২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর গুরুত্ব বুঝিয়ে দিচ্ছে করোনাকালের অনিয়ম

-

করোনাভাইরাসের কারণে দেশের অনেকের এখন বিচ্ছিন্নতার জীবন কাটছে। আর ডাক্তারদের মতে, আমার মতো প্রবীণদের ঝুঁকি কিছুটা বেশি। তবে বিচ্ছিন্ন জীবন আরো বেশি করে সুযোগ এনে দিয়েছে নিজের ভাবনাগুলো প্রসারিত করার। করোনা আমার জন্য এই সমাজকে আরো গভীরভাবে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। আমাদের জাতীয় জীবনে কতটা অবক্ষয় নেমে এসেছে সেটা আশপাশে তাকালেই বোঝা যায়। করোনা মহামারীর মধ্যে যখন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ত্রাণের পণ্য বিতরণে অনিয়ম ও আত্মসাতের অভিযোগ শুনি, তখন সেটা কারো জন্য সুনাম বয়ে আনে না। এটা কোনো নতুন প্রবণতা নয়। স্বাধীনতার পর প্রায় অর্ধশতক পেরোতে চললেও অনিয়মের প্রবণতা যেন ক্রমেই তীব্র আকার ধারণ করছে। সমাজের প্রতিটি স্তর- প্রাইমারি স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থনীতি থেকে প্রশাসনযন্ত্রের প্রতিটি শাখা- এমন কোনো খাত নেই যেখানে অনিয়ম নেই বলে শোনা যায় না। আমরা পত্রিকায় দেখছি, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে গরিব মানুষের জন্য যে দান করা হচ্ছে, সেটাও লুটপাট হচ্ছে। কিন্তু এর জন্য দায়ী কে? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাই এর জন্য দায়ী। মৌলিক গলদটি রয়েছে এখানেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই তো এসব মানুষ তৈরি হচ্ছে। এমন দুর্যোগের সময় আমরা ভুয়া হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরির খবর দেখছি। যিনি এটি তৈরি করছেন তিনি একজন কেমিস্ট। তিনি তো কিছু লেখাপড়া শিখেছেন। সেটা কি সুশিক্ষা?

আসলে আমরা যে শিক্ষা দিচ্ছি তা কুশিক্ষা। যে শিক্ষা মানুষকে পরশ্রীকাতরতা শেখায়, যে শিক্ষা মানুষকে হিংসা শেখায়, যে শিক্ষা মানুষকে তার প্রতিবেশীর প্রতি সমবেদনা জানাতে শেখায় না, যে শিক্ষা মানুষকে ভালোবাসা শেখায় না সেটা শিক্ষা হতে পারে না। এই শিক্ষাব্যবস্থাকে পুরোপুরি ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। রাষ্ট্রের ভর্তুকিতে কিন্তু এই শিক্ষাব্যবস্থা চলছে। একসময় মুসলিম বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা রাষ্ট্রের হাতে ছিল না। ছিল বেসরকারি খাতে। এর অর্থায়ন হতো মূলত ওয়াকফের মাধ্যমে। ফলে সে সময় শিক্ষাব্যবস্থা ছিল স্বাধীন। কোনো সরকারের তাঁবেদারি তারা করত না। তখনকার শিক্ষাব্যবস্থা ছিল আসলেই প্রকৃত মানুষ গড়ার কারখানা। সরকারের ভর্তুকিতে চলা শিক্ষা খাতকে তো সরকারের কথা শুনতে হবে। তাতেও সমস্যা ছিল না। কিন্তু সমস্যা হয়েছে ভর্তুকির রাজনীতিকীকরণ হওয়ায়।

এ ব্যাপারে আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়েছে নিজ জেলা সিরাজগঞ্জের নিমগাছীতে শিক্ষাবিস্তারের কিছু কাজ করতে গিয়ে। বিগত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে আমি সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জ উপজেলায় একটি প্রাইমারি স্কুল স্থাপনের মাধ্যমে এই গবেষণা করি। প্রাথমিকভাবে আমি স্কুলটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল করার কথা ভাবি। এলাকায় শিক্ষার অভাবে যে সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছিল সেগুলো দূর করা ছিল আমার উদ্দেশ্য। আইডিবির মুখ্য অর্থনীতিবিদের পদ থেকে আগাম অবসর নিয়ে দেশে ফিরে অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল, আমি ভেবেছিলাম যদি পূর্ণমেয়াদ চাকরি করে তা হলে শেষ বয়সে দেশে ফিরে যেসব মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে ভাবছি সেগুলো নিয়ে কাজ করার মতো শারীরিক অবস্থা হয়তো থাকবে না। আমি দেশে ফেরার পর অনেক নামকরা ব্যক্তি আমার কাছে এসেছিলেন। তাদের অনেকে চেয়েছিলেন আমাকে তাদের প্রতিষ্ঠিত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি করতে। আমি তাদের শুরুতেই জানিয়ে দেই, চাকরি করার ইচ্ছা আমার নেই। আমাকে বিশাল অঙ্কের বেতনের প্রস্তাব দেয়া হলো। বলা হলো, আমি যোগ দিলে ১০ লাখ টাকা বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দেয়া হবে। একের পর এক লোক আসতে থাকে। আমার কাছে আবাসন কোম্পানির চেয়ারম্যান হওয়ারও প্রস্তাব আসে। আমাকে সামনে রেখে ব্যাংক করারও প্রস্তাব এলো। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন বিষয়ের গভীরে প্রবেশ করতে থাকি তখন বুঝতে পারি যে, সবার উদ্দেশ্য একটিই। যেহেতু আইডিবিতে চাকরি করছি, বিশ্বের অনেক নামকরা ব্যক্তির সাথে আমার পরিচয় ও যোগাযোগ আছে, ফলে আমাকে ব্যবহার করে হয়তো ফান্ড জোগাড় করা যাবে। এরপর মানুষ কিভাবে কারো সাথে ছবি তুলে সেই ছবি দেখিয়েই প্রতারণা করতে পারে সেই তিক্ত অভিজ্ঞতাও আমার হয়। ফলে আমি সতর্ক হয়ে যাই। আমার অভিজ্ঞতা হয় যে, এই সমাজের অধঃপতন এটাই হয়েছে যে, এখানে মানুষ যা বলে তা করে না, আর যা করে তা কখনোই বলে না।

এসব দেখেশুনে ও পড়ে সোস্যাল ইসলামিক ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের পদ থেকে বিদায় নেয়ার পর আমি এই প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গবেষণা করার উদ্যোগ নেই। আমার পরীক্ষা ছিল একেবারে প্রাথমিক পর্যায় থেকে শিশুদের শিক্ষা দিয়ে সমাজের জন্য কিছু ভালো মানুষ তৈরি করা। যেনতেনভাবে নয়, স্কুলটিকে এলাকার সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করারো চেষ্টা করেছি। এর জন্য ওই এলাকার মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবকাঠামো তৈরি করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা দেয়ার জন্য বাংলাদেশে ব্যক্তি উদ্যোগে তৈরি এ ধরনের অবকাঠামো আছে কি না আমার জানা নেই। ২০০৪ সালে স্কুলটি যাত্রা শুরু করে। এরই মধ্যে ১৫টি বছর পেরিয়ে গেছে। আমি স্কুলের একাডেমিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হই। স্কুল করার পেছনে আমার জমানো টাকা খরচ করি। আমি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল চালু করার কয়েক মাসের মধ্যে সরকার জেলায় জেলায় ইংলিশ ভার্সন স্কুল করার ঘোষণা দেয়। ফলে সবার পরামর্শে আমি স্কুলটিকে ইংলিশ ভার্সন স্কুলে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত নেই। এরপর আসে আর্থিক খরচের প্রশ্ন। সেটাও শিক্ষার উন্নয়নের স্বার্থে মেনে নিলাম। অন্যান্য খাত তো বটেই শিক্ষার্থী পরিবহনের পেছনেও আমাকে ভর্তুকি দিতে হয়েছে। আমি ইচ্ছা করেই এবং সচেতনভাবে এটা করেছি। আমার সার্বিক প্রচেষ্টায় ওই প্রত্যন্ত এলাকায় ইংলিশ ভার্সনের মতো একটি স্কুলের শিক্ষার্থী সংখ্যা শতাধিক পেরিয়ে যায়। স্কুলটি এলাকায় সুনাম কুড়ায়। এখানকার অনেক শিক্ষার্থী কৃতিত্বের সাথে বৃত্তি পায়।

শতভাগ পাস করার সুনাম অর্জন করে। এটি এলাকার সেরা স্কুলে পরিণত হয়। আমার গবেষণার একটি অধ্যায় শেষ হয়। এরপর শুরু হয় দ্বিতীয় অধ্যায়। তখন আমার আরো কিছু স্বপ্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল বাস্তবায়ন করার দিকে মনোনিবেশ করি। পাশাপাশি একটি চ্যারিটেবল ট্রাস্টও করি। সঙ্গত কারণেই তখন স্কুল থেকে মনোযোগ অন্য দিকে সরে যায়। এই সুযোগে স্কুলটিতে অনিয়ম শুরু হয়। আমার ধারণা ছিল শিক্ষা খাতে ভর্তুকি দিলে এমন কিছু শিক্ষার্থী বেরিয়ে আসবে যারা সমাজে অবদান রাখতে পারবে। কিন্তু আমি দেখলাম স্কুলের এই ভর্তুকি নিয়ে যারা এত দিন চলছিল, তারাই একসময় স্কুলটিকে ভাঙার চেষ্টা শুরু করেছে। স্কুলেরই কিছু শিক্ষক ভাবল, বেশ ভালো তো। এই স্কুলে কাজ করার সুবাদে তাদেরও সুনাম হয়েছে। তাদের ডাকে তো ছাত্ররা আসছে। তখন কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকা আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠান খুলে শিক্ষাকে ব্যবসার হাতিয়ারে পরিণত করার চেষ্টা চালায়।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নিজস্ব গবেষণা ফলটি তুলে ধরার জন্যই মূলত এই লেখা। একেবারে মাঠপর্যায়ের এই পরীক্ষার ফল হলো সংক্ষেপে : আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা সুসন্তান তৈরি করতে পারছে না। এখানে এমন সন্তান তৈরি হচ্ছে যে তার মাকে জঙ্গলে ফেলে আসে। এমন শিক্ষার্থী তৈরি করা হচ্ছে যে শিক্ষককে প্রহার করে, দাড়ি ধরে পুকুরে ফেলে দেয়। এমন শিক্ষার্থী তৈরি হচ্ছে যে তার সহপাঠীকে ভিন্নমত পোষণ করার কারণে পিটিয়ে মেরে ফেলে। এমন সন্তান তৈরি হচ্ছে যে দুর্যোগের সময় ত্রাণ চুরি করছে। এমন মানুষ তৈরি হচ্ছে সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি যাদের দায়বদ্ধতা নেই। এমন উদাহরণ পশ্চিমা দেশগুলোতে বিরল। মূলত দু’টি কারণে এটা হচ্ছে : নৈতিক শিক্ষার অভাব ও সরকারি ভর্তুকির অপব্যবহার।

১৯৬০ সালে সিরাজগঞ্জ কলেজে অর্থনীতি বিষয়ে লেকচারার হিসেবে যোগ দেই। তখন এটা ছিল মহকুমা। জেলা ছিল পাবনা। গোটা জেলায় একটিমাত্র সরকারি কলেজ ছিল পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ। আজকের সময়ের সাথে তখনকার সময়ের তুলনা চলে না। এখন তো ব্যাঙের ছাতার মতো কলেজ হয়েছে। শিক্ষা খাতে বিপুল ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। আমি বলেছিলাম, ভর্তুকি দেয়া উচিত ছিল শুধু প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে। উচ্চ শিক্ষা খাত থেকে ভর্তুকি পুরোপুরি তুলে নেয়া দরকার। কারণ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেসব গ্রাজুয়েট তৈরি করছে তাদের মধ্য থেকে অমানুষ তৈরি হচ্ছে, একটি দুর্নীতিপরায়ণ জাতি তৈরি হচ্ছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আমলা সবাই যেন একই পথের পথিক। ভালো মানুষ যে কিছু তৈরি হচ্ছে না, তা নয়। হওয়া উচিত ছিল উল্টো। বেশির ভাগ ভালো মানুষের মধ্যে দু-একজন খারাপ মানুষ থাকতেই পারে।

আমি ভর্তুকি বন্ধের পক্ষে নই। এমন অনেক মেধা আছে যেগুলো বিকশিত করতে ভর্তুকি দেয়া প্রয়োজন। শুধু মেধা থাকলেই চলে না, সেটাকে বিকশিত করতে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তারও প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু যে অর্থায়ন মানুষের বদলে অমানুষ তৈরি করছে, সেটা জারি রাখার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। তাই মনে করি শিক্ষা খাতে যে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে তা বন্ধ অথবা পুরোপুরি সংস্কার, অথবা সিলেকটিভ হওয়া প্রয়োজন। অথবা অপরাধীদের শাস্তি দেয়া দরকার। কারো পয়সায় কেউ লেখাপড়া করলে সে কি করছে সেটা জানার অধিকার ভর্তুকিদাতার রয়েছে। তাকে মনিটর করার অধিকার থাকা উচিত। ভর্তুকি গ্রহীতা কোনো অসামাজিক কাজে জড়িত হলে সেটা মেনে নেয়া উচিত নয়। তাই শিক্ষা ভর্তুকি ও ঋণ দেয়ার আগে এর পরিণতিও বিশ্লেষণ করা উচিত। আর সে কারণেই আমি বলছি যে, শিক্ষা খাতকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া গেলে অনেক বেশি মনিটরিং করা যেত। সরকারি খাতে থাকার কারণে সরকার শুধু ভর্তুকি দিয়েই দায়িত্ব পালন করছে। মনিটরিং করছে না। কিন্তু মনিটরিং করার কোনো ধরনের উপায় অবশ্যই উদ্ভাবন করতে হবে। ছাত্রদের সমাজের মৌলিক নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধগুলো শিক্ষা দেয়া উচিত। কিন্ডারগার্টেন থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এই শিক্ষা থাকা উচিত। দেশের ৯০ শতাংশ মুসলমান হওয়ায় ইসলামিক মূল্যবোধ শিক্ষা কারিকুলামে থাকা উচিত। অন্য ধর্মাবলম্বীদেরও নিজ নিজ ধর্মীয় শিক্ষা দিতে হবে। অন্য ধর্ম নৈতিকতা সম্পর্কে কী বলছে সে শিক্ষাও শিশুদের দিতে হবে।

এই প্রায়োগিক পরীক্ষা থেকে আমার হাইপোথিসিস হলো : সরকার প্রাইমারি স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যে ভর্তুকি দিচ্ছে তা বহুলাংশে অপচয় ছাড়া কিছু নয়। আমি জীবনের একটি বড় সময় শিক্ষকতা করেছি। ফলে প্রাইমারি স্কুল পরিচালনার ১৫ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা আমাকে ওই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সাহায্য করেছে। ভর্তুকি দিয়ে যে শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালনা করা হচ্ছে তা প্রকৃত মানুষ তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আমি এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি যে শিক্ষাব্যবস্থা এ ধরনের অমানুষের বদলে মানুষ তৈরি করবে। এ জন্য তাদের ওভারহোলিং করার ব্যবস্থা থাকবে। শিক্ষার্থীকে সনদ দেয়া হবে সাময়িক। সার্টিফিকেট বাতিলের ক্ষমতা থাকবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। আমরা কি এমন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখতে পারি না, যেখানে শিক্ষার্থীর কর্মজীবনে সামাজিক দায়বদ্ধতার অঙ্গীকারস্বরূপ মানবকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা থাকবে? আবার দুর্নীতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীর ডিগ্রি বাতিলেরও ব্যবস্থা থাকবে?

কাক্সিক্ষত বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষার্থীর সারা জীবনের কর্মকাণ্ড ও অর্জন বিবেচনা করে ডিগ্রি দেয়া হবে। এখন স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় একটি সার্টিফিকেট ধরিয়ে দিয়ে দাবি করে, আমরা এই জনশক্তিকে তৈরি করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় যেন পণ্য উৎপাদনের কারখানা। উৎপাদনের পর পণ্যের গায়ে যেমন লেবেল লাগিয়ে দেয়া হয়, তেমনি শিক্ষার্থীর ডিগ্রিটাও যেন একটি লেবেল। কিন্তু কোনো পণ্য উৎপাদনের পর সে জিনিসটি ঠিকমতো চালু রাখতে কিংবা সেটি ঠিকমতো কাজ করছে কি না সে জন্য একটি সার্ভিসিং সুবিধা দেয়া হয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলো তাদের আঙ্গিনা থেকে চলে যাওয়া শিক্ষার্থী কী করছে তার কোনো খবর রাখে না। কোনো শিক্ষার্থী যদি কর্মজীবনে অপকর্ম-দুর্নীতি করে, তা হলে তার ডিগ্রি বাতিলের কোনো বিধান নেই। যন্ত্র নষ্ট হলে আমরা মেরামত করি। খুচরা যন্ত্রাংশ পাওয়া না গেলে বা সার্ভিসিং সুবিধা না থাকলে আমরা ওই যন্ত্রটি কিনি না। অথচ আমরা মানুষকে ‘জনশক্তি’ বললেও তার যে ‘সার্ভিসিং’ বা ‘আপগ্রেড’ করা দরকার, সে কথা কেউ বলি না। অথচ এটা হওয়া উচিত ছিল।

পাশ্চাত্যে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে কিন্তু এই ধ্যান-ধারণার প্রতিফলন ঘটতে শুরু করেছে। যেমন- অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের এমন অনেক বরেণ্য ব্যক্তিকে ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে যারা জীবনসংগ্রামে অনবদ্য লড়াই করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন এবং যারা একসময় ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের ছাত্র। এ ধরনের ব্যক্তিত্বকে ডেকে নিয়ে ডিগ্রি দেয়া হয়; কিন্তু গত শতকে এরকম দু’জন ব্যক্তিত্বকে ডিগ্রি প্রদানে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ও একই নীতি অনুসরণ করছে। তাদের কোনো ছাত্র বিশ্বপর্যায়ে কোনো কিছু অর্জন করলে তাকে ডেকে নিয়ে পিএইচডি দেয়া হয়। এই বিষয়গুলো আজো আমাদের লক্ষ্যের বাইরে রয়ে গেছে। আমেরিকায় একজন এমডি বা ডাক্তার হতে গেলে খুব কঠিন শিক্ষা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হয়; কিন্তু এর পরও যে ডিগ্রি তাকে দেয়া হয়, তা তার সারা জীবনের জন্য নয়। মাত্র ১০ বছরের জন্য। এই ১০ বছর পর আবার তাকে বোর্ডের সামনে হাজির হয়ে সমসাময়িক চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞানের পরীক্ষা দিতে হয়।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এ বিষয়টা পুরোপুরি অনুপস্থিত। এমনকি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো ছাত্রছাত্রী যদি বিশ্ব পর্যায়ে কোনো কৃতিত্ব অর্জন করে, তবুও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার কোনো খবর রাখে না। তাই বাংলাদেশের জন্য চাচ্ছি এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে কেউ ভালো কিছু করলে তার স্বীকৃতি দেয়া হবে; তেমনি খারাপ কিছু করলে তার শাস্তি তথা ডিগ্রি বাতিলের ব্যবস্থাও থাকবে। আমাদের সমাজে বিপ্লব ঘটাতে হলে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। এই ঢেলে সাজানোর অর্থ শুধু শিক্ষা কারিকুলাম পরিবর্তন নয়; সমাজ ও সংস্কৃতির আলোকে শিক্ষাব্যবস্থাকে বিন্যস্তকরণও। এর অভাবেই আমরা শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে এত দিনেও জবাবদিহি ও দায়িত্বশীলতা সৃৃষ্টি করতে পারিনি।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামি উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
hmct2004@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement