২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনার মাঝেও ভারতে ঘরওয়াপসির তাণ্ডব

করোনার মাঝেও ভারতে ঘরওয়াপসির তাণ্ডব - নয়া দিগন্ত

কোনো অহিন্দু ধর্মান্তরিত হয়ে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করতে পারে না। তবে ভারতে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর অন্য ধর্মাবলম্বীদের হিন্দু ধর্মভুক্ত করার একটি নয়া ফন্দি উদ্ভাবন করে। বিজেপির উগ্রপন্থী হিন্দুরা সে দেশের বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু ও খ্রিষ্টান পরিবারের লোকদের জোর করে হিন্দু ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করে। এরা বলে, এসব পরিবারের লোকজন একসময় হিন্দু ছিল, তাই তাদের এখন আবার হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে। অন্য কোনো ধর্মের লোকদের এরা হিন্দু বানাচ্ছে না। আর কোনো অহিন্দুকে হিন্দু ধর্মে ধর্মভুক্ত করার কোনো সুযোগও নেই। এরা বলছে, খ্রিষ্টান ও মুসলমানরা বিভিন্ন সময়ে যেসব হিন্দুকে জোর করে খ্রিষ্টান ও মুসলমান বানিয়েছিল, শুধু তাদের এখন হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এ কাজটিকেই এরা নাম দিয়েছে ঘরওয়াপসি বা ঘরে ফেরা। এরা ঘরওয়াপসি অনুষ্ঠান আয়োজন করে জোর করে মুসলমানদের কিংবা খ্রিষ্টানদের হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করে। বিজেপি সর্বশেষ ক্ষমতায় আসার পরপরই এই তথাকথিত ঘরওয়াপসি তৎপরতা শুরু করে। ঘরওয়াপসির কথা বলে ভারতের খ্রিষ্টান ও মুসলমান পরিবারগুলোকে জোর করে হিন্দু ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করার বিষয়টি ভারতে ও ভারতের বাইরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়লে, এর তীব্রতা কিছুটা কমে আসে। কিন্তু সম্প্রতি করোনা মহামারীর এ সঙ্কট সময়েও ঘরওয়াপসির তাণ্ডব ঘটে চলেছে বলে গণমাধ্যমে খবর আসছে।

গত ৩ মে ভারতের ঝাড়খন্ডের একটি গ্রামে একটি খ্রিষ্টান পরিবারের লোকদের ঘরওয়াপসির মাধ্যমে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করা হয়। পরিবারটি চার বছর আগে খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। সেই থেকে পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে খ্রিষ্টধর্ম আচার-অনুষ্ঠান পালন করে আসছিল। স্থানীয় যাজক মনোজ তাদের ধর্মগুরু ও এ পরিবারের বন্ধুজন। তিনি এ ঘটনার কথা জানিয়েছেন ‘পারসিকিউশন রিলিফ’ নামের সংগঠনকে। এ সংগঠনটি ভারতে নির্যাতিত খ্রিষ্টানদের সহায়তা দিয়ে থাকে। এই যাজক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, একদল যুবক নিয়মিত এই খ্রিষ্টান পরিবারের সাথে দেখা করত। এরা হঠাৎ করে তাদের নানাভাবে অপমানিত করতে শুরু করে। এক দিন ওই গোঁড়া হিন্দু যুবকরা বিকেলের দিকে ওই বাড়িতে গিয়ে তাদের খ্রিষ্টধর্ম পরিত্যাগ করতে বলে। তারা তা করতে অস্বীকার করলে তাদের নির্দয়ভাবে মারধর শুরু করে। এরপর ওই যুবকরা এক ঘরওয়াপসি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এবং তাদের করুণ পরিণতির হুমকি দিয়ে এই অনুষ্ঠানে যেতে বাধ্য করে।

করোনাভাইরাসের লকডাউন পরিস্থিতিতে পরিবারটি মারাত্মক অর্থকষ্টের মধ্য দিয়ে জীবনযাপন করছিল। এর মধ্যে ওই যুবকরা তাদের বলে, খ্রিষ্টধর্ম ত্যাগ করে হিন্দু ধর্মে ফিরে না এলে তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করা হবে। এ অবস্থায় পরিবারটির কাছে অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। যুবকদের চাপে ওই পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কের মধ্যে ঘরওয়াপসি অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। কারণ তখন তারা মনে করেছিল, তাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আরো ১৫টির মতো খ্রিষ্টান পরিবার এ গ্রামে বসবাস করে। ঘটনার শিকার পরিবারটির অবস্থা দেখে এসব পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কের মধ্যে ঘরবন্দী অবস্থায় রয়েছে।

পারসিকিউটেড রিলিফ নামের সংগঠনটি যাজক মনোজের মাধ্যমে ঘটনাটি জানতে পারে। কোনো ধরনের দেরি না করেই এই সংগঠন পুলিশ সুপারের সাথে দেখা করে পরিবারটিকে সহায়তা করতে অনুরোধ জানায়। স্বল্প সময়ের মধ্যেই পুলিশ কর্মকর্তাদের একটি টিম ওই গ্রামে যায়। সংশ্লিষ্ট পরিবারের সদস্যরা ওই যুবকদের বিরুদ্ধে জোর করে নানা ধনের হুমকির মুখে ধর্মান্তরিত করার অভিযোগ করে। পুলিশ কর্মকর্তারা ওই যুবকদের হামলার ব্যাপারে নিশ্চিত হন এবং তাদেরকে সতর্ক করে দেনÑ ওই পরিবারকে আর কোনো ধরনের হয়রানি যেন না করা হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা ওই যুবকদের বলেন, ‘ধর্ম ও ধর্মবিশ্বাস যার যার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের বিষয়। তোমরা সে সিদ্ধান্ত কারো ওপর চাপিয়ে দিতে পারো না।’

যাজক মনোজের চার্চ এবং এই গ্রামের খ্রিষ্টান পরিবারগুলো তাদের ধর্ম বিশ্বাসের কারণে প্রায়ই নানা ধরনের হয়রানির শিকার হয়। এর ফলে এসব পরিবারের লোকজন নানা ধরনের অনিশ্চয়তা ও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। অনেক খ্রিষ্টান পরিবারের সদস্যরা ভয়ে গির্জায় যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, হামলার শিকার হওয়ার আশঙ্কায়। এসব পরিবারের বেশির ভাগই গরিব ও নিরক্ষর কিংবা স্বল্পশিক্ষিত। এরা বাইবেল পড়তে জানে না। ফলে এরা সমাজের সহজ চাপের শিকারে পরিণত হয়। পারসিকিউশন রিলিফ একটি ঘটনার কথা জানায়Ñ এ ঘটনার শিকারও ওই গ্রামের একই খ্রিষ্টান পরিবার। ওই পরিবারটিকে এর আগেও বেশ কয়েকবার ধর্মত্যাগ করে হিন্দু ধর্ম গ্রহণের জন্য হুমকি দেয় হয়, নানাভাবে হয়রানি করা হয়। যখন পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যায়, তখন গত ২৮ এপ্রিল এ ঘটনা পোস্ট দেয়া হয়। একটি ঘটনায় জানা যায়, ঝাড়খন্ডে ১৬টি খ্রিষ্টান পরিবারকে হুমকি দেয়া হচ্ছে খ্রিষ্টান ধর্ম ত্যাগ করে হিন্দু ধর্ম গ্রহণের জন্য। উগ্রপন্থী হিন্দুরা তাদের হুমকি দিচ্ছে, তা না হলে এসব পরিবারকে সামাজিকভাবে বয়কট করা হবে।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ ও সংস্কৃতি নির্বিশেষে বিশ্বজুড়ে মানবসমাজ যখন করোনাভাইরাসের দাপট মোকাবেলা করছে, তখন ভারতের উগ্রবাদী হিন্দুরা জারি রেখেছে তাদের ঘরওয়াপসির তাণ্ডব। ৯ মে যখন এই লেখা লিখছি তখন ১৮৭টি দেশে চলছে করোনার শাসন। এ পর্যন্ত করোনা সংক্রমণের শিকার বিশ্বের ৪১ লাখেরও বেশি মানুষ। মারা গেছে পৌনে তিন লাখের বেশি। সংক্রমণের শিকার আরো লাখ লাখ মানুষ। তাই এটি এমন একটি সময়, যখন গোটা বিশ্বের মানুষের পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহাযোগিতা সবচেয়ে বেশি দরকার। কিন্তু সেখানে ঘরওয়াপসির মতো একটি অমানবিক তৎপরতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে ভারতের উগ্রবাদী হিন্দুরা। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, এ ধরনের কর্মকাণ্ড মাঝে মধ্যেই চলছে ক্ষমতাসীন দলের উসকানি আর ইশারা-ইঙ্গিতে।

যাজক মনোজ বাস করেন উত্তর ভারতের ঝাড়খন্ডের পালামো জেলার একটি গ্রামে। ২০০৭ সাল থেকে একটি গির্জায় নিয়োজিত রয়েছেন। তিনি তার গির্জার আশপাশের অনেক মানুষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি যে চার্চটি দেখাশোনা করেন, সম্প্রতি এর নিজস্ব ভবন নির্মাণ করেছে। এ ভবনেই আশপাশের খ্রিষ্টানরা সমবেত হন প্রার্থনার জন্য। আশপাশের গ্রামের খ্রিষ্টানরা জীবনের কঠিন সংগ্রামের মধ্যেও এই গির্জার মাধ্যমে এক ধরনের প্রশান্তি খুঁজে পায়। 
যাজক মনোজ সম্প্রতি কথা বলেছেন ‘পারসিকিউশন রিলিফ’-এর সাথে। তিনি তার এলাকার খ্রিষ্টানরা যেসব সমস্যা মোকাবেলা করেন, সে সম্পর্কে এ সংগঠনকে অবহিত করেন। এই গির্জায় আসেন এমন ১৬টি খ্রিষ্টান পরিবার বসবাস করে তার বসবাসের গ্রাম থেকে দুই কিলোমিটার দূরের এক গ্রামে। ওই গ্রামে ৪০০ লোক রয়েছে। এর মধ্যে ১০০ জন এই ১৬ খ্রিষ্টান পরিবারের। কয়েক সপ্তাহ ধরে কিছু লোক বাড়িতে গিয়ে এসব খ্রিষ্টান পরিবারের সদস্যদের হুমকি দিতে শুরু করে, খ্রিষ্টান ধর্ম ত্যাগ না করলে তাদের মারধর করবে। তা না হলে তারা গির্জা আক্রমণের হুমকিও দেয়। এরা ২৫-৩০ জনের একটি গ্রুপ তৈরি করে খ্রিষ্টানদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে গোয়েন্দা তৎপরতাও চালায়। কাউকে একা পেলে, তাকে তুলে নিয়ে নানা হুমকি দেয়। এরা এসব পরিবারের লোকদের ভয়াবহ পরিণতির কথাও জানায়। পাশের নদী, লেক ও কূপের পানি বন্ধ করে দেয়াসহ কৃষিকাজে বাধা দেয়ার কথাও বলে। সর্বোপরি তারা গ্রামের সব কাজে সামাজিক বয়কটের হুমকিও দেয়। এমনই অবস্থায় যাজক মনোজ নিজেও অসহায় বোধ করছেন। এর মাঝে দেশব্যাপী লকডাউনের কারণে তার স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পারসিকিউশন রিলিফও এসব পরিবারে তাদের নিত্যপণ্য সরবরাহ করে এদের সহায়তা করতে পারছে না।

২০২০ সালের প্রথম তিন মাসে ঝাড়খণ্ডে খ্রিষ্টানদের বিরুদ্ধে সাতটি হেইট ক্রাইম এবং সারা ভারতে ৭১টি হয়রানি, হুমকির ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে পারসিকিউশন রিলিফ খ্রিষ্টানবিরোধী এক হাজার ৯৬১টি হেইট ক্রাইমের রেকর্ড করেছে। ২০১৯ সালে এ ধরনের অপরাধ সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। এ বছরটিতে ঘটেছে এমন ৫২৭টি। ২০১৮ সালে ৪৪৭টি ও ২০১৭ সালে ৪৪০টি এবং ২০১৬ সালে ৩৩০টি। ২০১৯ সালে হুমকি প্রদান, কাজে বাধা দেয়া, হয়রানি করা, গির্জায় হামলা, শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ১০৪টি। এর মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনাও রয়েছে। শত শত হাউজ চার্চ জোর করে বন্ধ করে দিয়েছে এই গোঁড়া হিন্দুরা। শহর এলাকার মানুষ জানেও না, গ্রাম এলাকায় এসব কী ঘটছে! গ্রাম এলাকায় ভারতে যিশুখ্রিষ্টের প্রশংসা করা ও তার প্রার্থনা করা এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক খ্রিষ্টান পরিবার গির্জায় যেতে না পেরে ঘরে বসে প্রার্থনা করছে।

২০০৪ সাল থেকেই ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম (ইউএসআইআরএফ) ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রশ্নে বাজে রেটিং দিয়ে আসছে। ২০২০ সালেও এর রেটিং একই ধরনের। এই কমিশনের সুপারিশ হচ্ছেÑ যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর ভারতকে অভিহিত করেছে : ‘কান্ট্রি অব পার্টিকুলার কনসার্ন’ বা সিপিসি হিসেবে। বিগত সাত বছর সময়ে দেশটির অবস্থান ‘ওপেন ডোর’স ওয়ার্ল্ড ওয়াচ লিস্টে ৩১তম স্থান থেকে উঠে এসেছে দশম স্থানে। বলা হচ্ছে, দেশটিতে ধর্মীয় স্বাধীনতা ভয়ঙ্করভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে।

ধর্মের ব্যাপারে জোর-জবরদস্তি কোনো ধর্মেই স্বীকৃত নয়। কোনো আন্তর্জাতিক আইনেও এর স্বীকৃতি নেই। ভারতের সংবিধানও ধর্মের ব্যাপারে জোর-জবরদস্তি স্বীকার করে না। এর পরও ভারতের মতো একটি গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশে ঘরওয়াপসির নামে যে জোর-জবরদস্তির ঘটনা ঘটছে, তা সত্যিই বিস্ময়কর। শুধু খ্রিষ্টান সমাজই নয়, মুসলমানরাও ওই ঘরওয়াপসির শিকার যে হয়েছেন এবং হচ্ছেন, তা ভারতীয় গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিশ্বের মানুষ জেনেছে। ভারতের ও বিশ্বের বিবেকবান মানুষ বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন।

ওই সব বিবেকবান মানুষের সাথে আমরাও চাই অবিলম্বে ঘরওয়াপসির এই তাণ্ডব বন্ধ করে দেশটির সরকার অবিলম্বে প্রতিটি নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে।হ

 


আরো সংবাদ



premium cement