২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

যেন ইঁদুর-বিড়াল খেলা

যেন ইঁদুর-বিড়াল খেলা - সংগৃহীত

কার্টুন নেটওয়ার্ক সংক্ষেপে সিএন চ্যানেলে সারাক্ষণ সম্প্রচারিত হয় শুধুই কার্টুন ছবি। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘টম অ্যান্ড জেরি’। এর উপজীব্য ইঁদুর ও বিড়ালের মধ্যকার মজার সব ঘটনা। শিশুদের কাছে এই সিরিয়াল তুমুল জনপ্রিয়। শিশুরা দেখে খিলখিল করে হাসে আর লুটোপুটি খায়। তাদের মিষ্টিমুখ দেখে বড়দেরও মন ভরে যায়। মা-বাবা, বিশেষ করে তরুণী মায়েরা টম অ্যান্ড জেরি ছেড়ে দিয়ে সন্তানকে টিভি সেটের সামনে বসিয়ে নিশ্চিন্ত মনে গৃহকাজে মনোযোগী হন। সন্তান ঠাণ্ডা রাখতে অনেক মায়ের কাছেই এটি উত্তম দাওয়াই। অন্য দিকে কোনো সিরিয়াস বিষয়ে মশকরা করলে বলা হয়, ইঁদুর-বিড়াল খেলা হচ্ছে। তেমনি একটি জীবন-মরণ সমস্যা নিয়ে ঘটা করে ইঁদুর-বিড়াল খেলার চিত্রায়ন হয়ে গেল। যেখানে পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে; যাদের শ্রমে-ঘামে দেশে উত্থান ঘটেছে এই শিল্পের, সেই নায়কদের মানে, ৪৫ লাখ শ্রমিকের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার মহড়া এবার দেখলাম আমরা সবাই।

বিশ্বের করোনাকালে চলছে জীবন আর জীবিকার মধ্যে সঙ্ঘাত। বিশ্বজুড়েই জীবন না জীবিকা, এই নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ কেউ কেউ বলছেন, আপাতত জীবিকার চেয়ে জীবনের গুরুত্ব বেশি। তবে জীবন ও জীবিকা একসাথে চালানো দুরূহ একটি কাজ। যেসব দেশে অনানুষ্ঠানিক খাত বড়, যাদের জীবিকা প্রতিদিনকার মজুরির ওপর নির্ভরশীল, সেখানে সামাজিক দূরত্ব পালন করে যাওয়া খুব কঠিন একটি কাজ। বাংলাদেশে মোট শ্রমশক্তির বড় অংশই কাজ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে। তাই আমাদের দেশে জীবন ও জীবিকার ফারাক করা আরো কঠিন। তবু দেশে করোনা ছড়িয়ে পড়ারোধে সরকার গত ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল। পরে ছুটির মেয়াদ ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। তৃতীয় ধাপে ছুটি আরো বাড়িয়ে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত নিশ্চিত করা হয়েছে। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ারোধে সবাইকে বাড়িতে রাখতে ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতেই এ পদক্ষেপ। এ সময়ে জনসমাগম তো দূরে কথা, বিনা প্রয়োজনে বাড়ির বাইরেও যাতে মানুষ বের না হয়, এ জন্য মাঠে নামানো হয়েছে সেনা। চলছে প্রশাসন ও পুলিশের সমন্বিত সচেতনতা কার্যক্রম ও অভিযান। কিন্তু ছুটি পেয়ে দলে দলে মানুষ গ্রামের অভিমুখে ছুটে যান। গ্রাম থেকে যারা ঢাকায় ফিরছিলেন তার বড় একটা অংশই তৈরী পোশাক শ্রমিক।

পোশাক কারখানা খোলা বা বন্ধ রাখার বিষয়ে শুরু থেকেই ধোঁয়াশা ছিল। পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএর নেতারা কারখানা বন্ধ রাখার বিষয়ে সরকারের উপর মহলের দিকে তাকিয়েছিলেন। ২৬ মার্চ থেকে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটি শুরু হয়ে যায়। সে দিনই পোশাক কারখানা বন্ধ রাখতে সদস্যদের প্রতি অনুরোধ জানায় বিজিএমইএ। তার আগের দিনই নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ ৪ এপ্রিল পর্যন্ত কারখানা বন্ধ রাখতে সদস্যদের অনুরোধ করেছে। পয়লা এপ্রিল দেশের বাণিজ্য পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত সভাশেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘পোশাক কারখানা চলতে বাধা নেই। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।’ সভায় ৫ এপ্রিল কারখানা খোলার বিষয়েও গুরুত্ব দেয়া হয়। সে দিনই কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের (ডিআইএফই) এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যেসব কারখানায় ক্রয়াদেশ আছে এবং করোনা প্রতিরোধে জরুরি পণ্য- পারসোনাল প্রোটেকটিভ ইকুইপমেন্ট (পিপিই), মাস্ক, হ্যান্ডওয়াশ বা স্যানিটাইজার, ওষুধ ইত্যাদি উৎপাদন কার্যক্রম চলছে সেসব কারখানা বন্ধের বিষয়ে সরকার নির্দেশনা দেয়নি। পর দিন ২ এপ্রিল বিকেএমইএ আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়, ৪ এপ্রিলের পর তাদের সদস্য পোশাক কারখানা বন্ধ রাখার বিধি-নিষেধ থাকবে না। তবে কারখানা খোলার বিষয়ে মালিকদের ব্যক্তিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়। ফলে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে মানুষ গত শনিবার কর্মস্থল ঢাকার অভিমুখে ছুটতে শুরু করেন। এতে করোনা মোকবেলায় যে সামাজিক দূরত্বের কথা বলা হচ্ছে, তা মানা সম্ভব হয়নি।

এ দেশের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ দেখে লঙ্কাকাণ্ডে ‘হনুমানের লেজে আগুন লাগা’র মতো মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। এখানে আগুনের বদলে করোনাভাইরাস লাখ লাখ লেজে গোবরের মতো লাগিয়ে সারা দেশ ঘোরানো হলো এবং শেষ চক্রটা রাজধানীতে শেষ করা হয়েছে। প্রথমে এয়ারপোর্ট থেকে গ্রামগঞ্জে ঢুকিয়ে তাদের তাড়িয়ে বেড়ানো হয়। তারপর লাখ লাখ লোক সারা দেশে ছড়িয়ে যেতে দেয়া হলো! তারা আবার খুব ক্রিটিক্যাল সময়ে ফের ঢাকায় ঢুকে পড়লেন! তাদের যেন চরকির সাথে বেঁধে দেয়া হয়েছে, তাই জীবনের মায়া ত্যাগ করে জীবিকার জন্য ছুটছিলেন তারা।

কিন্তু এ মুহূর্তে করোনারোধে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে কার্যকর কৌশল হলো ‘আইসোলেশন’ বাড়ানো এবং সামাজিক দূরত্ব সর্বাত্মকভাবে কার্যকর করা। এটা যত বেশি সার্থক ও সম্পন্ন করা যাবে, তত বেশি পরীক্ষা না করিয়ে বেশি সুফল পেতে পারি আমরা। কিন্তু কী আজব তামাশা! করোনার যখন শিশুকাল তখন গার্মেন্টসকর্মীদের বলা হলো, তোমরা বাড়ি যাও। আর সেই করোনা শৈশব কাটিয়ে যখন যৌবনে পদার্পণ করেছে; তখন বলা হলো, ‘তোমরা চলে আসো।’ গণপরিবহন বন্ধ। তাতে কী! আয়-রোজগারের অবলম্বনটুকু বাঁচাতে ঝুঁকি নিয়ে বাধ্য হয়েই যে যেভাবে পারলেন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটলেন কর্মক্ষেত্রের দিকে। মুহূর্তে পাল্টে গেল চিত্রনাট্য। অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হলো জনে জনে করোনা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। এক দিকে লকডাউন। ‘সবাই ঘরে থাকো’। অন্য দিকে গার্মেন্টস খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই লকডাউন ভাঙার ক্ষেত্র তৈরি করা হয়! সে জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তের শ্রমিকরা শনিবার সকাল থেকে শিল্পাঞ্চলে ফিরতে থাকেন। সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকলেও ট্রাক, অটোরিকশা, মাহেন্দ্রসহ ছোট-বড় গাড়িতে করে ফিরতে থাকেন তারা। কোথাও গাড়ি না পেয়ে সারা পথ ভেঙে ভেঙে প্রায় ১০ গুণ বেশি টাকা খরচ করতে হয়েছে তাদের। আর ফেরিঘাটে তো ঘটে লঙ্কাকাণ্ড। একেকটি বড় ফেরিতে তিন থেকে চার হাজার মানুষ পার করা হচ্ছিল। ঈদের ছুটি ছাড়া এত ভিড় দেখা যায় না। ফলে কর্মস্থলে ফেরা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে করোনা প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি যেন ভুল হয়ে যায়।

এ নিয়ে বিভিন্ন মহলের উদ্বেগ প্রকাশের মুখে শনিবার রাতেই পোশাক কারখানা ১১ এপ্রিল পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা করে বিজিএমইএ। ফের যাতে শ্রমিকরা দল বেঁধে বাড়ি ফিরতে না পারেন এ জন্য রাতেই সব নৌযান চলাচল বন্ধের নির্দেশ আসে। তৈরী পোশাক শিল্পের এই অসহায় মানুষগুলো মাইলকে মাইল হেঁটে, রিকশা, খুদে বাহন, ট্রাকে চড়ে ঢাকায় স্রোতের মতো চলে এসেছেন নিজেরাই; নাকি বেতনের আশ্বাস আর চাকরি খেয়ে ফেলার হুমকি দিয়ে তাদের আসতে বাধ্য করেছে? অথচ ভয়াবহ করোনা-ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে দেশ। তাই হোম কোয়ারেফন্টনের আদেশ রয়েছে সরকারের। আদেশ না মানায় অনেককে লাঠিপেটা করেছে পুলিশ। করা হয়েছে জেল-জরিমানা।

কিন্তু যারা সরকারি আদেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হাজার হাজার মানুষকে ঢাকায় আসতে বাধ্য করেছেন, পুরো দেশকে ভয়াবহ করোনা-সংক্রমণের দিকে ঠেলে দিয়েছেন; তাদের কি কোনো জবাবদিহি করা হবে? নাকি তারা আইনের ঊর্ধ্বে? তবে দেশে যে দিনকাল পড়েছে, কথা কম বলাই ভালো। আমাদের অবস্থা হয়েছে সেই কৃষকের মতো, গ্রামীণ এক অনুষ্ঠানে যাকে অতিথি হিসেবে নিমন্ত্রণ জানানো হয়। তিনি যথা সময়ে অনুষ্ঠানস্থলে গিয়ে দেখলেন, অন্য সব বক্তা প্রধান অতিথিকে উদ্দেশ করে স্তুতিবাক্যের নহর বইয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তার তো সোজাসাপ্টা কথার ধাঁচ। দেখলেন, সত্য কথা বললে বিপদ; তাই তোষামোদি কথা থেকে রেহাই পেতে বললেন, ‘আমি যা বলতে এসেছিলাম, তা আগের বক্তা বলে গেছেন। আর আমি যা বলতে চাই, তা আমার পরের বক্তা বলবেন। এ দিকে হাটবেলা হয়ে যাচ্ছে। এই বলে বক্তব্য শেষ করছি’। 

 


আরো সংবাদ



premium cement