২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

নহর থেকে সরোবর

-

নহর আর সরোবর শব্দ দু’টি সমার্থক না হলেও অর্থের দিক থেকে খুব কাছাকাছি। আরবি নাহর থেকে বাংলায় নহর শব্দটি এসেছে। এর অর্থ নদী, প্রণালী, নালা, খাল, সরু জলপথ, স্রোতস্বিনী, জলধারা ইত্যাদি। অন্য দিকে, সরোবর মানে পদ্মফুলযুক্ত বড় পুষ্করিণী; হ্রদ বা দীঘি।

আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের ইতিহাসে নহর শব্দটির সাথে জুবায়দা নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। ইতিহাস ও কিংবদন্তি থেকে জানা যায়, আব্বাসীয় শাসনামলে ক্ষমতাধর নারী ছিলেন জুবায়দা। তিনি ছিলেন যেকোনো ভালো কাজে আগ্রহী আর অগ্রগামী। সমসাময়িক দুনিয়ায় তার মতো বিদুষী, সুন্দরী, পরোপকারী ও বুদ্ধিমতী নারী দ্বিতীয়জন ছিলেন না। তিনি কেবল উচ্চগুণসম্পন্ন নারীই ছিলেন না, ছিলেন একজন কবিও।

মরুপ্রবণ মক্কায় পানির তেমন উৎস ছিল না। তাই সবসময় পানি সঙ্কট ছিল তীব্র। ফলে সেকালে হজযাত্রীরা পানির অভাবে অসহনীয় কষ্ট পেতেন। ১৯৩ হিজরিতে আব্বাসীয় খলিফা হারুন অর রশিদের সময়ে পানির অভাব এতই তীব্র হয়েছিল যে, এক বালতি পানি ২০ দিরহামে বিক্রি করা হতো। খলিফা হারুন অর রশিদের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনাও হজযাত্রীদের পানির অভাব থেকে মুক্তি দিতে পারেনি। ৮০২ হিজরিতে সম্রাজ্ঞী জুবায়দা, পুত্রদ্বয় আমীন ও মামুনকে নিয়ে খলিফা হজ পালনে মক্কায় যান। এ সময় জুবায়দা হজ উপলক্ষে মক্কায় আসা হজযাত্রীদের পানীয়জলের কষ্ট দূর করার লক্ষ্যে এক লাখ দিনার ব্যয়ে পঁচিশ মাইল দূর থেকে একটি খাল খনন করে পবিত্র মক্কা নগরীতে পানি সরবরাহের উদ্যোগ নেন।

ঘটনাটি চমকপ্রদ। পবিত্র মক্কায় পানির কষ্ট দেখে জুবায়দা এতই ব্যথিত হন যে, এর অবসানে একটি খাল খননের সিদ্ধান্ত নেন। খালটি এমন সময়ে খনন করা হয়েছিল, যখন আধুনিক প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা ছিল না। শত শত বছর খালটি থেকে ওই অঞ্চলের মানুষ পানির চাহিদা মিটিয়েছে। সেকালে এই খাল খনন প্রকৌশলবিদ্যার এক অসাধারণ কীর্তি। রানী জুবায়দা খাল খননের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে বিখ্যাত সব প্রকৌশলী ও জরিপকারীকে ডেকে পাঠান। পুরো এলাকা জরিপের পর তারা সিদ্ধান্ত দিলেন হুনায়ন (পবিত্র মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী পাহাড়ি এলাকা) উপত্যকার পার্বত্য ঝর্ণাÑ যা সেখানকার অধিবাসীদের খাবার পানির প্রয়োজন মিটাত, সেখান থেকে খালটি খনন করে আনা হবে। হজ পালন শেষে বাগদাদে ফিরে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়নই জুবায়দার একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান হয়ে দাঁড়ায়। গভীর মনোনিবেশ করলেন শুধু এই কাজে।

মক্কার মরুপ্রবণ অঞ্চলটি কঙ্করময়, অনুর্বর, শুষ্ক এবং সেখানকার আবহাওয়া উষ্ণ। ফলে ভূপৃষ্ঠে একটি খালের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা ছিল কঠিন। তাই প্রকৌশলীরা টানেলের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ খাল খননের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন, জনগণ যাতে এ খাল থেকে পানি সংগ্রহ করে তাদের প্রয়োজন মেটাতে পারে। এর জন্য কিছু দূর অন্তর অন্তর ভূপৃষ্ঠে পানির কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। সম্রাজ্ঞী জুবায়দার নির্দেশে হুনায়ন উপত্যকার ঝর্ণাসহ পানির উৎসগুলো বিপুল অর্থের বিনিময়ে কিনে নেয়া হয়েছিল। পর্বতের মধ্য দিয়ে পানি আনা ছিল একটি কঠিন কাজ। যাতে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল বিপুল লোকবল এবং প্রচুর অর্থের। পর্বত কাটার জন্য, অনুর্বর এবং কঙ্করময় পাহাড় খনন করতে প্রয়োজন হয়েছিল বহু বিশেষজ্ঞের। কিন্তু কোনো কিছুই জুবায়দার দৃঢ়প্রতিজ্ঞাকে ক্ষুণœ করতে পারেনি। রানী বলেছিলেন, ‘যদি প্রয়োজন হয় কোদাল এবং শাবলের প্রতিটি আঘাতের জন্য আমি এক দিরহাম অর্থ পরিশোধ করব।’ এই বলে তিনি কাজ শুরু করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। বেশ কয়েক বছর টানা কঠোর পরিশ্রমের পর অবশেষে জাবালে রামা তথা দোয়ার পর্বত পেরিয়ে এ নহর আরাফাতে নিয়ে আসা হয়। তারপর নিয়ে আসা হয় মুজদালিফা এবং মিনায়। হুনায়ন উপত্যকার ঝর্ণার পানি এবং পথে অন্য উৎসগুলো এ নহর অভিমুখে এনে সংযুক্ত করা হয়। এ নহরের মাধ্যমে পানি সরবরাহের মধ্য দিয়ে হজ পালনকারী এবং মক্কার জনগণ খাবার পানির সঙ্কটমুক্ত হন। মানবদরদি ও বিশাল অন্তরের রানী জুবায়দার জীবনের এটি ছিল বিশেষ কীর্তি। ইতিহাসে এই খালই ‘নাহর-ই-জুবায়দা’ নামে প্রসিদ্ধ। বাংলা করলে দাঁড়ায় জুবায়দার নহর। এই হলো মানবহিতৈষী জুবায়দার চরিত্র মাধুর্য। নহরে জুবায়দার কাহিনী অনেকেরই কম-বেশি জানা।

এখন রাজধানীর ধানমন্ডি লেকের পাশে অবস্থিত রবীন্দ্র সরোবর মঞ্চও আমাদের অনেকের পরিচিত। তবে ‘সুলতানা সরোবর’র গল্পগাথা ভিন্ন ধাঁচের। দিন দশেক আগে ফের গণমাধ্যমে সরোবর শব্দটি উচ্চারিত হয় জোরেশোরে। তবে ‘সুলতানা সরোবর’ নামটি জানা যায় গত বছর ১৯ মে নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউনের বদৌলতে। এই নামকরণে বাদ সাধে একটি প্রতিবেদন। তার রচয়িতা বাংলা ট্রিবিউনের কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম। গত বছর মে মাসে আরিফুলের প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল, ‘কাবিখা’র টাকায় পুকুর সংস্কার করে ডিসির নামে নামকরণ!’ ‘কুড়িগ্রাম শহরে সরকারি ও ব্যক্তিপর্যায়ের অনুদানে পুকুর সংস্কার করে জেলা প্রশাসক মোছা: সুলতানা পারভীনের নাম অনুসারে ‘সুলতানা সরোবর’ রাখার বড় সাধ নাকি জাগে তার। এ নিয়ে জেলাজুড়ে আলোচনামুখর হন অনেকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বয়ে যায় সমালোচনার ঝড়। তাদের প্রশ্ন ছিল, সরকারি অর্থ ব্যয়ে পুকুর সংস্কার করে জেলা প্রশাসকের নাম দেয়াটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত?

খবরে প্রকাশ, ১৯৭৮ সালে কুড়িগ্রাম শহরে ওই পুকুর খনন করা হয়েছিল। নাম দেয়া হয় ‘নিউ টাউন পার্ক’। পুকুরটিতে মাছ চাষ করা হতো। এর পাড়ে গড়ে ওঠে নার্সারি। তবে বিভিন্ন সময় পুকুরপাড়ে অসামাজিক কার্যকলাপ চলার অভিযোগ ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আগের জেলা প্রশাসকের পরিকল্পনা অনুযায়ী জেলা প্রশাসন পুকুরটি সংস্কার করে এর পাড়ে সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্যোগ নেয়। সদ্য প্রত্যাহার করা জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন পুকুরটির সংস্কারকাজ শুরু করেন। এ কাজের অংশ হিসেবে পুকুরটি পুনঃখনন করে চার পাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণ করে স্থাপন করা হয় সোলার স্ট্রিট ল্যাম্প। পুকুর সংস্কারের বিষয়টি সব মহলে প্রশংসিত হলেও বিপত্তি ঘটে এর নাম পরিবর্তনের খবরে। গত বছরের ১৪ মে জেলা প্রশাসক মোছা: সুলতানা পারভীন নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে তার ছবিসহ পুকুরের নতুন নাম (সুলতানা সরোবর)সংবলিত একটি পোস্ট দেন। এরপর জেলাজুড়ে শুরু হয় সমালোচনা।

কিন্তু ওই প্রতিবেদনের জন্য আরিফুলকে চড়া মূল্য দিতে হলো বছরখানেক পরে এবার। অনেকের ধারণা, সদ্য প্রত্যাহার করা জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন করাই আরিফের কাল হয়েছে।

গত ১৩ মার্চ মধ্যরাতে আরিফকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, মাদকবিরোধী অভিযানে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার কাছ থেকে ৪৫০ গ্রাম দেশী মদ ও ১০০ গ্রাম গাঁজা উদ্ধার করা হয় বলে অভিযান পরিচালনাকারীদের দাবি। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে কুড়িগ্রাম শহরের চড়ুয়াপাড়ায় থাকেন আরিফুল। সেই বাড়িতেই অভিযান চালানো হয়েছিল। সেটি ছিল আরিফুলের জীবনের কালরাত। বিভীষিকার চিত্রটি ছিল এমনÑ মধ্যরাতে বাড়ির দরজায় আঘাত। পুলিশের কথা বলে দরজা খোলার আহ্বান। না খুলতে চাইলে দরজা ভেঙেই অনুপ্রবেশ। এরপর হাত-পা বেঁধে আরিফকে মারধর। চোখ বেঁধে জোর করে গাড়িতে তুলে নিয়ে গুলি করে হত্যার হুমকি। অনেক অনুনয়-বিনয়েও উপেক্ষাÑ যে বর্ণনা দেয়া হলো, তার সাথে কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের মিল খুঁজে পাওয়া স্বাভাবিক। অবাক করা ব্যাপার, কুড়িগ্রামের সাংবাদিক আরিফুল ইসলামের ওপর এ নিগ্রহ চালিয়েছে জেলা প্রশাসনের একটি দল।

সেই নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা গণমাধ্যমের কাছে তুলে ধরেছেন সাংবাদিক আরিফুল। তার অভিযোগ, খোদ জেলা প্রশাসনের আরডিসি (সিনিয়র সহকারী কমিশনার) নাজিম উদ্দীন এ হামলার নেতৃত্ব দিয়েছেন। নিজ হাতে পেটান তিনি। তদুপরি এনকাউন্টারে দেয়ারও হুমকি দেন। আরিফ বলেছেন, ‘মারধরের সময় বারবার জানতে চেয়েছি, আমার অপরাধ কী? তখন নাজিম উদ্দীন বলেন, তুই আমাদের অনেক জ্বালাচ্ছিস। ডিসির বিরুদ্ধে লিখিস। তুই বড় সাংবাদিক হয়ে গেছিস। আজ তোর সাংবাদিকতা ছোটাব।’

বর্ণিত দু’টি ঘটনার কেন্দ্রীয় চরিত্র দু’জন নারী। জুবায়দা ঐতিহাসিক চরিত্র। তার মানবহিতৈষী কাজ সর্বমহলে এখনো প্রশংসিত। আর সুলতানা পারভীন বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের সুবিদাপ্রাপ্ত নারী। তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা; যারা সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে থাকেন। তিনিই প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে প্রশাসনিক ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এক নিরীহ গোবেচারা সাংবাদিকের ওপর যার কিনা নুন আনতে পান্তা ফুরায়। ফলে গণমাধ্যমের কল্যাণে জানা গেল তার ‘গণবিরোধী’ কাজ । এতে লজ্জায় ফেলে দিয়েছেন মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার অসামান্য সৃষ্টি ‘সুলতানার স্বপ্ন’ গল্পের নায়িকা সুলতানাকে। অনেকে বলেছেন, ডিসি সুলতানা নিজের নামের প্রতিও সুবিচার করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

camirhamza@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement