১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ

পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ - ছবি : সংগৃহীত

পোশাক শিল্প করোনাভাইরাসের প্রভাবে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি জটিলতায় উৎপাদন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। তার ওপর বৈদেশিক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিতের কারণে রফতানি প্রক্রিয়ায়ও সৃষ্টি হয়েছে বড় ধরনের অচলাবস্থা। শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মতো অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক ঘটনাও ঘটেছে। সরকার এই শিল্পের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করলেও মালিক পক্ষের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে তা ইতিবাচক ফল বয়ে আনেনি।

করোনাভাইরাসের কারণে গত মার্চে তৈরী পোশাকের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ায় মালিকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লে সরকার রফতানিমুখী কারখানার শ্রমিকদের মজুরি দেয়ার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। সে তহবিল থেকে প্রায় ১ হাজার ৮০০ কারখানার মালিক মাত্র ২ শতাংশ সেবা মাশুলে ঋণ নিয়ে শ্রমিকদের তিন মাসের মজুরি পরিশোধ করেছেন। অন্য দিকে মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে পোশাক রফতানিতে গতি ফিরলেও ইতোমধ্যেই হাজার হাজার শ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন, যা দায়িত্বহীন ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ শ্রমিক বাঁচাতে সরকার প্রণোদনা দিলেও তা যথাযথভাবে কাজে লাগানো হয়নি বলে জোরালো অভিযোগ উঠেছে।

বিজিএমইএর দেয়া তথ্যানুযায়ী, করোনায় ৩১৮ কোটি ডলারের পোশাক রফতানির ক্রয়াদেশ প্রাথমিকভাবে বাতিল ও স্থগিত হয়েছিল। তার মধ্যে প্রাইমার্ক ৩৩ কোটি, ইন্ডিটেক্স ৮ কোটি ৭০, বেস্ট সেলার ৮ কোটি ৩০ লাখ, মাদারকেয়ার ৫ কোটি ৬০ লাখ, কোহলস ৫ কোটি ৪০ লাখ, গ্যাপ ৩ কোটি ৮০ লাখ, জেসি পেনি সাড়ে ৩ কোটি, ওয়ালমার্ট ১ কোটি ৯০ লাখ, ডেবেনহাম ১ কোটি ৮০ লাখ ও রালফ লরেন ১ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করে। তবে আশার কথা হচ্ছে ইতোমধ্যেই বাতিল ও স্থগিত ক্রয়াদেশগুলো আবার ফিরতে শুরু করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় গত মার্চে দেশগুলোর বড় বড় ক্রেতারা একের পর এক ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত করতে শুরু করে। এ দিকে দেশেও ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর মাস খানেক পোশাক কারখানা বন্ধ ছিল। এতে এপ্রিলে মাত্র ৩৭ কোটি মার্কিন ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে, যা গত দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। পরের মাসে রফতানি হয় ১২৩ কোটি ডলারের পোশাক। জুনে সেটি বেড়ে ২২৫ কোটি ডলারে গিয়ে দাঁড়ায়। বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২ হাজার ৭৯৫ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়, যা আগের বছরের চেয়ে ৬১৮ কোটি ডলার কম।
অতি সামান্য মজুরিতে এই শিল্পে শ্রমিকদের কাজ করানো হয়। উভয় পক্ষের মধ্যে রয়েছে মনস্তাত্বিক দূরত্ব যা কমানো গেলে এই শিল্পকে আরো অধিক লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই দূরত্ব আরো বেড়েছে। বৈশ্বিক মহামারী করোনার মধ্যেই শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘোষণা এসেছে মালিক সমিতির শীর্ষ পর্যায় থেকে। সরকারি সুবিধা আদায়ে বরাবরের মতো এবারো শ্রমিক ইস্যুকে সামনে নিয়ে এসেছেন উদ্যোক্তারা।

উদ্যোক্তারা সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া পেশ করেছেন এবং তাদের কিছু দাবি সরকার মেনেও নিয়েছে। গার্মেন্ট মালিকদের বাজেটীয় দাবির মধ্যে রয়েছে রুগ্ণ ও দেউলিয়া হয়ে যাওয়া কারখানাসহ যেকোনো সময় উদ্যোক্তারা ব্যবসা থেকে বের হয়ে যেতে চাইলে তাদের জন্য নিরাপদ এক্সিট পলিসি তৈরি করার বিষয়টি। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটাতে ৫০০ কোটি টাকার তহবিল গঠনেরও দাবি করেছেন মালিক সমিতি। দাবির মধ্যে আরো রয়েছে, শিল্প খাত বহুমুখীকরণে কারিগরি ও অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিলের সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন এবং উদ্যোক্তাদের বিশেষ সহায়তা দেয়া। এ জন্য বিশেষ উৎসাহ এবং ১০ শতাংশ নগদ সহায়তা ১০ বছরের জন্য প্রদান, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প স্থানান্তর এবং নতুন ভবন নির্মাণ বাবদ বিশেষ ঋণসুবিধা প্রদান, ১৫ বছর মেয়াদি এবং বাণিজ্যিক সুদহারের অর্ধেকে প্রদান করার বিষয়টিও। আর এসব দাবির সবগুলোই মালিক পক্ষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট, শ্রমিকদের স্বার্থ এখানে উপেক্ষিত হয়েছে। গতবারের তুলনায় এবার ৭০-৮০ শতাংশ ক্রয়াদেশ আসছে। অনেকগুলো বড় ব্র্যান্ড স্থগিত ও বাতিল করা ক্রয়াদেশের পণ্য আবার নিতে শুরু করায় পোশাক রফতানি গত জুনে বেশ খানিকটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

দেশের পোশাক কারখানার বৃহৎ প্রতিষ্ঠান রাইজিং গ্রুপের বক্তব্য নতুন করে আশাবাদের সৃষ্টি করেছে। প্রতিষ্ঠানটির বক্তব্য হচ্ছে, ‘আমাদের সাতটি কারখানার মধ্যে ছয়টিতে ভালো ক্রয়াদেশ আসছে। সবমিলিয়ে গতবারের তুলনায় ক্রয়াদেশের পরিমাণ ৮০ শতাংশের কম নয়। তা ছাড়া মার্চে বাতিল ও স্থগিত হওয়া সব ক্রয়াদেশের পণ্য ক্রেতারা নিতে শুরু করেছেন। যদিও একটি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানকে ৪ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার মূল্যছাড় দিতে হয়েছে।’ তারা আরো বলছেন, করোনার শুরুর দিকে ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হওয়ায় আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। তবে বর্তমানে ক্রয়াদেশ আসার হার বেশ আশা জাগানিয়া। উদ্যোক্তারা গতবারের তুলনায় ৭০-৮০ শতাংশ ক্রয়াদেশ প্রাপ্তির যে কথা বলছেন, তার সাথে রফতানি আয়ের চিত্রও বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ বলেই মনে হচ্ছে। পোশাক শিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ জানিয়েছেন, ১ থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত ৯৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছে। গত বছরের একই সময়ে রফতানি হয়েছিল ১১৯ কোটি ডলারের পোশাক। ২ জুলাই লেভি স্ট্রজ ও তার কয়েক দিন পর গ্যাপ ইনকরপোরেশন বাতিল করা ক্রয়াদেশের পোশাক পূর্ণ দাম দিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ফলে ব্র্যান্ড দু’টির ৩০-৪০টি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তারা অনেকটাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন।

বাংলাদেশী পোশাকের অন্যতম বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠান এইচঅ্যান্ডএম। সুইডেনভিত্তিক এই ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে বছরে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার বা ২৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার পোশাক কিনে থাকে। মূলত ১০ শতাংশ বাংলাদেশী পোশাকের ক্রেতা হচ্ছে এইচঅ্যান্ডএম। আশার কথা হচ্ছে, করোনায় কোনো ক্রয়াদেশ বাতিল করেনি এই প্রতিষ্ঠানটি। স্থগিত হওয়া ক্রয়াদেশের পণ্য নেয়া শুরুর পাশাপাশি উদ্যোক্তাদের কাছে কোনো মূল্যছাড়ও চায়নি। পোশাকের ক্রয়াদেশের দাম পরিশোধের শর্তেও কোনো রকম পরিবর্তন করেনি এইচঅ্যান্ডএম। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, গত দুই থেকে আড়াই মাসে আমরা ৫০ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ দিয়েছি। আমাদের ৩০০ সরবরাহকারী কারখানার সবাই ক্রয়াদেশ পেয়েছে। এইচঅ্যান্ডএমের ক্রয়াদেশ পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্য প্রতিযোগী দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। চীন ও তুরস্ক থেকে যেসব ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে, তার একটি অংশ বাংলাদেশে আসছে। কারণ বাংলাদেশে উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম।

বাংলাদেশী পোশাকের আরেক বড় ক্রেতা যুক্তরাজ্যভিত্তিক ব্র্যান্ড মার্ক্স অ্যান্ড স্পেনসার (এমঅ্যান্ডএস)। ব্র্যান্ডটির ১ হাজার ৪৬৩ বিক্রয়কেন্দ্রে গত বছর বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের পোশাক গেছে। বর্তমানে এমঅ্যান্ডএসের পোশাক তৈরি করে দেশের ৫৫ জন সরবরাহকারী। কারখানার সংখ্যা ৮৩।
দেশের পোশাক রফতানিতে বড় প্রতিষ্ঠান এনভয় গ্রুপ। ১৯৮৪ সালে শুরু করা গ্রুপটির অধীনে রয়েছে ১৫টি পোশাক কারখানা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিখ্যাত জারা, নেক্সট, সিঅ্যান্ডএ, কেলভিন ক্লেইন, আমেরিকান ঈগল, ওয়ালমার্ট, ডিজনিসহ বেশ কয়েকটি ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠানটি। এই গ্রুপ সংশ্লিষ্টরা জানাচ্ছেন, যেসব ক্রয়াদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়েছিল, সেগুলো ক্রেতারা আবারো নিতে শুরু করেছেন। অন্য দিকে নতুন ক্রয়াদেশ আসার যে প্রবণতা রয়েছে, সেটিও বেশ ইতিবাচক। যদিও জুলাই-আগস্ট লিংক পিরিয়ড। প্রতি বছরই মাস দু’টিতে ক্রয়াদেশ কিছুটা কম থাকে। মূলত সরবরাহকারীদের কাছে ক্রয়াদেশের চাহিদা বেশি থাকায় বর্তমানে বেশ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। তাতে কিছু ক্রেতা গতবারের চেয়ে কম দাম দিচ্ছেন। তবে অধিকাংশই আগের দামে ক্রয়াদেশ দিচ্ছেন, যা সম্ভাবনাময় এই শিল্পে নতুন করে আশাবাদের সৃষ্টি করেছে।

পোশাক শিল্পে সুদিন ফিরে আশার সম্ভাবনাকে অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করছেন কেউ কেউ। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, সাধারণ ছুটির মধ্যে কারখানা খুলে দেয়ার মতো চ্যালেঞ্জিং সিদ্ধান্ত এবং শ্রমিকদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারায় পোশাক রফতানি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এতে আরো বলা হয়, বড় কারখানাগুলো টিকে থাকার মতো ক্রয়াদেশ পেলেও ছোট ও মাঝারি কারখানা সেভাবে পাচ্ছে না। তাই অন্তত দুই মাস তাদের শ্রমিক-কর্মচারীর মজুরির জন্য সহায়তা দরকার।

অতীব দুঃখের সাথেই বলতে হচ্ছে, ক্রয়াদেশ সাময়িকভাবে বাতিল ও স্থগিত হওয়ায় মালিকপক্ষ শিল্পবন্ধের কথা বলে যেভাবে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের মতো অনাকাক্সিক্ষত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। সরকারি সাহায্য পাওয়ার পরও এমন নেতিবাচক মানসিকতা প্রদর্শন দুঃখজনক। কোনো ব্যবসায় ঝুঁকির ঊর্ধ্বে নয়। তাই এ বিষয়ে সবাইকে অবশ্যই দায়িত্বশীল হতে হবে। অন্যথায় রফতানি আয়ের সবচেয়ে বড় খাত তৈরী পোশাক শিল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।

smmjoy@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement