২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ক্রীতদাস বনাম মানসিক দাসত্ব

ক্রীতদাস বনাম মানসিক দাসত্ব - ছবি : নয়া দিগন্ত

দাস প্রথা চালু করার নায়করা জনতার কাছে এখন খলনায়কে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বরং কথিত নায়কদের মূর্তি ভেঙে পানিতে নিক্ষেপ করে নিন্দার গভীরতা প্রকাশ করেছে জেগে উঠা জনগণ। দাসপ্রথা বা মানুষকে দাস বানিয়ে বিক্রি করে যারা মুনাফা অর্জন করেছে তাদের অন্যতম কলম্বাস, ভাস্কোদাগামা, রবার্ট ক্লাইভসহ অন্যদের ইউরোপের গণমানুষ এখন নিন্দার চোখে দেখছে। জনতার অপমান অপদস্ত থেকে তারা কেউই বাদ পড়েনি। মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের অন্যতম বড় শহর মিনেপলিসে পুলিশি হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ জজ ফ্লয়েডকে হত্যার পর দাস ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পুনরায় গণঘৃণা জেগে উঠে। ব্রিটেনে বর্ণবৈষম্য ও কৃষ্ণাঙ্গ নির্যাতনবিরোধী আন্দোলনকারীরা অন্যদের সাথে দাস ব্যবসায়ী অ্যাডওয়ার্ড কোলস্ট্রেনের মূর্তি ভেঙে গত ৭ জুন সাগরে নিক্ষেপ করেছে।

দাসপ্রথার বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বারবারই কথা বলে আসছে, কিন্তু তাদের কথা কেউ কানে তুলেনি। দুর্বলের ওপর সবলের প্রভাব প্রতিপত্তি থেকেই দাসপ্রথার উদ্ভব হয়েছিল, দুর্বলতা বলতে যেমন শারীরিক দুর্বলতা বুঝায়, এ ক্ষেত্রে দুর্বলতা বলতে অর্থনৈতিক দুর্বলতাই মুখ্য বিষয় হিসেবে কাজ করেছে। শরীরের রঙ, নিরক্ষরতা ও দরিদ্রতার কশাঘাতে নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষগুলোই দাসপ্রথার ভিকটিম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কথিত মালিকরা দাসের সাথে পশুর চেয়েও খারাপ আচরণ করত। যে মানুষগুলো পণ্যের মতো বাজারে বিক্রি হয়েছে তারাই দাস, বিক্রীত মানুষটি ‘মানুষ’ হিসেবে কোথাও কোনো প্রকার দাবি, অধিকার ও একজন মানুষ অন্য একজন মানুষ থেকে যে আচরণ প্রাপ্য, দাসরা সে আচরণ প্রত্যাশা করতে পারেনি। ইউরোপ ছাড়াও আরব অধ্যুষিত এলাকায় দাসপ্রথা প্রকটভাবে ছিল। দাসপ্রথা নিয়ে এখন অনেকেই অনেক কথা বলেন বটে, কিন্তু আজ থেকে এক হাজার ৫০০ বছর আগে মানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মদ সা: ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণে দাসপ্রথা নিরুৎসাহিত করেন। সৌদি ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ক্রয়কৃত দাস মুক্তি পেয়েছিল। তিনি দাসমুক্তিকে ইবাদতের অংশ হিসেবে গণ্য করেছেন। যুগে যুগে মানবতাবাদী মনীষীরা দাসপ্রথার বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন যাদের মধ্যে আব্রাহাম লিঙ্কনের নাম উল্লেখযোগ্য। কিন্তু অনেক দাস ব্যবসায়ী রয়েছে যাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছিল।

আমেরিকা অতিসম্প্রতি সংবিধান সংশোধন করে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করেছে। মানবাধিকার বিষয়ক ইউরোপীয় কনভেনশনের ৪ অনুচ্ছেদে যেভাবে দাসত্ব বা জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে, তা এখন ১৯৯৮ সালের মানবাধিকার আইনের ফলে যুক্তরাজ্যের আইনের অঙ্গীভূত। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদের জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

দাসের ইংরেজি শব্দার্থ Slave. Oxford Dictionary-এর মতে Slave হলো (1) a person who is legally owned and is forced to work for them, (2) a person who is completely dominated or influnced’. বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রণীত অভিধানে Slave বলতে- ১. ক্রীতদাস, কেনা গোলাম; ২. ‘যে ব্যক্তি অন্যোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য হয়’ শব্দার্থ করা হয়েছে।

লেলিন বলেছেন, দাসত্ব তিনি প্রকার। প্রথমত, এক শ্রেণীর লোক স্বেচ্ছায় দাসত্ব গ্রহণ করে বিনিময়ে তার ক্ষুধার জ্বালা নিবারণসহ জীবন ধারণের প্রয়োজনীয়তা মেটাতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকে না। দ্বিতীয়ত, এক শ্রেণীর লোক রয়েছে যারা নিজেরা বুঝতেই পারছে না যে, তারা দাসত্ব করে যাচ্ছে বিনিময়ে আরাম-আয়াশে দিন কাটাচ্ছে, কিন্তু সত্য-মিথ্যার তারতম্য করতে পারে না; ৩. ব্যতিক্রমধর্মী এক শ্রেণীর লোক রয়েছে যারা দাসত্বকে না মেনে প্রতিবাদ করে আসছেন তারাই বিদ্রোহী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন, বিনিময়ে পাচ্ছেন জেল-জুলুম, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, এমনকি ফাঁসির দড়ি।

দাসত্ব গ্লানির ও অপমানজনক। অন্য দিকে ‘বিদ্রোহী’ জীবন অনেক কষ্টের তবে সম্মানজনক। যদিও আইন করে কৃতদাস প্রথা বা দাসপ্রথা বিলুপ্ত বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু আমাদের সমাজে কি দাসত্ব বন্ধ হয়েছে? বরং ‘মানসিক দাসত্বের’ পরিমাণ অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। খেয়ে পরে একটু স্বস্তিতে থাকার জন্য, কোথাও প্রমোশনের জন্য, কোথাও পদ-পদবি পাওয়ার জন্য মানুষ বিশেষ করে আমাদের সমাজে যারা বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত তারা নির্লজ্জের মতো দাসত্ব করে যাচ্ছে। কলকাতামনস্ক কিছু বুদ্ধিজীবী আছেন যারা পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রকে নিজের দেশ মনে করেন, তাদের মানসিক দাসত্ব প্রকটভাবে দেখা দিচ্ছে, বিশেষ করে তাদের লেখনি ও বক্তব্যে।

মানসিক দাসত্ব করতে শরীর খাটাতে হয় না, বরং মনমানসিকতা ও বিবেককে বিক্রি করে নিজ সত্তাকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। নিয়োগকর্তার স্বার্থ রক্ষার্থে সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করা এবং মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করে বিনিময়ে শাসকগোষ্ঠীর সুদৃষ্টি অর্জন করে নিজ ও পরিবারের জন্য সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আদায় করার নামই মানসিক দাসত্ব। এ ধরনের দাসের সংখ্যা বিশেষ করে কথিত বুদ্ধিজীবী সমাজ, কলকাতামনস্ক বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এ প্রবণতা এখন সবচেয়ে বেশি। সম্প্রতিককালে কথিত বুদ্ধিজীবীদের সাথে পাল্লা দিয়ে সরকারি আমলাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কোনো সদস্য, যারা সংখ্যায় মোটেও কম নয়, মানসিক দাসত্বের চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে, যার ফলে জনগণ এখন আর সাধারণত সত্যের আলোর মুখ দেখতে পায় না।

মানুষের জন্যই সভ্যতা। গর্ভ করে বুক ফুলিয়ে মানুষ দাবি করে বলে, ‘মানুষ হলো সৃষ্টিকর্তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি’। সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির স্বীকৃতির একমাত্র উপাদান মানুষের ‘বিবেক’। অনেক পশু রয়েছে যারা অনেক চতুর বা চালাক, অনেক সাহসী, অনেক শক্তিধর। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকে তারা বিবেকসম্পন্ন হয় না বলে তাদের ‘পশু’ বলা হয়। তবে মানবজাতির মধ্যে কিছু মানুষ রয়েছে যাদের কর্মকাণ্ড পশুত্বকেও হার মানায়। পশুত্ব থেকে দু’পা বিশিষ্ট মানবজাতিকে রক্ষা করার জন্য যুগে যুগে শতাব্দীতে সৃষ্টিকর্তা বার্তাবাহক পাঠিয়েছেন যাদের কেউ অনুকরণ করে, কেউ করে না। মানুষ মাত্রই ‘বিবেক’ রয়েছে, কিন্তু পশুত্ব, লোভ, কামনা-বাসনার কাছে কোথাও কোথাও মানুষের বিবেক হার মেনে যায়, তখন কি শুরু হয় মানসিক দাসত্ব? ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ বলতে যা বোঝায় তা পৃথিবীতে এখন বিরল প্রজাতির মতোই একটি দু®প্রাপ্য বিষয়। মানসিক দাসত্বের কারণে মানুষ হয়ে পড়ে বিবেকবর্জিত এবং যাদের বিবেক চলে গেছে তাদের পক্ষে যেকোনো কাজ করা সম্ভব যা চার পা-বিশিষ্ট পশুরা করে থাকে।

সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় এই যে, রাষ্ট্রও মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে। যখন শাসকগোষ্ঠী মনে করে, মিথ্যা বলা ছাড়া জনগণকে ধোঁকা দেয়া যাবে না, তখনই রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্র মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে প্রচার শুরু করে। ফলে রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রের ওপরেও জনগণের আস্থা কমে গেছে। পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রচারযন্ত্রগুলোও কোথাও সরকারের বা কোথাও মালিকের স্বার্থ রক্ষা করে, প্রয়োজনে ‘সত্য’কে জলাঞ্জলি দিচ্ছে।

সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ বলেছেন, ‘মানুষ আসলে বড়ই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করতে থেকেছে এবং একজন অন্যজনকে হক কথা ও সরব করার উপদেশ দেয়।’ (সূরা আল-আসর, আয়াত : ২-৩) উল্লেখ্য, ‘হক’ শব্দটি ‘বাতিলের’ বিপরীত। অর্থাৎ ‘হক কথা’ বলতে সঠিক, নির্ভুল, সত্য, ন্যায় ও ইনসাফের কথা বলাকে বোঝায়। কুরআনিক নির্দেশনা মোতাবেক ‘হক’ কথা ‘ইবাদতের অংশ, ব্যর্থতায় গুনাহগার হতে হবে। তবে যারা নাস্তিক তাদের কাছে ইবাদত সম্পর্কে কথা বলা অরণ্যে রোদনের শামিল। কিন্তু যারা ধর্মের প্রশ্নে ভাবাবেগে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তারাও কি হক কথা বলেন?

‘বিবেক’ সব সময়ই সত্যের সন্ধানে থাকে, কিন্তু ব্যত্যয় হয় তখনই যখন লোভ, বৈষয়িক প্রতিপত্তি ও চাওয়া-পাওয়ার কামনা-বাসনা মনের ভেতর গভীরভাবে বাসা বাঁধে। ‘সত্য’কে মানুষ তখনই পরিহার করে যখন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আশা আকাঙ্ক্ষা প্রকট আকার ধারণ করে। গেরুয়া পোশাক পরে ‘সাধু’ হওয়ার সংখ্যাই এখন বেশি, ‘মন’ রাঙিয়ে ‘সাধু’ হওয়া অর্থাৎ মনে-প্রাণে ‘সাধু’ হওয়ার আধিক্য এখন কোথায়? সবাই বলি ‘সত্য’ সুন্দর অথচ এই সুন্দরকেই আমরা পরিহার করি যখন মানসিক দাসত্ব আমাদের মন-মগজে বাসা বাঁধে।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
(অ্যাপিলেট ডিভিশন)

taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement