২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

জাতিগিরির ‘স্বদেশী জাগরণ’ অচল

জাতিগিরির ‘স্বদেশী জাগরণ’ অচল - ছবি : নয়া দিগন্ত

প্রসঙ্গটা ভারত থেকে শুরু হলেও তা কেবল ভারতেই সীমাবদ্ধ নয়। জাতি বা স্বদেশীপনার ভুল চিন্তার প্রভাব সবখানে আছে। বিশেষ করে যেখানে দেশ বা রাষ্ট্র বলতেই মনে খামোখা ‘জাতি’ ধারণা আসে; যদিও ‘জনগোষ্ঠীগত কমন স্বার্থ’ অথবা ‘জনস্বার্থ’ বা ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট’- এসব ধারণা থাকবে। এর সাথে রাষ্ট্রে কোনো ‘জাতি’ ধারণা থাকা না থাকার কোনো সম্পর্ক নেই, অনিবার্যও নয়। বিজাতীয় বা বি-জাতির বিপরীতে জাতি ধারণা, অপ্রয়োজনীয় ‘নিজেদের’ বলে একটা ধারণা। সেই সাথে, বিদেশী মানে খারাপ, বিদেশের বিরুদ্ধে ‘আমরা’ অথবা ‘স্বদেশী’ ধরনের এক ধারণা হলো জাতি। এখান থেকেই স্বদেশী পণ্য ভালো, তা মোটা ভাত বা মোটা কাপড় হলেও ভালো ইত্যাদি বলে ভুয়া দাবি করা হয়।

এ ছাড়াও বিপুলসংখ্যক মানুষের ধারণা হচ্ছে, একটা ‘জাতিবোধ’ ছাড়া ‘দেশ’, ‘রাজনীতি’ বা ‘রাষ্ট্রের’ কল্পনা অসম্ভব। কাজেই একটা জাতিবোধ থাকতেই হবে আর সেই সাথে জাতীয় বা দেশীয় পণ্যের প্রতি ভালোবাসা আর বিদেশী পণ্যের প্রতি ঘৃণা, পারলে তা বর্জন; না হলেও অন্তত কম-ভালোবাসা থাকার ‘স্বদেশীপনা’ তো থাকতেই হবে! এটা জাতি ধারণার পক্ষে ভুয়া বয়ান!

এখানে স্বদেশীপনা শব্দটা ব্যবহার করেছি নেতি ও ঠাট্টা অর্থে। অনেকটা ছেলেমিপনা, আদেখলাপনা বা পোলাপান শব্দের মতো নেতিবাচক অর্থে। অর্থাৎ যাকে ‘স্বদেশী’ বলছি তা আসলে স্বদেশী বা দেশের জন্য ইতিবাচক নয়; সেটা বুঝাতে; আর আসলে তা নয় সেই হুঁশ আনার জন্য।

এদিকে এ ধরনের আলোচনার সমস্যা হয় যেটা, তা হলো, ব্যাপারটা কী তা বুঝিয়ে বললেও এবং বুঝলেও সেটা তত্ত্বগত ধারণার মতো একটা দূরত্বেই থেকে যায়। তাই অবস্থা হয়- কথা সত্য কিন্তু মানব না- ধরনের। তাই একেবারে বাস্তবে ঘটেছে, বাস্তব সমস্যা হিসেবে হাজির হয়েছে সেটা দেখিয়ে এখানে বলব, কথিত জাতিবোধের স্বদেশীপনা একটা অকার্যকর ও ভুল ধারণা। সেটা এখানে দেখাব ভারতের এখনকার বাস্তব সমস্যা বা উদাহরণের পরিপ্রেক্ষিতে।

এদিকে আরো সমস্যা হচ্ছে প্রায় সবাই স্বদেশীপনা শব্দের সাথে পরিচিত। ধারণাটা জানা আছে কিন্তু কেউ বাস্তবে একালের নিজ নিজ দেশে ধারণাটা পরীক্ষা করে দেখেনি। তবে একালে ধারণাটার সত্যতা না থাকলেও এর একটা আবেগী দিক আছে- ‘দেশের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া’ বা ‘কল্পিত বিদেশী বা শত্রুর বিরুদ্ধে এক হওয়া’ ধরনের; আর এটাই সবাই ব্যবহার করে গেছে এ পর্যন্ত, আর সমানে ফায়দা তুলে গেছে। তাতে ধারণাটা সত্য না হলেও কোনো সুবিধা হয়নি।

কেন এমন সুযোগ পাওয়া যায়? কারণ যত দিন দুনিয়ায় মানুষে মানুষে বা এক জনগোষ্ঠীর সাথে অন্য জনগোষ্ঠী এবং অন্য সব জনগোষ্ঠীর সাথে পণ্য বিনিময় ব্যাপক হয়ে না ওঠে, তত দিন স্বদেশীপনা ধারণাটা যে মিথ্যা বা ধারণাটার যে সমস্যা তা টের পাওয়া যায় না।

গত ১৬০৭ সাল থেকে ধরা হলে পরের প্রায় ৩০০ বছর চালু ব্যবস্থাটা হলো, দখলবাজ ছোটবড় পাঁচ-ছয় রাষ্ট্র বাকি প্রায় সব দেশকে দখল করে কলোনি বা উপনিবেশ যুগ কায়েম করেছিল। সে সময় কোনো দেশের বাইরে পণ্য বিনিময় লেনদেন বলতে ছিল দখল-মালিক দেশ আর প্রজা দেশের মধ্যে; তাও আবার ছিল একপক্ষীয়- মূলত প্রজা বা দখলি-হওয়া দেশ থেকে লুটেরা সম্পদ দখল-মালিক দেশে নেয়া (যেমন ব্রিটিশ-ইন্ডিয়া থেকে ব্রিটেনে)। এ ছাড়া ওদিকে পাঁচ-ছয়টা কলোনি দখলদার মালিকের নিজেদের মধ্যে লেনদেন- সেটাও ছিল খুবই সীমিত পর্যায়ে। তাই জাতি ধারণা আর স্বদেশীপনা যে ভুয়া অচল ধারণা তা ইউরোপ কলোনিযুগে টের পায়নি। আবার কলোনি যুগের প্রায় ৩০০ বছর ইউরোপ ‘বিদেশী মাত্রই শত্রু’ গণ্য করা জাতি ধারণার জাতিরাষ্ট্র, নেশন-স্টেট ছিল। এটাই কলোনি-মালিক জাতি-রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে লেনদেন ও বিনিময় বাণিজ্য প্রায় ‘নাই’ ধরনের সীমিত হয়ে থাকার আরেক কারণ। সুতরাং, এক কথায় ‘জাতি’ ধারণাটা বা দেশকে জাতি বলে বুঝা- এটা মূলত কলোনি দখল করা যেসব দেশের মূল ব্যবসা তাদের অনুসৃত ও প্রচলিত ধারণা। এদের চিনবার মূল বৈশিষ্ট্য হলো এরা জাত বা জাতির বাইরে কারো সাথে লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময় পছন্দ করে না, খারাপ মনে করে। তাই এখান থেকেই স্বদেশী বলে ধারণা জন্মানো সহজ ও সম্ভব।

এজন্যই, স্বদেশী-জাতি-কলোনি যুগ এগুলো সম্পর্কযুক্ত শব্দ। কলোনি যুগেই জাতি বা স্বদেশী ধারণা পাওয়া যায়। দুনিয়াতে প্রথমত জাতি বা জাতিরাষ্ট্র ধারণাটার জন্ম বা পাওয়া যায় কলোনি যুগে; মানে ১৬০৭-১৯৪৫ অর্থাৎ প্রায় ৩০০ বছরের সময়কালের এবং মূলত ইউরোপে।

তবে কলোনি যুগ-পরবর্তী সময়কালের তুলনায় অনেক ছোট, প্রায় পঁচাত্তর বছর, ১৯৪৫ থেকে একাল পর্যন্ত সময়টা কলোনিমুক্ত স্বাধীন রাষ্ট্র হওয়ার কাল। মোটা দাগে সবার আগে কলোনি মুক্তি ঘটেছিল এশিয়ায়; পরে ল্যাটিন আমেরিকা আর শেষে ১৯৮০ সালের মধ্যে আফ্রিকা (সাউথ আফ্রিকা বাদে) সবাই প্রায় স্বাধীন হয়ে যায়। ফলে এবার সব রাষ্ট্রের সাথে সব রাষ্ট্রের লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময় ব্যাপক রূপ নেয়া শুরু হয়। তবে কমিউনিস্টরা লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময় করতে শুরু থেকেই রাজি হয়নি মূলত সোভিয়েত ইউনিয়নের কারণে আর ১৯৫৩ থেকে ১৯৯১ সাল- কোল্ডওয়্যারের এই যুগের কারণে। ফলে সোভিয়েতকে অনুসরণ করে পুরা কমিউনিস্ট ব্লক লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময় করতে আসেনি।

কিন্তু এর আগেই সব অর্গল খুলে যায়। কারণ, আশির দশকের শুরু থেকেই গ্লোবালাইজেশন শুরু হয়ে গিয়েছিল। মানে যেকোনো দেশের সাথে যেকোনো দেশের লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময় ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হতে শুরু করেছিল। আমাদের জন্য তা সহজে বোঝার চিহ্ন হলো, যখন থেকে আমরা গার্মেন্ট এক্সপোর্ট শুরু করি এবং ক্রমে তা বাড়াতে থাকি।

একটা পর্যবেক্ষণ হিসাবে বলা যায়, গত ৪০০ বছরের দুনিয়ায় দেশ (রাষ্ট্র)গুলোর মধ্যে লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময় চালু ছিল মাত্র শেষের চল্লিশ বছর। এর আগে রাষ্ট্রগুলো পরস্পরের কাছে উন্মুক্ত থাকলে ব্যাপক লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময় চালুর প্রস্তুতি নিতেই চলে যায় ত্রিশ বছর। আবার এরও পেছনের ৩০০ বছর লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময় প্রায় ছিল না বলা চলে। এখন একটা সাধারণ সূত্র হলো, লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময় না থাকা মানেই সেটা জাতি বা জাতি-রাষ্ট্র বা স্বদেশী চিন্তার কাল। আর যতই গ্লোবালাইজেশন, ততই লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময় ব্যাপকতর; ততই বাস্তবে জাতি বা জাতিরাষ্ট্র বা স্বদেশী চিন্তার অকার্যকারিতা বা বিলুপ্তির দিকে চলে যাওয়া।

ফ্যাক্টস হলো, ইউরোপ ১৯৪৫ সালের পরে জাতি বা জাতিরাষ্ট্র বা স্বদেশী চিন্তা ত্যাগ করে সরে যায় অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্রে নিজেদের রূপান্তরিত করে নিয়ে।

কিন্তু ট্রাজেডিটা হলো ইউরোপ রূপান্তরিত হয়ে গেলেও আমরা জানি না আর তাল বুঝি না বলে অবুঝ-নাবুঝ হয়ে আমাদের মতো দেশের মডেল হয়ে গেল পুরানা ‘জাতি’ ধারণা মানে, জাতিরাষ্ট্র বা স্বদেশী চিন্তা। এমন চিন্তার সপক্ষে কমিউনিস্টরা সাপোর্ট করেছিল। এখনো বেশির ভাগই জেনে না জেনে করে থাকে। অথচ এটা স্ববিরোধী। কারণ জাতিরাষ্ট্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনীতি হলো, কলোনি দখল যুগে থাকা। আরেক বৈশিষ্ট্য হলো খুবই সীমিত বৈদেশিক লেনদেন-বাণিজ্য-বিনিময়ে থাকা। এই স্ববিরোধিতা কী ধরনের সঙ্কট নিয়ে হাজির হয় তা এখন আমরা দেখব ভারতের ক্ষেত্রে। সেখানে ১৯৪৭ সালে জন্ম থেকেই এটা জাতিরাষ্ট্র ধারণাকে খুবই শক্ত করে (অন্তত আমাদের চেয়ে অনেক বেশি) আঁকড়ে ধরা এক রাষ্ট্র গড়েছিল। এর ওপর আবার ‘জাতি’ বলতে এটা হিন্দু-জাতির এক জাতিরাষ্ট্র বুঝেছিল তারা। গত ২০১৪ সাল থেকে বিজেপি ক্ষমতায় থাকাতে এই হিন্দু জাতিরাষ্ট্র বোধ সবার উপরে চাপানোর ঝোঁক আরো প্রবল। এখন চীনের সাথে সীমান্ত সঙ্ঘাতে ২০ সেনাকে হারিয়ে যতই স্বদেশীপনাকে নরেন্দ্র মোদি আঁকড়ে ধরতে চাইছেন ততই জাতিরাষ্ট্র, হিন্দুত্ব বা স্বদেশীপনা ধারণার অকার্যকারিতা আর ভুয়া আবেগসর্বস্বতা প্রকট হয়ে হাজির হচ্ছে।

উদাহরণ বাস্তব হিন্দু জাতিরাষ্ট্র ও এর স্বদেশীপনা :
ভারতের একটা মিডিয়া রিপোর্ট পড়ে শুরু করা যাক। দ্য হিন্দু পত্রিকার ঘরেরই আরেকটা পত্রিকা আছে যেটা ব্যবসা-বাণিজ্যকে প্রাধান্য দিয়ে প্রকাশিত হয়, এর নাম ‘হিন্দু বিজনেস লাইন’। সে পত্রিকার ২৭ জুলাইয়ের এক লিডিং রিপোর্ট বলছে, জাপান ভারতের কাছে এক আজব অনুরোধ রেখেছে। সেটা হলো, ‘ভারত যেন চীন থেকে আসা পণ্যের ওপর বাড়তি ট্যাক্স এবং কোনো কোনো চীনা পণ্যের আমদানির উপরেই যে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা যেন আরোপ না করা হয়।’ জাপানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ট্রেড প্রমোশন ডিপার্টমেন্ট এই অনুরোধ নিয়ে মোদি মন্ত্রিসভার দরবারে এসেছে তদবির করতে।

আগে একটু বলে নেই, চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ, অন্তত ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পর পালটা প্রশাসনিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে মোদি ভারতে সাথে চীনের বাণিজ্য সম্পর্ককে বিরূপ করে তুলতে সব মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই সাথে চীনা পণ্য বর্জনের রাজনৈতিক কর্মসূচিও নিয়েছিলেন। এই প্রপাগান্ডা কাজের জন্য আগে থেকেই বিজেপি-আরএসএস এর দলীয় এক অঙ্গ-সংগঠন তৈরি করাই ছিল যার নাম ‘স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ’। দেশে-বিদেশে এই সংগঠনের তৎপরতাই জোরদার করা হয়েছে- চীনা পণ্য বর্জনের স্লোগান এদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে। যেমন ইন্ডিয়ান ক্রিকেটে এবারের সম্ভবত আইপিএলে স্পন্সর হয়েছিল চীনা মোবাইল কোম্পানি ‘ভিভো’।

তবে বলাই বাহুল্য, এটা স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সাথে মিলে চীনা ভিভোর সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। এখন মোদি চীনা কোম্পানির ওপর বৈষম্য বা বিরূপতা আরোপের নির্দেশ জারি করাতে ওই জাগরণ মঞ্চ বোর্ডের কাছে ভিভোকে বাতিল করার আবেদন নিয়ে যায় এই যুক্তিতে যে, এটা চীনা কোম্পানি বলে এরা ‘জাতির বর্তমান মুডের বিরুদ্ধে’। অবশেষে ক্রিকেট বোর্ড ভিভোকে স্পন্সরশিপ থেকে বাদ দিতে গিয়ে দেখে তাদের প্রফিট মার্জিনে টান পড়ছে। কাজেই মোদিকে বলে, ভিভোকে রেখেই চলা যায় কিনা। এ ছাড়া সিনিয়র মন্ত্রী নীতিন গড়করি যিনি বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প দেখাশুনা করেন, তিনি ঘোষণাই করে দিয়েছেন কোনো চীনা কোম্পানি ভারতে টেন্ডারে অংশ নিতেই পারবে না। অর্থাৎ চীনা কোম্পানির সাথে সেগরিগেশন বা বিচ্ছেদ ইতোমধ্যেই মাঠে কার্যকর। একই হিসাব মতে, ম্যানুফাকচারিং খাতেও চীনা পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে, না হয় শুল্ক এমন বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে যেন কেউ আমদানি না করে।

অনেকেরই ধারণা, ভারতে চীনের প্রতিদ্বন্দ্বী জাপান। এ ছাড়া চীনবিরোধী চার দেশ জাপান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া আর আমেরিকা- এদের জোট ‘কোয়াড’ যার মধ্যে জাপানও আছে এবং তারা সামরিক জোট হিসেবে কাজ করার কথাও চিন্তা করছেন; এদের তো এতে পোয়া বারো। জাপানের এখন তাহলে চার দিকে লাভ আর লাভ হওয়ার কথা।

কিন্তু না! আমরা দেখছি উলটা জাপানের ট্রেড প্রমোশন বিভাগই দেনদরবার করছে, চীনা পণ্য আমদানি যেন অটুট থাকে, চীনকে কোনো বাধা না দেয়া হয়। কেন? তাহলে দেশপ্রেম, স্বদেশীপনা বা জাতিগিরি ফলানো এগুলো আর সহজ মনে হচ্ছে না।

কেন এ রকম হচ্ছে? আর জাপানের চীনা পণ্যের প্রতিই বা এমন মায়া কেন?
ভারতে গাড়ির কোম্পানির বেশির ভাগই জাপানি ব্র্যান্ডের সাথে জয়েন্ট ভেঞ্চার। কিন্তু তা হলে হবে কী, এর ম্যানুফেকচারিং ও অ্যাসেম্বলিতে স্পেয়ার নিজেরা বানায় না। চীন থেকে কিনে আনে। আর অ্যাসেম্বল বা জোড়া লাগিয়ে জাপানি গাড়ি তৈরি করা হয়। কেন? কারণ ওসব পার্টস জাপানে তৈরি করলে গাড়ির দাম দেড় গুণ হয়ে যাবে। কারণ লেবার কষ্ট বা ন্যূনতম মজুরি অনেক বেশি। আবার ভারতে তা তৈরি করতে গেলে সে ক্ষেত্রেও চীনের তুলনায় অদক্ষতার কারণে দাম বেশি পড়বে, কোয়ালিটিও খারাপ হবেÑ সামগ্রিকভাবে জাপানি গাড়ি বিক্রির প্রফিটে টান পড়বে। অতএব চীনা পার্টস ওটাতেই মোক্ষ। এতে একেবারে মুখ্য কারণ, চীনা যেকোনো ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানায় প্রোডাকশন লাইন সাজানোর নতুন কৌশল। এটা অ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট বুদ্ধিতে সাজানো। ফলে তা দক্ষ এবং কম উৎপাদন খরচ বলে সবার চেয়ে কমপিটিটিভ। আর সেটার লোভেই জাপানিরা কোয়াডের লোভ ভুলে উলটা মোদির কাছে চীনকে ভারতে রেখে দেয়ার সুপারিশে লেগে পড়েছেন।

অর্থাৎ এটাই হলো সরাসরি কথিত স্বদেশীপনা বনাম গ্লোবালাইজেশন। যে পণ্যে যে সবচেয়ে বেশি কম খরচে মানে কম শ্রমে ও দক্ষতায় বানাতে পারে, সবাই ওই পণ্য তার কাছেই কিনবে- এটাই হলো গ্লোবালাইজেশনের ভিত্তি। তাতে সে দেশী-বিদেশী না কোন দেশী সেটা কোনো বিবেচ্য নয়। ফাঁপা আবেগের দেশীবোধ বলে কিছু নেই। দেখাই যাচ্ছে এটা কাজ করছে না। অর্থাৎ গ্লোবালাইজেশনের এত ভিত্তি ও খেলার নিয়মে প্রত্যেক রাষ্ট্রকেই কোনো না কোনো পণ্যে বা ওর কোনো পার্টস উৎপাদনে সবচেয়ে কম শ্রমে ও বেশি দক্ষতায় বানাতে পারতেই হবে। তা হলেই ভ্যালু অ্যাডেড প্রোগ্রামে তাকেও অন্য সব রাষ্ট্র গোনায় ধরতেই হবে। চাইলেও বাদ দেয়া যাবে না। এভাবেই যা কিছু দেশটা ভোগ করে তার সব কিছুই আর স্বনির্ভরতা বা আত্মনির্ভরতার ভুয়া স্লোগান দিয়ে নিজের অদক্ষ হাতে বানাতে হবে না। বরং এর বিপরীত ‘গিভ অ্যান্ড টেক’। আরো বেশি করে পরস্পর পরস্পরের ওপর নির্ভরশীলতায় জড়িয়ে পড়তে হবে যাতে কেউ আলগা ‘ফুটানি’, বেশি দাম, বেশি গরজ তৈরি করতে না পারে। বরং সবাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement