২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

২২ পরিবার থেকে ধনিক শ্রেণীর বিবর্তন

-

ধনী গোষ্ঠী কিভাবে রাষ্ট্রকে অকার্যকর করে যুগে যুগে তার অনেক উদাহরণ আমরা দেখেছি। আমরা যদি পাকিস্তান আমল তথা ১৯৬০-এর দশকের কথাই বলি, তখন আমরা বলতাম ২২টি পরিবারের হাতে দেশের সব সম্পদ পুঞ্জীভূত। তারাই সব শিল্প কারখানা ও ব্যাংক-বীমার মালিক। আরো লক্ষণীয় বিষয় ছিল এসব পরিবারের একটিও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের ছিল না। তখন এই গুটিকয় পরিবারের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হতে হতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য এতটাই প্রকট রূপ নেয় যে, সুইডিশ অর্থনীতিবিদ গুনান মিরডাল তার ‘এশিয়ান ড্রামা’ বইতে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে উন্নয়ন বৈষম্যের ফলে যে টানাপড়েন সৃষ্টি হচ্ছে তা সমাজ সহ্য করতে পারবে না। তোমার চোখের সামনে তোমার টাকা নিয়ে আরেক ভাই বড়লোক হচ্ছে, অথচ তুমি খেতে পারছ না। তখন তুমি তো বসে থাকবে না। তুমি ভাইকে যতই ভালোবাস না কেন, যখন দেখবে তুমি খেতে পারছ না আর তোমার সম্পদ নিয়ে তোমার আরেক ভাই গাড়ি-বাড়ি করছে, মার্সিডিজ চালাচ্ছে, তখন তুমি সহ্য করবে না।

১৯৬০-এর দশকে আমি পাকিস্তান প্লানিং কমিশনের ফিসক্যাল মনিটরি সেকশনে যোগ দিই। আমি ছিলাম পূর্ব পাকিস্তান থেকে এই সেকশনে যোগ দেয়া প্রথম অ্যাসিস্ট্যান্ট চিফ। এতেই বোঝা যায় তখন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য কেমন ছিল। যেকোনো দেশের ফিসক্যাল মনিটরিং সেকশন খুবই ক্রিটিক্যাল একটি জায়গা। যেখানে সারা দেশ থেকে অর্থনৈতিক উপাত্ত এসে জমা হয় এবং সেগুলো বিশ্লেষণ করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। ফলে দুই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যটি আমার কাছে ছিল খুবই স্পষ্ট। শেখ মুজিবুর রহমান যখন ছয় দফা ঘোষণা করেন, তখন এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝতেও আমার কোনো বেগ পেতে হয়নি। আরো মজার বিষয় হলো, আমি তখন ইসলামাবাদে। আমি প্রথম ছয় দফা শব্দটি আইয়ুব খানের মুখে শুনি। আর আমি ভাবি, ভালো তো, শেখ মুজিবের ছয় দফার প্রচারণা চালাচ্ছেন আইয়ুব খান। এরপর নিজে খোঁজ-খবর নিয়ে ছয় দফা বিষয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করি। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করাই ছিল এর মূল লক্ষ্য। শেষ পর্যন্ত এটাই আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র হয়ে দাঁড়ায়।

পাকিস্তানের ২২ ধনিক পরিবারের একটিও পূর্ব পাকিস্তানের ছিল না। তখন কোনো শিল্প-কারখানা এমনকি একটি ব্যাংকও বাঙালির মালিকানায় ছিল না। সম্ভবত একটি ব্যাংকের কিছু শেয়ার কিনেছিলেন নুরুল আমিন। যেটা আজকের রূপালী ব্যাংক। তখন এর নাম ছিল মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক। পঞ্চাশের দশকে ঢাকার রাস্তায় হাতেগোনা কিছু মোটরযান চলাচল করত। এরপর আমরা স্বাধীন হলাম। স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছর হতে চলল। আজ বাংলাদেশে নতুন এক শ্রেণীর ধনিক গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে। ঠিক পাকিস্তান আমলের ২২ পরিবারের মতোই। এই গোষ্ঠীগুলো আজ আবারো রাষ্ট্রকে অকার্যকর করার উপক্রম করেছে। এখন ধনিক গোষ্ঠীর নাম হয়েছে গ্রুপ।

বেশ কয়েক বছর একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সুবাদে এই ধনিক গোষ্ঠীগুলোকে আমার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চেনার সুযোগ হয়েছে। বিভিন্ন কাজে এদের অনেকে আমার কাছে আসতেন। ব্যবসায়িক কিছু হলে আমি বিনয়ের সাথে তাদের বলে দিতাম যে সেটা আমার বিষয় নয়, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বিষয়। অর্থনীতির একজন ছাত্র হিসেবে ব্যাংকিংয়ে আমার আগ্রহ ছিল। ফলে বিভিন্ন ব্যবসায়িক কার্যক্রম নিয়ে বোর্ড মিটিংয়ে এমডি যেসব মেমো উপস্থাপন করতেন সেগুলো আমি খুঁটিয়ে পড়তাম। কোনো কোনো মেমোর বিবরণ আমার কাছে বেখাপ্পা লাগত। তখন আমি প্রকাশ্য বোর্ড মিটিংয়ে একাধিকবার এগুলো নিয়ে এমডির প্রতি রূঢ় বাক্য ব্যবহার করেছি। মেমোর বিবরণ পড়েই বোঝা যেত যে, এমডি হয়তো কোনোভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। আমি এও বলেছি, আপনি যে এ ধরনের মেমো এনেছেন কত ঘুষ খেয়েছেন? আর আমার ভাগটিইবা কোথায়? আমার এ ধরনের কথা শুনে বোর্ডের সবাই হতভম্ব হয়ে গেছে। আমি মনে করি একজন এমডি, যিনি খুবই সম্মানিত একজন ব্যক্তি ও সিনিয়র ব্যাংকার, তার সাথে এ ধরনের রূঢ় বাক্য ব্যবহার করা কোনো চেয়ারম্যানের জন্য শোভনীয় নয়। তবে আমার এও মনে হয়েছে যে, ব্যাংককে নীতির প্রশ্নে আপসহীন রাখতে হলে এ ধরনের রূঢ় বাক্য ব্যবহার ছাড়া উপায় নেই। যার ফলে তৎকালীন এমডির নেতৃত্বেই এসআইবিএলের ওভারডিউ লায়াবিলিটি ২%-এর নিচে নেমে আসে এবং এটি দেশের বেসরকারি খাতে শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছিল।

ব্যাংক ঋণ দেয়। সেই ঋণ সঠিক সময়ে আদায় করতে পারলে ওভারডিউ লায়াবিলিটি কম হবে। আজকে আমরা দেখছি আমাদের ব্যাংকগুলোর ওভারডিউ লায়াবিলিটি ৪০%-৫০%। আমাদের দেশে যে ধনিক গ্রুপগুলোর একটি অংশের মধ্যে ব্যাংকের ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করার প্রবণতা প্রকট। আমি ব্যাংকে থাকাকালে দেখেছি যারা এক কোটি বা চার কোটি টাকার জন্য ধরনা দিত তারা এখন শত কোটি, হাজার কোটি টাকার মালিক। এদের উত্থান অবিশ্বাস্য। আজকে আমাদের দেশের আর্থিক দৈন্যদশার কারণ এরাই। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যারা ক্ষুদ্র ঋণগ্রহীতা তারা তুলনামূলক কম খেলাপি। অন্য দিকে যারা বড় অংকের ঋণ নেয় তাদের মধ্যেই ঋণ পরিশোধ না করার প্রবণতা বেশি। ঋণ খেলাপিদের বিষয়ে আমাদের অর্থমন্ত্রীও সংসদে বলেছেন। এদের কেউ কিন্তু সাধারণ কোনো খেটে খাওয়া মানুষ নয়। এরা সবাই সমাজের অভিজাত শ্রেণীর মানুষ হিসেবে পরিচিত। ঋণ গ্রহণের জন্য নানা কৌশলের আশ্রয় নেয় তারা। এরা ঋণখেলাপি হয়ে নিজেরা সম্পদ কুক্ষিগত করছে। আবার এরাই ব্যাংকেরও মালিক। ধনিক গোষ্ঠী যখন ভূমিদস্যু হয়ে পরিবেশ বিপন্ন করে, যখন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করার বদলে অবৈধভাবে বিদেশে পাচার করে সেখানে বিত্তবৈভব গড়ে তোলে, যখন শাসনব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে, যখন রাজনৈতিক সদিচ্ছায় প্রতিবন্ধতকা সৃষ্টি করে বা করার ক্ষমতা অর্জন করে তখন রাষ্ট্র অকার্যকর হয়ে যায়।

এমন ধনিক গোষ্ঠীর কারণেই পাকিস্তান আমলে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছিল। যেটা আজকেও দেখছি। বাংলাদেশে ধনী মানুষের প্রবৃদ্ধি বিশ্বে সর্বোচ্চ। এটা ব্রিটিশ সম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েলথএক্সের তথ্য। এটাও ঠিক যে, উন্নয়নের জন্য উদ্যোক্তা চাই। উন্নয়নের জন্য শ্রমিক, শ্রম ও পুঁজি থাকলেই চলবে না উদ্যোক্তাও থাকতে হবে। কিন্তু উদ্যোক্তাদের তো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তা না হলে এই উদ্যোক্তা গোষ্ঠী যে অর্থশোষক গোষ্ঠীতে পরিণত হতে পারে। এর উদাহরণ আজকে বাংলাদেশে আমরা দেখতে পাচ্ছি। সে কারণেই কথিত একটি গ্রুপের মালিকানার শরিক লোকজনের হাতে একটি ব্যাংকের এমডি অপদস্ত হওয়ার খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ঋণের জন্য তাকে নাকি প্রাণনাশের হুমকি পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। এই খবর প্রকাশের পরপর অভিযুক্তদের দেশ থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় পালিয়ে যাওয়ার খবরও আমরা দেখেছি। একটি ব্যাংকের এমডি যখন ভয়ভীতির শিকার হন তখন সেই ব্যাংক আর কাজ করতে পারে না। এর প্রভাব হয় সুদূরপ্রসারী।

অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি যে, এই ধনিক শ্রেণী চাটুকারিতায় ওস্তাদ। এরা চাটুকারিতায় অনেককে বশ করে ফেলতে পারে। আমি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনুরোধ জানাব, এসব চাটুকার থেকে দূরে থাকতে। জীবনের শেষ বেলায় আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। তাই অভিজ্ঞতার আলোকেই আমি কথাগুলো বলছি। সমাজকে গড়ে তুলতে হলে সুদৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকা চাই। এই ধনিকগোষ্ঠী সেই সদিচ্ছা বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আমি দৃঢ়তার সাথে বলব, এই বাধা দূর করতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রভাবিত হয় বলেই আমরা দেখি খুনের দায়ে দণ্ডিত ব্যক্তি ক্ষমা পেয়ে আবারো খুনের দায়ে অভিযুক্ত হয়। ওই খুনি ব্যক্তির বিশেষ রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। মানবিক কারণে ক্ষমা পাওয়া ও রাজনৈতিক কারণে ক্ষমা পাওয়া এক নয়। তা হলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে? তারা অসহায় হয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষ যখন ভাবতে শুরু করে সে ন্যায়বিচার পাবে না, তখনই রাষ্ট্র ভেঙে পড়ার সূচনা হয়।

আমাদের দেশে ক্যাসিনো সংস্কৃতির বিস্তার ঘটিয়েছে কারা? হাজার হাজার কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার করা হচ্ছে বলে খবর শুনছি। এর সঙ্গে কারা জড়িত? এরা কখনো কখনো রাজনীতিকের ছদ্মবেশ ধারণ করে অথবা রাজনীতিবিদদের প্রভাবিত করে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অকার্যকর করার অপচেষ্টা চালায়। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে দেশ আজ প্রধানমন্ত্রীর দিকেই তাকিয়ে আছে। দেশ পরিচালনা খুবই পিচ্ছিল একটি পথ। যেকোনো সময় পদস্খলন ঘটার আশঙ্কা থাকে। তাই প্রধানমন্ত্রীর সতর্ক হওয়া উচিত যেন এই মুজিব শতবর্ষে এসে দেশের শাসনব্যবস্থার ওপর থেকে জনগণের আস্থা উঠে যায় কেউ এমন কোনো কাজ করতে না পারে। আমরা এখন নতুন যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। সব কিছু নিয়ে আমাদের নতুনভাবে চিন্তাভাবনা করা দরকার। এখন সময় এসেছে দল-মত নির্বিশেষে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার। দেশে এখনো অনেক ভালো মানুষ রয়েছেন, যারা তাকে নিঃস্বার্থভাবে গঠনমূলক সুপরামর্শ দিতে পারেন। তাদের কথা শোনার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করব।

এই করোনা মহামারী আমাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজনীয়তা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এ সময় আমাদের সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা যদি প্রত্যেকে তার প্রতিবেশী দরিদ্র লোকজনের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেন, তাহলে সমাজে সৌহার্দ্যরে সুবাতাস বইবে। অথচ এমন দুর্যোগের সময়ও আমরা ত্রাণ, গরিবের সহায়তার সরকারি অর্থ আত্মসাতের খবর শুনি। আমাদের সমাজের নৈতিক অবক্ষয় কোন পর্যায়ে চলে গেছে।

পরিস্থিতির উত্তরণে দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতার ওপর জোর দেয়া উচিত। ‘আমি মানুষের কাছে দায়বদ্ধ’ এমন একটি জাতীয় স্লোগান বের করা উচিত। ধনিকরা যদি অন্তর থেকে বুঝতে পারে যে, দেশের খেটে খাওয়া মানুষের কাছে তার দায়বদ্ধতা আছে তাহলে খেলাপি সংস্কৃতির অবসান ঘটতে পারে।

লেখক : ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ।


আরো সংবাদ



premium cement