২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মিসর ও তুরস্কের যুদ্ধ হবে লিবিয়ায়?

মিসর ও তুরস্কের যুদ্ধ হবে লিবিয়ায়? - ছবি : সংগ্রহ

লিবিয়াকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বাড়ছেই। মিসরীয় সংসদে লিবিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের ব্যাপারে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়েছে। অন্য দিকে, তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান লিবিয়ার ‘যুদ্ধবাজ নেতা’ খলিফা হাফতারকে সমর্থন দেয়া বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। এই ইস্যু নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আলাদা আলাদাভাবে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান, মিসরীয় প্রেসিডেন্ট আবদুল ফাত্তাহ সিসি এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রনের সাথে কথা বলেছেন। এদিকে হাফতার বাহিনীর কাছ থেকে সির্তে দখলের জন্য জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত জিএনএ সরকারের সেনাবাহিনী অগ্রসর হতে শুরু করেছে। যেকোনো সময় দুই পক্ষের মধ্যে চূড়ান্ত সঙ্ঘাত শুরু হতে পারে।

সব মিলিয়ে লিবিয়ার পরিস্থিতি এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি উত্তেজনাকর ও জটিল অবস্থায় উপনীত হয়েছে। প্রশ্ন হলো, জিএনএ সরকারের পক্ষে তুরস্কের সামরিক হস্তক্ষেপের পর মিসর দেশটিতে হাফতারের পক্ষে সেনাবাহিনী পাঠালে লিবিয়ার এই সঙ্ঘাত কি অন্য দেশের মাটিতে মিসর-তুরস্ক যুদ্ধে রূপ নেবে? এ ধরনের লড়াইয়ে কেউ কি পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছে? যদি তাই ঘটে থাকে তাহলে যুদ্ধের পরিণতি কী দাঁড়াতে পারে আর মধ্যপ্রাচ্যের সার্বিক পরিস্থিতিতে এর প্রভাবইবা কেমন হতে পারে।

মিসরের নতুন সম্পৃক্ততা
জাতিসঙ্ঘ-সমর্থিত সরকারের সেনাবাহিনী খলিফা হাফতারের নিয়ন্ত্রণাধীন কৌশলগত সির্তে শহরের কাছাকাছি পৌঁছার পরে মিসরীয় সংসদে লিবিয়ায় সেনাবাহিনী পাঠানোর বিষয় অনুমোদনের ঘটনা ঘটেছে। মিসরের সংসদের সেরকম আলাদা কোনো গুরুত্ব না থাকায় দেশটির রাষ্ট্রপতি সিসি লিবিয়ায় সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের কথা বলার পরেই সেনা মোতায়েনের সম্ভাবনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সংসদে প্রস্তাব অনুমোদনের পর এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘মিসরের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য সংসদ সর্বসম্মতিক্রমে সীমান্তের বাইরে যুদ্ধ মিসনে মিসরীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য মোতায়েনের অনুমোদন দিয়েছে।’

সংসদের এই ভোটাভুটির কিছুক্ষণ আগে সিসি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফোনে কথা বলেছেন। এরপর হোয়াইট হাউজ এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘দুই দেশের নেতারা যুদ্ধবিরতি এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আলোচনার অগ্রগতির মাধ্যমে লিবিয়ার সঙ্ঘাত তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।’
হোয়াইট হাউজ বলেছে, ট্রাম্প ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমমানুয়েল ম্যাক্রনকে ফোনে বলেছিলেন যে বিদেশী বাহিনী এবং অস্ত্রের উপস্থিতি দ্বন্দ্বকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। অন্য দিকে জাতিসঙ্ঘের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক সাংবাদিকদের বলেছেন : ‘লিবিয়ায় বর্তমান সঙ্কটের কোনো সামরিক সমাধান নেই এবং অবশ্যই তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতি হওয়া উচিত।’

প্রক্সি যুদ্ধ চাঙ্গা হবে?
বলা হচ্ছে, জাতিসঙ্ঘ-সমর্থিত লিবিয়ার সরকারি বাহিনী যে কেন্দ্রীয় শহর সির্তের কাছে চলে গেছে এবং তারা হাফতারের অবৈধ মিলিশিয়া যে থেকে পুনরায় দখল করার চেষ্টা করছে সেটি লিবিয়ার বিশৃঙ্খল প্রক্সি যুদ্ধের প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষকে সমর্থনকারী মিসর ও তুরস্কের মতো যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সরাসরি লড়াইয়ে ডেকে আনতে পারে। সিসি কৌশলগত উপকূলীয় শহর সির্তেকে ‘রেডলাইন’ হিসেবে অভিহিত করে আগেই সতর্ক করেন যে, এই শহরে যেকোনো আক্রমণই কায়রোকে তেলসমৃদ্ধ দেশটিতে সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করতে প্ররোচিত করবে।

মিসর শুরু থেকেই পূর্বাঞ্চলভিত্তিক হাফতারের মিলিশিয়াকে সমর্থন করে আসছে আর তুরস্ক পশ্চিমে ত্রিপোলিতে ইউএন-সমর্থিত সরকারকে সমর্থন করে। মিসরের পাশাপাশি খলিফা হাফতারকে সংযুক্ত আরব আমিরাত আর রাশিয়াও সমর্থন দেয়। অন্য দিকে, তুরস্ক ছাড়াও ত্রিপোলি বাহিনীকে কাতার ও ইতালি সহায়তা করে।
খলিফা হাফতারের মিলিশিয়ারা গত বছরের এপ্রিলে জাতিসঙ্ঘ সমর্থিত সরকারের কাছ থেকে ত্রিপোলি দখলের জন্য আক্রমণ শুরু করেছিল। কিন্তু লিবিয়ার রাজধানীর উপকণ্ঠে পৌঁছার পর তা অচল হয়ে পড়ে। আর গত মাসে ত্রিপোলি সরকার মিত্র তুরস্কের সহায়তায় পাল্টা অভিযান চালিয়ে রাজধানীর বিমানবন্দর, শহরের সব প্রধান প্রবেশদ্বার ও প্রস্থানপথ এবং এই অঞ্চলের মূল নগরগুলোর একটি পুনরুদ্ধার করে। এখন আরো পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে মধ্যাঞ্চলের কৌশলগত নগরী সির্তে দখল করতে চাইছে। এটি সম্ভব হলে লিবিয়ার সরকারি বাহিনীর পক্ষে আরো পূর্বের দিকে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর হাফতারের নিয়ন্ত্রণ থেকে অত্যাবশ্যকীয় তেল স্থাপনা, টার্মিনাল এবং ক্ষেত্রগুলো দখল করে নিতে পারবে জিএনএ বাহিনী।

তুরস্কের সংশ্লিষ্টতা
লিবিয়ায় রাজনৈতিক সমাধানকেই তুরস্ক সমর্থন করে। তবে এই প্রক্রিয়া থেকে হাফতারের বিদায় কামনা করে। গত ২০ জুলাই আঙ্কারায় তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকার লিবিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ফেথি বাসাগা এবং মাল্টার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাইরন ক্যামিলারির সাথে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেছেন। আঙ্কারায় ত্রিপক্ষীয় আলোচনা শেষে তারা লিবিয়ায় যুদ্ধবাজ খলিফা হাফতারের প্রতি সমর্থন অবিলম্বে বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

এটি বেশ অবাক করা বিষয় যে নন-ন্যাটো রাশিয়া এবং ন্যাটো-সদস্য ফ্রান্স একই সমান্তরালে ন্যাটো সদস্য তুরস্কের বিরুদ্ধে এসে দাঁড়িয়েছে। লিবিয়ার জটিল দ্বন্দ্বের সাথে অনেক দেশই জড়িত। এর ফলে সব পক্ষের মধ্যে স্পষ্ট প্রক্সি যুদ্ধের সূচনা হচ্ছে। তবে লিবিয়ায় তাদের জাতীয় নিরাপত্তা এবং গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থের গভীর প্রভাবের কারণে মিসর এবং তুরস্ক দেশটির সাথে সবচেয়ে বেশি জড়িত।

দুই দেশের সমুদ্রসীমা সীমানা নির্ধারণে গত বছর একটি চুক্তি স্বাক্ষরের পর লিবিয়ার জাতীয় সমঝোতা (জিএনএ) সরকারকে সমর্থন করতে তুর্কি সামরিক সংশ্লিষ্টতা তৈরি হয়। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক সম্পদের পরিকল্পিত অনুসন্ধানে তুরস্ক নিজের জন্য বৃহত্তর ভূমিকা নিতে চায় এবং জিএনএবিরোধী মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, রাশিয়া, ফ্রান্স এমনকি গ্রিস দ্বারা সমর্থিত খলিফা হাফতারের বাহিনীকে দুর্বল করতে চায়।

মার্কিন নীতির বিভ্রান্তি!
কৌশলগত স্বার্থ সেভাবে না থাকায় লিবিয়ায় মার্কিন অবস্থান বা ভূমিকা সুস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। ওয়াশিংটন লিবিয়াকে তার সামরিক ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টার প্রান্তসীমায় ঠেলে দিয়েছে, কিন্তু রাশিয়ার এই সঙ্ঘাতের ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্ব মার্কিন অবস্থানকে বদলে দিতে পারে বলেও অনেকেই মনে করছেন। আমেরিকার মিত্র দেশগুলোর মধ্যে ইতালি ও তুরস্ক জিএনএকে সমর্থন করছে, অন্যদিকে ফ্রান্স গ্রিস ও মিসর হাফতার বাহিনীকে সমর্থন করে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরব হাফতারকে সমর্থন করলেও রিয়াদ মৌখিক সহায়তার চেয়ে বেশি কিছু করছে বলে দেখা যাচ্ছে না; যদিও সংযুক্ত আরব আমিরাত এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেপরোয়া ভূমিকা নিচ্ছে।

কায়রো-আঙ্কারার সক্ষমতা
লিবিয়ায় মুখোমুখি দুই পক্ষ তুরস্ক এবং মিসরের সেনাবাহিনীর এফ-১৬ বিমানসহ শত শত অন্য যুদ্ধবিমান রয়েছে। মিসরীয় সেনাবাহিনী হাজার হাজার ট্যাংক নিয়ে কাগজে-কলমে বিশ্বের নবমতম শক্তিশালী। তুরস্ক রয়েছে একাদশ স্থানে। তবে সম্ভবত ন্যাটোর সদস্য হওয়ায় তুর্কি বাহিনীকে মিসরের চেয়ে বেশি কার্যকর মনে করা হয়। অবশ্য এই তত্ত্বগত আলোচনার বাইরে বাস্তবে, ক্ষমতা এবং কার্যকারিতার মধ্যে একটি বিস্তৃত ফাঁক আছে। মিসর দীর্ঘকাল বাইরের কোনো সঙ্ঘাতের জন্য পরীক্ষিত হয়নি আর প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে ঘরে বসে দুর্বল সশস্ত্র দলগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল। গত সাত বছর ধরে সিনাই উপদ্বীপে দায়েশ বাহিনীর সাথে এর সঙ্ঘাত চলছে, কিন্তু ৭০০০-এরও কম যোদ্ধাসম্বলিত সীমিত বিদ্রোহও নির্মূল করতে পারেনি। অন্য দিকে, বিদ্রোহের মুখে তুরস্কের অভিজ্ঞতা এবং কার্যকারিতা অনেক বেশি প্রমাণিত হয়েছে। দেশটির সেনাবাহিনী বহু বছর ধরে সিরিয়ায় জড়িত ছিল এবং কুর্দি পিকেকে বাহিনীকে তারা মোকাবেলা করছে। তুর্কি বাহিনী আইএসকেও শক্তিশালীভাবে মোকাবেলা করেছিল।

কৌশলগত হিসাব-নিকাশ
মূল প্রশ্নটি হলো লিবিয়ায় মিনর ও তুরস্কের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা কতটা রয়েছে? আল-সিসির ‘হস্তক্ষেপ’ যদি ঘটে তবে তা কি সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি ব্যাপক যুদ্ধে রূপ নেবে? তুরস্ক অবশ্য এর মধ্যে দেখিয়েছে যে, দেশটি জিএনএর পাশে কার্যকরভাবে দাঁড়িয়েছে এবং এর অতীব গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। রাশিয়া সচেতন যে, তুরস্ক লিবিয়ায় নিজের অবস্থান থেকে সরে যাবে না, আমেরিকাও বুঝতে পেরেছে যে, আঙ্কারা তার লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আর মস্কো ও তেহরানের সাথে সহযোগিতা সীমাবদ্ধ করতে ওয়াশিংটন তুর্কি সরকারকে সমর্থন করতে আগ্রহী। কিন্তু সমস্যা হলো যুক্তরাষ্ট্রের লিবিয়া নীতি অস্থির। এই অস্থিরতার কারণে রাশিয়ার পক্ষে জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত জিএনএ সরকারের বিরুদ্ধে লিবিয়ার যুদ্ধবাজ জেনারেল খলিফা হাফতারের সেনাবাহিনীকে সমর্থন করা আরো সহজ হয়ে গিয়েছিল? সৌদি আরব, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ফ্রান্সের সাথে নিজেকে একত্র করে রাশিয়া হাফতারকে সমর্থন করছে। অথচ কে ভেবেছিল যে রাশিয়া ইয়েমেনের বিধ্বংসী গৃহযুদ্ধের স্থপতি সৌদি আরব এবং আমিরাতিদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলবে। সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত মিসরে সামরিক অভ্যুত্থানের নেতা জেনারেল সিসিকে সমর্থন করেছিল। প্রশ্ন হলো কী ধরনের মাস্টারমাইন্ড রাশিয়াকে তাদের সাথে নিয়ে এসেছিল?

রাশিয়া মার্কিনবিরোধী পদক্ষেপ হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকাতে জনবিরোধী সরকারকে সমর্থন করে। ব্ল্যাকওয়াটারের মতো বেসরকারি আমেরিকান নিরাপত্তা সংস্থা ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের নোংরা নীতিগুলো বাস্তবায়ন করে। আর এখন, বেসরকারি রাশিয়ান সংস্থাগুলোকে সে কাজে নামানো হয়েছে লিবিয়া ও অন্য কয়েকটি দেশে।
স্নায়ুযুদ্ধের যুগে রাশিয়াকে মারাত্মক প্রতিযোগিতার দিকে চালিত করেছিল যুক্তরাষ্ট্র । ‘তারকা যুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে দেয়। আফগানিস্তান আক্রমণ করার পর এটি সোভিয়েত ইউনিয়নকে আরো কঠিন কাদায় আটকে ফেলে। আর এই দুটি কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন নিয়ে এসেছিল। প্রশ্ন হলো, পুতিনের রাশিয়া কি একই দিকে চলেছে?

দেখে মনে হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে নিজেদের বাহিনীকে পুনর্গঠন করা এবং চীনের উত্থান বন্ধে মধ্যপ্রাচ্যে তার কার্যক্রমকে থামিয়ে দেবে। প্রশ্ন হলো এই অঞ্চলে রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান ভূমিকার সাথে কি এর কোনো যোগসূত্র রয়েছে? যুক্তরাষ্ট্র কি রাশিয়াকে ভিলেন হওয়ার উপাধি দিয়ে দিতে চায়? পুতিন কি তার নিজের খেলা খেলছে, নাকি দাবা বোর্ডের বড় ছবিতে তিনি কেবলই একটি ঘুঁটি? কিছু আমেরিকান বলেছেন যে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে আসার ফলে যে শূন্যতার সৃষ্টি হবে, রাশিয়া তা পূরণ করলে ওয়াশিংটন খুশি হবে। এটাই এমন একটি প্রশ্ন যার উত্তর অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।

তুরস্কের কৌশলগত লাভ
আঙ্কারা সম্ভবত তার সামরিক বিজয়গুলো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সুনির্দিষ্ট আর্থিক, কৌশলগত এবং ভূ-রাজনৈতিক লাভে অনুবাদ করার চেষ্টা করবে। কৌশলগত ও ভূ-রাজনৈতিক স্তরে এটি যত দ্রুত সম্ভব এয়ার (আল-ওয়াতিয়া) এবং নৌ (মিগ্র্যাট) উভয় ঘাঁটি স্থাপন এবং পরিচালনা করার চেষ্টা করবে। তুরস্কের কার্গো বিমানগুলো ইতোমধ্যে আল-ওয়াতিয়া বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে।

আর্থিক ও জ্বালানি দিক থেকে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান এবং অবকাঠামো ও নির্মাণ প্রকল্পে প্রধান ভূমিকা নিতে আগ্রহী আঙ্কারা। আঙ্কারা লিবিয়ায় নিরাপত্তা খাত সংস্কারে সহযোগিতা করতে চায়, লিবিয়ান বাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং জিএনএকে বিদ্যুতের মতো প্রাথমিক পরিষেবা সরবরাহ করতে সহায়তা করতে চায়।

জিএনএ এখনও প্রমাণ করতে পারেনি যে, এটি লিবিয়ার কেবল যুদ্ধবিরোধী অন্য একটি দল নয়, সুসংগঠিত সরকার হিসেবে এটি কাজ করতে পারে। এ ব্যাপারে সর্বাধিক পরীক্ষাটি হবে প্রশাসনের ক্ষেত্রে জিএনএর সক্ষমতা এবং সদ্য অর্জিত অঞ্চলের বাসিন্দাদের চিকিৎসাসহ মৌলিক পরিষেবাদির নিশ্চিতকরণের মধ্যে।
লিবিয়ার তেল অর্ধচন্দ্রের নিকটবর্তী সির্তে এবং জুফ্রার ভবিষ্যৎ তুরস্ক এবং রাশিয়া আমিরাত-মিসর জোটের মধ্যে বিরোধের মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তুরস্কের সমর্থনে জিএনএ সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে, আর তুরস্ক যে কোনো যুদ্ধবিরতির পূর্বশর্ত হিসেবে এলএনএ বাহিনীকে এই অঞ্চল থেকে সরিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
তুরস্ক ও রাশিয়ার সম্পর্ক এবং মস্কোর সামরিক উপস্থিতি বিবেচনায় সিরিয়া ও লিবিয়ার দ্বন্দ্বের পরস্পর সংযুক্ত প্রকৃতির কারণে আঙ্কারা রাশিয়ার সম্পূর্ণ বিরোধিতা করার ব্যাপারে সতর্ক থাকবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, আঙ্কারার তাৎক্ষণিক লক্ষ্য এই অঞ্চলগুলো থেকে এলএনএ’র পশ্চাৎপসরণ।

আঙ্কারার লাল রেখা
সির্তে এবং জুফরার নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি যখন আসে তখন তুরস্ক জিএনএ’র সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে বিভিন্ন বিকল্পের বিষয়টিও যুক্তিযুক্তভাবে বিবেচনায় রাখবে। এই অঞ্চলে স্থানীয় প্রশাসন বা কোনো আন্তর্জাতিক বাহিনীর উপস্থিতি জিএনএ বা এলএনএ দ্বারা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বিকল্প হতে পারে। তবে এখানকার এলএনএ’র নিয়ন্ত্রণ তুরস্কের জন্য প্রধান লাল রেখা বলে মনে হয়।

এই ক্ষেত্রে, সামরিক হস্তক্ষেপের মিসরীয় হুমকি আঙ্কারায় উচ্চপর্যায়ের উদ্বেগের কারণ বলে মনে হচ্ছে না। যদিও মিসরীয় হস্তক্ষেপ বা একটি ভুল গণনাযোগ্য পদক্ষেপের বিষয়টি একেবারে অস্বীকার করা যায় না। কারণ মিসর তার জনগণের সামনে দেয়া প্রতিশ্রুতি ও হুমকির পরে সির্তে-জুফ্রার ওপর সামরিক আক্রমণের প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হতে পারে। তবে সম্ভবত এটি সীমিত, প্রতীকী এবং আরো বেশি হবে স্থল অভিযানের চেয়ে বিমান হামলার রূপে।

অন্য দিকে, দুই মার্কিন সহযোগী, আঙ্কারা এবং কায়রোর মধ্যে ক্রমবর্ধমান মাত্রায় সঙ্ঘাত আমেরিকার জন্য মধ্যস্থতা করার চাপ সৃষ্টি করতে পারে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুরস্ক ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং ইতালি লিবিয়ায় পৌঁছে যাচ্ছে, অন্য দিকে তুরস্ক-ফ্রান্সের মধ্যকার বৈরিতার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকতে পারে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে উত্তর আফ্রিকা এবং লিবিয়া বিশেষত পূর্ব ভূমধ্যসাগর, সাহেল এবং সিরিয়া বিতর্কিত ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্র বাড়ছে। জার্মানির মতো ফ্রান্সে তুরস্কের বিশাল জনগোষ্ঠী নেই, তাই তুরস্কের জন্য প্যারিসের প্রতি কঠোর অবস্থান গ্রহণে কোনো দেশীয় রাজনৈতিক ব্যয় নেই। আর এই কলহ লিবিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে অনেক ঝামেলা সৃষ্টি করবে।

প্রত্যক্ষ যুদ্ধ কি হবে?
তুরস্ক ও মিসর দুই পক্ষই সির্তে ও জুফ্রাকে লাল রেখা হিসেবে চিহ্নিত করে সামরিক সঙ্ঘাতে জড়ানোর হুমকি দিয়ে এলেও কোনো দেশই এখানে সরাসরি লড়াইয়ে লিপ্ত হতে চায় বলে মনে হয় না। এ কারণে দুই পক্ষই রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমেই সঙ্কটের সমাধান করার কথা বলছে। জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্থতায় এ ধরনের আলোচনার শুরু এবং যুদ্ধবিরতির পথে মূল বাধাটিই হলো সির্তে ও জুফ্রার নিয়ন্ত্রণ। উপরে যে তৃতীয় বিকল্প অর্থাৎ সির্তে ও জুফ্রার নিয়ন্ত্রণ আন্তর্জাতিক বাহিনীর হাতে ছেড়ে দিয়ে সেখান থেকে এলএনএ বাহিনীর প্রত্যাহার অথবা জিএনএ ও এলএনএ’র যৌথ উপস্থিতি নিশ্চিত করার মতো কোনো ফর্মুলায় উভয়পক্ষ সম্মত হলে সামরিক সঙ্ঘাত এড়ানো যেতে পারে। এরপর আলোচনার মাধ্যমে লিবিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হতে পারে। সেই সম্ভাবনা এখনো অনেক বেশি এ কারণে যে, সিসি যতই যুদ্ধে জড়ানোর হুমকি দিক না কেন মিসরের সেনাবাহিনীর সক্ষমতা এখন একবারে নিম্ন পর্যায়ে। দেশটি নিরস্ত্র নিজ দেশের জনগণের সামনে বীরত্ব দেখালেও ব্যবসাবাণিজ্য ও বিলাসী জীবনেই সেনাবাহিনীর সদস্যদের নানাভাবে অভ্যস্ত করে তোলা হয়েছে। তুরস্কের বিষয়টি সেরকম নয়।

এরপরও ইসরাইল আমিরাত এমনকি সৌদি আরবও চাইবে লিবিয়ায় মিসরকে ডেকে এনে তুরস্কের সাথে সঙ্ঘাতে জড়িয়ে দিতে। এই ফাঁকে ইসরাইল নিজের সীমান্ত স্থায়ীভাবে পশ্চিম তীর ও জর্দান উপত্যকায় সম্প্রসারণের কাজটি সম্পন্ন করতে পারবে। অন্য দিকে, সিরিয়ায় রাশিয়া ইরান তুরস্কের সমঝোতার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে তা দীর্ঘায়িত হবে। ২০২৩ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর উসমানীয় খেলাফত ভেঙে দেয়ার ব্যাপারে করা অপমানমূলক লুজান চুক্তির অবসান ঘটছে। এরপর তুরস্কের জন্য নিজেকে সীমিত করে রাখার বাধ্যবাধকতা সেভাবে থাকবে না। দেশটি তার প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে বেশি সক্রিয় হতে পারবে। এ সময় আসার আগেই তুরস্কের শক্তিমত্তাকে যুদ্ধের জটিল আবর্তে জড়ানোর একটি কৌশল কোনো কোনো পক্ষের থাকতেও পারে। তবে এটিও ঠিক যে সিরিয়া এবং লিবিয়ায় সামরিক পরীক্ষায় প্রাথমিকভাবে তুরস্ক যে উত্তীর্ণতার প্রমাণ দিয়েছে সেটিই দেশটিকে এখন প্রভাবশালী আঞ্চলিক শক্তির মর্যাদা এনে দিয়েছে। সব মিলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তর ক্যানভাসেই বিবেচনা করতে হবে লিবিয়ার পরিস্থিতিকে। সেখানে আরো অনেক ঘটনা ঘটতে বাকি রয়েছে বলে মনে হচ্ছে, যার ওপর দেশটির ভবিষ্যৎ অবস্থার অনেকখানি নির্ভর করছে।

mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement