২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সমাধান হলো সম্পদের সুষম বণ্টন

সমাধান হলো সম্পদের সুষম বণ্টন - ছবি : নয়া দিগন্ত

দেশে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, হত্যা, আত্মহত্যা, পিতা কর্তৃক সন্তান খুন, পুত্র-কন্যা কর্তৃক পিতা-মাতা খুন, বর্ডার এলাকায় ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশী খুন, র্যাবের হাতে মাদক ব্যবসায়ী বা চিহ্নিত সন্ত্রাসী খুন প্রভৃতি বেড়েই চলেছে। রাজধানীতে থানার সংখ্যা দ্বিগুণ করা হয়েছে। কিন্তু অপরাধ বা অপরাধীর সংখ্যা কমেনি বরং বৃদ্ধি পেয়েছে এবং অপরাধের কারিগরি কৌশল হয়েছে পরিবর্তন। হত্যা প্রতিশোধের জন্য হয়ে থাকে বা এলাকার প্রভাব প্রতিপত্তি, জমি দখল, বাড়ি/ব্যবসা দখলের জন্য হয়। যা পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে হয়ে আসছে। যেখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনিশ্চয়তায় থাকে, যেখানে মানুষের মধ্যে সীমা লঙ্ঘনের প্রবৃত্তি প্রকটভাবে দেখা দেয় সেখানেই চলে হত্যাযজ্ঞ। 

আরেক প্রকার হত্যা রাষ্ট্রীয় মদদে হয়ে থাকে যেমনÑ রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকারের হত্যাযজ্ঞ, এনআরসি বাস্তবায়নের জন্য মোদি সরকার কর্তৃক ভারতীয় মুসলমানদের ওপর হত্যাযজ্ঞ, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বাঙালিদের ওপর হত্যাযজ্ঞ প্রভৃতি। পক্ষান্তরে বলা যায়, আমাদের সমাজে পারিবারিক কলহের কারণেই স্বামী কর্তৃক স্ত্রী খুন, স্ত্রী কর্তৃক স্বামী খুন, সন্তান হত্যা করে নিজে আত্মহত্যার চেষ্টা প্রভৃতির মূল কারণ হলো সংসারে অভাব অনটন। জনগণ যদি রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষম বণ্টনের অংশীদার হতো তবে দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বড় অংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত না। দরিদ্রতার কারণেই চুরি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা হয়ে থাকে। ধনীর দুলালরা অনেকেই মাদক সেবন করে বটে, কিন্তু মাদক কারবারি যাদের র্যাব বা পুলিশ ক্রসফায়ার করেছে তাদের মোটামোটি সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। দরিদ্রতার কারণে কিশোর গ্যাং সৃষ্টি হয়েছে, দরিদ্রতার জন্য তারা লেখাপড়া করতে পারে না এবং একই কারণে গডফাদারদের নিয়ন্ত্রণে তারা মাদক সাপ্লাইয়ার হিসেবে কাজ করে, বিনিময়ে পেট ভরে ভাত খেতে পারে।

স্বাধীনতা আন্দোলনের অঙ্গীকার ‘সম্পদের সুষম বণ্টনে’ রাষ্ট্র সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। যার কারণে গরিব দিন দিন হচ্ছে পথের কাঙাল এবং ধনীরা গড়ে তুলছে সম্পদের অট্টালিকা। অথচ ০৪-১১-১৯৭২ ‘বাংলাদেশের সংবিধান’ জাতীয় সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হলেও স্বাধীনতা আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য অর্থাৎ সম্পদের সুষম বণ্টনের প্রশ্নে রাষ্ট্র আজ পর্যন্ত কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে যে, ‘সব নাগরিকের জন্য আইনে শাসন, মৌলিক অধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ অত্র আলোচনায় ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক’ সাম্যের ওপর আলোকপাত করে বলতে চাই যে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য আদৌ রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছি কি? বাংলাদেশে ধনী ও গরিবের যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য সেখানে কিভাবে সাম্যের অবস্থার সৃষ্টি হবে? 

অর্থ লোভী পাষণ্ডরা অর্থ উপার্জনে সাধারণ মানুষের রক্ত যেভাবে চুষে খায় তাতে মনে হয় টয়লেট থেকে কামড় দিয়ে টাকা তুলে নিতেও তাদের বিবেক কুণ্ঠিত হবে না। এক পাকিস্তানি নেতা যিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, (পরবর্তীতে আদালতের রায়ে ফাঁসিতে মৃত্যু) একসময় বলেছিলেন যে, ‘মুজে শরাব পিতে হায় জুরুর, লেকিন গরিবোকি খুন পিতা নেহি’ অর্থাৎ ‘আমি নিশ্চয় মদ খাই বটে, তবে গরিবের রক্ত পান করি না’ (তবে ষড়যন্ত্র করে ১৯৭১ সালে তিনি বাঙালিদের রক্ত পান করেছিলেন)। এখন প্রশ্ন হলো যত দিন অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের কালো পথ রাষ্ট্র বন্ধ না করবে, তত দিন পর্যন্ত গরিবের রক্তশোষণ অব্যাহত থাকবে। নীতিনির্ধারকদের অর্থাৎ যারাই ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করেছে তাদের খাই খাই অভ্যাসের কারণে বাংলাদেশ হয়েছে একটি সিস্টেম লসের দেশ, ব্যতিক্রম যা আছে তার সংখ্যা মাইক্রোসকোপে দেখতে হবে। এ দেশে যে কোনো অবৈধ কাজের জন্য রাষ্ট্রীয় যন্ত্রই শেল্টার দিয়ে থাকে।

এ দেশে আইন দুই ভাগে প্রয়োগ হয় বিধায় টাউট, বাটপার, অর্থ পিশাচররা সরকারি দলের আশ্রয় খোঁজে, আর সরকারি দল করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বা পুলিশ তাদের গায়ে হাত দেয় না, যখন লঙ্ঘনের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন বিধি বাম হলে সমালোচনার আঘাত যখন রাষ্ট্রের গায়ে আঘাতের পর আঘাত হানে তখনই হয় বিপত্তি, ফলে শুরু হয় অভিযান, কোথাও লোক দেখানো, কোথাও জেনুইন অভিযান যা নির্ভর করে অভিযানকারী কর্মকর্তার ওপর। কিন্তু কিছু দিন পার হলেই মুখ থুবড়ে পড়ে সে অভিযান। হাঁকডাক যতই হোক, যত গর্জে তত বর্ষে না। 

একটি জনগোষ্ঠীর সার্বিক স্বাধীনতা শুধু একটি ভৌগোলিক সীমারেখার ওপর নির্ভরশীল নয়। তবে ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে নিজস্ব শাসনব্যবস্থা কায়েম থাকাই সার্বভৌমিকতার মূল উপাদান। রাষ্ট্র সার্বভৌমিকভাবে স্বাধীন হলেও সর্বস্তরের জনগণ যদি এর সুফল ভোগ করতে না পারে তবে তখন সে স্বাধীনতার সুযোগের অপব্যবহারে সৃষ্টি হয় শ্রেণী বৈষম্য। সে বৈষম্যের কশাঘাতে বাংলাদেশ এখন রক্তাক্ত, অর্থাৎ প্রতিটি নাগরিকের জন্য স্বাধীনতার সুফল এখন ‘ডুমুরের ফুল’ মাত্র। এক পেশে বা অনৈতিক শাসনব্যবস্থা কোনো দিনই সমষ্টিগত কল্যাণ বয়ে আনে না। সংবিধানের পরিপূর্ণতা অর্জনের জন্য প্রস্তাবনায় আরো বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণœ রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য।’ কিন্তু সে মতে ‘জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তি’ বাস্তবায়নের জন্য বিগত ৫০ বছরে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখাতে পারেনি। রাষ্ট্রীয় সাহায্য যথা বয়স্কভাতা, ভিজিডি কার্ড, ত্রাণ, অনুদান, দান খয়রাত প্রভৃতি এবং একজন নাগরিককে ‘স্বনির্ভর’ বা সচ্ছল করার পদক্ষেপ নেয়া এক কথা নয়।

রাষ্ট্রীয় সাহায্য বা দান খয়রাত বা রিলিফের দুর্নীতির কথা বাদ দিলেও প্রতিটি নাগরিককে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার পদক্ষেপ রাষ্ট্রকে নিতে হবে, এ পদক্ষেপ কোনো সামাজিক সংগঠন বা এনজিও কর্তৃক সম্ভব নয়। বাংলাদেশের কিছু এনজিও এ মর্মে কিছু পদক্ষেপ নিলেও সম্পদ অর্জনের যে মনোপলি পদক্ষেপ একটি শ্রেণীর কাছে বন্দী হওয়ার কারণে এনজিও পদক্ষেপ ম্লান হয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া এনজিও ঋণ গ্রহণকারীদের সুদের বোঝা অনেক বেশি বহন করতে হয় বলেই অনেক ঋণ গ্রহীতাই সচ্ছলতার পরিবর্তে পা পিছলে পড়ে যায়, যারা সফল তাদের সংখ্যা নিতান্তই কম। 

স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এখন বা সাম্প্রতিকালে যারা প্রতিষ্ঠা করেছেন বা করছেন তারা কেউই সেবার উদ্দেশ্যে করছেন না। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এখন বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চলে। এখন হাসপাতালের মতোই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো লাভজনক একটি ব্যবসা। বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ঢাকায় কোনো কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীদের মাসিক বেতন দিতে হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা, যা একটি নি¤œ-মধ্যবিত্ত পরিবারের এক মাসের খরচের সমতুল্য। সম্প্রতি করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে শতাধিক বাঙালি ইতালিতে গিয়েছিল, কিন্তু ইতালি বিমানবন্দরে পজিটিভ শনাক্ত হওয়ায় ফিরতি বিমানে তাদের বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। অর্থের বিনিময়ে যারা করোনা সম্পর্কিত ভুয়া/জাল রিপোর্ট দেয় তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য বিবেক বিক্রি করে অঢেল বিত্তশালী হওয়া। বিত্তশালী হওয়ার নেশায় কিছু মানুষ তাদের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। অবস্থাটা যেন এ রকম যে, ‘ওলটপালট করে দে মা লুটেপুটে খাই।’ 

সমাজে ভদ্র চেহারার লোক হিসেবে পরিচিত যারা প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাষ্ট্রীয় কর্ণধার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বড় বড় কর্মকর্তাদের সাথে ছবি তোলার জন্য লোক দেখানো কিছু জনহিতকর কাজ করে এবং এ ছবিগুলোই দুর্বৃত্তায়ন করার জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। অযাচিত ছবি বা ফটোসেশনের বিষয়ে কর্তাব্যক্তিদের আরো সচেতন থাকা দরকার। আমাদের রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার সুযোগে ‘রাজনীতি’ দুর্বৃত্তদের পকেটস্থ হওয়ায় কোনো ধারাবাহিকতা ছাড়াই অর্থের প্রভাবে যেকোনো দুর্বৃত্ত যেকোনো সময় রাজনীতিতে ঢুকে গোটা পরিবেশকে কলুষিত করে ফেলেছে। 

সাধারণ মানুষ এখন দাঁড়াবে কোথায়? ‘লাজ ফার্মা’ দেশে একটি বিখ্যাত ও বুনিয়াদি ওষুধ বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মানুষ জানত। তাদের ওষুধের দোকান থেকে মেয়াদবহির্ভূত ওষুধ উদ্ধার করেছে র্যাব। বর্তমানে সমাজে বিশ্বাস করার মতো কোনো জায়গা আর রইল না। এর মূল কারণও বিত্তবৈভবের মালিক হওয়ার নেশা, যে নেশায় পুড়ে যাচ্ছে দেশ ও জাতি। 
দেশে অপরাধ বৃদ্ধির মূল কারণ কোথাও অর্থনৈতিক দৈন্যতা ও কোথাও অঢেল সম্পত্তির মালিক হওয়ার নেশা। আইন করে এ অবস্থার পরিবর্তন করা যাবে না, পুলিশের সংখ্যা বাড়িয়েও কোনো লাভ হবে না, যতক্ষণ না রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষম বণ্টন হবে। ফলে সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ হলো রাষ্ট্রীয় সম্পদের সুষম বণ্টন যা ছিল স্বাধীনতা পূর্ব স্বাধিকার আন্দোলনের মূল দাবি। 

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী 

taimuralamkhandaker@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
থামছে না পুঁজিবাজারে পতন বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদ ভারতের লোকসভা নির্বাচনে ভোট শুরু: নাগাল্যান্ডে ভোটার উপস্থিতি প্রায় শূন্য কারাগার এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা: রিজভী আন্দোলনে ব্যর্থ বিএনপির হাল ধরার কেউ নেই : ওবায়দুল কাদের পাবনায় ভারতীয় চিনি বোঝাই ১২টি ট্রাকসহ ২৩ জন আটক স্বচ্ছতার সাথে সরকারি অনুদানের চলচ্চিত্র বাছাই হবে: তথ্য প্রতিমন্ত্রী মিয়ানমার বিজিপির আরো ১৩ সদস্য পালিয়ে এলো বাংলাদেশে শ্যালকের অপকর্মে দুঃখ প্রকাশ করলেন প্রতিমন্ত্রী পলক মন্দিরে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ তুলে ২ ভাইকে হত্যা ইরানে ইসরাইলি হামলার খবরে বাড়ল তেল সোনার দাম যতই বাধা আসুক ইকামাতে দ্বীনের কাজ চালিয়ে যাবো : ডা: শফিকুর রহমান

সকল