২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`
অবলোকন

করোনা-উত্তর ভূ-রাজনীতি ও বিশ্বব্যবস্থা

করোনা-উত্তর ভূ-রাজনীতি ও বিশ্বব্যবস্থা - সংগৃহীত

করোনাভাইরাস পুরো বিশ্বব্যবস্থাকে ওলট পালট করে দিচ্ছে বলে মনে হয়। প্রধানত স্বাস্থ্যসঙ্কট হিসেবে তিন মাস আগে এর সূচনা হলেও এটি এখন বিশ্বের অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের উৎপত্তি ও বিস্তৃতি নিয়ে যথেষ্ট তর্ক রয়েছে। এটি কি কোনো দুর্ঘটনাবশত অথবা পরিকল্পনার আওতায় জীবাণু অস্ত্র হিসেবে পরীক্ষাগার থেকে মানব শরীরে ঢুকে ছড়িয়ে পড়েছে নাকি কোনো পশুর শরীর থেকে এর সৃষ্টি ও প্রবেশ মানব শরীরেÑ এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ নিয়ে রাজনীতি না করে এটিকে শুধু স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু এর পরও করোনা নিয়ে পরস্পরের প্রতি দোষারোপের খেলা চলছেই। কেউ বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র পরিকল্পিতভাবে এটি চীন ও ইরানে ছড়িয়েছে। আবার কেউ বলছেন, এটি চীনের জীবাণু অস্ত্রের পরীক্ষাগার থেকে ছড়িয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এর উৎস যাই হোক না কেন, এটি বিশ্বের ভূ-রাজনৈতিক ব্যবস্থা এবং বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাকে পাল্টে দিতে পারে। যদিও করোনাভাইরাস শেষ পর্যন্ত কোথায় কত দূর গিয়ে থামবে তা বলা যাচ্ছে না।

আঘাতের নতুন কেন্দ্র ও মন্দার পদধ্বনি!
করোনাভাইরাসের সর্বশেষ শিকার হয়ে দাঁড়িয়েছে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র ইউরোপ -আমেরিকার দেশগুলো। করোনাভাইরাস বিস্তারের প্রাথমিক পর্যায়েই যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা চীনকে ছাড়িয়ে গেছে। ইতালি আর স্পেনের মৃত্যুর সংখ্যাও বেশ আগেই চীনকে অতিক্রম করেছে। এখন চীনে যেখানে এর বিস্তার অনেকখানি থেমেছে তখন যুক্তরাষ্ট্র ব্রিটেন ফ্রান্স জার্মানি লড়াই করছে এর ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য। আরো তিন থেকে ছয় মাস ধরে এর রেশ চলবে বলে মনে হচ্ছে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণে বিশ্বজুড়ে লকডাউন, কারফিউ পরিস্থিতির কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ায় অর্থনীতিবিদরা এক মহা সঙ্কটের আশঙ্কা করছেন সামনের দিনগুলোতে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল-আইএমএফের প্রধান ক্রিস্টালিয়া জর্জিয়েভা অনলাইনে এক সংবাদ সম্মেলনে নিশ্চিত করেই বলেছেন, অর্থনৈতিক মন্দায় প্রবেশ করেছি আমরা। এটি ২০০৯ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার চেয়েও কঠিন হবে।

করোনায়ও মেরুকরণ?
২০০৮ সালে যখন আর্থিক বিপর্যয় বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার দিকে পরিচালিত করেছিল, যুক্তরাষ্ট্র তখনও জি-২০-এর মাধ্যমে একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যথেষ্ট চেষ্টা নিয়েছে, যদিও ওয়াশিংটন এই প্রক্রিয়াতে বেইজিংকে জড়িত করার ব্যাপারে সতর্ক ছিল। ২০১৪ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স থেকে চীন ও কিউবা পর্যন্ত দেশগুলো পশ্চিম আফ্রিকার ইবোলা-সঙ্কটের জন্য একটি বিচ্ছিন্ন বহুপক্ষীয় উদ্যোগ নেয়। আন্তর্জাতিক প্রভাব সৃষ্টিতে ইতোমধ্যে যথেষ্ট দুর্বল হয়ে পড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোভিড-১৯ ইস্যুতে এক দিকে ঘরোয়াভাবে ভুল বার্তা দিয়েছে, অন্য দিকে এই ইস্যুতে দেশগুলোকে একত্র করতে ব্যর্থ হয়ে আন্তর্জাতিক বিরক্তি জাগিয়ে তুলেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প কেবল রোগের চীনা উৎসের প্রতি তোপ দাগেননি একই সাথে এই ইস্যুতে ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও সমালোচনা করেছেন। এখন প্রবল প্রতাপে তা যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত হানতে শুরু করলে ট্রাম্প নিজেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছেন।

এর বিপরীতে চীন প্রাথমিক প্রাদুর্ভাবের পরিণতিগুলি মোকাবেলা করার চেষ্টা করেছে। আফ্রিকা মহাদেশে কোভিড-১৯-এর সম্ভাব্য ব্যাপক প্রাদুর্ভাবের আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার নেতৃত্ব হিসেবে চীন তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে উচ্চ গিয়ারে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের মতো মিত্র ও আধা মিত্র দেশগুলোর পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টাও করছে বেইজিং। চীনা বিলিয়নেয়ার জ্যাক মা ঘোষণা করেন যে, তার ফাউন্ডেশন আফ্রিকা মহাদেশের ৫৪টি দেশকে ২০,০০০ টেস্টিং কিট, ১০০,০০০ মাস্ক এবং এক হাজার ইউনিট প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম দেবে। জ্যাক মার পাঠানো কিছু সরঞ্জাম এর মধ্যে বাংলাদেশে এসে গেছে।
সামগ্রিকভাবে, ঐক্যের জন্য ডব্লিউএইচও’র আবেদন সত্ত্বেও এই মহামারী নিয়ে একটি বিভাজিত ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। কিছু নেতা এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে চেয়েছেন। বর্তমানে জি-২০-এর সভাপতিত্বকারী রিয়াদ গ্রুপ নেতাদের জি -৭ এর মতো একটি ‘ভার্চুয়াল শীর্ষ সম্মেলন’ করার আহ্বান জানিয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ এই উত্তেজনা কমিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন গ্রুপের প্রতি প্রতিপক্ষকে ছাড় দিয়ে বিরোধের একটি সার্বিক বৈশ্বিক নিষ্পত্তির দিকে এগিয়ে আসার সুপারিশ করেছিল। ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত অবরোধ তুলে নিতে শুরুতেই অস্বীকৃতি জানিয়ে এটি নাকচ করে দিয়েছে ওয়াশিংটন। ফলে সাধারণ বৈশ্বিক স্বাস্থ্যবিপদ সবাইকে একতাবদ্ধ করতে পারেনি; বরং বিরোধ যেন আরো বেড়ে যাচ্ছে। পরস্পরবিরোধী উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত ওয়াশিংটন, বেইজিং এবং অন্য শক্তিগুলোর মধ্যে উত্তেজনা আরো বাড়াতে পারে।

চীন এগিয়ে যাবে এরপরও
চীন কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে ভালো কাজ করেছে এবং আইসোলেশন লকডাউন ফর্মুলা প্রয়োগ করে এর বিস্তৃতি রোধ করেছে। এখন স্থবির হয়ে পড়া চীনা অর্থনীতি আবার সক্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিক্রিয়া এবং কাজও অসাধারণ হয়েছে। নতুন পরিস্থিতিতে বিশেষত তিনটি ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের সহায়তা প্রয়োজন বলে মনে হচ্ছে। প্রথমত, সরবরাহের চেইন এবং রসদ উন্মুক্ত রাখা, যাতে ওষুধ, ভ্যাকসিন এবং সুরক্ষা উপকরণের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মোকাবেলা করা যায়। দ্বিতীয়ত, স্বাস্থ্য ও সেবাকর্মীদের বিশ্বস্ত তথ্য সরবরাহ করা। প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ, স্বচ্ছ এবং যতটা কার্যকরভাবে সম্ভব সেটি করা উচিত। তৃতীয়ত, ডায়াগনস্টিক টেস্ট, জনস্বাস্থ্য এবং প্রতিরোধ সম্পর্কিত গবেষণা কার্যক্রম জোরদার করা। কোভিড-১৯-এ সংক্রমিত রোগীদের জন্য নতুন ওষুধ ও ভ্যাকসিন, চিকিৎসা এবং ওষুধের উন্নয়ন এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কোভিড-১৯ ভাইরাস দিয়ে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সম্পর্ক মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির সরবরাহের ওপর পশ্চিমকে কম নির্ভরশীল করার দাবিও জোরালো হচ্ছে। প্রশ্ন এসেছে এই মহামারী বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় কি প্রভাব ফেলতে পারে? একুশ শতকের শুরুতে বিশ্বায়নের বর্তমান মডেলটি রূপ নিয়েছিল। এক দশক আগে, রাশিয়া ইন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স জার্নাল লিখেছিল, পুরো বিষয়টি এমন এক ধারণার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়ানো যে, পুরনো বাজার অর্থনীতির দেশগুলো একই সাথে তাদের নিজস্ব উৎপাদন চীনে স্থানান্তর এবং আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে পাশ্চাত্য ব্যবস্থার অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হবে।

মার্চ ২০১৪, টাইম ম্যাগাজিনে উল্লেখ করা হয় যে, গত দুই বছরে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য বৃদ্ধি বিশ্বব্যাপী জিডিপি প্রবৃদ্ধির তুলনায় কম হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এটিই ছিল এ ধরনের প্রথম ঘটনা। আর বিশ্ব অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় চিহ্নিত করে পেরিফেরিয়াল দেশগুলো থেকে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থার অ্যাংলো-স্যাকসন কেন্দ্রে আসা পণ্যের স্থান করে নেয়ার সম্ভাবনা এতে তীব্রতর হয়েছে।
এ দিকে সৃষ্ট নানা পরিস্থিতিতে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলো আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার সম্ভাব্য পতনের বিরুদ্ধে সুরক্ষাকারী হিসেবে কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ওয়াশিংটন গত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল নয় এমন আর্থিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরির উপায় অনুসন্ধান করছে বলে মনে হয়। এতে অঞ্চল-বিস্তৃত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবয়ব গ্রহণসহ ইউরেশিয়া, এশিয়া এবং আফ্রিকাতে নতুন রাজনৈতিক জোট তৈরি হচ্ছে।

প্রশ্নবিদ্ধ পশ্চিমকেন্দ্রিক উন্নয়ন মডেল
বর্তমানে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রবর্তক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু এটি যেভাবে চলছে তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই ক্রমেই অসন্তুষ্ট হয়ে উঠছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের গত তিন বছরের টুইট বার্তাগুলো এবং সুনির্দিষ্ট বিচ্ছিন্নতাবাদী বাণিজ্য ব্যবস্থাগুলো প্রায় পুরো ‘পশ্চিমকেন্দ্রিক’ উন্নয়নের মডেলকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ফলস্বরূপ, কোভিড-১৯ সম্পর্কে প্রথম রিপোর্ট আসতে শুরু করার সাথে সাথে, চীনের সাথে আমেরিকার চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের প্রেক্ষাপটেই এটিকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যাখ্যা করা হয়।

প্রকৃতপক্ষে, ২০১৭ সালে ট্রাম্প নতুন জাতীয় সুরক্ষার কৌশল উন্মোচন করেন। ট্রাম্প তখন বলেন যে, বিশ্ব প্রতিযোগিতার নতুন এক ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এখন আক্ষরিক অর্থে প্রতিটি দিন আমাদের কাছে নতুন প্রমাণ এনে দেয় যে, পশ্চিম এবং বাকি বিশ্ব সত্যিকার অর্থে চীন থেকে সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল। আমেরিকা এবং ইউরোপের খুব কম নীতিপ্রণেতাই বিগত দশকগুলোর বৈদেশিক নীতি পুনর্বিবেচনা করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে।

২০১৮ সালের সমাপ্তিতে, ওয়াশিংটনের ‘ভিত্তি ভেঙে ফেলার’ নীতি বাণিজ্যযুদ্ধ প্রতিরোধের জন্য ডব্লিউটিও-অনুপ্রাণিত রীতিনীতির আত্মবিশ্বাসকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে। এ ছাড়া আগে থেকেই হোয়াইট হাউজ ‘জাতীয় সুরক্ষা স্বার্থকে’ বৈশ্বিক ব্যবস্থার সীমিত ব্যবহারের ন্যায্যতা হিসেবে উল্লেখ করে। ফলে যে কোনো দেশ এখন বিশ্বব্যাপী মহামারীটি শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাঠামোর বাইরে বাণিজ্যবিরোধ সমাধানের সুবিধার্থে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এ প্রসঙ্গে ইকোনমিস্ট তাৎপর্যপূর্ণভাবে বলেছে, ‘বর্তমানের পর্যায়ে বিশ্বায়নে কে কী অবদান রেখেছে তার অনেক কিছুই এখন গুরুত্বপূর্ণ নয়।’

অনেকে মনে করছেন, কোভিড-১৯ মহামারীটি ‘হিংসাত্মকতা এবং সুরক্ষাবাদ’-এর ওপর ভিত্তি করে বিশ্বব্যবস্থার দর্শনের বৈধতা দেয়ার একটি সুযোগ এনে দিয়েছে। মহামারী সৃষ্ট ব্যাপক আকারে মৃত্যুর আশঙ্কার মুখোমুখি এসে যে কেউ একতরফাবাদের নিন্দা ত্যাগ করতে পারে। সমালোচকদের মতে, এটি যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সংশোধনবাদী ভূ-অর্থনৈতিক প্রকল্পের আন্ডার লাইন, যা ট্রাম্প-পরবর্তী মার্কিন শাসকগোষ্ঠীর দীর্ঘমেয়াদি লক্ষের প্রতিফলন।

কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ব্রিটিশ মিডিয়া রিপোর্টগুলো এবং সেই সাথে বিশ্বের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ চীন থেকে অ্যান্টিবায়োটিক বা যোগাযোগ সরঞ্জাম আমদানির সমালোচনা করেছে। তদুপরি, পশ্চিমা বিশ্লেষকরা বিশ্বাস করেন যে, প্রযুক্তিগত এবং লজিস্টিকাল দৃষ্টিকোণ থেকে এই অপ্রয়োজনীয়তা থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ হবে কারণ শিল্প ও ভোগ্যপণ্যের অনেক ক্ষেত্রে চীনের আধিপত্য শুরু হয়েছিল মাত্র ১০-১৫ বছর আগে। এর অর্থ এই যে, কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব এই পুরো পরিস্থিতিতে এক ধরনের স্বস্তি এনে দিয়েছে। যেহেতু ‘প্রকৃতির বাহিনী’ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা শক্ত, তাই কিছু লোক বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা পরিচালিত বিদ্যমান আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়াগুলোর কাঠামোর মধ্যে সীমান্তের লোক ও পণ্য পরিবহনের বর্তমান বিধিনিষেধকে আরো কিছু সময়ের জন্য স্বাগত জানাবে।
অবশেষে, এটি স্পষ্ট যে ‘জাতীয় সুরক্ষা’ আর মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আরোপিত বিভিন্ন পদক্ষেপ ও নিষেধাজ্ঞা ‘বাণিজ্যচুক্তির পাতলা আস্তরণকে’ লঙ্ঘন করবে, যা পুরো বিশ্ব গত দশক ধরে গড়ে তুলেছে। তদুপরি, যুক্তরাষ্ট্র সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় আমেরিকার শীর্ষস্থান ধরে রাখতে আগ্রহী। ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউজে প্রথম বছরেই স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছিল, আমেরিকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যচুক্তিতে অংশ নেয়ার সুবিধাগুলো উপেক্ষা করে কেবল দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্পর্কের সুবিধা অর্জন করতে চায়। অধিকন্তু, বাস্তব অনুশীলন দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া এ জাতীয় চুক্তিগুলো কার্যকর করা এবং প্রয়োগ করা যেতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এই সময়ে আমেরিকা সৌদি আরবের হতাশার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে এবং মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটন তার প্রতিশ্রুতি ফিরিয়ে নিয়েছে। রিয়াদ ডাম্পিং অফারের মাধ্যমে বৈশ্বিক তেল বাজারকে আবারো অবয়ব দিতে চায় আর মার্কিন শেল তেল শিল্পকে অলাভজনক করে তুলতে চায়। এটি হলে শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র আবার মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে বাধ্য হবে। আবার পুরনো ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার বিষয় বিবেচনা করবে। এতে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে তার নীতির প্রথম শিকার হিসেবে আবিষ্কার করতে পারে।

চীন-নির্ভরতা ও নতুন ভারসাম্য পয়েন্ট
পাশ্চাত্যের রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা ‘আউটসোর্সিং’-এর অতীতের ইতিহাস এবং সব কিছুতে দ্রুত চীনের ওপর নির্ভরতা হ্রাসের আকাক্সক্ষা সামনে আনতে পারে। ক্রমশ ভারসাম্যহীন হওয়ায় বিদ্যমান বাজারের গঠনটি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হতে পারে। তবে এখনো পর্যন্ত, ‘নতুন ভারসাম্য পয়েন্ট’-এর অনুসন্ধান চলছে। পরিবর্তনের সময়গুলোতে সর্বদা নতুন সুযোগের অনুসন্ধান চলে। তবে চীনা উৎপাদনকারীদের বারবার অন্য কারো তুলনায় বাজারের পরিবর্তনের সাথে বেশি খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হতে দেখা গেছে। অন্য দিকে পশ্চিমা সংস্থাগুলো নমনীয়তা হারাতে থাকে এবং উন্নয়ন ও উৎপাদন ব্যয় তারা বাড়িয়ে তোলে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, চীন ইতোমধ্যে কার্যকরভাবে এর বিস্তার রোধ করে মহামারীর চরম অবস্থাকে পিছনে ফেলে এসেছে। চীনা স্টক সূচকগুলো বাড়ছে। অন্য দিকে আমেরিকান এবং ইউরোপীয়দের ক্ষেত্রে মনে হচ্ছে যে মূল আঘাতটি এখনো এগিয়ে যাচ্ছে।
তাত্ত্বিকভাবে, বিশ্বায়নের বর্তমান মডেলের সম্ভবত বিদ্যমান ভারসাম্যহীনতা নিয়ে হতাশাকে কিছুটা হ্রাস করতে পারে। তবে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি যে সাধারণ কাঠামোগত সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে তা কমাতে এটি কার্যকর কি না সেই প্রশ্ন থেকেই যাবে।

আশাবাদীদের বিশ্বাস
আশাবাদীরা বিশ্বাস করেন যে, মহামারী পরিস্থিতির উন্নয়নের সাথে সাথে অর্থনীতিতে এর আপেক্ষিক প্রভাব কমতে থাকবে। আর শেষ পর্যন্ত অর্থনীতিতে ভাইরাসের প্রভাব আসলে উপকারীই প্রমাণিত হবে। এতে প্রবৃদ্ধির হার কমবে, তবে এটি একটি ‘স্বাস্থ্যকর’ প্রাকৃতিক প্রবৃদ্ধি হবে। সম্পত্তির বাজারগুলোতে অনুমানমূলক ‘বুদ্বুদগুলো’ প্রাকৃতিক উপায়ে ফেটে যাবে এবং শীর্ষস্থানীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো অর্থ সরবরাহ বাড়িয়ে তুলবে। এ সবই নেতৃস্থানীয় অর্থনীতিগুলোকে মন্দা পড়ার পরিবর্তে ধীরগতিতে হলেও তাদের বৃদ্ধি বজায় রাখতে সক্ষম করবে। এর অর্থ হলো ‘মহামারীর কারণে বিশ্বব্যাপী সঙ্কট অনিবার্য না-ও হতে পারে।’

অনেক পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করেন যে, করোনাভাইরাস মহামারীটির চিকিৎসাসংক্রান্ত পরিণতি বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের জন্য অনেক কম ধ্বংসাত্মক প্রমাণ হতে পারে। অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের বিশেষজ্ঞরা ইতোমধ্যে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, যোগাযোগ এবং স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করার নীতি কেবল সঙ্কট আরো বাড়িয়েই তুলতে পারে এবং ভবিষ্যতে তা অতিরিক্ত সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

বিশ্বব্যবস্থা নতুন অবয়ব নেবে?
তবে এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ২০০৮-২০০৯ সঙ্কটের দশ বছর পরে কোভিড-১৯ মহামারীটি আবারো রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী সম্প্রদায় এবং সাধারণ জনগণের কাছে বর্তমান আন্তর্জাতিক আর্থিক ও অর্থনৈতিক মডেলের দুর্বলতা প্রদর্শন করছে। অনেক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান মূলত উৎপাদনকে ভোক্তাদের কাছে নিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে উৎপাদন ও সরবরাহের লাইন পুনর্গঠনের চেষ্টা করবে। বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বিনোদন শিল্প শেষ পর্যন্ত হতে পারে এক অনলাইন বাহন।

অনেক দেশের কর্তৃপক্ষের খাদ্য ও ওষুধ শিল্পসহ কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে স্থানীয় উৎপাদন পুনরুদ্ধার বা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে কাজ করার সম্ভাবনা রয়েছে। দেশীয় উৎপাদকদের রাষ্ট্রীয় সহায়তার নীতি আবার জনপ্রিয়তা পাবে। এর লক্ষ্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সীমাবদ্ধ করার পক্ষে তেমন কিছু হয়তো হবে না, তবে একটি নির্ভরযোগ্য দেশীয় বাজার তৈরি হবে, যা সঙ্ঘাত আর বিশ্ববাণিজ্য দিয়ে উত্থিত চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর কম নির্ভরশীল হবে।

এটিও সত্যি যে, বিশ্বব্যবস্থার বর্তমান গঠনটি কেবল আদর্শগতভাবে অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে তাই নয় অধিকন্তু এটি এখন মানবিক, প্রযুক্তিগত, জলবায়ু এবং নতুন বৈশ্বিক উত্থান ঘটানোর ক্ষেত্রে রীতিমতো বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পরও আদর্শিকভাবে এবং প্রায়োগিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বায়ন সুস্পষ্টভাবে আরো বিকশিত হতে থাকবে। জনগণ এবং দেশগুলোর মধ্যে নতুন পরিচিতিগুলোকে পুরোপুরি বিলুপ্ত করার কোনো উপায় থাকবে না; তবে বিশ্বায়ন যে নতুন রূপ নেবে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে জাতীয় এবং বৈশ্বিক উন্নয়নের অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে একটি নতুন ভারসাম্য খুঁজে পেতেই হবে। 
mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement