২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

জরুরি অবস্থা ঘোষণা কি সংবিধানসম্মত?

জরুরি অবস্থা ঘোষণা কি সংবিধানসম্মত? - সংগৃহীত

আমাদের মূল ’৭২-এর সংবিধানে জরুরি অবস্থা ঘোষণাসংক্রান্ত বিধান ছিল না। স্বাধীনতা-পরবর্তী হত্যা, গুম, লুটপাট, চোরাচালান, ব্যাংক ডাকাতি, চুরি, নাশকতা প্রভৃতি আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেলে প্রচলিত শাসনব্যবস্থা ও আইন তা নিবারণে অপ্রতুল বিবেচিত হওয়ায় জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধানাবলি সংবিধানে সংযোজনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়।
এর ফলে সংবিধান (দ্বিতীয় সংশোধন) আইন, ১৯৭৩ এর মাধ্যমে সংবিধানে ৯ম-ক ভাগ অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ৯ম-ক ভাগ ১৪১ক, ১৪১খ ও ১৪১গ এ তিনটি অনুচ্ছেদ সমন্বয়ে গঠিত। এ তিনটি অনুচ্ছেদে জরুরি অবস্থার প্রেক্ষাপট ও কার্যকরতা, কতিপয় ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নে রাষ্ট্রের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার অকার্যকরতা এবং জরুরি অবস্থা বহাল থাকাকালীন সংবিধানের তৃতীয় ভাগের অন্তর্ভুক্ত মৌলিক অধিকারগুলো স্থগিত সংক্রান্তে বিধানাবলি প্রণয়ন করা হয়েছে।

আমাদের বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২৮ নভেম্বর, ২০১২ নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক জনসভায় সরকারের উদ্দেশে বলেন, জরুরি অবস্থা দিয়েও ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। বিরোধীদলীয় নেত্রীর বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে সংসদের ১৫তম অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সরকারের জরুরি অবস্থা ঘোষণার কোনো ইচ্ছা নেই; তবে বিরোধীদলীয় নেত্রীই জরুরি অবস্থা ঘোষণার পাঁয়তারা করছেন। এ যাবৎকাল পর্যন্ত আনীত সংবিধানের ১৫টি সংশোধনীর মাধ্যমে কিছু মৌলিক বিষয়ে উপর্যুপরি পরিবর্তন ও পুনঃপ্রবর্তনের কারণে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে বর্তমানে জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রয়োজন অনুভূত হলে তা সংবিধানসম্মত হবে কি না? দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক যারা দীর্ঘ দিন ধরে সাংবিধানিক আইন বিষয়ে পাঠদান করে আসছেন তাদের অভিমত সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১ পরবর্তী সংবিধানের জরুরি বিধানাবলি অন্তর্ভুক্তি থাকা স্ববিরোধিতার বেড়াজালে আবদ্ধ হওয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ।

তাদের অভিমত সংবিধান (দ্বিতীয় সংশোধন) আইন, ১৯৭৩ প্রণয়নকালে যুগপৎভাবে ১৪২ অনুচ্ছেদে দফা (২) সন্নিবেশনের মাধ্যমে বলা হয়Ñ ‘এ অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত কোনো সংশোধনের ক্ষেত্রে ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই প্রযোজ্য হবে না।’ অপর দিকে ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদে দফা(৩) সন্নিবেশনের মাধ্যমে বলা হয়Ñ ‘সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অধীন প্রণীত সংশোধনের ক্ষেত্রে এ অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই প্রযোজ্য হবে না।’ যদিও সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১ দ্বারা ১৪২ অনুচ্ছেদের দফা(২) অবলুপ্ত করা হয় কিন্তু ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদের দফা(৩) অক্ষুণœ থাকায় একটির অবস্থান ও অপরটির বিয়োজন পরস্পরবিরোধী। তা ছাড়া সংবিধানে নব সন্নিবেশিত ৭খ অনুচ্ছেদ দ্বারা ১৪২ নম্বর অনুচ্ছেদের সংবিধানের বিধান সংশোধনের ক্ষমতার ওপর সীমাবদ্ধতা আরোপ করায় জরুরি অবস্থা বহাল থাকাকালীন সংবিধানের তৃতীয় ভাগের ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ ও ৪২ নম্বর অনুচ্ছেদগুলোর ছত্রছায়ায় প্রণীত আইন তৃতীয় ভাগের সাথে সাংঘর্ষিক বিবেচিত হবে না। কিন্তু তৃতীয় ভাগের অন্যান্য অনুচ্ছেদের ক্ষেত্রে ৭খ অনুচ্ছেদে কোনো রক্ষাকবচ না দেয়ায় এবং ৭খ অনুচ্ছেদের সাথে অনুচ্ছেদ নম্বর ২৬-এর দফা (৩) সাংঘর্ষিক হওয়ায় ১৪২ নম্বর অনুচ্ছেদের সংশোধনী ক্ষমতা জরুরি অবস্থা বহাল থাকাকালীন সংবিধানের তৃতীয় ভাগের কিছু অনুচ্ছেদ ব্যতীত অপরাপর অনুচ্ছেদগুলোর ওপর বিস্তৃত নয়। এখানে কিছু অনুচ্ছেদ অর্থাৎ ৭খ অনুচ্ছেদে বিবৃত ৯ম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলিসাপেক্ষে অনুচ্ছেদ নম্বর ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ ও ৪২ এর বিষয়ে আইন প্রণয়ন করা হলেও জরুরি অবস্থা অবসান-পরবর্তী সে আইন যে কার্যকর থাকবে না তা অনুচ্ছেদ নম্বর ১৪২খ এর অধ্যয়ন হতে সুস্পষ্ট।

সংবিধানে ১৪১ক, ১৪২খ ও ১৪১গ অনুচ্ছেদগুলোর মাধ্যমে জরুরি বিধানাবলি সন্নিবেশন অনুচ্ছেদ নম্বর ১৪২-এর দফা(২) ও অনুচ্ছেদ নম্বর ২৬-এর দফা (৩) দ্বারা উভয় দিক থেকে সমভাবে সুরক্ষিত ছিল। কিন্তু অনুচ্ছেদ নম্বর ১৪২-এর দফা (২)-এর বিলুপ্তি এবং অনুচ্ছেদ নম্বর ৭খ-এর অন্তর্ভুক্তির কারণে বর্তমানে অনুচ্ছেদ নম্বর ২৬-এর দফা (৩) অনুচ্ছেদ নম্বর ৭খ-এর সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়েছে। তাই পূর্বোল্লেখিত সুরক্ষা কতটুকু কার্যক্ষম তা প্রণিধানযোগ্য।
আলোচ্য নিবন্ধের ফলপ্রসূ আলোচনার পরিসমাপ্তিতে অনুচ্ছেদ নম্বর ১৪১ক, ১৪১খ ও ১৪১গ তে সুনির্দিষ্টভাবে কী বলা হয়েছে সে দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করাসহ এর পাশাপাশি অনুচ্ছেদ নম্বর ১৪২ ও ৭খ-এর পর্যালোচনা আবশ্যক।

পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে অনুচ্ছেদ নম্বর ১৪১ক, ১৪১খ ও ১৪১গ জরুরি বিধানাবলি সংশ্লেষে ৯ম-ক ভাগ দ্বারা সংবিধানে সন্নিবেশিত। অনুচ্ছেদ নম্বর ১৪১ক তে বলা হয়েছে রাষ্ট্রপতির কাছে যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এমন জরুরি অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে, যাতে যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের দ্বারা বাংলাদেশ বা এর যেকোনো অংশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন, তা হলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষরসাপেক্ষে অনধিক ১২০ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন।

অনুচ্ছেদ নম্বর ১৪১খ তে বলা হয়েছেÑ এ সংবিধানের তৃতীয় ভাগের অন্তর্গত বিধানাবলির কারণে রাষ্ট্র যে আইন প্রণয়ন করতে ও নির্বাহী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্ষম নন, জরুরি অবস্থা ঘোষণা কার্যকরতাকালে এ সংবিধানের ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ ও ৪২ নম্বর অনুচ্ছেদগুলোর কোনো কিছুই সেরূপ আইন প্রণয়ন ও নির্বাহী ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পর্কিত রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করবে না; তবে অনুরূপভাবে প্রণীত কোনো আইনের কর্তৃত্বে যা করা হয়েছে বা করা হয়নি, তা ব্যতীত অনুরূপ আইন যে পরিমাণে কর্তৃত্বহীন, জরুরি অবস্থা ঘোষণা অকার্যকর হওয়ার অব্যবহিত পরে তা সে পরিমাণে অকার্যকর হবে।

অনুচ্ছেদ ১৪১গ তে বলা হয়েছেÑ জরুরি অবস্থা ঘোষণা কার্যকরকালে প্রধানমন্ত্রীর লিখিত পরামর্শ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা ঘোষণা করতে পারবেন যে, আদেশে উল্লেখিত এবং সংবিধানের তৃতীয় ভাগের অন্তর্গত মৌলিক অধিকারগুলো বলবৎকরণের জন্য আদালতে মামলা রুজু করার অধিকার এবং আদেশে অনুরূপভাবে কোনো উল্লেখিত অধিকার বলবৎকরণের জন্য কোনো আদালতে বিচারাধীন সব মামলা জরুরি অবস্থা ঘোষণা কার্যকরতাকালে কিংবা ওই আদেশের দ্বারা নির্ধারিত স্বল্পতরকালের জন্য স্থগিত থাকবে।

সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১ এর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ নম্বর ১৪২ এ সংশোধনী আনয়নের ফলে এ অনুচ্ছেদটির অবাধ সংশোধন ক্ষমতা বর্তমানে সীমিত হয়ে পড়েছে। এ অনুচ্ছেদটির বর্তমান বিধানাবলির দিকে আলোকপাত করলে দেখা যায় এতে বলা হয়েছেÑ এ সংবিধানে যা বলা হয়েছে তা সত্তে¡ও সংসদের আইন দ্বারা ও সংবিধানের কোনো বিধান সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন বা রহিতকরণের দ্বারা সংশোধিত হতে পারবে; তবে শর্ত থাকে যে অনুরূপ সংশোধনীর জন্য সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অন্যূন দু-তৃতীয়াংশ ভোটে গৃহীত না হলে অনুরূপ কোনো বিলে সম্মতিদানের জন্য তা রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপিত হবে না। আর উপরোক্ত উপায়ে কোনো বিল গৃহীত হওয়ার পর সম্মতির জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে তা উপস্থাপিত হলে উপস্থাপনের সাত দিনের মধ্যে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করবেন এবং তিনি তা করতে অসমর্থ হলে ওই মেয়াদের অবসানে তিনি বিলটিতে সম্মতিদান করেছেন বলে গণ্য হবে।

নব সন্নিবেশিত অনুচ্ছেদ নম্বর ৭খ-এর প্রতি আলোকপাত করলে দেখা যায়, তাতে বলা হয়েছে সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদে যা কিছুই থাকুক না কেন, সংবিধানের প্রস্তাবনা, প্রথম ভাগের সব অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ, ৯ম-ক ভাগে বর্ণিত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলিসাপেক্ষে তৃতীয় ভাগের সব অনুচ্ছেদ এবং একাদশ ভাগের ১৫০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধানের অন্যান্য মৌলিক কাঠামোসংক্রান্ত অনুচ্ছেদগুলোর বিধানাবলি সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ কিংবা অন্য কোনো পন্থায় সংশোধন অযোগ্য হবে।

সংবিধান দেশের অন্যান্য প্রচলিত আইনের মতো আইন হলেও এটি দেশের সর্বোচ্চ আইন হওয়ার কারণে এ আইনটির অবস্থান অন্যান্য আইন থেকে ভিন্নতর। এ আইনের সংশোধন প্রক্রিয়া যেকোনো সাধারণ আইনের সংশোধন প্রক্রিয়ার সমরূপ নয়। তা ছাড়া দেশের কোনো সাধারণ আইন এ আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হলে সাধারণ আইনের ওপর এ আইন প্রাধান্য পাবে।
আইনের সংশোধন চলমান প্রক্রিয়া হলেও দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়া জটিলতর করা হয়েছে এ কারণে যে, ঘন ঘন সংশোধনীর মাধ্যমে যেন দেশের সর্বোচ্চ আইনের মৌলিক কাঠামো ও অন্যান্য বিধানাবলি সংশোধন করত জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিতে রচিত সংবিধানের চেতনা ক্ষুণœ করা না হয়। সংবিধানকে পূর্ণাঙ্গরূপে বুঝতে হলে এর প্রতিটি অনুচ্ছেদ বিষয়ে ধারণা থাকা আবশ্যক। তাই খণ্ডিত অধ্যয়নের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন ফলপ্রসূ হয় না।

সংবিধানের বর্তমান অবস্থান বিবেচনায় নিলে দেখা যায় তৃতীয় ভাগের কোনো অনুচ্ছেদ সাধারণ অবস্থায় সংশোধন করা যাবে না। কিন্তু ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদ থেকে দফা (৩) সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) আইন, ২০১১ দ্বারা অবলুপ্ত না করায় স্পষ্টত ওই অনুচ্ছেদের দফা (৩)-এর মর্মার্থ অনুযায়ী অনুচ্ছেদ নম্বর ১৪২-এর সংশোধনী ক্ষমতা ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদের কোনো হানি না ঘটিয়ে বহাল আছে যদিও ৭খ অনুচ্ছেদের দেয়া সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় নিলে দেখা যায় সে ক্ষমতা অকার্যকর। এখন প্রশ্ন বর্তমান সংসদ অনুচ্ছেদ নম্বর ৭খ-এর সীমাবদ্ধতাকে উপেক্ষা করে সংশোধনী আনয়নপূর্বক অনুচ্ছেদ নম্বর ২৬-এর দফা (৩) অবলুপ্ত করবে কি না? আর অবলুপ্ত করা হোক বা না হোক জরুরি বিধানাবলি যে স্ববিরোধীভাবে সংবিধানে সন্নিবেশিত রয়েছে সে বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার অবকাশ কোথায়?হ
লেখক : সাবেক জজ ও সাবেক রেজিস্ট্রার, সুপ্রিম কোর্ট

E-mail: iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement