মনে হচ্ছে, ওসিকে খুশি রেখেই এসপিকে চলতে হয়।

‘এক-এগারো’র সরকারের সময়ে দেখা গেছে, মাসাধিককাল আটক রেখে পরে থানায় গ্রেফতার দেখানো হতো। ধরে নিয়ে যাওয়া হতো এক জায়গা থেকে, অথচ গ্রেফতার দেখানো হতো অন্য কোনো থানায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারী কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে দেয়ার হুমকি পর্যন্ত দেয়া হয়েছে।

The Police Act’ 1861’ ১৮৬১ প্রণয়নের মাধ্যমে জনগণের জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান তথা দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনকে উদ্দেশ্য করে ১৮৬১ সালে আইনগতভাবে এ উপমহাদেশে পুলিশ বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। জনগণের জীবন, সম্পদ, সম্মান, জীবিকা প্রভৃতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশের সংবিধান। পুলিশের অনেক অতিউৎসাহী কর্মকর্তার রাজনৈতিক আচরণ তাদের লোভনীয় প্রমোশন ও পোস্টিংয়ের বিষয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। রাজনীতিবিদরা ক্ষমতায় বসেই প্রতিপক্ষকে দমন-পীড়নের জন্য পুলিশ তোষণ শুরু করেন। ফলে তাদের (পুলিশ) জিহ্বা বড় হতে হতে এত বড় হয়েছে যে, ছোটখাটো রাজনৈতিক নেতাদের এখন আর তারা তোয়াজ করে না। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিচে তাদের কোনো প্রটোকল আছে বলে তারা মনে করে না। তবে বদলি হওয়ার ভয়ে স্থানীয় এমপিদের সব বায়না পূরণ করা হয়, বিশেষ করে এমপিদের অবৈধ কার্যকলাপ বিনা বাধায় করার সহযোগী হিসেবে।

জনগণকে এখন দু’ধরনের ট্যাক্স দিতে হয়। একটি সরকারি ট্যাক্স; অপরটি এমপি বাহিনী ও পুলিশি ট্যাক্স। ফুটপাথের ফেরিওয়ালা, বেবিট্যাক্সি, টেম্পো স্ট্যান্ড থেকে শুরু করে জুয়ার আসর, মদের আসর, হোটেলে অবৈধ নারী ব্যবসা, ফেনসিডিল ব্যবসা, হাটবাজার পর্যন্ত এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে জনগণকে সরকারি ট্যাক্সের পাশাপাশি বেসরকারি ট্যাক্স দিতে হয় না, বেসরকারি ট্যাক্স না দিলেই পুলিশি হয়রানি। হয়রানি কী ও কত প্রকার তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ আঁচ করতে পারে না। প্রবাদ রয়েছে, চাকরির মধ্যে বড় চাকরি হলো ডিসি ও ওসির চাকরি। কারণ ওসি পুরো থানাকে শাসন করে, ওসিদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা ডিসিদের ছিল, কিন্তু বর্তমানে ডিসিদের সে ক্ষমতা নেই। রাজনীতিবিদরা জেলায় পুলিশকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা পুলিশের কাছেই হস্তান্তর করেছেন। ফলে তারাই এখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। যাদের উপর তলায় সরাসরি কানেকশন আছে সে সব পুলিশ অফিসার উপরস্থ কর্মকর্তাদের মান্য না করার অনেক অভিযোগ শোনা যায়। ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে পুলিশের চাঁদাবাজি এখন নিত্যনৈমিত্তিক খবরে প্রকাশ পাচ্ছে। বিষয়গুলোতে সরকারের বোধোদয় হওয়ার সময় এখনো কি হয়নি? তবে বাংলাদেশের পুলিশ অনেকগুলো জটিল মামলা সুরাহা করতে পেরেছে, আবার অনেকগুলো করেনি। এর পেছনেও রাজনৈতিক প্রভাব বিদ্যমান। পুলিশ বাহিনীকে জনগণের আস্থার জন্য সময়ে সময়ে বিভিন্ন কলাকৌশলের কথা সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের মুখে শোনা যায়। কিন্তু বাস্তবে পুলিশ জনগণের আস্থা কতটুকু অর্জন করতে পেরেছে, তা কি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহল চিন্তা করে দেখছে?

পুলিশকে যেহেতু ক্ষমতা দখলে রাখার রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, সেহেতু অতিউৎসাহী পুলিশরা ফায়দা লুটবেই। প্রমাণিত হয়েছে, পুলিশ জনগণের আস্থায় নয়- বরং সরকারের আস্থায় থাকে। প্রতিবাদী জনগণ যারা সাংবিধানিক অধিকার আদায়ের জন্য রাস্তায় নামে, তখন তাদের ঠেঙ্গানো ও গায়েবি মামলায় কারাবন্দী রাখার জন্য পুলিশের চেয়ে সরকারের ‘বিশ্বস্ত বন্ধু’ আর কে হতে পারে? তবে ক্ষমতার রদবদল হলে কে কার আসল বন্ধু তখনই উপলব্ধি করা যায়। উচ্চাভিলাষী পুলিশ কর্মকর্তারা আকাশচুম্বী স্বপ্নে বিভোর। তাদের হাত এখন অনেক লম্বা রাজনীতিবিদদের অপরাজনীতির কারণে, অর্থসম্পদেও তারা এখন বিত্তশালী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ (অ্যাডভোকেট) বলেছিলেন, ‘যে পুলিশ আমার পাছার মধ্যে লাঠি দিয়ে বাড়ি মেরেছে, সেই এখন আমার সাথে রাজনীতি করতে চায়।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেও পুলিশের সংস্কারের কথা বলছেন। তবে এটি নতুন কোনো কথা নয়, কোনো ঘটনা ঘটলেই জনগণকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য এটি বলা হয়। শুনতে খুব ভালো লাগে। তবে দেখা যাক, এর বাস্তবায়ন কতটুকু হয়! পুলিশকে ‘আবর্জনামুক্ত’ রাখতে না পারলে জনগণের আস্থায় আনা যাবে না। সরকার সত্যিই যদি পুলিশ বিভাগকে সংস্কার করতে চায় তবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা রদবদলের জন্য পুলিশকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। ক্ষমতাসীনরা সর্বকালেই নিরস্ত্র জনগণকে দমানোর জন্য সশস্ত্র পুলিশকে ব্যবহার করে তাদের বেপরোয়া করে তোলার কারণেই সময়ে সময়ে জনগণের এ ধরনের ভোগান্তি। নিরীহ জনগণ এর পরিসমাপ্তির অপেক্ষায়।

দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ পর্যন্ত পুলিশ বাহিনীর ৬৬ জন সদস্য মৃত্যুবরণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধেও তাদের অনেক ভূমিকা ছিল। পুলিশ বাহিনীতে সৎ লোক আছে অনেক। তবে চেকপোস্টে গাড়ি থামানোর ক্ষমতা পুলিশের, অস্ত্র পুলিশের, পোশাক পুলিশের, বেতন চলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে; এখন আইজিপি বলবেনÑ দায় পুলিশের নয়, ব্যক্তি প্রদীপের, এমন অদ্ভুত কথা জনগণ মানবে না। ভয়ে চুপ থাকার নাম মেনে নেয়া নয়। ঘাটে নৌকা বেঁধে দিন-রাত দাঁড় টানলেও নৌকা যে তিমিরে ছিল, সেখানেই ঘুরপাক খাবে, এগোবে না। পুলিশ বাহিনীতে সংস্কার যদি আনতেই হয় তবে ‘টপ টু বটম’ স্ক্যানিং অপারেশন দরকার। তবেই জাতি অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সার্বিক সেবা পাওয়ার নিশ্চয়তা পাবে।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)

E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement