২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

করোনা, বাজেট ও বাংলাদেশের অর্থনীতি

করোনা, বাজেট ও বাংলাদেশের অর্থনীতি - সংগৃহীত

অব্যাহত করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির নজিরবিহীন সঙ্কটের মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রী এ এইচ এম মুস্তফা কামাল আগামী ১১ জুন জাতীয় সংসদে প্রায় পাঁচ লাখ ৬৬ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করতে যাচ্ছেন। সম্ভাব্য ওই বাজেট আগের অর্থবছরের মূল বাজেটের তুলনায় টাকার অঙ্কে সাড়ে ৭ শতাংশের মতো বড়। সাধারণভাবে, অর্থনীতির বিকাশ হার এবং মূল্যস্ফীতির সমন্বিত হারের সমপরিমাণ টাকার অঙ্কে বড় হলে বাজেট বরাদ্দ প্রকৃত অর্থে অপরিবর্তিত রয়েছে বলে মনে করা হয়। এই হিসাবে অন্তত ১২ শতাংশের মতো বরাদ্দ বাড়লে বাজেটকে জিডিপির হার অনুযায়ী অপরিবর্তিত বলে ধরে নেয়া যেত। সেই হিসাবে এবারের বাজেট সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। আর বাজেটের প্রকৃত বাস্তবায়ন হিসাব করা হলে এই সঙ্কোচনের হার হবে আরো বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটেরও ১১ শতাংশের কাছাকাছি অবাস্তবায়িত থেকে যায়। এবার এই অবাস্তবায়নের হার আরো বেড়ে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

‘কোভিড-১৯’ ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন এক সঙ্কটময় অবস্থায় উপনীত হয়েছে। মহামারীটি জাতীয় বাজেট বাস্তবায়নের পাশাপাশি নিম্ন আয়ের মানুষকে অস্বাভাবিকভাবে প্রভাবিত করেছে। দেশের প্রায় ১০ কোটি ২২ লাখ মানুষ অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত দুর্বলতার ঝুঁকিতে রয়েছে। দেশের প্রায় ৭৪ শতাংশ পরিবারের উপার্জন কমে গেছে। ১৪ লাখেরও বেশি প্রবাসী শ্রমিক চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন বা আসছেন। দেশের প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ এখন চরম দরিদ্র অবস্থায় উপনীত, যাদের দৈনিক আয় মাত্র ১ দশমিক ৯ ডলার।
বাংলাদেশের অর্থনীতি যেসব মৌল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তার প্রায় সব কটিই করোনা পরিস্থিতির কারণে আক্রান্ত হয়েছে।

ভয়ঙ্কর রাজস্ব সঙ্কটে অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা
রাজস্ব আয় রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান অবলম্বন। করোনার ফলে ২০১৯-২০ অর্থবছরের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির থাকায়, স্বাধীনতার পর এই প্রথমবারের মতো টাকার চলতি মূল্যেই রাজস্ব আদায়ে ‘নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি’ হচ্ছে। এ সময়ে বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল তার চেয়ে দেড় লাখ কোটি টাকা
কম রাজস্ব আদায় হবে। আগের অর্থবছরের মূল লক্ষ্যমাত্রা
তিন লাখ ৭৭ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতে, সম্ভাব্য আদায় হতে পারে দুই লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা।

অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আট মাসে মোট লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ রাজস্ব আদায় হয়েছে। বাকি চার মাসে বড়জোর আর ৭০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হতে পারে। তবে সরকার চোখ বন্ধ করে তিন লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সংশোধিত বাজেটে। এ ধরনের অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে মূল বাজেটের ১৯ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা শেষ পর্যন্ত ৫০ শতাংশ রাজস্ব প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রায় উন্নীত হয়েছে।

জুন থেকে সরকারি আফিস-আদালত উন্মুক্ত করা হলেও অর্থনীতির এই মন্দার ধারা ২০২০ সালের বাকি সময়ে অব্যাহত থাকতে পারে। এর ফলে নতুন অর্থবছরে রাজস্ব আয় বাস্তবভিত্তিক রাখতে হলে আগের অর্থবছরের চেয়ে লক্ষ্যমাত্রা কম নির্ধারণ করারই কথা। কিন্তু এরই মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) প্রায় অবাস্তব, তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে (চলতি সালের লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা) ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট প্রণীত হচ্ছে। তবে খোদ এনবিআরই বলছে, রাজস্বের এ লক্ষ্যমাত্রা কোনোভাবেই অর্জন সম্ভব নয়। প্রশ্ন হলো, এনবিআর ভ্যাট আদায় বাড়াবে কিভাবে যেখানে ব্যবসায়-বাণিজ্য কার্যত অচল? আমদানি-রফতানিতেও ধস, তাই শুল্কও বাড়বে না। এতে অতিরিক্ত রাজস্বের চাপে হয়রানিতে পড়বেন করদাতারা। রাজস্ব কর্মকর্তাদের ধারণা, চলতি অর্থবছর শেষে রাজস্ব আদায় গত অর্থবছরের চেয়ে কমবে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। এ অনুমান সত্য হলে দেশের ইতিহাসে এবারই প্রথম আগের অর্থবছরের তুলনায় কম রাজস্ব আহরণ হবে। রাজস্ব আহরণে অতিরিক্ত লক্ষ্যমাত্রা দেয়ার পর তা অর্জন সম্ভব না হলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সমস্যা সৃষ্টি হয়।

সরকার কত টাকা ব্যয় করবে, তা ধরেই মূলত বাজেট প্রণয়ন করা হয়। ব্যয়ের বাজেট ঠিক করেই সরকার আয়ের বাজেট করে থাকে। এর ফলে ব্যয়ের বাজেট বড় হওয়ায় হিসাব মেলাতে রাজস্ব আহরণের টার্গেটও বড় হয়। এটি ঠিক, ‘সরকারের ব্যয় মানেই অর্থনীতির আয়’। কিন্তু সে জন্য টাকার সংস্থান আছে কি না, তা না দেখে ব্যয়ের বাজেট বাড়ানো হলে দেখা দেয় বিপত্তি। এনবিআরকে একটি অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা দেয়ার পর তারা তা অর্জন করতে না পারলে ব্যয় মেটাতে সরকারকে দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিতে হবে। অতিরিক্ত সেই ঋণের বোঝা বহন করতে হবে জনগণকে। এভাবে দিন দিন জাতির ঘাড়ে বেড়ে যাচ্ছে ঋণের মাত্রা।

অর্থনীতির সঙ্কোচনের ফাঁদ
বাংলাদেশের অর্থনীতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৭-৮ শতাংশ হারে বিকশিত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির এই হার বাস্তবে অর্জিত হয়েছে কি না তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অর্থনীতির ভিত্তি এই সময়ে বিস্তৃত হয়েছে। এই বছর (২০১৯-২০) ৮ দশমিক ৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আইএমএফÑ বিশ্বব্যাংক মাত্র ২ শতাংশ আর সরকার ৫ শতাংশ; প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে প্রাক্কলন করছে। বাস্তব অবস্থায় দেখা যাচ্ছে, দেশের মানুষের স্বদেশ ও প্রবাস দুই ধরনের আয়ই কমে যাচ্ছে। দেশের সব স্তরের মানুষের ব্যক্তিগত আয় এবং জাতীয় আয় দুই ক্ষেত্রেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক, ডেটা সেন্স এও উন্নয়ন সমন্বয়ের এক যৌথ সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, দেশে অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাঁচ কোটি ৩৬ লাখ মানুষ চরম দরিদ্র (দৈনিক আয় ১.৯ ডলার)। তাদের মধ্যে নতুন করে চরম দরিদ্র হয়ে পড়া পরিবারগুলোও রয়েছে। উচ্চ অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে থাকা চরম দরিদ্রের সংখ্যা চার কোটি ৭৩ লাখ এবং উচ্চ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে তিন কোটি ৬৩ লাখ মানুষ। এই জরিপে দেখা গেছে, ‘কোভিড-১৯’-এর কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর বহুবিধ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যেসব পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, এর মধ্যে ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ পরিবারের কমপক্ষে একজন সদস্য চাকরি হারিয়েছেন। মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে গড় পারিবারিক উপার্জন প্রায় ৭৪ শতাংশ কমে গেছে। দিনমজুরসহ অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরতরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। উৎপাদন খাতেও বড় ধাক্কা লেগেছে। তৈরী পোশাক খাতে রফতানি এপ্রিল ২০১৯-এর তুলনায় ২০২০ সালের এপ্রিলে ৮৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এ বছর মার্চের মাঝামাঝি থেকে ৭ এপ্রিলের মধ্যে ১১১৬টি কারখানা বন্ধ ঘোষিত হয়েছে এবং চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ২২ লাখ শ্রমিক।

বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের বড় অংশ হয় দেশের অভ্যন্তরে কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে। এর মধ্যে কৃষি ছাড়া বাকি দুই খাতে কর্মসংস্থানে বড় ধরনের সঙ্কট দেখা দিতে পারে। শিল্পের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোও বড় ধরনের চাপে রয়েছে। ব্যবসায়-বাণিজ্য হোটেল-রেস্তোরাঁ এবং নির্মাণ খাতের অবস্থাও বেশ নাজুক। সার্বিকভাবে কর্মসংস্থানে বড় ধরনের সঙ্কট তৈরি হতে পারে। এই বাস্তবতার সাথে সরকারের সাড়ে ৫ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের আশাবাদের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং বাংলাদেশের অর্থনীতি এবার সঙ্কুচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বৈদেশিক খাতে বিপর্যয় : রফতানি-রেমিট্যান্সে স্থবিরতা
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী হওয়ার কারণে, বিশেষত বাংলাদেশের রফতানি পণ্যের বাজার ইউরোপ ও আমেরিকা এর প্রধান শিকার হওয়ার ফলে রফতানি চাহিদা সেসব দেশে বিশেষভাবে কমে গেছে। এ কারণে এবার বাংলাদেশের রফতানি আয়ে বড় ধরনের ‘নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি’ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসে রফতানি আয়ে পৌনে ১২ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অর্থবছর শেষে এটি ২০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে। রফতানি খাতের দুরবস্থার প্রভাব আমদানিপণ্যের চাহিদা এবং কর্মসংস্থান, দুটোর ওপরই পড়ছে। আট মাসে ৪ শতাংশের কাছাকাছি আমদানি কমে গেছে আগের বছরের তুলনায়। বছর শেষে আমদানির এই ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছতে পারে।

অর্থবছরের শুরু থেকে অর্থনীতির নানা দিকে দুরবস্থার মধ্যেও প্রবাস আয়ে কিছুটা আশার আলো দেখা গিয়েছিল। করোনা মহামারী সেই আলো নিভিয়ে দিয়েছে। মার্চ থেকে প্রতি মাসে বড় হারের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির কারণে অর্থবছর শেষে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি ২০ শতাংশ থেকে কমে শূন্যের কোটায় নেমে আসতে পারে। এপ্রিলে ২৪ শতাংশ এবং মে মাসে ১৪ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে রেমিট্যান্সে। প্রবাস আয় করোনার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশের বিদেশ কর্মসংস্থানের প্রধান ক্ষেত্র হলো মধ্যপ্রাচ্য। সেখানে করোনা সংক্রমণ এবং জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা নেমে এসেছে। এর ফলে বেশির ভাগ দেশই বিদেশী শ্রমিক ও জনবলকে দেশে পাঠিয়ে দেয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের এক কোটির বেশি প্রবাসীর একটি অংশ এর মধ্যে দেশে চলে এসেছে। আরেকটি বড় অংশকে ফিরে আসতে হতে পারে। ফলে রেমিট্যান্স আয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বড় রকমের চাপে পড়তে হতে পারে। রফতানি ও রেমিট্যান্স হ্রাসের প্রভাব পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের ভারসাম্যে।

ঋণনির্ভরতা ও জীবনযাত্রার ব্যয় স্ফীতি
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা এবং সরকারের রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার কারণে করোনাজনিত প্রণোদনা এবং সরকারি প্রশাসনযন্ত্রের বেতন-ভাতার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ তথা নতুন টাকা ছাপানোর প্রবণতা বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, সরকার ইতোমধ্যে ১৮ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট ছাপিয়েছে। আর গণমাধ্যমের খবর অনুসারে, ৭৩ হাজার কোটি টাকার নতুন প্রণোদনা প্যাকেজের সমপরিমাণ নতুন নোট ছাপার কথা ভাবা হচ্ছে। এর প্রভাব পড়বে টাকার বিনিময় হারের ওপর।

করোনা পরিস্থিতিতে সরকার কতটা বিদেশী সাহায্য আকর্ষণ করতে পারে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে বাজেট ঘাটতি পূরণে অভ্যন্তরীণ উৎসের পুরোটাই ব্যাংকনির্ভর হয়ে যাচ্ছে। আগের অর্থবছরে যেখানে প্রায় ৪৮ হাজার কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করা হয়েছিল, এবার তা সাত মাসে নেমে এসেছে মাত্র সাড়ে সাত হাজার ৬৭৩ কোটি টাকায়। অন্য দিকে, ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ গ্রহণে বাজেটের মূল লক্ষ্যমাত্রা ৪৭ হাজার কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৩ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। এভাবে ব্যাংক ব্যবস্থার তহবিল সরকারের ঋণ গ্রহণে চলে গেলে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রাপ্তি সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে। এর প্রভাব পড়বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর। আর মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি, তথা টাকার অঙ্কে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে।

সামাজিক নিরাপত্তা জাল ও মৃত্যু ঠেকানোর চেষ্টা
করোনাভাইরাসের বড় চ্যালেঞ্জ হলো মহামারীর মৃত্যু ঠেকানো এবং ক্ষুধা ও অনাহার থেকে হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা। সরকার এবং নিরাপত্তা সংস্থাগুলো এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করছে। এর পাশাপাশি, রমজানে দেশের অবস্থাপন্ন মানুষের জাকাত ও আন্যান্য দান অনুদানে দরিদ্রদের দুঃখ-দুর্দশা কিছুটা লাঘব হয়েছে। সামনে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে সম্পদের প্রবাহে ঘাটতি দেখা দিলে পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, সরকারের অনুসৃত নীতির ত্রুটি ও অসংলগ্নতা দূর করা। দেশে করোনার বিস্তার যখন উচ্চ হারে ঘটছে তখনই লকডাউন খুলে দেয়া হয়েছে। এর ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্ত আর মৃত্যু সংখ্যা। অন্য দিকে, জনগণের কাছে ত্রাণ সাহায্য পৌঁছানোর ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও চুরির ঘটনা বেড়েই চলেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ত্রাণ বিতরণ যেখানে প্রশ্নের ঊর্র্ধ্বে দেখা যাচ্ছে, সেখানে সরকারি দল ও জনপ্রতিনিধিদের ত্রাণ বিতরণে পক্ষপাতিত্ব ও চুরির খবর আসছে অব্যাহতভাবে। এ বিষয়টি প্রতিরোধ করতে না পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হতে পারে।

কী করতে পারে সরকার
ত্রাণ বিতরণ : অনুদান ও প্রণোদনার অর্থ সঠিক স্থানে পৌঁছানোর নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে সরকারকে। জনগণের দুর্দশা লাঘবে রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এর পরও যে সম্পদ সামাজিক নিরাপত্তা জাল এবং প্রণোদনা খাতে ব্যয় করা হচ্ছে তার সদ্ব্যবহার জরুরি। এ ক্ষেত্রে দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের অনুদানের অর্থ নিরাপত্তা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিতরণ করা যেতে পারে। প্রণোদনার অন্যান্য অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা বজায় রাখা প্রয়োজন।
আত্মকর্মসংস্থান : করোনাসৃষ্ট পরিস্থিতিতে সারা দেশে আত্মকর্মসংস্থানের প্রতি জোর দিতে হবে। এ জন্য সামাজিক পুঁজি গঠনে স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠনগুলোর উদ্যোগকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। ব্যাংকগুলোকে গ্রামমুখী ক্ষুদ্র উদ্যোগে অর্র্থায়ন বা বিনিয়োগে উৎসাহিত করা যেতে পারে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করতে রাষ্ট্রীয় বিধিনিষেধ শিথিল করা প্রয়োজন।

রাজস্ব আদায়ে গুণগত সংস্কার : রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের গুণগত সংস্কার ছাড়া অর্থনীতিকে আয় স্থবিরতার খাদ থেকে উদ্ধার করা কঠিন। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, আসন্ন ২০২০-২১ অর্থবছরে রাজস্ব বাড়াতে চারটি কৌশল গ্রহণ করেছে সরকার। এগুলো হলো- আয়কর প্রদানকারীর সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ, প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিশেষ প্রণোদনা প্রদান এবং কাস্টমস ও বন্ডেড ওয়্যারহাউজের সব কার্যক্রম অটোমেশনের আওতায় আনা। এ ছাড়া ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের নিমিত্তে দ্রুত ও ব্যাপক ভিত্তিতে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) যন্ত্র ক্রয়, স্থাপন ও কার্যকর করার কথা বলা হচ্ছে। সরকারের এসব কৌশল একেবারে গতানুগতিক।

রাজস্ব আদায়ে স্থবিরতা দূর করতে হলে উন্নয়ন ও সামাজিক অর্থব্যয়কে রাজস্ব আহরণের সাথে যুক্ত করা যেতে পারে। এ ধরনের ব্যয়কে রাজস্ব আহরণের সাথে সংযুক্ত করা গেলে এটি সামাজিক উন্নয়ন এবং রাজস্ব আহরণ দুটোকেই চাঙ্গা করবে। বিষয়টা এ রকম হতে পারে। যেমন সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য এক হাজার কোটি টাকা প্রদান করে থাকে প্রতি বছর। অন্য দিকে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান সরকারকে ৭০০ কোটি টাকা রাজস্ব দেয়। এই পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে বলা হলো, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাজার কোটি টাকার চাহিদা পূরণ করবে। আর এটাকে সরকারের তাদের রাজস্ব প্রাপ্তি হিসাবে গ্রহণ ও সমন্বয় করা হবে। সরকার এই আয় ও ব্যয়- দুটোকেই বাজেটে হিসাব করবে। কোনো সড়ক বা রাস্তার উন্নয়নকেও এভাবে রাজস্ব আদায়ের সাথে সংযুক্ত করা যেতে পারে। এতে করদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান জনগণ সরাসরি জানতে পারবে। আর বাড়তি কর দিতে করপোরেট বা শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো আগ্রহ বোধ করবে। যেমন- বসুন্ধরা গ্রুপকে যদি বলা হয়, তারা করের অর্র্থ দিয়ে ঢাকায় একটি ফ্লাইওভার তৈরি করে দেবে। এতে তারা স্বাভাবিক করের চেয়ে ৫০ ভাগ বেশি অর্থ খরচ করতে দ্বিধা করবে না। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর করের অর্থ সরাসরি এ ধরনের সামাজিক ও উন্নয়ন খাতে ব্যয় করা হলে তারা অধিক কর দিতে উৎসাহিত হবে। একই সাথে কার্যকর রাজস্ব আহরণ বাড়বে। এই ব্যবস্থা তৃণমূলের স্বাস্থ্য ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য করা যেতে পারে।

প্রবাসে কর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ : বিদেশ থেকে দেশে ফিরে আসা প্রবাসীদের দক্ষতা অনুসারে আত্মকর্মসংস্থানের জন্য প্রশিক্ষণ ও পুঁজির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। একই সাথে করোনা-উত্তর সময়ে বিদেশের বাজারে চাহিদাকে সামনে রেখে যুবকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং তাদের বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশের করোনাজনিত সঙ্কট কত দূর এবং কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সে সম্পর্কে অনুমান করা কঠিন। তবে এই সঙ্কট অর্র্থনীতির ওপর যতটা ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করা হয়েছিল, তার চেয়ে প্রভাব অনেক গভীর হবে। শুধু সরকার নয়, পুরো দেশের মানুষকে এর প্রভাব কাটাতে সক্রিয় করতে না পারলে এই সঙ্কট উত্তরণ কঠিন হতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারের উদার ও সমন্বয়ের নীতি গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই।

mrkmmb@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement