২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ইসলামী মূল্যবোধ ৩

ইসলামী মূল্যবোধ - নয়া দিগন্ত

আমরা আগেই বলেছি, ইসলামী ব্যবস্থার প্রধান দিক তিনটি : আকিদা বা বিশ্বাস, আইন এবং আখলাখ বা আচরণ। আচরণ গড়ে ওঠে ব্যক্তি এবং সমাজের মূল্যবোধের ওপর। এটা যেকোনো আদর্শের প্রকাশ্য দিক এবং এর মাধ্যমেই একটি জাতিকে চেনা যায়। আকিদা প্রকাশ্য দিক নয়, তবে আইন প্রকাশ্য দিক।
এই সিরিজে আমি এর আগে আরও দু’টি পর্ব লিখেছি এবং এখন তৃতীয় পর্ব লিখছি।

১. দৃষ্টিমানেরা বিচার বিশ্লেষণ করে চলুন (ফাআতাবেরু ইয়া উলিল আবছার) (সূরা হাশর আয়াত নং-০২) এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবোধ। এই সূরাতে ইয়াহুদি গোত্র বনোনজির-এর সঙ্গে সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে মদিনা ত্যাগ করে যাওয়ার প্রেক্ষিতে এই সূরা নাজিল হয়। এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, দৃশ্যত বনোনজির-এর মদিনা ত্যাগের কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তায়ালা এমন ব্যবস্থা করলেন যে, তারা মদিনা ত্যাগ করে চলে গেলেন এবং এ জন্য রাসূলকে সা: যুদ্ধ করতে হলো না। এই প্রেক্ষিতেই বলা হয়েছে যে, (ফাআতাবেরু ইয়া উলিল আবছার) অর্থাৎ বনোনজির-এর সাথে যে ঘটনা ঘটল সেই ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করতে আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে আহ্বান জানালেন।

সব ঘটনা যা আমাদের জীবনে ঘটে তা ভালো করে বিশ্লেষণ করা ইসলামের একটি মূল্যবোধ, যা আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে শিখিয়েছেন। বিশ্লেষণ না করে কাজ করা ঠিক না। আবেগি বিশ্লেষণও ঠিক না। বিশ্লেষণ হতে হবে যথার্থ ও সঠিক।

ইসলামী ফিকাহ শাস্ত্রে একটি প্রধান উৎস হচ্ছে ইজতেহাদ। কুরআন ও সুন্নাহর পর এটাই ইসলামী আইনের অন্যতম উৎস। ইজতেহাদের পক্ষে দলিল উপস্থাপন করেছেন ফিকাহবিদরা। সেই প্রসঙ্গে কুরআন থেকে তারা সূরা হাশরের এই আয়াত অংশ সমর্থন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ (ফাআতাবেরু ইয়া উলিল আবছার) ইজতেহাদের পক্ষে দলিল। ইজতেহাদের বিভিন্ন রূপ হচ্ছে কিয়াস, ইসতিহছান, ইসতিইছলা, ইসতিসাব প্রভৃতি।

২. যেন তোমাদের অর্থসম্পদ কেবল ধনীদের মধ্যে ঘোরাফেরা না করে (লায়া কুনা দুলাতান বাইনাল আগনিয়ামে মিনকুম) (সূরা আল হাশর আয়াত নং-৭) এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলছেন যে, যে সম্পদ আল্লাহ তায়ালা বনোনজির থেকে উঠিয়ে নিয়ে রাসূলকে দান করেছেন তার জন্য তাকে কোনো যুদ্ধ করতে হয়নি। বিনা যুদ্ধেই এই সম্পদ রাসূলের হস্তগত হয়েছে। এই সম্পদ বণ্টন হবে আল্লাহ তায়ালার জন্য, রাসূলের জন্য, রাসূলের নিকট আত্মীয়দের জন্য, এতিমদের জন্য, মিসকিনদের জন্য এবং পথের লোকদের জন্য। এর পরপরই বলা হয়েছে এই বিস্তৃত বিভাগের প্রয়োজন হয়েছে এ জন্য যে ধনসম্পদ কেবল বড়লোকদের হাতেই ঘোরাফেরা না করে। আল্লাহ তায়ালার জন্য অর্থ দেশের বা রাষ্ট্রের সব প্রয়োজনের জন্য এবং সব অসহায়দের জন্য অর্থ ব্যয় করা। এটি আল্লাহর জন্য বলা হলেও এটি আসলে ব্যাপক বণ্টন।

এই আয়াত অংশ (লায়া কুনা দুলাতান বাইনাল আগনিয়ামে মিনকুম) ইসলামী অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি। ইসলামী অর্থনীতি সম্পদ পুঞ্জীভূত করার বিরুদ্ধে। ইসলাম চায় ব্যাপক বণ্টননীতি। যাতে সম্পদ কেবল কিছু ধনী লোকের হাতে না থাকতে পারে। এ জন্য ইসলামী অর্থনীতিতে অনেক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সুদ হারাম করা হয়েছে এবং সুদবিহীন অর্থব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, জাকাত ধার্য করা হয়েছে, ওয়াক্ফের ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে, করজে হাসানার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। এসবের লক্ষ্য যাতে বণ্টন ব্যাপক হয় এবং কেবল ধনী লোকদের কাছে সম্পদ না থাকে। এ ছাড়াও ইসলামী রাষ্ট্র সুবিচারের প্রয়োজনে বাজার ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ করবে, খারাপ জিনিস উৎপাদন করতে দেবে না, ভেজাল ইত্যাদি বন্ধ করবে, অতিরিক্ত মুনাফাখোরি বন্ধ করবে, অতিপ্রয়োজনে কিছু শিল্প জাতীয়করণ করবে, অর্থাৎ সার্বিক ব্যবস্থা নেবে, যাতে বণ্টন ব্যাপক হয়, সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য দূর হয়। এ জন্য ইসলামী অর্থনীতিতে শ্রমিকদের বেতন আজকের মতো নয়, বরং মানসম্মত জীবন যাপন করতে পারে এমন পরিমাণে নির্ধারণ করবে। শ্রমিকদের শোষণ বিশ্বব্যাপী একটি সমস্যা, ইসলাম এটি মেনে নিতে পারে না। রাসূল সা: বলেছেন কাজের লোকদের পারিশ্রমিক এমন দিতে হবে যাতে সে মালিকের মতোই খেয়ে পরে বাঁচতে পারে। রাসূলের কথা থেকে আমরা একটি নীতি পাই, জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় মজুরি দিতে হবে।

৩. রাসূল সা: যা করতে বলেন তা কর এবং যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত হও (মা আতাকুম রাসূলু ফা খুজুহু- ওয়া মা নাহাকুম মিনহু ফানতাহু) (সূরা হাশর) এতে দু’টি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি পাওয়া যায় যে, রাসূল থেকে প্রমাণিত যেকোনো আদেশ মানতে হবে এবং যেকোনো নিষেধাজ্ঞাও মানতে হবে।

আশা করি, সবাই এই পয়েন্টগুলো গভীরভাবে চিন্তা করবেন এবং সমাজে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করবেন।

লেখক : সাবেক সচিব বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement