১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আল্লামা শাহ কুতুব উদ্দিন রহ.

আল্লামা শাহ কুতুব উদ্দিন রহ.
আল্লামা শাহ কুতুব উদ্দিন রহ. - সংগৃহীত

চট্টগ্রাম বায়তুশ শরফের পীর, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের শরিয়াহ সুপারভাইজরি কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, জাতীয় পর্যায়ে ‘শ্রেষ্ঠ অধ্যক্ষ’ হিসেবে পুরস্কারপ্রাপ্ত, শাহ সুফি আল্লামা কুতুব উদ্দিন রহ: পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন গত ২০ মে। তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর। তিনি স্ত্রী, ছয় মেয়ে ও এক ছেলে ছাড়াও অসংখ্য শিষ্য ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তিনি দীর্ঘ দিন ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছিলেন। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার আধুনগর ইউনিয়নের সুফি মিয়াজীপাড়া গ্রামে ৯ মার্চ ১৯৩৯ সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ফাজিল পর্যন্ত লেখাপড়া করেন চুনতি হাকিমিয়া আলিয়া মাদরাসায়। ছাত্রজীবনের প্রতিটি স্তরে রেকর্ড পরিমাণ নম্বর নিয়ে অনন্য সফলতার স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৫৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম শহরের চন্দনপুরা দারুল উলুম আলিয়া মাদরাসা থেকে স্বর্ণপদকসহ প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অর্জন করে হাদিসশাস্ত্রে কামিল ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। বহুমাত্রিকতা তার জীবনের অনন্য বৈশিষ্ট্য। ব্যতিক্রমধর্মী মেধা আর সৃজনশীল ধীশক্তির অধিকারী হওয়ার কারণে তিনি ধর্মীয় মহলে ‘বাহরুল উলুম’ (জ্ঞানের সাগর) নামে সমধিক পরিচিতি লাভ করেন। তিনি শায়খুল হাদিস এবং আরবি, উর্দু ও ফারসি সাহিত্যের খ্যাতিমান পণ্ডিত ছিলেন।

চট্টগ্রাম নগরীর ডবলমুরিং থানা এলাকার ধনিয়ালাপাড়ায় অবস্থিত, বায়তুশ শরফের প্রতিষ্ঠাতা প্রখ্যাত সুফিসাধক শাহ মাওলানা মীর মুহাম্মদ আখতার রহ: এবং বায়তুশ শরফের প্রধান রূপকার শাহ সুফি মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল জব্বার রহ:-এর সান্নিধ্যে অবস্থান করে তিনি আধ্যাত্মিক সাধনায় নিমগ্ন হয়েছিলেন। ১৯৫২ সালের ২ অক্টোবর মসজিদভিত্তিক মানবসেবামূলক সংগঠন বায়তুশ শরফ ‘আঞ্জুমানে ইত্তেহাদ বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে আমৃত্যু হজরত আল্লামা শাহ কুতুব উদ্দিন রহ: বায়তুশ শরফের পীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার লেখা একাধিক ধর্মীয় গ্রন্থের মধ্যে উর্দুভাষায় রচিত ‘গুলহায়ে আকিদত’ বিদগ্ধজনের কাছে বেশ সমাদৃত। বায়তুশ শরফ আদর্শ কামিল মাদরাসার শায়খুল হাদিস ও অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি দেশের সেরা অধ্যক্ষের পুরস্কার লাভ করেছেন।

বায়তুশ শরফের পীর সাহেব হজরত আল্লামা শাহ কুতুব উদ্দিন সাহেব রহ: ছিলেন বড় অন্তরের অধিকারী। উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও সহৃদয়তার মতো গুণের কারণে সর্বস্তরের মানুষের কাছে তিনি জনপ্রিয় ছিলেন। সঙ্কীর্ণতার দুষ্টকীট তাকে দংশন করতে পারেনি। দলমত নির্বিশেষে সব মানুষকে আপন করে নেয়ার গুণ ছিল তার সহজাত। চুনতি হাকিমিয়া আলিয়া ও চট্টগ্রাম দারুল উলুমে অধ্যয়নকালে আলিয়া ও কওমি ধারার উস্তাদদের কাছে তিনি ইলমে দ্বীন হাসিল করেছিলেন। কলকাতা আলিয়া মাদরাসা থেকে স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত গবেষক হজরত মাওলানা মুহাম্মদ আমিন রহ:-এর কাছে তিনি বুখারি শরিফ অধ্যয়ন করেন। তরিকতের সিলিসিলায় মাওলানা মুহাম্মদ আমিন রহ: ছিলেন হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী রহ:-এর অনুসারী এবং তার বাইয়াতগ্রহীতা। হাদিসের বিশ্বখ্যাত ভাষ্যের ‘ই’ লাউস সুনান’ (২২ খণ্ড) লেখক আল্লামা যাফর আহমদ ওসমানী রহ:-এর ছেলে মাওলানা ওমর আহমদ ওসমানী রহ:-এর কাছেও তিনি হাদিসের পাঠ গ্রহণ করেন। ফলে ছাত্রজীবন থেকে তার মধ্যে উদারতা, সহিষ্ণুতা, পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং মানুষকে সম্মান প্রদর্শনের মানসিকতার জন্ম হয়। ‘শামায়েলে তিরমিজি’-এর বাংলা অনুবাদক, ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর মোজাহেরুল উলুম মাদরাসার কৃতীছাত্র, চুনতি হাকিমিয়া আলিয়া কামিল মাদরাসার নাজিমে আলা হজরত আল্লøামা ফজলুল্লাহ রহ:-এর কাছে বিশেষভাবে তিনি আরবি সাহিত্য, ফিকহে ইসলামী ও তাফসির অধ্যয়ন করেন।

মধুর কণ্ঠর অধিকারী একজন সুবক্তা হিসেবেও শাহ কুতুবউদ্দিনের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় প্রতি বছর শিষ্যদের নিয়ে হজব্রত পালন করা ছিল তার রুটিন। মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও হাসপাতালের বেডে তাসবিহ হাতে জিকির করতে দেখা গেছে তাকে। ব্যক্তিজীবনে সুন্নতের পাবন্দ, সর্বদা হাসিখুশি, প্রাণবন্ত ও দরাজদিলের অধিকারী ছিলেন। প্রচারবিমুখ এই মনীষীর বিনয় ও সৌজন্য ছিল তার মধুর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রায় সময় তিনি ছাত্র, আলেম ওলামাদের টাকা হাদিয়া দিতেন। মানুষকে সম্মান জানিয়ে তিনি আনন্দ পেতেন। অন্তর্গত বিশ্বাস, বোধ ও শুদ্ধাচারে তিনি ছিলেন অটল।বহু মানুষ তার পবিত্র পরশে পাপাচারমুক্ত জীবনের সন্ধান পেয়েছেন।

২০১০ সালে বায়তুশ শরফের পীর হজরত আল্লøামা শাহ কুতুব উদ্দিন রহ:-এর সাথে চট্টগ্রামের ধনিয়ালাপাড়ায় সাক্ষাৎ করেছিলাম। বরাবরের মতো তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কুশল জিজ্ঞেস করেন। পটিয়া জামিয়া ইসলামিয়ার শায়খুল হাদিস, সাবেক সংসদ সদস্য খতিবে আজম হজরত মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ রহ:-এর জীবন ও কর্ম নিয়ে প্রকাশিতব্য স্মারকগ্রন্থে তার একটি লেখা চাইলাম। তিনি জানালেন, এ বিষয়ে তিনি উর্দু ভাষায় একটি মরছিয়া (শোকগাথা ) লিখবেন এবং সময়মতো আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। ক’দিন পর লোক মারফত তিনি এটা কলেজে পাঠিয়ে দেন। ১৮ লাইনের এ কবিতার ছত্রে ছত্রে খতিবে আজমের প্রতি তার ভক্তি ও অনুরাগ প্রকাশ পেয়েছে। তিনি আলিয়াধারায় গড়ে ওঠা একজন মনীষী, অপর দিকে মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ রহ: ছিলেন কওমিধারার অন্যতম পুরোধা। কিন্তু তাদের পারস্পরিক মুহাব্বত কতইনা গভীর। কবিতাটি পীর সাহেব লিখেছেন তাহাজ্জুদের সময়। আমার অনুরোধে শোকগাথা রচনা করেনÑ এই কথাটি লিখতেও তিনি ভুলে যাননি। মানুষকে স্নেহ ও সম্মান করার যোগ্যতা আল্লাহ প্রদত্ত। উর্দু শোকগাথার বাংলা কাব্যানুবাদ-
খতিবে আজমের প্রস্থান তো কেয়ামত
জীবনজুড়েই উল্লেøখ্য যার খেদমত
চুল থেকে নখ ছিলেন যিনি চরিত্রবান
দ্ব্যর্থহীন আর শিল্প ছিল যার বয়ান!
চলায়-বলায় ছিলেন যিনি প্রফুল্ল
রাজনীতিতে ছিলেন যিনি সতর্ক।
লোহাকে যার হায়দরি হাঁক মোম করেছে
তুলনাহীন যার ভাষণে দিল্ ভরেছে!
ওয়াজে ছিল শিক্ষা এবং জ্ঞান অধিক
সকল কথাই ছিল যে তার দালিলিক।
শ্রুতিবোধে তীক্ষ্ম ছিল ধীশক্তি যার
কথায়-লেখায় বর্ণনাতীত যোগ্যতা তার!
তার সুপ্ত পূর্ণতা তো খোদার কৃপা
দৃশ্য শোভা? সে যে হেদায়েতের বিভা!
তার মতো আর আলোকিত নেই, কেউ নেই
কৌলিন্যে, নেতৃত্বে নেই, জুড়ি নেই!
নামধামহীন অধম কুতুব কাব্য লিখে
চায় পেতে চায় কিছুটা তার সুদৃষ্টিকে!

কাব্যানুবাদ : আলাউদ্দিন কবির

বায়তুশ শরফের কীর্তিমান মনীষী শাহ সুফি মাওলানা মুহাম্মদ আবদুল জব্বার রহ:-এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে হজরত আল্লøামা শাহ কুতুব উদ্দিন রহ: মসজিদকেন্দ্রিক সমাজসেবার বিস্তার, ইসলামী শিক্ষা ও দীক্ষার প্রচলন, কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং সুদমুক্ত ব্যাংকিং সিস্টেম প্রবর্তনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গেছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় বিশেষত চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা, যশোর, পিরোজপুর, মৌলভীবাজার, বি-বাড়িয়া, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চাঁদপুর ও খাগড়াছড়িতে বায়তুশ শরফ আঞ্জুমানে ইত্তেহাদের শাখা খোলা হয়েছে। ১৯৯৮ সাল থেকে হজরত আল্লামা শাহ কুতুব উদ্দিন রহ: ১৩টি মাদরাসা, ১৬টি এতিমখানা, ১৫টি হিফজখানা, তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আটটি ইসলামী গণপাঠাগার, পাঁচটি ইসলামী পুস্তক বিপণন কেন্দ্র, তিনটি কার্পেন্ট্রি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, পাঁচটি টেইলারিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, তিনটি হেয়ার কাটিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, দু’টি প্যাকেজিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, একটি ছাপাখানা এবং ছয়টি হাসপাতাল ও দাতব্য চিকিৎসালয় পরিচালনা করে গেছেন। প্রতি বছর রবিউল আউয়াল মাসে তরুণ প্রজন্মকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে তামাদ্দুনিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বিগত ২৫ বছরে মোট ৯৮ জন শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত ও বিদগ্ধ ব্যক্তিকে সংবর্ধনা ও পদক দান করা হয়েছে।

নবনির্বাচিত পীর সাহেব, বিশিষ্ট গ্রন্থকার মাওলানা আবদুল হাই নদভী হাফিজাহুল্লাহ ভারতের লক্ষ্মৌস্থ দারুল উলুম নদওয়া থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেছেন। তার উদার আচরণ, নিরহঙ্কার জীবনধারা ও মার্জিত ব্যবহার মানুষকে মোহিত করে থাকে। তিনি বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী স্কলার হজরত আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ:, নদওয়ার মুহতামিম আল্লামা রাবে’ হাসান নদভী এবং আরবি মাসিক ‘আলবা’সুল ইসলামীর সম্পাদক ড. মাওলানা সাঈদ আল আযমীর ছাত্র। আলিয়া ও দেওবন্দীধারার বহু আলেমের কাছে তিনি হাদিসের পাঠ গ্রহণ করেছেন। তার লিখিত বড়-ছোট ২০০ গ্রন্থ বেরিয়েছে। বায়তুশ শরফের ঐতিহ্য সংরক্ষণ, আধ্যাত্ম সাধনা, শিক্ষা ও মানবসেবার ধারা আগামী দিনগুলোতে আরো বেগবান হবে, এটাই ভক্তমহলের প্রত্যাশা। আল্লøাহ তায়ালা তাদের উত্তম জাযা দান করুন, আমিন।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ওমর গণি এমইএস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম


আরো সংবাদ



premium cement
বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক মামলা করা হয়নি : প্রধানমন্ত্রী দাওয়াতী ময়দানে সকল নেতাদের ভূমিকা রাখতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি ছাড়িয়ে গেল শ্রমিকদের মাঝে ইসলামের আদর্শের আহ্বান পৌঁছাতে হবে : ডা. শফিকুর রহমান ঢাকা শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে বিমানবন্দরের টার্মিনালে ঢুকে গেলো বাস, ইঞ্জিনিয়ার নিহত গোয়ালন্দে প্রবাসীর স্ত্রী-সন্তানকে মারধর, বিচারের দাবিতে মানববন্ধন সিরিয়ায় আইএস-এর হামলায় সরকার সমর্থক ২০ সেনা সদস্য নিহত ফরিদপুরে ট্রেনে কাটা পড়ে যুবকের মৃত্যু জনসমর্থনহীন সরকার জনগণের আওয়াজ নির্মমভাবে দমন করে : রিজভী সরিষাবাড়ীতে স্কুলছাত্র হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি

সকল