২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গণহত্যার প্রধান শিকার

স্রেব্রেনিসায় এক গণজানাজা অনুষ্ঠান - ছবি : সংগৃহীত

ইসলামের অভ্যুদয়ের পর থেকে এর বিরুদ্ধে চলেছে নানা প্রতিরোধ, ষড়যন্ত্র এবং আক্রমণ। আর আক্রমণগুলো এসেছে নানা অবয়বে- কখনো প্রকাশ্য, আবার কখনো কৌশলে। প্রকাশ্যে বিরোধিতার কারণগুলো সহজেই বোঝা যায়; কিন্তু কৌশলেরগুলো নয়। এই কৌশলগত বিরোধিতা প্রযুক্তির যুগে ক্রমাগত জটিল হয়ে চলেছে।

কেন ইসলাম এই বিরোধিতা সম্মুখীন হয় এর বিশ্লেষণ অনেক হয়েছে। বিরোধিতার মুখেও ইসলামের প্রসার থমকে থাকছে না কেন? এর সবচেয়ে ছোট্ট জবাব, কারণ ইসলামে সাধারণ মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন পাওয়া যায়। একটি কথাই বলা যাক, ইসলাম ‘হক’ বা অধিকারের ওপর জোর দেয় সবচেয়ে বেশি। হক হলো সত্য। মানুষ জানতে চায় সত্যটা কী? ইতিহাস বারবার উল্লেখ করেছে, মুসলমানরা কেন আক্রমণের লক্ষ্য। এর একটি উদাহরণ ভারতের দিল্লিতে মুসলিম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাবলি। নিউ ইয়র্ক টাইমস তাদের ‘হাউ দ্য দিলহিজ পুলিশ টার্নড অ্যাগেইনস্ট মুসলিমস’ শিরোনামে গত ১২ মার্চ এক চমৎকার প্রতিবেদন ছাপে। এর চারজন প্রতিবেদকের একজন মাত্র মুসলমান। প্রতিবেদনে অনেক নিরপেক্ষ চিত্র উঠে এসেছে।

পশ্চিমা গণমাধ্যম এবং আলোচনায় একটি চিত্র বারবার উঠে আসে। তা হলো, মুসলমানরা হত্যাকারী এবং ইসলাম জঙ্গি ধর্ম। তবে এটা সত্য, এর জবাব মুসলমানদের তরফ থেকে এসেছে। কিন্তু তা প্রচার পেয়েছে কম। কারণ, বিশ্বগণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে মাত্র ছয়টি ইহুদি প্রতিষ্ঠান। যেমনÑ ওয়াল্ট ডিজনি, টাইম ওয়ার্নার, ভিয়াকম, নিউজ করপোরেশন, ওয়েস্টিং হাউজ ও র্যানডম হাউজ। এ ছ’টি সংস্থা এক দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ৯৬ শতাংশ গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এই গণমাধ্যমগুলো সারা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমগুলোকে ‘বিশ্বসংবাদ’ তাদের মনের মাধুরী মিশিয়ে সরবরাহ করে থাকে। তবে তারা সর্বাগ্রে ইহুদি স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে আসছে।

দ্য জার্নাল অব হিস্টরি এক নিবন্ধে (২০১০ সাল) উল্লেখ করেছে, ‘এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠী তালমুদের (ইহুদি আইনগ্রন্থ) স্বার্থরক্ষার জন্য তাদের ইচ্ছা-নিয়মকানুন বিশ্বের ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। অথচ এগুলো বিশ্বের মানুষের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার বিপরীতে। এদের নিন্দা ও আক্রমণের প্রধান লক্ষ্যের মধ্যে আছে মুসলমানরা।’ 

এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে যে সত্যটি এখানে তুলে ধরা যায়, তা হলো- বিশ্ব হত্যাকাণ্ডগুলো সংঘটিত হয়েছে নানা সঙ্ঘাত-যুদ্ধ-সংগ্রামের মাঝ দিয়ে এবং তার প্রধান শিকার হয়েছে মুসলমানরা। সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে যে ক্ষুদ্র ইহুদি গোষ্ঠী, তারা তা প্রচার করে এমনভাবে যেন এর জন্য মুসলমানরাই দায়ী। এর মধ্যে তিনটি সবচেয়ে প্রভাবশালী। যেমন- নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও ওয়াশিংটন পোস্ট। এরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা বিশ্বে সংবাদ কেমন হবে, কোনটা সংবাদ তা নির্ধারণ করে। প্রায়ই এরা সংবাদ তৈরিও করে। অন্যান্য মাধ্যম এগুলোকে শুধু অনুকরণ করে। এগুলো ইহুদিদের মালিকানায়। নিউ ইয়র্ক টাইমসের আর্থার সুলবার্জারের নাম কে না জানে? তিনি আরো ৩৩টি সংবাদপত্র এবং কয়েক ডজন টিভি স্টেশনের মালিক। অর্থাৎ সংবাদমাধ্যমের প্রধান ধারার নিয়ন্ত্রণকারী। তারা কেউই মুসলমান বা ইসলামের সমর্থক বা সহানুভূতিশীল নন। এরা রক্ষণশীল ডানপন্থী।

অবশ্য প্রশ্ন আসতে পারে- ইহুদিরা সংবাদমাধ্যম কেমন করে এত ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে? এর সহজ উত্তর- অর্থনীতি। যেহেতু সংবাদমাধ্যম বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল, তাই বিজ্ঞাপনদাতারা প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে তা নিয়ন্ত্রণ করে। বিশ্বের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে ইহুদি আর্থিক ব্যবস্থা। বিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদি সম্প্রদায় অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণের সুযোগ পায় এবং এরপর থেকে তারা ক্রমান্বয়ে সংবাদমাধ্যমকেও আয়ত্তে আনতে থাকে। এক হিসাবে দেখা গেছে, সে দেশের এক হাজার ৫০০ সংবাদপত্রের মাত্র ২৫ শতাংশ নিরপেক্ষ হলেও ইহুদি আর্থিক ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। এ থেকে বোঝা যায়, কেন মুসলমানরা বিশ্বসংবাদমাধ্যমে ভালো চিত্রে অবস্থান করছে না। এ জন্য গণহত্যার প্রধান শিকার তারা হলেও উল্টো তাদেরই দায়ী করা হচ্ছে এই প্রচারমাধ্যমে।

এটা সবাই জানে, সংবাদমাধ্যম প্রচণ্ডভাবে নিয়ন্ত্রিত। কখনো মালিক প্রকাশ্যে করেন আবার কখনো অন্তরাল থেকে। আর সরকারও নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে সংবাদ তার প্রকৃত চিত্র নিয়ে কতটা আবির্ভূত হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা ও অনুসন্ধানের শেষ নেই।
যেহেতু মুসলমান এবং ইসলাম এই নিয়ন্ত্রক গোষ্ঠীর প্রায়ই প্রধান সমালোচনার লক্ষ্য হয়ে থাকে, তাই তাদের নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যমও তেমন আচারে অভ্যস্ত হবে, তা বলাই বাহুল্য। তবে কাজটি বেশির ভাগ সময়ে নির্যাতিতদের দ্বারাই ওরা করে থাকে। 

বলা হয়ে থাকে, সত্যকে সব সময় লুকিয়ে রাখা যায় না। তেমনি মুসলমানদের ওপর অত্যাচারের চিত্র অত্যাচারীরাই খানিকটা চিত্রায়িত করে থাকে, নিজেদের মতো করে হলেও। সে চিত্র থেকেই জানা যায় নাইন-ইলেভেনে নিউ ইয়র্কে টুইন টাওয়ারের ওপর আক্রমণের পরে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের’ (ওয়ার অন টেরর) নামে বিশ্বব্যাপী মার্কিন নেতৃত্বে নানা সংস্থা ও দেশ যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে, তাতে ৩২ মিলিয়ন (তিন কোটি ২০ লাখ) মুসলমানের মৃত্যু ঘটে। অবশ্য এই মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে পশ্চিমা শক্তি এবং তাদের নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম (যা বিশ্বসংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে) অত্যন্ত স্পর্শকাতর। দেখা যায়, কোনো প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষ কোনো সমীক্ষা যদি তাদের সমীক্ষার সাথে না মেলে, তখন তারা অনেক অভাবনীয় ঘটনার জন্ম দেয়। তবে তাদের তিনটি বিখ্যাত চিকিৎসক সমিতির সমীক্ষাকে তারা হজম করতে বাধ্য হয়। তারা বলেছেন, মৃত্যুসংখ্যা ২৭ মিলিয়নের (দুই কোটি ৭০ লাখ) বেশি শুধু আফগানিস্তান ও তাদের পাশের দেশগুলোতেই। যেমন মার্কিন ‘জাস্ট ফরেন পলিসি’ বলেছে, আফগানিস্তানে মার্কিন ও তাদের সহযোগীদের আক্রমণের ফলে ২.৭ মিলিয়ন (২৭ লাখ) মানুষের মৃত্যু ঘটেছে।

এসব সমীক্ষা এবং আলোচনার সারাংশ করেছে চিকিৎসক সমিতি। তারা বলেছেন, যুদ্ধের কারণে খাদ্যের অভাব ও নানা রোগে ৫০ লাখ লোক মারা যায় এবং ১৫ বছরের যুদ্ধে এ দেশগুলোতে মারা গেছে অবশিষ্ট ২৭ মিলিয়ন (দুই কোটি ৭০ লাখ) মানুষ।

জাতিসঙ্ঘ ডেমোগ্রাফি সংস্থা এবং ইউকে ওআরবি এই হত্যাকাণ্ডগুলোকে ‘জেনোসাইড’ (গণহত্যা) বলে আখ্যায়িত করেছে। আন্তর্জাতিক আইনে জেনোসাইডের জন্য ক্ষমতাসীনদের দায়ী করা হয়। আলোচনাকারীরা আফগানিস্তানসহ মুসলিম দেশগুলোতে চলমান হত্যাকাণ্ডগুলোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কখনো চালিকাশক্তি, কখনো উৎসাহদানকারী হিসেবে বর্ণনা করে দাবি করেছে, তাদের ‘বিশ্বব্যাপী প্রভাব রক্ষার’ ইচ্ছা এটা থাকতে সাহায্য করছে।

যেহেতু হত্যাকাণ্ডগুলো পশ্চিমাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের ফলে ঘটেছে, তাই পশ্চিমা শক্তি এবং তাদের সংবাদমাধ্যম এর সঠিক ও সত্য চিত্র কখনোই প্রচার করে না। বিশ্বঘটনাবলির দিকে একটু দৃকপাত করলেই এটা প্রতিভাত হয়। ইংরেজিতে আলোচকেরা এগুলো দু’টি শব্দ দিয়ে প্রকাশ করেনÑ হলোকাস্ট ও জেনোসাইড, যা বিশ্বব্যাপী নিন্দিত।
ইংরেজিভাষী দেশগুলোর নেতা এবং সংবাদমাধ্যম তাদের এই হত্যাকাণ্ডগুলোকে নিয়ে মিথ্যাচার করে এসেছে। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় সাম্রাজ্য বিস্তারের প্রয়াসে যে অভিযানগুলো চালানো হয়, তাতে নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ দেশগুলোতে অভাবিত হত্যাকাণ্ড ঘটে এবং ধ্বংসযজ্ঞ চলে। এ সত্য বলতে বা প্রকাশ করতে চায় না বিশেষ গোষ্ঠী। যেমন ব্রিটিশেরা আফগানিস্তান সাতবার আক্রমণ করেছে। ভারত দখল করে প্রতিবাদী বা প্রতিপক্ষকে নানা চাপে রাখার কৌশল অবলম্বন করে। ফলে ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার যৌথ অভিযানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বাংলায় মন্বন্তর ঘটে এবং ৭০ লাখ লোক খাদ্যের অভাবে মৃত্যুবরণ করে। 

সাম্রাজ্যবাদী কর্মকাণ্ডের ওপর চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন তাদের এক সাংবাদিক কিট ও কনেল, টেক্সাসের মিন্ট প্রেস এবং শ্যাডো গ্রুপের সম্পাদক। তিনি লিখেছেন, “মধ্যপ্রাচ্যে চলমান পশ্চিমা আক্রমণের কারণে মৃতের সংখ্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের প্রকৃত চিত্র কখনোই পাওয়া যাবে না। মৃতের সংখ্যা ৪০ লাখও হতে পারে অথবা তারো বেশি। যেহেতু মৃত ব্যক্তিরা সবাই মুসলমান এবং আরব, তারা হত্যার শিকার হয়েছেন। এমন হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা (জেনোসাইড) বলা হয়। অর্থাৎ এসব মুসলিম হত্যার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করা যৌক্তিক, সে জন্য মুসলিম গণহত্যার জন্য সে দায়ী। ও কনেল লিখেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চাইবে না, এই মুসলিম গণহত্যার জন্য সে দায়ী, তা প্রচার হোক।

তিনটি চিকিৎসক সংস্থা- (১) ইন্টারন্যাশনাল ফিজিসিয়ানস ফর প্রিভেনশন অব নিউক্লিয়ার ওয়ার (আইপিপিএনডব্লিউ), (২) ফিজিসিয়ানস ফর সোসিয়াল রেসপনসিবিলিটি (পিএসআর), (৩) ফিজিসিয়ানস ফর গ্লোবাল সারভাইভাল ২০১৫ সালে ‘পশ্চিমা যুদ্ধে মুসলিমদের মৃত্যু’ বলে এক সমীক্ষা প্রকাশ করেছে। লক্ষণীয় ব্যাপার- পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম এ সমীক্ষাটি চেপে যায়। এই সমীক্ষায় বলা হয়, ‘মৃত্যের সংখ্যা রক্ষণশীল দৃষ্টি থেকে দেখা হয়েছে।’ এই দৃষ্টিতেও বলা হয় মৃতের সংখ্যা ২০ লাখ। বিখ্যাত ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল ল্যান্সেট তার সমীক্ষায় সত্য তুলে ধরলে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।

এখানে ২০টি মুসলিম দেশের (পশ্চিমা শক্তিগুলোর ধ্বংসযজ্ঞের শিকার) নাম উল্লেখ করা যায়। এটা এই তিন চিকিৎসক সমিতির সমীক্ষায় এসেছে। নামগুলোর সাথে সমিতির দেয়া পরিহারযোগ্য মুসলিম মৃতের (পমৃ) সংখ্যাও দেয়া হয়েছে। তারা হলো (১) আফগানিস্তান (পরিহারযোগ্য ২০০১-২০১৫, মৃত ১৬.৬ মিলিয়ন), (২) বুরকিনা ফাসো (৬.৮ মিলিয়ন), (৩) সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক (২.৩ মিলিয়ন), (৪) শাদ (৫.১ মি), (৫) আইভরি কোস্ট (৭ মিলিয়ন), (৬) জিবুতি (১৪১০০০), (৭) ইরাক (৫.৩ মিলিয়ন), (৮) ইরান (১৪.৩ মিলিয়ন), (৯) লেবানন (.৫ মিলিয়ন), (১০) লিবিয়া (.৮ মিলিয়ন), (১১) মালি (৭ মিলিয়ন), (১২) মৌরিতানিয়া (১.৩ মিলিয়ন), (১৩) নাইজার (৬.৬ মিলিয়ন), (১৪) পাকিস্তান (৪৯.৭ মিলিয়ন), (১৫) ফিলিস্তিন (.৭ মিলিয়ন), (১৬) ফিলিপাইন (৯.১ মিলিয়ন), (১৭) সোমালিয়া (৫.৬ মিলিয়ন), (১৮) সুদান (৩.৫ মিলিয়ন), (১৯) সিরিয়া (২.২ মিলিয়ন), (২০) ইয়েমেন ( ৬.৬ মিলিয়ন)। 

এ হিসাব দিয়ে লেখক লিখেছেন নাইন-ইলেভেনের পরের ২০ দেশে অভিযানগুলোতে ৩০ মিলিয়ন মৃত্যু ঘটে, এর বেশির ভাগই মুসলমান। অর্থাৎ ২৬.৮ মিলিয়ন মুসলমান এই পশ্চিমা অভিযানে মৃত্যুবরণ করে। এমন ভয়াবহ মৃত্যুর চিত্র পশ্চিমা মিডিয়া বা নেতাদের বক্তব্যে আসে না। প্যারিসের ঘৃণ্য ঘটনাটি (যেখানে মাত্র ১৩০ জনের মৃত্যু ঘটেছে) বারবার বিশ্বমিডিয়ায় আসছে, অথচ মুসলিম জনপদ ধ্বংস ও হত্যার কথা আসে দায়সারাভাবে এবং শিগগিরই তা হারিয়ে যায়। ইরাকের হত্যাযজ্ঞের কথাই ধরা যাক। সেখানে সরকারগুলোও পশ্চিমা তথ্যই প্রচার করে থাকে। কারণ, তারা নির্ভরশীল পশ্চিমা শক্তির ইচ্ছার ওপর। প্যারিসের ১৩০ জনের দুঃখজনক ঘটনা স্মরণ করতে কেউ আপত্তি করবে না। তবে এর সাথে অবশ্যই স্মরণ করতে হবে ২৭ মিলিয়ন (দুই কোটি ৭০ লাখ) মুসলিম হত্যার কথা, যারা নাইন-ইলেভেনের পর গত ১৫ বছরে কথিত সন্ত্রাস দমনের অভিযানে ২০টি দেশে মৃত্যুবরণ করেছে।
কেউই প্রশ্ন করতে পারে না যে, ফরাসি সাম্রাজ্য নির্মাণে ১৪২ মিলিয়ন মানুষ (বেশির ভাগই মুসলিম) মৃত্যুবরণ করেছিল। একই উপায়ে ইউরোপীয় সাম্রাজ্য বিস্তারে প্রাণহানি হয়েছিল, তাদের বেশির ভাগই মুসলিম। এখন ইসরাইল একই রকম হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে ফিলিস্তিনে।

চেঞ্জমেকার মিডিয়ার ডেভিড ডিগ্র যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চলমান যুদ্ধের ওপর এক অনুসন্ধান চালিয়েছেন। জর্জ বুশকে ‘ওয়ার প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি লিখেন, বুশ এক ইরাকেই ৭০ হাজার বোমা নিক্ষেপ করেছেন। তবে তিনি শান্তির জন্য নোবেল প্রাইজধারী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার চেয়ে বোমা কম বর্ষণ করেছেন। ওবামা এক কোটি বোমা সাতটি দেশে বর্ষণ করেন। ডিগ্র লিখেছেন নানা উৎস উল্লেখ করে। অবশ্য আরেকজন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী বিশ্বে নানা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। তিনি হলেন হেনরি কিসিঞ্জার। তার ভিয়েতনাম যুদ্ধ শুরু করার ঘটনা সবাই জানে। তিনি ওবামার সমালোচনা করেন যুদ্ধ বিস্তৃত করার জন্য। খানিকটা ‘ঝাঁজরের চালার’ নিন্দা। দুটোরই ফুটো আছে- অথচ একে অন্যের ফুটোর নিন্দা করছে। উদ্দেশ্য, বিশ্বকে বিভ্রান্ত করা। মার্কিন এয়ারফোর্সের এক গোপন নথি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে- বর্তমান ট্রাম্প সরকার বোমা বর্ষণে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে।

এখানে দেখা যায়, বুশ সরকার প্রতিদিন ২৪টি বোমা বর্ষণ করত (বছরে আট হাজার ৭৫০টি)। আর ওবামা সরকার বর্ষণ করত প্রতিদিন ৩৪টি এবং বছরে ১২ হাজার ৫০০টি। অথচ ট্রাম্পের প্রথম বছরেই বর্ষণ করেছেন ৪৪ হাজার ৯৬টি বোমা। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ১২১টি বোমা। অন্য কথায়, ট্রাম্প যুদ্ধক্ষেত্রে প্রতি ঘণ্টায় পাঁচটি করে বোমাবর্ষণ করছেন অথবা প্রতি ১২ মিনিটে একটি বোমা। তবে এই বোমা বর্ষণের গতি আরো বেড়েছে বলে সরকারি সূত্রে উল্লেখ করেছেন ডিগ্র। সর্বশেষ সরকারি হিসাবে এখন প্রতিদিন গড়ে ১৪৪টি করে বোমা বর্ষণ করা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রথম ৯ মাসে প্রতিদিন গড়ে ১৪৪টি বোমা বর্ষণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সাংবাদিক হুইটনি ওয়েব সিআইএ’র প্রতিবেদন উল্লেখ করে লিখেছেন, এখন বোমা বর্ষণের মাত্রা বুশের সময়ের চেয়ে ৮০ গুণ বেড়েছে এবং তারা জানে না কাদের তারা হত্যা করছে। শুধু তারা তাদের বোমা বর্ষণের জন্য এলাকা নির্দিষ্ট করে ঘোষণা দেয়Ñ এটি ‘শত্রু এলাকা’। তারা কাদের শত্রু বলছে তাও জানে না বলে ডেভিড ডিগ্র উল্লেখ করেছেন। 

প্রতি বোমা বর্ষণে খরচ হচ্ছে ২.৫ মিলিয়ন ডলার। ‘ওয়ার অন টেরর’ শুরু হওয়ার পর দুই লাখ বোমা বর্ষণ করা হয়েছে। এতে লাভবান হচ্ছে রেথিওন, লকহিড মার্টিন প্রভৃতি অস্ত্র প্রস্তুতকারী। যুদ্ধ বন্ধ করা হোক, তারা চায় না। একমাত্র লকহিড তাদের এফ-৩৫ বিক্রি করে লাভ করেছে ১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার (এক ট্রিলিয়ন সমান এক লাখ কোটি)।

তবে এ অভিযানগুলোকে ‘যুদ্ধ’ বলা ঠিক নয়। কারণ, অভিযানগুলোর প্রতিপক্ষ বা বিরোধীরা বেশির ভাগ সময় নিরস্ত্র ও গরিব। তাই তারা প্রতিবাদ করতে কেমন করে যুদ্ধ করবে? তবে তাদের আছে তেল। তাই বলা হয়, যত দিন যে এলাকায় তেল থাকবে, তত দিন সে এলাকার প্রতি অস্ত্রে বলীয়ানরা দৃষ্টি রাখবে এবং এসব ‘যুদ্ধ’ (যা আসলে দখলের অভিযান) চালিয়ে যাবে। যদি এ এলাকার মানুষ স্বাধীনভাবে বাঁচতে চায় বা সরকার গঠন করে, তখন বিশ্ব মিডিয়া এবং তাদের প্রভুরা বিশ্বশান্তি রক্ষার নামে সেখানে অভিযান চালিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে আনবে। নানা গোষ্ঠী নির্মাণ করে সেসব জায়গায় অশান্তি সৃষ্টি এবং বিশাল প্রচারণা শুরু করবে। যেমন আইএসআই, আল-নুসরা ইত্যাদি দলের কর্মকাণ্ড-হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে বিশাল প্রচারের মধ্য দিয়ে জনমত সৃষ্টি করে তাদের ফায়দা লুট করা হয়।

মার্কিন জেনারেল স্মেডলে বাটলার এক উল্লেখযোগ্য মন্তব্য করেছেন। ‘আমি ৩৩ বছর চার মাস মিলিটারিতে চাকরি করেছি। আমার বেশির ভাগ সময় যে কর্মকাণ্ড (যুদ্ধ) করেছি তা বড় ব্যবসায়ী, ওয়াল স্ট্রিট এবং ব্যাংকারদের জন্য।’ অর্থাৎ যুদ্ধ চলবেই, সঙ্ঘাত-সংঘর্র্ষ তৈরি হবে। আর সাথে থাকবে দুর্নীতি। কারণ, যুদ্ধের খরচের কোনো হিসাব কেউ দেয় না। মার্কিন স্পেশাল ইন্সপেক্টর জেনারেল জন এফ সোপকো বলেছেন, ‘মার্কিনিরা জানে না তাদের টাকা কেমনভাবে খরচ হচ্ছে এবং কারা ব্যবহার করছে।’ যেমন এ বছরের জন্য আফগানিস্তানে তাদের বাজেট ১০৪ বিলিয়ন ডলার। এর আগের বছরের খরচের হিসাব নেই। সম্প্রতি এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, পেন্টাগন ৪৮ বিলিয়ন ডলারের হিসাব পাচ্ছে না।

 পর্যন্ত পেন্টাগন খরচ করেছে ২১ ট্রিলিয়ন ডলার এবং তার হিসাব সরকারের কাছে নেই। সম্প্রতি মিলিটারি টাইমসের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৫০ মিলিয়ন ডলারের হিসাব নেই। এর সাথে আছে সাতটি দামি গাড়ি এবং প্রতি সামরিক অফিসারের বেতন। তাদের কারো বেতন চার লাখ ডলার। এর ফলে মার্কিন সরকার ২১ ট্রিলিয়ন ঋণে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তাই বিখ্যাত মার্কিন লেখক ডেভিড সোয়ানসন আকুল প্রার্থনা করেছেন? ‘অন্তত দু’টি দিনের জন্য তোমরা হত্যাকাণ্ড বন্ধ রাখতে পারো না?’ দার্শনিক নিৎশের বক্তব্য দিয়ে শেষ করা যায়Ñ “ব্যক্তিগত পাগলামি খুবই কম। কিন্তু দল, জাতীয় এবং সময়ের পাগলামিই যেন আইন। এ থেকে বাঁচলেই তবে হবে শান্তি, সুন্দর জীবন।”


আরো সংবাদ



premium cement