২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ভবিষ্যৎ মানব সভ্যতার ভিত্তি ও প্রকৃতি

ভবিষ্যৎ মানব সভ্যতার ভিত্তি ও প্রকৃতি - ছবি : নয়া দিগন্ত

তিনটি বিষয় সভ্যতাকে বিভক্ত করে রাখে, মানবজাতির সংহতি বিনষ্ট করে। একটি হচ্ছে বর্ণবাদ, কালো মানুষ ও সাদা মানুষের মধ্যে পার্থক্য করা। এটা একেবারেই অযৌক্তিক। মানুষ রঙ নির্বিশেষে মূলত এক। তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মূলত এক। তাদের সষ্ট্রাও একই। কুরআনে বলা হয়েছে যে, বিভিন্ন রঙ আল্লাহর সৃষ্টি কৌশলের অংশ। আল্লাহর রাসূল মুহাম্মদ সা: বিদায় হজের ভাষণে বলেছেন যে, কালোর ওপর সাদার কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তেমনিভাবে সাদার ওপর কালোর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। এ সত্ত্বেও ইউরোপীয়রা আফ্রিকা থেকে কালো মানুষ ধরে আনে এবং তাদের দাস বানায়। সে এক অবর্ণনীয় দুঃখের কাহিনী। যেভাবে দাস ধরা হতো, তাদের জাহাজে করে আমেরিকা আনা হতো, যেভাবে তাদের ওপর অত্যাচার করা হতো তা ইতিহাসের কালো অধ্যায়। এ কাজ করেছিল সাদা ইউরোপীয়রা, যারা ইউরোপ থেকে আমেরিকা গিয়েছিল। সেখানে তারা স্থানীয় অধিবাসীদের হত্যা করে। অন্য দিকে আফ্রিকা থেকে মানুষ ধরে এনে তাদের দাস বানায়। তাদের কোনো মানবাধিকার ছিল না।

আব্রাহাম লিংকনের প্রচেষ্টায় আমেরিকায় আইনগতভাবে দাস প্রথার অবসান হয়। কিন্তু বাস্তবে দাস প্রথা চলতে থাকে। দাস প্রথা বিলোপের সিদ্ধান্তের ওপর আমেরিকায় কয়েক বছরব্যাপী রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ হয়। বাস্তবে আমেরিকায় কালো-সাদার পার্থক্য অব্যাহত রয়েছে। অধিকাংশ সাদা মানুষের মধ্যে এ প্রথা বদ্ধমূল হয়ে আছে। এ বর্ণবাদের ভিত্তিতে কোনো সভ্যতা গড়ে উঠতে পারে না। সভ্যতার ভিত্তি হতে হবে সব মানুষের সমতা ও ঐক্য।

বর্ণবাদের পর যে মতবাদ মানবজাতিকে বিভক্ত করে রেখেছে তা হচ্ছে শ্রেণী সংগ্রামের মত। মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধানের প্রয়োজন। সব মানুষ যাতে ভালো করে থাকতে পারে তার ব্যবস্থা করা দরকার। কিন্তু মানবজাতিকে ধনী গরিব দুই শ্রেণীতে ভাগ করা এবং এ দু’টি শ্রেণির মধ্যে চিরন্তর শ্রেণী সংগ্রাম আছে বলা বাড়াবাড়ি। কমিউনিজম তাই করেছিল। কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর তাদের হাতে কোটি কোটি লোক নিহত হয় রাশিয়া ও অন্যান্য স্থানে। মধ্য এশিয়ায় কমিউনিস্ট মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর ওপর রাশিয়া আরো বেশি নির্যাতন করে। তাদের ধর্ম পালনের অধিকার ছিনিয়ে নেয়া হয়। তাদের মসজিদ ধ্বংস করা হয়।

মসজিদের স্থানে পানশালা করা হয়। কমিউনিস্টরা ধর্মকে আফিম বলে। তারা এক পার্টির সরকার চায়। সবকিছু জাতীয়করণ করে। ফলে তাদের উৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস হয়। শেষ পর্যন্ত এ কারণেই কমিউনিজমের পতন হয়। প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের কোথাও এখন কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় নেই। চীনে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় আছে কিন্তু সে রাষ্ট্র আসলে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র, কমিউনিস্ট রাষ্ট্র নয়। শ্রেণীর ভিত্তিতে মানুষকে গণ্য করে এরকম মতবাদ দিয়ে আদর্শ কোনো সভ্যতা গড়ে উঠতে পারে না। তাদের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তৃতীয় যে মতবাদ মানবজাতিকে বিভক্ত করেছে তা হচ্ছে জাতপাত ব্যবস্থা (কাস্ট সিস্টেম)। মানুষকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রীয়, শূদ্রে ভাগ করা হয়। যে ব্যবস্থা ভারতে আছে। এ ব্যবস্থা মানব ঐক্যের সহায়ক নয়। এর ভিত্তিতে কোনো উন্নত সভ্যতা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ভারতে এর বিরুদ্ধে বিশাল জনমত রয়েছে, যদিও এ ব্যবস্থা সমাজের গভীরে শিকড় গেড়ে আছে।

উপরে উল্লেখিত তিনটি মতবাদের ভিত্তিতে উন্নত মানবিক সভ্যতা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এর জন্য আমাদের অন্য ব্যবস্থা অনুসন্ধান করতে হবে।
পাশ্চাত্য সভ্যতা কি আদর্শ সভ্যতা হতে পারে? এটি এখন আলোচনা করব। প্রত্যেক সভ্যতার একটি শরীর আছে, আর আছে তার আত্মা। পাশ্চাত্য সভ্যতার শরীয় খুব ভালো মনে হয়। অনেক দালান, অনেক শিল্প, অনেক উন্নতমানের রাস্তা ইত্যাদি। পাশ্চাত্য সভ্যতার শরীরটি খুব ভালো। কিন্তু তার আত্মা পচে গেছে। আত্মা হচ্ছে তার সামাজিক ব্যবস্থা ও মূল্যবোধ। পাশ্চাত্য সমাজে যৌনক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা চলছে। পরিবার প্রথা ভেঙে গেছে। সমকামিতা বৈধ। শিশুরা অবহেলিত, বৃদ্ধরা অবহেলিত। তারপর রয়েছে মাদকতা। শতকরা ৯০ ভাগ লোক মাদকাসক্ত। চায়ের দোকানেও হেরোইন পাওয়া যায়। অনেক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গ পায় না। তারা কুফুর নিয়ে বাস করে। সেখানে হত্যা, আত্মহত্যা, অস্ত্রের সাহায্যে হামলা হয় অনেক বেশি।

সুতরাং পাশ্চাত্য সভ্যতা আদর্শ সভ্যতার ভিত্তি হতে পারে না। ড. ইউসুফ আল কারযাভী তার ‘ভবিষ্যতের সভ্যতা’ গ্রন্থে এ কথাই বলেছেন। তার মতে, ইসলাম সে ব্যবস্থা যা ভবিষ্যৎ মানব সভ্যতার ভিত্তি হতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে তাওহিদ, স্রষ্টা একক, তাঁর সব সৃষ্টি। এর মধ্যে রয়েছে সার্বিকভাবে সবার প্রতি সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। এর মধ্যে রয়েছে অসহায়দের জন্য জাকাতের ব্যবস্থা এবং যে ব্যবস্থায় সরকার সব অসহায়ের দায়িত্ব গ্রহণ করে। আমি মনে করি, ড. ইউসুফ আল কারযাভী সঠিক কথা বলেছেন। যদি মানবজাতি চিন্তা করে কাজ করে এবং মুসলিমরাও যদি দায়িত্ব পালন করে তা হলে ইসলামই হবে ভবিষ্যৎ মানব সভ্যতা।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার।


আরো সংবাদ



premium cement