১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পরিবেশ দিবসের উপলব্ধি এবং করোনা

পরিবেশ দিবসের উপলব্ধি এবং করোনা - ছবি : নয়া দিগন্ত

৫ জুন। প্রতি বছর এই দিনটি বিশ্বজুড়ে পালিত হয় ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে। দিবসটিকে কেউ কেউ পিপলস ডে বা ‘জনদিবস’ নামেও আখ্যায়িত করে থাকেন। এই দিবস পালনের সাধারণ লক্ষ্য হচ্ছে জনগণের মধ্যে পরিবশ-সচেতনতা গড়ে তুলে পরিবেশের ভারসাম্য সুরক্ষা করা, যাতে মানবজাতিসহ প্রাণী ও উদ্ভিদকুলের জীবনযাপন সহজ হয়। ২০২০ সালে এই দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে বায়োডাইভার্সিটি বা জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব। জাতিসঙ্ঘ নির্ধারিত এ বছরের এই দিবসের ধারণাশব্দ হচ্ছে : ‘বায়োডাইভার্সিটি’। আর মুখ্য স্লোগান হচ্ছে : ‘টাইম ফর ন্যাচার’।

‘জীববৈচিত্র্য’ বলতে আমরা বুঝি পৃথিবীতে বিদ্যমান থাকা সব ধরনের প্রাণীকে। এতে অন্তর্ভুক্ত আছে পৃথিবীর বিপুলসংখ্যক প্রজাতির পরস্পর সম্পর্কযুক্ত ও সমন্বিতভাবে ক্রিয়াশীল ক্ষুদ্র প্রাণিসত্তা বা উদ্ভিদসত্তা, জলজ উদ্ভিদ, শৈবাল, ছত্রাক, গাছ-গাছড়া ও সমগ্র প্রাণীকুল। এগুলোর বসবাস রয়েছে জলে বা স্থলে। সবচেয়ে ছোট ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে সবচেয়ে বড় মেরুদণ্ডী প্রাণী পর্যন্ত, সব প্রাণীই এই জীববৈচিত্র্যের আওতাভুক্ত। সব জীবন্ত প্রাণী বা উদ্ভিদকুল পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। একটির ওপর রয়েছে আরেকটির নির্ভরশীলতা। এর মাধ্যমেই এরা পরিবেশ-প্রতিবেশ সম্পর্কিত ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। আর এই পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য জলে ও স্থলে বসবাসরত সব প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতি থেকে একটি মাত্র উপাদান হারিয়ে গেলেও পরিবেশ-প্রতিবেশে ভারসাম্যহীনতা কিছুটা ক্ষুণœ হতে পারে। তা প্রাণী ও উদ্ভিদকুলের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করতে পারে। এখন পর্যন্ত, আমরা জীববৈচিত্র্য অনেকটা হারিয়ে ফেলেছি। এর ফলে, অস্তিত্ব হারিয়েছে নানা প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ এবং পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে ব্যাপকভাবে।

এর ফলে মানবজাতি মুখোমুখি হচ্ছে নানা ধরনের নতুন চ্যালেঞ্জের। এখন পরিবেশ বিজ্ঞানীরাও বলছেন, আজকের দিনের করোনা মহামারী তেমনি একটি মহাচ্যালেঞ্জ। পরিবেশের ভারসাম্যহীনতাই জন্ম দিচ্ছে এ ধরনের আরো অনেক ভাইরাস সংক্রমণ-জনিত মহামারীর। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েক ধরনে ভাইরাসের সংক্রমণ একই সূত্রে গাঁথা। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা এই মর্মে জোরালো সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করছেন, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দিচ্ছেনÑ কী করে জীববৈচিত্র্য হারানোর বিষয়টি সম্পর্কিত রয়েছে এ ধরনের সংক্রমণের সাথে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জীববৈচিত্র্য হারিয়ে যাওয়ার ফলে জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে কয়েক ধরনের তড়ড়হড়ংরং রোগ বেড়ে যাওয়ার। জুনোসিস হচ্ছে প্রাণীদেহের একটি রোগ। আর এই রোগ প্রাণীদেহ থেকে মানবদেহেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। একটি সমীক্ষা মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোর বিকাশমান সংক্রামক রোগের উদ্ভব ঘটেছে এই জুনোসিস থেকে। সবিশেষ উল্লেখ্য, কোভিড-১৯ সম্পর্কিত সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকেও এই সত্যই জানা যায়।

সাধারণত, বেশ কিছু প্রজাতি সংক্রমণ ছড়িয়ে দেয়ার সাথে জড়িত এই জীববৈচিত্র্য হারানোর বিষয়টি। আর প্রকৃতিতে তা ব্যাপকভাবে অবাধে ছড়িয়ে পড়ার কারণে, বর্তমান করোনা ভাইরাসের বাফার জোন হিসেবে কাজ করে প্রকৃতি বা ন্যাচার। জীববৈচিত্র্য হারিয়ে ফেলার মাধ্যমে এসব সংক্রামক প্রজাতির প্রাকৃতিক বসতি ধ্বংস হয়ে চলেছে। এর সাথে চলছে এসব প্রজাতির অস্তিত্ব বিলপ্তির কাজও। জীববৈচিত্র্য হারানোর প্রক্রিয়ায় এসব প্যাথোজেন অর্থাৎ সংক্রামক রোগ সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও অন্যান্য অণুজীব সহজেই পথ পেয়ে যাচ্ছে তাদের অবস্থান প্রাকৃতিক বসতি থেকে মানবসমাজে সরিয়ে নেয়ার। জানা গেছে, দক্ষিণ আমেরিকায় অ্যামাজন অববাহিকায় ব্যাপক হারে ম্যালেরিয়া বেড়ে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, ব্যাপক হারে এই বিশাল বনের ধ্বংসসাধন। ইবোলা ও বার্ড-ফ্লু ছড়িয়ে পড়ার পেছনেও একই কারণের কথা বলা হচ্ছে। কোভিড-১৯ নিয়ে বিশ্বব্যাপী চলছে নানা ধরনের বিতর্ক। পরাশক্তিগুলো বলছে, এই ভাইরাস ল্যাবরেটরিতে সৃষ্ট। যুক্তরাষ্ট্র বলছে, চীন এই ভাইরাস নিজেদের ল্যাবরেটরিতে তৈরি করে বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে। চীনও একই ধরনের পাল্টা অভিযোগ করছে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই ভাইরাস ল্যাবোরেটরিতে সৃষ্টি করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব এটি ছড়িয়েছে প্রাকৃতিক উৎস থেকেই। প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানীরা আজ একমত, জীববৈচিত্র্য পরিস্থিতির অবনতির ফলেই আজ আমরা এই কোভিড-১৯ নামের ভাইরাসের শিকার। চলমান গবেষণা থেকে প্রমাণ মিলছে, করোনাভাইরাসের এই ছড়িয়ে পড়া প্রাণী থেকে। মাধ্যমিক প্রজাতির বিলুপ্তির কারণে পশুর দেহ থেকে সরাসরি এই ভাইরাস মানবদেহে সঞ্চালিত হওয়া সম্ভব।

সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণই জীববৈচিত্র্যের একমাত্র কাজ নয়। এটি হচ্ছে সেই স্তম্ভ, যা ইকোসিস্টেম (গাছপালা ও পশুপাখির সাথে তাদের প্রাণহীন পরিপার্শ্বের পারস্পরিক ক্রিয়াব্যবস্থা) কার্যকর রেখে মানবজাতিকে বাঁচিয়ে রাখতে সহায়তা করে। জীববৈচিত্র্য আমাদের ও অন্যান্য নানা উন্নত প্রজাতির খাদ্যের উৎস। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও দরিদ্রতা নাশে জীববৈচিত্র্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের নানা পণ্য উৎপাদন ও ভোগের জন্য জীববৈচিত্র্য জোগায় কাঁচামাল। এভাবেই জীববৈচিত্র্যের বড় ধরনের একটা প্রভাব রয়েছে অর্থনীতিতে। বিশ্বের বেশির ভাগ গরিব মানুষ বনভূমি, জলাভূমি, চারণভূমি, পানি, কৃষিজমির ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের বেঁচে থাকার জন্য এই জীববৈচিত্র্যের ওপর নির্ভরশীল। আবহাওয়া পরিস্থিতির ওপরও জীববৈচিত্র্যের প্রভাব রয়েছে। এমনকি বৈজ্ঞানিক, সাংস্কৃতিক ও আত্মনিরোধী মূল্যবোধেও রয়েছে এই জীববৈচিত্র্যের সুস্পষ্ট প্রভাব।

এই প্রভাবকে অবমূল্যায়িত করা যাবে না। মহান সৃষ্টিকর্তা মানুষকে দিয়েছেন সর্বোত্তম চিন্তাশক্তি ও অনুধাবন ক্ষমতা। সে কারণে, বুঝেশুনে চলায় মানবজাতির ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তা সত্ত্বেও মানুষ তার এই বিরাট ভূমিকা পালন বারবার এড়িয়ে চলছে সীমাহীনভাবে। আমরা কখনোই চেষ্টা করছি না, উন্নয়ন ও চাহিদার মধ্যে একটা ভারসাম্য বজায় রাখতে। আমাদের সচেতন প্রয়াস নেই পরিবেশের ভারসাম্য সুরক্ষায়। আমরা লম্বা লম্বা কথা বলি টেকসই উন্নয়ন নিয়ে। কিন্তু বাস্তবে নেই এর প্রতিফলন।
এরই মধ্যে বিপুলসংখ্যক প্রজাতির উদ্ভিদ, পশুপাখি, মেরুদণ্ডী প্রাণী ও অণুজীব পৃৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এর ফলে নানা প্রজাতি হারিয়ে ফেলেছে ও ফেলছে তাদের প্রাকৃতিক বসতিস্থল। এলোপাতাড়ি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ধ্বংস করেছি জীববৈচিত্র্যের জন্য অতি প্রয়োজনীয় বনভূমি। আমরা আজ অবিবেচকের মতো বনভূমিতে আগুন লাগিয়ে সেগুলোকে চাষের জমি বানাচ্ছি। এ ধরনের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে অ্যামাজন বন ধ্বংসের চলমান অপকর্ম। বিশ্বব্যাপী পরিবেশকর্মী ও সচেতন মানুষের প্রবল প্রতিবাদের মুখেও থামছে না এই অপচেষ্টা। বন নিধন জীববৈচিত্র্য বিনাশের প্রতি সবচেয়ে বড় হুমকি। সবচেয়ে দুঃখজনক হলোÑ এ হুমকি সৃষ্টির জন্য সরাসরি ও শতভাগ দায়ী মানুষ।

জাতিসঙ্ঘের একটি অবাক করা প্রতিবেদনে দেখা যায়Ñ সম্প্রতি মানুষের অবিবেচনাপ্রসূত কর্মকাণ্ডের ফলে লাখ লাখ প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ আজ বিলুপ্তির মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। ‘ওয়ার্ল্ড কনজারভেশন মনিটরিং সেন্টার’-এর প্রতিবেদন মতে, প্রায় এক হাজারের মতো প্রজাতির প্রাণী এবং ৫০০-এর মতো উদ্ভিদ প্রজাতি ১৬০০ সালের পরবর্তী সময়ে বিলুপ্ত হয়েছে মানবসৃষ্ট কারণে; প্রকৃতির প্রতি মানুষের বিবেচনাহীন আচরণে। অন্য একটি প্রতিবেদন মতে, ১৯০০ সালের পরবর্তী সময়ে পৃথিবী থেকে গড়ে প্রতি বছর একটি করে স্তন্যপায়ী প্রজাতির বিলুপ্তি ঘটেছে। স্তন্যপায়ী ছাড়াও আরো অনেক প্রজাতির প্রাণীকে বিলুপ্তির মুখোমুখি এনে দাঁড় করানো হয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে এই বিলুপ্তির চেয়ে মানবসৃষ্ট কারণে বিলুপ্তির প্রবণতা অনেক বেশি প্রবল। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে অচিরেই মানবজাতিকে মুখোমুখি হতে হবে করুণ পরিণতির। তখন মানবজাতিও পড়তে পারে এ ধরনের বিলুপ্তির আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো ও পরিবেশবাদীরা সর্বত্মক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন জীববৈচিত্র্যের এই ভয়াবহ বিনাশ ও এর পরিণতি সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করে তুলতে। বৈশ্বিক পরিবেশ সমস্যা নিয়ে প্রকাশ করা হচ্ছে উদ্বেগজনক নানা প্রতিবেদন। সমাধানকল্পে নানা পরিকল্পনা সূত্রায়িত হচ্ছে। তবে বিতর্কহীন সত্যটি হচ্ছেÑ এসব পরিকল্পনায় জনগণকে সম্পৃক্ত না করলে কোনো উদ্যোগই কার্যকর ইতিবাচক কোনো ফল বয়ে আনতে পারবে না। অতএব, সচেতন দায়িত্বশীল নাগরিকদের, বিশেষ করে শিক্ষিত যুবশ্রেণীর নাগরিকদের এগিয়ে আসা উচিত। এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের এবং করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সময়ে আমাদের অধিকতর সচেতনতা প্রকাশের তাগিদ এসেছে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সম্পর্কিত নানা ধরনের উদ্বেগজনক প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। এগুলো অধিকতর গুরুত্বের সাথে আমলে নেয়ার সময় এটি। সরকারের ও বেসরকারি পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর সাথে আমাদের একযোগে কাজ করতে হবে জীববৈচিত্র্যের এই বিনাশ ঠেকাতে। সেই অনুধাবন নিয়েই পালিত হোক বিশ্ব পরিবেশ দিবস। আমরা যেন গভীরভাবে অনুধাবন করি এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের স্লোগান ‘টাইম ফর ন্যাচার’ এবং এর মুখ্য প্রতিপাদ্য ‘জীববৈচিত্র্য’ পদবাচ্যটি। সৃষ্টিকর্তা মানবজাতি সৃষ্টি করেছেন। ভুললে চলবে না আমাদের উদ্ভব তিনি ঘটিয়ছেন প্রাকৃতিকভাবেই। প্রকৃতিতেই আমাদের বসবাস। প্রকৃতির কাছ থেকেই আহরণ করি আমাদের বেঁচে থাকার যাবতীয় উপাদান : বায়ু, পানি, খাবার, অর্থনৈতিক উৎপাদনের কাঁচামাল।। প্রকৃতি আর জীববৈচিত্র্য আমাদের প্রয়োজনেই সৃষ্টি। অতএব, প্রকৃতি জীববৈচিত্র্য আমাদের রক্ষা করতে হবে আমাদের স্বার্থেই। সে দায়িত্বও যেন আমরা ভুলে না যাই। 

 


আরো সংবাদ



premium cement