২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কোরবানির হাট বনাম রাজনীতির মাঠ

কোরবানির হাট বনাম রাজনীতির মাঠ - ছবি : নয়া দিগন্ত

ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদের আনন্দ এবার মাটি হয়ে গেছে করোনা আতঙ্কে। একই সাথে বাঙালির বৈশাখী উৎসব এবং রোজার ঈদের মন্দাভাবে ক্রয়-বিক্রয়ের অভাবে উদ্যোক্তা, বিক্রেতা, দোকানিসহ ব্যবসার সাথে জড়িত সবারই কপালে হাত পড়েছে, যা আমাদের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি দুঃসংবাদ। করোনা শুধু উল্লিখিত উৎসব আনন্দের দিনগুলো মাটি করে দেয়নি, কাঙ্ক্ষিত উৎসবও বেদনায় পরিণত হয়েছে। এ জন্যই ইংরেজিতে একটি প্রবাদ রয়েছেÑ গধহ চৎড়ঢ়ড়ংবং, নঁঃ মড়ফ ড়ঢ়ঢ়ড়ংবং। বাংলায় প্রবাদটি আরো হতাশাজনক, তা হলো- ‘অতি আশা নিষ্ফল’। সময়ে সময়ে এ ধরনের পরিস্থিতি ব্যক্তি, পরিবার, জাতীয় এবং সামাজিক অবস্থানকে বিপর্যস্ত করে দিলেও ‘আশা’ নিয়েই মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়। এ কথাও ধ্রুব সত্য- বিপদ, মহামারী কোনো কালেই চিরস্থায়ী হয়নি। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সূরা এনশেরা ৫ ও ৬ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে রয়েছে স্বস্তি’।

আল্লাহর কাছ থেকে নিরাশ বা হতাশা হওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি উত্তম কাজের জন্য উৎসাহিত করে বলেছেন, ‘উত্তম কাজের জন্য উত্তম পুরস্কার ব্যতীত আর কী হতে পারে?’ (সূরা আর-রহমান, আয়াত-৬০) সৃষ্টিকর্তা মানবজাতির কাছ থেকে উত্তম কর্মই প্রত্যাশা করেন। কিন্তু যখনই এর ব্যত্যয় ঘটে, তখনই নেমে আসে করোনার মতো কঠিন বিপর্যয়। তিনি (সৃষ্টিকর্তা) আল কুরআনে বারবার বলেছেন, ‘আমি মানবজাতি ও জিনের হিসাব গ্রহণে অত্যন্ত তৎপর’।

রোজার ঈদ ও কোরবানির ঈদ (ঈদুল আজহা) মুসলমানদের বড় উৎসব হলেও দুটি ঈদের বাণিজ্যিক বিনিয়োগ ভিন্নতর। রোজার ঈদে একটি পরিবারের মূল বাজেট খরচ হয় পোশাক পরিচ্ছদ, প্রসাধনী ও উপভোগ্য বস্তুভিত্তিক। কিন্তু কোরবানির ঈদ যদি করোনার কারণে বাধাগ্রস্ত হয় তবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে একটি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী; যারা শুধু কোরবানির ঈদ টার্গেট করে গরু, ছাগল, মহিষ প্রভৃতি পশু বাণিজ্যিক ভিত্তিতে লালন পালন করে, এতে ব্যাংক ঋণসহ বিভিন্ন প্রকার বিনিয়োগ জড়িত রয়েছে। চলতি বাজেটে বিদেশ থেকে আমদানি করা পেঁয়াজের ওপর শুল্ক ধার্য করা হয়েছে। এতে যদি বিদেশী পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি পায়, বাংলাদেশের কৃষকরা দেশী পেঁয়াজ চাষে উৎসাহীত হবেন। তবে এ জন্য সংশ্লিষ্ট চাষিদের পর্যাপ্ত চাষাবাদের জন্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। নতুবা সিন্ডিকেটের তৎপরতায় ফের পেঁয়াজের মূল্য নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে। ফলে জনদুর্ভোগ আরো বৃদ্ধি পাবে।

সরকার ভারত থেকে গরু আমদানি বা চোরাই পথে গরু বাংলাদেশে প্রবেশ বন্ধ রাখতে পারলে দেশীয় গরু খামারিরা ব্যবসায়ীকভাবে লাভবান হবেন। তবে এতে গরুর গোশতের মূল্য বৃদ্ধি পাবে বটে। তারপরও আমরা মনে করি, যদি ভারতীয় গরু দেশে প্রবেশ বন্ধ রাখা যায় তবে দেশীয় গবাদিপশু উৎপাদনে দেশীয় গবাদি খামারিরা ব্যাপকভাবে উৎসাহিত হবে, এ মর্মে প্রান্তিক খামারিরা যাতে সহজভাবে সরাসরি সরকারি সহযোগিতা পায় এ জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। এ তো গেল কোরবানির হাটের দুরবস্থা। কিন্তু রাজনীতির মাঠ যে করোনাভাইরাসের বহু আগেই দিনে দিনে মানব পাচারকারী, অর্থ পাচারকারী, দুর্নীতিপরায়ণ উচ্চাবিলাসী আমলা, ভূমিদস্যু, ব্যাংক লুটেরাদের হাতে পণবন্দী হয়ে গেল, আগাগোড়া তারা পুরোটাই গিলে খাচ্ছে, এ থেকে দেশবাসীর পরিত্রাণের উপায় কী?

দেশের ৯০ শতাংশ সম্পদ একটি শ্রেণীর হাতে কুক্ষিগত। তারা গাছের উপরেরটা তো খায়ই, তলেরটাও কুড়িয়ে নেয়। রাজনৈতিক মাঠটি বিত্তশালীদের বদৌলতে কলুষিত এবং একচ্ছত্র আধিপত্যের কারণে সাধারণ নাগরিকদের বিনা চিকিৎসায় মরতে হচ্ছে, হাসপাতালে ভর্তি তাদের জন্য যেন ‘অরণ্যে রোদন’। জেলা সদরে তো দূরের কথা, ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে আইসিইউ নেই, যে কয়টা আছে তা ভিভিআইপিদের জন্য সংরক্ষিত। মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক, ভাষাসৈনিক কামাল লোহানী ৮৬ বছর বয়সে (পরিবারের পক্ষ থেকে) বহুবার আবেদন করেও সিএমএইচে একটি আইসিইউতে চিকিৎসা নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। ২০ জুন না ফেরার দেশে চলে গেছেন। এতে সরকার লজ্জিত না হলেও দেশের বিবেকবান মানুষ নিশ্চয়ই লজ্জিত হওয়ার কথা। হাইকোর্ট সাধারণ নাগরিকদের হাসপাতালে ভর্তির বিষয়ে নির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, হাসপাতালে ভর্তি না করাটা একটি ফৌজদারি অপরাধ। হাসপাতালগুলো অক্সিজেন নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত ব্যবসা করে বিধায় হাইকোর্ট এ মর্মেও নির্দেশনা দিয়েছেন যাতে অতিরিক্ত মূল্য না নেয়া হয়। যে কাজগুলো করার কথা ছিল জনপ্রতিনিধিদের, সে কাজগুলো করতে হচ্ছে হাইকোর্টকে।

জনপ্রতিনিধিদের জবাবহিহি না থাকায় দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা এখন অত্যন্ত দুর্বল। কারণ, আমাদের ভাগ্যবিধাতা যারা সংসদে বসে আছেন, তারা কাশি, শর্দি, জ্বর হলেও বিদেশে চিকিৎসা নেয়ার জন্য চলে যেতেন। ফলে হাসপাতালগুলোর অবস্থা কী তা তাদের দেখতে হয়নি। বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ চার মাস অতিক্রম হতে চলল। ৮ মার্চ করোনায় প্রথম মৃত্যু শনাক্ত হয়। আর ১৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়। প্রতিদিনই করোনায় আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হচ্ছে যা এক দিনে গড়ে ৪৫-৫০-৫৩ সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু সরকার এখনো চিকিৎসাব্যবস্থায় গতি ফিরিয়ে আনতে পারেনি, তা সত্ত্বে¡ও কিছু মন্ত্রীর মুখরোচক কথায় সাধারণ নাগরিকদের আর পেট ভরছে না। রাজনৈতিক মাঠ যদি জনগণের নিয়ন্ত্রণে থাকত, অর্থাৎ জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হতো তবে এ পরিস্থিতির উদ্ভব হতো না। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয়, অতিকথনে যারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তারা এ স্বভাবকে তাদের একটি কোয়ালিফিকেশন মনে করলেও জনগণ তা কতটুকু মূল্যায়ন করে; সে বোধোদয় সরকারের অনেক মন্ত্রীর হয়নি এবং ‘বর্তমান’ তো আরো কয়েক ডিগ্রি এগিয়ে।

‘জবাবদিহির’ বিষয়ে প্রশ্ন করাটাই যেন একটা বোকামি। এখন নীতি-আদর্শ লাগে না, উপর তলার একটি ‘ছায়া’ হলেই অনায়াসে, জনপ্রতিনিধিমূলক পদ-পদবি পাওয়া যায়। সরকারের মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অর্থসহায়তা, হতদরিদ্র জনসাধারণের জন্য বরাদ্দকৃত চাল আত্মসাৎ এবং স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে উপকারভোগীদের তালিকা প্রণয়নের অনিয়মসহ বিভিন্ন অভিযোগে করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাব শুরু হওয়ার পর থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত ১০০ জনপ্রতিনিধিকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৩০ জন ইউপি চেয়ারম্যান, ৬৪ জন ইউপি সদস্য, একজন জেলা পরিষদ সদস্য, চারজন পৌর কাউন্সিলর ও একজন উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান (সূত্র : জাতীয় দৈনিক, ১৮ জুন ২০২০)। লেখাটি প্রকাশ হওয়ার দিন এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে, মানুষ যখন প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু আতঙ্কে ভুগছে তখন জনপ্রতিনিধিরা ত্রাণের টাকা আত্মসাৎ করেন, তা কি একজন সুস্থ বিবেকসম্পন্ন মানুষের পক্ষে সম্ভব? নিজের বিবেকের কাছে যদি নিজের জবাবদিহি থাকত; তাহলে এ ধরনের পৈশাচিকতা কোনো জনপ্রতিনিধির পক্ষে সম্ভব হতো কি?

বাঙালি জাতির আন্দোলন সংগ্রামের একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এ জাতি প্রতিবাদমুখী, কিন্তু জাতি এখন আদর্শভিত্তিক রাজনীতি অনুকরণ ও অনুশীলনবিমুখ হয়ে পড়েছে। রাজনীতির মাঠ এখন কোরবানির হাটে রূপান্তরিত হয়েছে। এক হাটে বিক্রি না হলে অন্য হাটে তো বিক্রি হবেই। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এখন আর আদর্শের ধার ধারে না। এক দল বাদ দিলে টাকা থাকলে অন্য দল সাদরে আমন্ত্রণ জানায়। ফলে জীবনার্দশের সাথে রাজনৈতিক আদর্শের সামঞ্জস্য থাকা বর্তমানে রাজনৈতিক মাঠে অত্যাবশ্যক নয়। শুধু নির্বাচনে জয়লাভ করার মতো বিত্তশালী প্রার্থীই এখন দলগুলোর বেশি পছন্দ। ফলে বিত্তশালীরা নমিনেশন বাণিজ্যে এগিয়ে থাকে এবং ক্ষমতা পেয়েই শুরু করে ক্ষমতার অপব্যবহার, বাণিজ্য। তাদের বাণিজ্যিক অধিক্ষেত্রে রয়েছে ত্রাণ, উন্নয়ন, হাট-বাজারের মাসোয়ারা, নিয়োগ, বদলি, সরকারি ক্রয়-বিক্রয়, টেন্ডার প্রভৃতি। অধিকন্তু তদবির বাণিজ্য তো রয়েছেই। এ জন্য রাজনীতিতে দলীয় প্রধানের নেতৃত্বের ব্যর্থতার পাশাপাশি জনগণের চোখ বন্ধ রাখার মনমানসিকতা অনেকাংশে দায়ী। কারণ দেশের জনগণ এখন প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ গড়ে তোলা ভুলে গেছেন। এখন দেশ, জাতি ও রাজনীতি চলছে ভিন্ন স্বাদ ও সংস্কৃতিতে, তবে জাতীয় স্বার্থে এর অবসান হতেই হবে। জনতার বিবেক অবশ্যই একদিন জেগে উঠবে, ইনশা আল্লাহ। নতুবা স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ দেশের আপামর জনগণ কোনোদিনই ভোগ করতে পারবে না।

রাজনীতিতে এখন চলছে ভানুমতির খেল। পকেট ভারী তো খেলা আছে, পকেট খালি তো খেল খতম। অর্থাৎ যে রাজনীতিকের হাতে অঢেল টাকা নেই তার জন্য রাজনৈতিক অধিক্ষেত্র একটি মরুভূমির মরচিকা মাত্র। জনগণও প্রতারিত হতে হতে তাদের একটি অংশ এখন টাকাওয়ালাদেরই ক্ষণিকের ‘দাতা হাতেম তাই’ মনে করে ‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও’ নীতিকেই প্রাধান্য দেয়ায় এখন মুখ বুঝে সব অনাচার সহ্য করে নিচ্ছে। জনগণই বা যাবে কোথায়? জনগণ আস্থায় আনতে পারে সেই আস্থাশীল পরিবেশ এখন কোথায়? ‘বিনা ভোটের’ সংস্কৃতিতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে নিজেদের কতটুকু দায়বদ্ধ করতে পেরেছেন? স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এখন কি শুধু ভিভিআইপিদের জন্য? বাংলাদেশে মেঘা প্রকল্পের কথা সরকারের মুখে মুখে, অথচ মেঘা দুর্নীতির সংবাদও সুনির্দিষ্ট আকারে খাতওয়ারি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ পাচ্ছে। এক শ্রেণীর মানুষের কাছে দেশবাসী অসহায় হয়ে পড়েছে, রাষ্ট্রটি যেন কারো কারো পকেটে চলে গেছে, ভবিষ্যৎপ্রজন্মের স্বার্থে যা চলতে দেয়া যায় না। হাসপাতালে রোগী ভর্তি নেয় না, অন্য দিকে আইসিইউয়ের অভাবে দিনে দিনে মৃত্যুর মিছিল ভারী হওয়ার কাহিনী, পাশাপাশি রয়েছে রোগীদের নি¤œমানের ও বাসিপচা খাবার পরিবেশনের মর্মান্তিক কাহিনীর সংবাদ পত্রিকার পাতায়। নাগরিকদের স্বচ্ছ ভোটে দেশে যদি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকত, তবে এ ধরনের পরিস্থিতিতে নিশ্চয়ই জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্বহীনতার পরিচয় ভোটাররা দেখতে পেত না।

সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় মনে হচ্ছে, চিকিৎসার আশায় হাসপাতালে ভর্তির উদ্দেশে গাড়িতে মৃত্যুবরণ না করে বিনা চিকিৎসায় বাড়িতেই মৃত্যুবরণ কম কষ্টদায়ক বলে ভুক্তভোগীরা মনে করছে। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কতটুকু ভঙ্গুর করোনার আবির্ভাব না হলে অতিকথনের চোটে তা আঁচ করা যেত না। হাসপাতালগুলো এখন সেবার কেন্দ্রস্থল নয়, বরং অত্যধিক একটি লোভনীয় ও লাভজনক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। চিকিৎসাক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসকদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই ৪০-৪৫ চিকিৎসক মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের প্রতি রইল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা। একজন রোগীর মৃত্যুতে খুলনার ডা: রাকিবের ওপর হামলার কারণে মৃত্যু নিশ্চয়ই দেশ ও জাতির জন্য দুঃসংবাদ। স্বজনহারাদের ধৈর্যহীনতা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর অনাস্থার কারণেই এ ধরনের ঘটনার সূত্রপাত। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি কোনো কারণেই কাম্য নয়। এ জন্য সব পক্ষেরই সচেতন হওয়া আবশ্যক।

দেশে প্রতিহিংসার রাজনীতি কেমন তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ উপলব্ধি করতে পারে না। প্রতিহিংসাকে কার্যকর করতে পূর্ব জামানার বিভিন্ন কৌশলের সাথে স্মরণকালে সম্পৃক্ত হয়েছে আইন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কিছু সদস্য। কারণ আইনকে অপপ্রয়োগ করে বা ইচ্ছামতো আইন প্রণয়ন করে রাষ্ট্রীয় সার্ভেন্টদের মাধ্যমে রাষ্ট্রযন্ত্র নিজেই ভিন্নমতাবলম্বী নাগরিকদের নিপীড়ন করে, মনোবাসনা পূর্ণ করে তাদের যাদের হাতে থাকে রাষ্ট্রীয় কর্র্তৃত্ব। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বহু অপপ্রয়োগের কথাই পৃথিবীব্যাপী অনেক ঘটনা রয়েছে যার কিছু অংশ প্রকাশিত, বেশির ভাগই থেকে যায় অপ্রকাশিত। কোথাও প্রভাবশালীদের চাপে, কোথাও ভিন্ন কারণে, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিপীড়িতদের দুর্বলতা ও মিডিয়ার পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণে অনেক ঘটনার সংবাদ হয় চাপাপড়ে থাকে, নতুবা প্রচারিত হয় ভিন্নভাবে। ইতিহাসের পাতায় কোথাও ভিলেন হয়ে পরে নায়ক, নায়ক হয়ে পরে ভিলেন। অনেক ঘটনাই আছে যা নায়ক বা ভিলেন কেউ দায়ী নন, বরং সংগঠিত হয় তৃতীয়পক্ষ দ্বারা।

কথা প্রসঙ্গে নিজের কথাই বলতে চাই। ২০০১ সালে ১৬ জুন নারায়ণগঞ্জ শহরে চাষাঢ়ায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ অফিসে পৈশাচিক বোমা হামলায় ২২ নিরীহ সাক্ষাৎকারপ্রার্থী (পুরুষ-মহিলা) নিহত হন, যাদের মধ্যে জনপ্রিয় কাউন্সিলর বাপ্পি, ছাত্রলীগ নেতা আখতার, মশু নামে দুই ভাই, নজরুল ইসলাম বাচ্চু নামে সম্ভাবনাময় কণ্ঠশিল্পী নিহত হয়েছিলেন, শামীম ওসমানসহ (তৎকালীন ও বর্তমান এমপি) অনেকেই আহত হয়েছেন, চন্দনশীল নামে এক সম্ভাবনাময় উদীয়মান রাজনৈতিক যুব ব্যক্তিত্ব চিরতরে পা হারিয়েছেন, এমন পৈশাচিক ঘটনার নিন্দা জানানোর কোনো সুযোগই পাইনি, তখন কারো দুঃখের সাথে নিজের অশ্রু ঝরাতে পারিনি। কারণ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০৫ নম্বর কক্ষে আমার কিউবিক্যালে বসে যখন ঘটনা শুনে আহত-নিহতদের পাশে থাকার জন্য নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখনই জানতে পারি আমার নেতৃত্বে বোমা হামলার অভিযোগে আমার বাড়িতে হামলা হয়েছে। আমার বাড়ির টিনের বাংলো টাইপ ঘর ‘গুলি’ করে ঝাঁজরা করে দেয়া হয়েছে। বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নেয়ায় আমার বৃদ্ধ মা-বাবা এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে যান। পরে আরো জানতে পারি, মিডিয়াতে প্রকাশিত হচ্ছে ‘তৈমূর আলম খন্দকারের নেতৃত্বে এই পৈশাচিক বোমা হামলা।’

এ সংবাদ শুনে মুড়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (রূপগঞ্জ) সাবেক ইউপি সদস্য মফিজ মেম্বারের ছেলে ছাত্রদল নেতা শফিক সুপ্রিম কোর্ট থেকে মোটরসাইকেলে আমাকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি স্থানে রেখে আসেন। আরো জানতে পারি, আমাকে প্রধান আসামি করে বিএনপির আরো ২৬ জনের নাম উল্লেখ করে নারায়ণগঞ্জ থানায় ৯(৬)২০০১ ধারা ৩০২ দ.বি. এবং নারায়ণগঞ্জ থানায় ১০(৬)২০০১ ধারা ৩/৪ বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি পৃথক মামলা করা হয়। মামলা হওয়ার পর নিজের ওপর ধিক্কার জন্মে এ জন্য যে, ঘটনার সাথে যাদের সম্পৃক্ততা নেই তাদের ২২ জন লোক হত্যায় জড়িয়ে দেয়ার নামই কি রাজনীতি? মিডিয়ার সংবাদ শুনে আমার জ্যেষ্ঠ কন্যা ভিকারুননিসা নূন স্কুলের তৎকালীন ছাত্রী (ব্যারিস্টার মার-ই-য়াম তৈমূর) আত্মগোপন অবস্থায় মোবাইল টেলিফোনে আমাকে বলেছিল, ‘রাজনীতির কারণে কি তোমরা বোমা মেরে মানুষ খুন করতে পারো?’ এ ধরনের অপবাদের মানসিক যন্ত্রণা মাথায় নিয়ে আমাকে কাটাতে হয়েছে ১৩টি বছর। ঘটনার কিছুদিন পরই নিজের আত্মবিশ্বাস নিয়ে হাইকোর্টে এন্টিসিপেটরি জামিনের জন্য আমি একাই আত্মসমর্পণ করি। তৎকালীন অ্যাডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেল (বর্তমান অ্যাটর্নি জেনারেল) আমার জামিনের ঘোর বিরোধিতা করলে হাইকোর্ট জানতে চান, এজাহারের ভাষ্যমতে আমার বিরুদ্ধে কোনো তথ্য রাষ্ট্রপক্ষ উপস্থাপন করতে পারবে কি না? একই ব্যক্তি তৈমূর আলম খন্দকারের বিরুদ্ধে ইতঃপূর্বেও একাধিক মামলার বাদি হওয়ার কারণ কি?

রাষ্ট্রপক্ষ এ সব তথ্যপ্রমাণ দাখিল করার জন্য একদিনের সময় প্রার্থনা করলে আমাকে একদিনের অস্থায়ী জামিন দিয়ে এজাহারের সমর্থনে তথ্যাদি উপস্থাপনের জন্য তৎকালীন অ্যাডিশনাল অ্যাটর্নি জেনারেলকে নির্দেশ দেন। পরের দিন আমার জামিনের প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জে অর্ধদিবস হরতাল আহ্বান করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। চূড়ান্ত শুনানিতে আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ কোনো তথ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি বিধায় হাইকোর্ট আমাকে এন্টিসিপেটরি জামিন মঞ্জুর করেন। আমাদের বিরুদ্ধে ঘটনার সম্পৃক্ততা না পেয়ে ওই মামলাগুলোতে পুলিশ ফাইনাল রিপোর্ট দেয়, সুপ্রিম কোর্টের একজন বিচারপতি জুডিশিয়াল ইনকুয়ারি করে আমাদের নির্দোষ মন্তব্য করে ঘটনাটি তৃতীয় পক্ষ দ্বারা সংগঠিত হয়েছে বলে প্রতিবেদন দেন। ২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বাদিপক্ষের আবেদনে মামলাটি আবার পুনরায় চালু হয়। দীর্ঘ ১৩ বছর মামলাটি অমানসিক যন্ত্রণা মাথায় নিয়ে চলাবস্থায় ২ মে ২০১৩ জানতে পারি, ওই পৈশাচিক ঘটনার সাথে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা না থাকায় সিআইডি ঊর্র্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে মোকদ্দমা থেকে আমাদের অব্যাহতি দেয়ার আবেদন করেছে।

এ ঘটনায় যারা মৃত্যুবরণ বা আহত হয়েছেন তারা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন কি না জানি না, তবে এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার মতো নয়। কারণ যারা নিহত বা আহত হয়েছেন তারা ছিলেন সম্পূর্ণ নির্দোষ। এ মামলার অন্যতম আসামি জাহাঙ্গীর ও রফিক কমিশনার দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। পৃথিবী থেকে আমরা চলে যাবো, কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের রেখে যাচ্ছি, তাই এ ধরনের ঘটনায় কোনো চিরশত্রুর মৃত্যু চাই না এবং মিথ্যাভাবে কোনো চিরশত্রুকেও যেন আসামি না করা হয়। পৃথিবী হয়তো একদিন করোনামুক্ত হবে, কিন্তু রাজনীতি প্রতিহিংসা বা বর্ণ ও ধর্মীয় বৈষম্যের ভাইরাস থেকে মুক্ত হবে কিনা জানি না। তবে দৃশ্যপট বলে, বৈষম্য ও প্রতিহিংসার ভাইরাস করোনা থেকে আরো জঘন্য ও নির্মম। মানুষ হত্যা এবং হত্যা মামলায় জেনেশোনে শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য নির্দোষ ব্যক্তিকে জড়িয়ে আসামি করার পৈশাচিক সংস্কৃতি থেকে পৃথিবী মুক্তি পাক, এটা দৃঢ়ভাবে কামনা করি। দৃঢ়চিত্তে কামনা করি, করোনা যেন আমাদের কিছু নৈতিক শিক্ষা ও দীক্ষা দিয়ে যায়। 

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)

ঃধরসঁৎধষধসশযধহফধশবৎ@মসধরষ.পড়স

 


আরো সংবাদ



premium cement