১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রাজস্ব আয় দিয়ে রাজস্ব ব্যয় মেটানো কঠিন

-

ইংরেজিতে প্রবাদবাক্য আছে ঈঁঃ ুড়ঁৎ পড়ধঃ ধপপড়ৎফরহম ঃড় ুড়ঁৎ পষড়ঃয. বাংলায় এর ভাবার্থ ‘আয় বুঝে ব্যয় করো’। করোনার কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। সেহেতু রাজস্ব আয় দিয়ে রাজস্ব ব্যয় মেটানো কঠিন। বিশ্বব্যাংক বলেছে, এ বছর বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির হার ৩ শতাংশের বেশি হবে না। আইএমএফ বলেছে, ২ শতাংশ আর বিবিএস অর্থবছরের প্রথম ৮ মাসের পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে বলেছে, প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হবে। ৩০ মে একটি জাতীয় দৈনিক এ তথ্য তুলে ধরেছে। নোবেল বিজয়ী অভিজিতের ভাষায় অর্থনীতির ‘চালিকাশক্তি গরিব মানুষ- ধনী মানুষরা নয়। দেশে খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশ। এই ৮০ শতাংশ মানুষ যদি কর্মহীন হয়ে পড়ে তাহলে দেশে অর্থনৈতিক অবস্থা কোনোভাবেই সচল হবে না। শুধু বিদেশী ঋণ দিয়ে একটি দেশ পরিচালনা করা যায় না। বাংলাদেশ এখন স্বনির্ভর দেশ নয়, ঋণনির্ভর দেশ হওয়ার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের আয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় খাতগুলোর একটি হলো প্রবাসীদের আয়। এই খাতটিতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে শুধু আমেরিকায় প্রায় ৪০০ বাংলাদেশীর মৃত্যু হয়েছে। ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে বিগত ছয় মাসে কয়েক হাজার

বাংলাদেশী ফেরত এসেছে। তারা আর ওইসব দেশে ফিরে যেতে পারবে না। খাতটিকে মেরুদণ্ড সোজা দাঁড়াতে হলে বিদেশে নতুন কর্মসংস্থানের পথ সৃষ্টি করতে হবে। দ্বিতীয়ত, যে খাতটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থাকে চাঙ্গা রাখত বিশেষভাবে সেটিও দুর্বল হতে চলেছে। সেই সেক্টরটির নাম গার্মেন্টস শিল্প। বহু দিন ধরে এই সেক্টরটিতে মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে বিরোধ চলছে। এ ছাড়াও আগুন দিয়ে এই শিল্পকে দুর্বল করে দেয়া হয়েছে, যেমন স্বাধীনের পর পাটের গুদামে আগুন দিয়ে পাটশিল্পকে ধ্বংস করা হয়েছিল। পাটের রফতানি বাজার এখন ভারতের দখলে। যখনই আমরা স্বনির্ভর হতে এগিয়ে যাই তখনই আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র শুরু হয়। তবে এসব ব্যাপারে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না।

মনে রাখা দরকারÑ জাতীয় বাজেট বা জনবাজেট স্বাধীন বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিচ্ছবি। এটা কোনো ভিশন বা স্বপ্ন নয়, বরং দেশের সব শ্রেণীর জনগোষ্ঠীর সাংবিধানিক অধিকারের বিষয়। প্রত্যেক বছরের মতো এবারো ২০২০-২১ সালের বাজেট পেশ করা হয়েছে জাতীয় সংসদে। সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকার এই বাজেটে জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলন কতটুকু হবে সেটি দেখার বিষয়। ১৯৭২-৭৩ থেকে ২০১৯-২০ সাল পর্যন্ত ৪৯টি বাজেট দেখেছি। এসব বাজেটে আয়ের চেয়ে ব্যয়ের অঙ্ক বেশি ছিল যাকে এক কথায় বলা হয় ‘ঘাটতি বাজেট’। উল্লেখ্য, প্রতি বছর এই ঘাটতি বাজেটের অঙ্ক লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। ২০২০-২১ এর বাজেটেও এ চিত্র আমরা দেখতে পাবো। আমাদের প্রশ্ন হলো, আয়ের অঙ্ক না বাড়িয়ে কেন ব্যয়ের একটি বিশাল অঙ্ক বাড়িয়ে চলছেন। এই ঘাটতি বাজেটের যে টাকা বাজেটে দেখানো হয় সেটি সরকার পরিকল্পিত উপায়ে সঞ্চয়পত্রে গরিব মানুষের জমাকৃত অর্থ এবং বাকি টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে থাকে। জনগণের গচ্ছিত টাকার ওপর সুদের হারও কমিয়ে দেয়া হয়েছে, কিন্তু সরকার জনগণের টাকা ঘাটতি মোকাবেলায় ঋণ হিসেবে তুলে নেয়ার সময় ঋণের সুদের হারও কমিয়ে দেয়।

টাকা জনগণের কিন্তু তারা গচ্ছিত আমানতের ওপর লভাংশ বা সুদ কম পাচ্ছেন। আগামী অর্থবছরে ব্যাংক থেকে প্রায় এক লাখ কোটি টাকা উত্তোলন করবে সরকার, যা বাংলাদেশ ব্যাংককে আগাম জানিয়ে দেয়া হয়েছে। করোনায় ৭৪ শতাংশ পরিবারের আয় কমেছে এবং বেকার হয়ে পড়েছে ১০ লাখ প্রবাসী শ্রমিক। এসব প্রক্রিয়া বাজেট বাস্তবায়নে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে নিঃসন্দেহে। জিএফআই রিপোর্ট ২০১৯ অনুযায়ী, ২০০৬ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ছয় হাজার ৩২৮ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ৫ দশমিক ৩০ লাখ কোটি টাকা। একক বছর হিসাবে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ থেকে ৫৯০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী এবং বর্তমান এমপি রাশেদ খান মেনন বরিশাল হলে একটি অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, বর্তমান সরকারের ১০ বছরে ৯ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এই পাচারকৃত টাকায় কানাডায় ‘বেগমপাড়া’ এবং মালয়েশিয়াসহ অনেক দেশে ‘সেকেন্ড হোম’ করা হয়েছে বলেও পত্রিকায় প্রকাশ। আমাদের দেশে বিগত ১২ বছরে প্রতিটি পণ্যমূল্যের দাম শতকরা ৫০ থেকে ৭০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শতভাগ বেড়েছে। দেশে বাজার নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পিত কোনো ব্যবস্থা নেই। জনগণের সেবা দিতে বলে একটি গণবান্ধব বাজেট উপস্থাপন করা সময়ের দাবি। রাষ্ট্রের অদক্ষতার বোঝা সাধারণ মানুষের ওপর চাপানো যথার্থ নয়। রাষ্ট্রের অভিভাবকদের ভুল জনগণ কেন নেবে? তারা তো দেশ পরিচালনা করছে না। একটি পত্রিকায় লিখেছে (২১ অক্টোবর ১৯) সাবেক একজন মন্ত্রী বলেছেন, দুর্বৃত্তরাই রাষ্ট্র দখল করেছে।

বাজেট ষোলো আনা বাস্তবায়িত না হওয়ার মূল কারণ হলো- যখন লোভ মিথ্যার কাছে পরাস্ত হয়, যখন ঘুষ-দুর্নীতি স্পিড মানি হিসেবে গণ্য হয়। যখন ক্ষুদ্র মনের মানুষরা বড় বড় পদ দখল করে থাকে। বলতে ইচ্ছা হয় ৪৯ বছর পর আমাদের রাষ্ট্র, তুমি কোথায়? রাষ্ট্রের সব কিছুই সঠিকভাবে চলবে যদি এই দু’টি কথা মনে রাখি। ‘শুদ্ধাচার ও শিষ্টাচার সভ্য জাতির অহঙ্কার; করলে সবাই চেষ্টা এগিয়ে যাবে দেশটা।’ করোনায় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদিত ত্রাণসামগ্রী লুট হয়ে যাচ্ছে। গরিবের টাকা যাচ্ছে নেতাদের পকেটে। এখন চলছে ‘ডিজিটাল ত্রাণ চুরি’। ত্রাণের পর নগদ টাকাও লুট হচ্ছে। মে মাসের জাতীয় দৈনিকগুলোতে এসব খবরে বের হয়েছে।

২৭ এপ্রিল একটি পত্রিকায় লিখেছে, করোনাভাইরাস সঙ্কটে নাগরিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৮টি গুরুত্বপূর্ণ দেশের মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। তীব্র খাদ্যসঙ্কটে বা তার চেয়েও খারাপ অবস্থায় থাকা মানুষকে নিয়ে গত বছরে (২০১৯) গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২০ প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বের ৫৫টি দেশের বাসিন্দা যার মধ্যে বাংলাদেশের নামও আছে, সেবা বন্ধ হওয়ার ঝুঁকির তালিকায়। তাই স্বচ্ছ বাজেট বাস্তবায়নে সর্বস্তরে প্রয়োজন শুদ্ধাচার ও শিষ্টাচার।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক, ডেটা সেন্স এবং উন্নয়ন সমন্বয়ের যৌথ সমীক্ষার তথ্য ২ জুন ২০২০ পত্রিকায় উঠেছে। তারা বলেছেন, করোনায় দেশের সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ এখন চরম দরিদ্র। করোনা ছড়িয়ে পড়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন একটি সঙ্কটময় মুহূর্তে উপনীত হয়েছে। মহামারীটি নিম্ন আয়ের মানুষকে অস্বাভাবিক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। দেশের প্রায় ২০ কোটি ২২ লাখ মানুষ অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত দুর্বলতার ঝুঁকিতে রয়েছেন। প্রায় ৮০ শতাংশ পরিবারের আয় রোজগার কমে গেছে। উৎপাদন খাতেও বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছে। উদাহরণস্বরূপ, তৈরী পোশাক খাতে রফতানি এপ্রিল ২০১৯-এর তুলনায় ২০২০ সালের এপ্রিলে ৮৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। চলতি বছরে মার্চের মাঝামাঝি থেকে ৭ এপ্রিলের মধ্যে ১১১৬টি কারখানা বন্ধ ঘোষিত হয়েছে এবং চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ২২ লাখ গার্মেন্টস শ্রমিক। ১৪ লাখেরও বেশি প্রবাসী শ্রমিক চাকরি হারানোর কারণে ফিরে এসেছেন বা আসছেন। ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেছেন, মানুষকে আগে বাঁচার সুযোগ দিতে হবে। তারপর স্বপ্নপূরণ আর সুখে থাকার চিন্তা। তাই এবারের বাজেট হোক বেঁচে থাকার বা টিকে থাকার বাজেট।

২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেট শেষ পর্যন্ত প্রায় ২৫ শতাংশ অবাস্তবায়িত থেকে গেছে। দেশের অর্থনীতির অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ স্থবিরতায় কর্মসংস্থানের
অভাব একটি বড় সঙ্কটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক বছর ধরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ২১-২২ শতাংশের মধ্যেই হয়েছে।

অভিজ্ঞতার আলোকে বলছি, দক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে বাজেট বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়। চলতি অর্থবছরে (২০১৯-২০) শুরু থেকেই রফতানি ও প্রবাসী আয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে প্রবৃদ্ধির গতি নিম্নমুখী। এ ছাড়া কৃষির উৎপাদন প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে পড়ছে। এরকম অবস্থায় রাজস্ব আয়ের উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা চ্যালেঞ্জ ঘটে। অর্জনযোগ্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং তা অর্জনে তদারকি ও নিবিড় পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। বিশাল অঙ্কের বাজেট প্রণয়ন করে বসে থাকলে হবে না বরং ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে রাজস্ব আয়ের নিত্য তদারকির ব্যবস্থা থাকতে হবে।

বাজেটে আয় এবং ব্যয়ের সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হবে। অর্থাৎ বাজেটে ঘাটতি কমিয়ে আনতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রতি বছর জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। খরচের সাথে সামঞ্জস্য রেখে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি। অতীতের দিকে তাকালে বোঝা যাবে, রাজস্ব আদায়ে গতি আনতে প্রশাসনিক দক্ষতা ও এনবিআরের সংস্কারের কথা বাজেটে উল্লেখ থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। আমরা প্রত্যাশ করব, বাজেট বাস্তবায়নে সরকার যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। একজন দক্ষ ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকেই বলা যায়, যিনি ব্যয় এবং আয়ের পার্থক্য নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে সফলতা অর্জন করেন। এটাই বাজেটের দর্শন এবং মূলনীতি হওয়া উচিত। রাষ্ট্র সে দিকেই নজর দেবে বলে আমরা প্রত্যাশা করি।

লেখক : গ্রন্থকার ও গবেষক


আরো সংবাদ



premium cement