২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অন্য ঈদ, চামড়া ও আমরা

অন্য ঈদ, চামড়া ও আমরা - ছবি : নয়া দিগন্ত

এবার ঈদুল আজহা উপলক্ষে রিকশা ও অটোরিকশা, বাস-মিনিবাস কিংবা সাইকেল বা মোটরসাইকেল অর্থাৎ যেকোনো যানযোগে বাড়ি যাওয়া, মানুষের জন্য এক প্রকার ‘নিষিদ্ধ’ ছিল। তবে এ ঈদে কোরবানির হাটের পশুদের অনেকেই ‘ভ্রমণের রাজা’ রেলগাড়িতে চড়ার সুযোগ পেয়ে ধন্য হয়েছে। পত্রিকার প্রধান ছবিতে ওদের ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে ট্রেন থেকে বীরদর্পে রাজধানীতে মাস্ক দিয়ে অবতীর্ণ হওয়ার ছবি ছিল উপভোগ্য। এদিকে, মহামারী ঠেকাতে সরকার ঈদে বাড়ি যেতে যতই নিষেধ করুক, হাজার হাজার মানুষকে ঠেকানো যায়নি এই সাংবার্ষিক প্রবণতা থেকে।

এর আগে ঈদুল ফিতর পড়েছিল করোনাকালের ‘সাধারণ ছুটি’ নামের কার্যত লকডাউনের আওতায়। তাই দেশের মানুষ সে ঈদকে নিরানন্দের উপলক্ষ বলে গ্রহণ করেছিল আগেই। কিন্তু এ দীর্ঘ ছুটি শেষে দুই মাসেও করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়ে বরঞ্চ এর অবনতি দেখে দেশবাসী এখন শঙ্কিত। কোরবানির ঈদও যে এবার এমন আনন্দহীন ও বিষাদভরা হবে, তা কে জানত? সবই আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা। মানুষের এ নিয়তি মেনে নেয়া ছাড়া উপায় কী?

এ বছর দুই ঈদেই বাংলাদেশের সঙ্গী ছিল অপরিচিত ও পরিচিত দুর্যোগ। অপরিচিত ভাইরাস বিপর্যয়ে দেশ দুনিয়া লণ্ডভণ্ড বিপর্যস্ত, তার সাথে পরিচিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যার হানা। রোজার ঈদের সময়ে তা ছিল একটি অঞ্চলে সীমিত যদিও আমফান ঝড়ের ক্ষতিও কম নয়। কোরবানির ঈদ কাটল দেশের বিস্তীর্ণ জনপদে বানের পানির সয়লাবের মাঝে। ঈদুল ফিতরে চাঞ্চল্যকর খবর ছিল, খুলনার কয়রা উপজেলায় এক হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে বন্যার্ত বনি আদমদের ঈদের নামাজ আদায়। আর ঈদুল আজহার দিন খবর এলো, পদ্মার ভয়াল ভাঙনে পদ্মা সেতুর বিপুল নির্মাণ উপকরণ ও সাজসরঞ্জামসমেত ৪৬ বিঘা ভূমি পানিতে বিলীন হয়ে গেছে। পশুর চামড়ার সঠিক দাম নিয়ে উদ্বেগ তো ছিলই। আগের ঈদের তুলনায় কিঞ্চিৎ ইতিবাচক পরিবর্তন যা পরিলক্ষিত হয়েছে, তা হলো ঈদুল ফিতরে যারা মসজিদে যেতে না পেরে ঘরে বসেই ঈদের নামাজ পড়েছেন, তাদের বিরাট অংশ এবার মসজিদে গিয়ে এ নামাজ আদায় করলেন। অবশ্য স্বাস্থ্যবিধির কড়াকড়িতে তাদের অনেকেই মসজিদ পর্যন্ত পৌঁছতে পারেননি।

কর্তৃপক্ষ জীবন বনাম জীবিকার দ্বন্দ্বে নিরুপায় হয়ে যেমন কোরবানির পশুর হাট বসানো থেকে বিরত থাকতে পারেনি, তেমনি ঈদের ছুটির মেয়াদও তিন দিন থেকে বাড়েনি। বরং একাধিক মন্ত্রণালয়ের সব স্টাফের ছুটি বাতিল হয়ে গেছে। তদুপরি কর্মস্থল ত্যাগ না করা এবং বাড়িতে না যাওয়ার নির্দেশ ছিল সবার প্রতি। বাংলাদেশের মতো, অতিরিক্ত জনভারে বিপর্যস্ত এবং দারিদ্র্যপীড়িত দেশের এখন চরম সঙ্কট। তাই মৃত্যুঝুঁকি পর্যন্ত উপেক্ষা করে মেহনতি মানুষ স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করছে কেবল জীবিকার তাগিদে। অনেক মার্কেটে লেখা আছে, ‘জীবন না জীবিকা আগে? সে সিদ্ধান্ত আপনার।’ সত্যিই, দেশের মানুষ নিজ নিজ শ্রেণীগত অবস্থান ও আর্থিক অবস্থার নিরিখে সে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এদিকে, সমাজের প্রান্তিক অংশের মানুষদের বক্তব্য- না খেয়ে মারা যাওয়ার চেয়ে, খেয়ে মরা উত্তম। তাই জীবিকার ধান্ধায় জীবনের পরোয়া করছে না অনেকে।

গত কোরবানির ঈদে দৃশ্যত আড়তদার ও ফড়িয়া মধ্যস্বত্বভোগীদের কারসাজিতে পশুর চামড়ার দাম পড়ে গিয়েছিল। কপাল পুড়েছিল খুদে ব্যবসায়ী এবং মাদরাসা-এতিমখানার। এবার ঈদের আগে ব্যবসায়ী বাণিজ্যমন্ত্রীর কথায় যতটা কৌশল ছিল, ততটা ভরসা ছিল না। তার ভাষায় ‘কোরবানির চামড়ার দাম গত বছরের চেয়ে কম হবে না।’

তার কিন্তু বলা উচিত ছিল গত বছরের মতো দামের বিপর্যয় ঘটবে না চামড়া নিয়ে। বরং এবার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত হবে।’ সরকারের সে মনের জোর নেই। অতএব, আশঙ্কাই সত্য হয়েছে। কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কার্যত মোটেও বাড়েনি। বরং কোরবানিদাতা এবং সংশ্লিষ্ট মাদরাসা-এতিমখানা কর্তৃপক্ষের তীব্র অসন্তোষের খবর মিডিয়ার কল্যাণে জানা গেছে ঈদের দিনেই। জানা গেল, গত কয়েক মাসের করোনা বিপর্যয়ে দেশের ২০ শতাংশ মানুষ গরিব হয়ে গেছে এবং এ কারণে কোরবানি দেয়ার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে। বাংলাদেশের কোরবানিনির্ভর যে বিশাল অর্থনীতি, এর ৪০ শতাংশ কমে গেছে এবার। এ দেশের একটি প্রধান প্রচলিত রফতানিপণ্য হচ্ছে চামড়া ও চর্মজাত আইটেম। এ দেশে চামড়ার বেশির ভাগ সংগ্রহ করা হয় ঈদুল আজহার সময়। তা থেকেই অনুমান করা যায়, কোরবানি আমাদের জাতীয় অর্থনীতির জন্য কত বেশি গুরুত্ব বহন করে।

প্রশ্ন হলো, কোরবানি অর্থনীতির সঙ্কোচন কিংবা চামড়ার মূল্যপতনের দরুন কাদের কোরবানি (ত্যাগ) দিতে হয় সবচেয়ে বেশি? নিশ্চয়ই এ ক্ষেত্রে ট্যানারি মালিক বা বড় ব্যবসায়ীদের চেয়ে গরিব-ফকির-মিসকিন, এতিমদের দুর্ভোগ ও বঞ্চনা অনেক বেশি। তাদের প্রতি আমরা কি সামাজিক-নৈতিক-মানবিক-রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করছি?

এমনিতেই করোনা আর বন্যা (অনেক ক্ষেত্রে ডেঙ্গু) বিপর্যয়ে দেশের মানুষ দিশাহারা। এর সাথে ঈদের দিন যোগ হলো কোরবানির পশুর চামড়ার দামের বিপর্যয়। সরকার যেখানে ভূমিধস বিজয়ে ক্ষমতাসীন হয়ে দেশ চালাচ্ছে, সেখানে এবারো বিশেষ সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে কেন চামড়ার দামে ধস নেমেছে? সিন্ডিকেট শুধু চট্টগ্রামেই সাড়ে চার কোটি টাকা লুটে নিলো কিভাবে? আবারো বর্জ্যরে মতো রাস্তায় রাস্তায় কাঁচা চামড়া ফেলে রাখতে দেখা গেছে। কারণ অনেক ক্ষেত্রে মাত্র ১৫-২০ টাকা দিয়েও কেউ চামড়া কিনেনি। মৌসুমি ব্যবসায়ীরা সরকার নির্ধারিত দামে চামড়া কিনে আড়তে বেচতে গিয়ে ঠকেছেন। মোট কথা, ছোট ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত, বড় কারবারিদের মুখে হাসি। চামড়া আছে ক্রেতা নেই অথবা ক্রেতা থাকলেও দাম নেই- এ অবস্থা কেন বারবার দেখতে হবে?

আজকাল আমরা কোরবানির ঈদকে বলে থাকি সাধারণত ‘ঈদুল আজহা’। অতীতে বলা হতো ‘ঈদুজ্জোহা’। সাধারণ মানুষের ভাষায় এটা ছিল বকরিদ বা বকরি ঈদ। ‘বকরি’ বলতে এখনো ছাগলকে বুঝায়। বিশেষ করে ব্রিটিশ আমলে অমুসলিম ও সাম্প্রদায়িক জমিদার-তালুকদারদের দাপটে, বাঙালি মুসলিমরা গরিষ্ঠ হয়েও গরু জবাই করতে নানা বাধার সম্মুখীন হতো। তখন চালু হলো ছাগল কোরবানি দেয়ার ‘নিরাপদ ও নিরপেক্ষ’ প্রথা। অবশ্য মুসলমানদের আর্থিক অবস্থা সাধারণত ভালো না থাকায় তাদের গোটা পরিবারকে একটা ছাগল কোরবানি দিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হতো। ছোট সাইজের গরু দিয়েও সাত শরিকের কোরবানি সম্ভব। অথচ একটা ছাগল দিয়ে শুধু একজনের নামেই কোরবানি দেয়া যায়।

প্রতিবেশী ভারতের অধিকাংশ প্রদেশে এখন আর গরু কোরবানি দেয়া যায় না। দেশটির সবচেয়ে বড় রাজ্যের নাম ‘উত্তরপ্রদেশ’। হিন্দুত্ববাদী যোগী আদিত্যনাথ শাসিত প্রদেশটি ভারতীয় রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। উত্তরপ্রদেশেই অবস্থিত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ দেওবন্দ মাদরাসা। সেখানেও গরু নয়, মহিষ কোরবানি দিতে হয়। এই মহিষ নিয়ে এবার আমাদের বাংলাদেশে মর্মান্তিক অঘটন ঘটেছে। ঈদের প্রথম দিনে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামের এক স্থানে কোরবানির মহিষের শিংয়ের গুঁতোয় এক শিশু নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়েছে।

এবার অতীতের একটি প্রসঙ্গ। একজন বিখ্যাত সিএসপি আমলা তার স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন, তদানীন্তন পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার প্রায় এক দশক পরে তিনি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি মহকুমার (বর্তমানে জেলা) প্রশাসক, অর্থাৎ এসডিও নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি ঈদুল আজহার সময় দেখলেন স্থানীয় মুসলমানরা গরু কোরবানি দিতে আগ্রহী নন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, জোতদার-জমিদারদের কড়াকড়িতে দীর্ঘদিনে প্রায় লোপ পেয়েছে গরু জবাই ও গোমাংশ ভক্ষণের প্রথা। এই এসডিও তখন উদ্যোগী হয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করলেন গরু কোরবানি দেয়ার জন্য। অবশ্য অনেকে স্বাস্থ্যগত বিধিনিষেধে গরুর গোশত খেতে পারেন না। তারা বাধ্য হয়ে ছাগল (সাধারণত খাসি) কোরবানি দিয়ে থাকেন।

একটা চুটকি চালু আছে। এক ব্যক্তি ধর্মকর্ম করতেন না। কিন্তু ‘সামাজিকতা’ বলে কথা! অতএব, তিনি বাজার থেকে বিরাট দু’টি খাসি মোরগ এনে জবাই করলেন। কোরবানির ঈদের দিন একবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী জবাই করেছ?’ দোস্তের জবাব, আস্ত খাসি। খাবে নাকি? তাহলে চলো জলদি।’ এ বন্ধু তার সাথে বাসায় গিয়ে খেতে বসল। ডাইনিং টেবিলের বাটিতে ছাগলের বদলে স্রেফ মোরগের গোশতের টুকরো দেখে মেহমানের চোখ ছানাবড়া! তিনি মেজবানকে বললেন, ‘এ কী? ছাগল জবাই দিয়েছ ভেবেছিলাম।’ বন্ধুর উত্তর- “বলেছি, ‘খাসি’। আমি তো বলিনি, ছাগল খাসি কোরবানি করেছি।’

পাদটীকা : এবার ঈদের সময়ে দেশের একটি জেলায় ঘটেছে বিশেষ দু’টি ঘটনা। প্রথম ঘটনায় কোরবানির মহিষের গুঁতো খেয়ে একজন মারা গেছে এবং আহত একাধিক জন। আরেক ঘটনায় কোরবানির গোশত ভাগাভাগি নিয়ে প্রথমে বিতর্ক, এরপর ক্রমান্বয়ে তা ভয়াবহ সংঘর্ষের রূপ নেয়। এতে বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুরের অভিযোগের পাশাপাশি জানা যায়, একজনের মৃত্যু ঘটেছে আর জখম কয়েকজন।
‘মানুষ যখন মন্দ হয়, তখন পশুরও অধম’। সেটাই আবার প্রমাণিত হলো। নিজের পশুত্বের বদলে মনুষ্যত্বকে কোরবানি দেয়ার পরিণাম শেষের ঘটনাটা।


আরো সংবাদ



premium cement