১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভাইরাস, জীবাণু মারণাস্ত্র : বৈশ্বিক নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ

-

[গত কালের পর]

২.
চীন ছাড়া আর দুটি দেশ মৃত্যুহার ও প্রাদুর্ভাবের দিক থেকে করোনাভাইরাসে ভীষণভাবে আক্রান্ত: একটি ইতালি, আরেকটি ইরান। ইরান করোনাভাইরাসে অতিশয় আক্রান্ত তিনটি দেশের একটি। ইরানের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতার পরামর্শদাতাদের একজন, আয়াতুল্লাহ হাশেম বাথায়ি গোলপায়েগানি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ডাক্তারি পরীক্ষায় নিশ্চিত হওয়ার দুই দিনের মধ্যেই মারা গিয়েছেন। ইরানের রেভুলিউশনারি গার্ড কোরের একজন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাসের শাবানি কোভিড-১৯ সংক্রমণে মারা গিয়েছেন। ইরানে মৃতের সংখ্যা ইতোমধ্যে, যখন এ লেখা লিখছি, ৮৫০ ছাড়িয়ে গিয়েছে।

বাংলাদেশ ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে। এ রোগের সংক্রমণ সরকারি পর্যায়ে অস্বীকার করবার প্রবণতা আমরা শুরু থেকেই লক্ষ করছি। সংক্রমণ শনাক্তকরণের কোনো বিধিবদ্ধ ব্যাপক ব্যবস্থা নাই। আমরা আসল পরিস্থিতি ঠিক কী, জানি না। জানার কোনো উপায় নাই। জনস্বাস্থ্যের প্রতি উদাসীনতার যে অবিশ্বাস্য মাত্রা আমরা লক্ষ করছি, তা ভয়ঙ্কর। এর জন্য বাংলাদেশের উন্নয়ন সহযোগী দ্বিপক্ষীয় সহযোগীরাই প্রধানভাবে দায়ী। তারাই সরকারের এই ধরনের আচরণ টিকিয়ে রেখেছে।

সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করলে তা সারা পৃথিবীর জন্য হুমকি হয়ে উঠবে। এর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও দায়ী। কারণ তাদের তরফ থেকে সরকারের ওপর কোনো চাপ দেয়ার লক্ষণ আমরা দেখছি না। এতে তথ্য লুকিয়ে রাখবার সুবিধা হচ্ছে। কথিত উন্নয়ন সহযোগীদের তরফ থেকে কোনো উচ্চবাচ্য নেই। সরকার টিকিয়ে রেখেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বহুপাক্ষিক সংগঠন। কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে বাংলাদেশের জনগণকে করোনাভাইরাসে মারবার প্রস্তুতিই চলছে যেন! ভয়াবহ।

মনে রাখবেন, পরিস্থিতি এমন যে, করোনাভাইরাস জৈব মারণাস্ত্র হোক না হোক, অসম বিশ্বব্যবস্থায় সংক্রমণের মাত্রা ও ক্ষতি আপনাকেই বহন করতে হবে। বিশ্বব্যাপী প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের বিনাশ, ভারসাম্যহীনতা ও অব্যবস্থাপনার শিকার হবেন আপনি। ল্যাবরেটরিতে তৈরি না হলেও প্রকৃতি ধ্বংস করলে তার প্রতিশোধ মহামারী মড়ক ইত্যাদির মাধ্যমে প্রকৃতি নিয়ে থাকে। আপনি ক্ষমতাসীন সরকার এবং পাশ্চাত্য শক্তিগুলোর চোখে স্রেফ সংখ্যা মাত্র। মানুষ নন। আপনি বাদুড়ের মতো করোনাভাইরাস বহনকারী জীব। কিন্তু আপনার নিজেরই কোনো হুঁশ নাই।

আমাদের বেহুঁশ হাল ও অজ্ঞানতার সুযোগে ক্ষমতাসীনরা তথ্য লুকাচ্ছে। এই বিপর্যয় থেকে মানুষকে রক্ষা করবার প্রস্তুতি তাদের নাই। মানুষ মরে কি বাঁচে তাতে কারোই মাথাব্যথা নাই।

একটি লুটেরা রাষ্ট্র ব্যবস্থা দিল্লি-ওয়াশিংটন-লণ্ডন-ব্রাসেলস টিকিয়ে রেখেছে, পিকিং অর্থনৈতিক ফায়দা তুলে নিচ্ছে। কিন্তু আপনার নিজের বিপদ সম্পর্কে আপনার নিজেরই কি কোনো হুঁশ আছে?

করোনাভাইরাস সম্পর্কে আমরা শুধু ইউরোপিয়ানদের ভাষ্য শুনি। তাদেরই তথ্য, বিশ্লেষণ, দাবি আর পাল্টা দাবি শুনি। কিন্তু ইরান করোনাভাইরাস সংক্রমণ সম্পর্কে কী বলে আমরা শুনি না। কারণ সেখানে শিয়া ইমামরা ক্ষমতায় আছেন। আমরা তাদের পছন্দ করি না। করোনাভাইরাস শিয়া-সুন্নি ভেদ করতে পারে কি না, সেই গবেষণার কোনো খবর আমার জানা নেই। আপনি ইরানের কথা শুনছেন না। একে ‘প্রপাগান্ডা’ বলছেন, কিংবা বলছেন মার্কিনিরা যেমন পণ্ডিতি করে বলে থাকে ‘ল্যাকিং এভিডেন্স’।

এতে আপনার কথায় একটা বৈজ্ঞানিক নিরপেক্ষতার ভাব আসে, কিন্তু আপনাকে ‘বিশুদ্ধ বেকুব’ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। মনে রাখবেন, ষোলো বা সতেরো শতাব্দীর বিজ্ঞানের কেচ্ছা শুনে বিজ্ঞান সম্পর্কে আপনি যে নির্বিচার ধারণা গড়ে তুলেছেন, সেটা স্রেফ অন্ধবিশ্বাস। যেমন, বিজ্ঞান আর কৃৎকৌশল মানেই দেশকালপাত্র ভেদে সবসময়ই সত্য এবং মঙ্গল। এই নির্বিচার অনুমানকেই ‘অন্ধবিশ্বাস’ বলা হয়। অন্ধ বিশ্বাস ত্যাগ করুন। আপনার মাথা বিগড়ে আছে। নিজের প্রতিরক্ষার কথা ভাবুন।

ঠিক আছে, না হয় ‘অন্ধবিশ্বাস’ বললেন না। কিন্তু একালে ‘বিজ্ঞান’ নামক ধারণা আসলে ‘ইডিওলজি’। আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করবার মতাদর্শিক হাতিয়ার। দেখুন, ‘ধারণা’ বলেছি, বিজ্ঞান বা কৃৎকৌশল আমাদের মঙ্গল করে নাকি মন্দ, সেটা সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশল পর্যালোচনা করেই করতে হবে। বিজ্ঞান মানেই ভালো, কৃৎকৌশল মানেই ভালো- এই গড়ে হরিবোল ধারণা ‘ইডিওলজি’। তাই বিজ্ঞানের যে স্পিরিট অর্থাৎ প্রত্যক্ষভাবে জগতকে জেনে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কোনো একটি অনুমান, প্রস্তাব বা থিসিস সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসা- সেই স্পিরিট এখন তলানিতে। বিজ্ঞানের জগত দখলে নিয়েছে বহুজাতিক কোম্পানি, মারণাস্ত্র ইন্ডাস্ট্রি এবং পরাশক্তি দেশগুলোর প্রতিরক্ষা বিভাগ। এর বাইরে সত্যিকারের বিজ্ঞানের নিজস্ব ক্ষেত্র ও লড়াই আছে; প্রাণ, পরিবেশ ও প্রকৃতি সুরক্ষার বিজ্ঞান যেমন, যার ভিত্তি হাজার হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছে। সেই বিজ্ঞানে বিজ্ঞানী হয়ে উঠতে হবে আমাদের। আমাদের দরকার উন্নত গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যেখানে লোকায়ত চর্চা, প্রজ্ঞা, বিজ্ঞান, নীতিনৈতিকতা এবং দূরদৃষ্টি অর্জন প্রধান ভূমিকা রাখবে। কারণ এই অসম বিশ্বে আমাদের বেঁচে থাকতে হবে। ইঁদুরের মতো মুখে ফেনা তুলে মরে গেলে চলবে না।

মানুষের সব কর্মকাণ্ডই নৈতিক পর্যালোচনা সাপেক্ষে বিচার্য। কারণ মানুষ জন্তু-জানোয়ার নয়। কিন্তু ‘বিজ্ঞান’ নামক ইডিওলজির নামে আপনার নৈতিক জীবন অস্বীকার করা হয়। বিজ্ঞানের কাজ কি শুধু ভোগী মানুষের ভোগের চাহিদা মেটানো? নৈতিকতার জায়গা থেকে বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের পর্যালোচনা জরুরি। কিন্তু এই অতি প্রাথমিক কর্তব্য থেকে মানুষ সরে এসেছে। বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশল মানেই কোনো প্রকার বিবেচনা ছাড়াই ভালো- এই মহামূর্খতার প্রচার ও আধিপত্য এমনই বেড়েছে যে, আপনি বুঝতেই পারছেন না- বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশল এখন দুনিয়ার অল্পকিছু বহুজাতিক কোম্পানি এবং মারণাস্ত্র তৈরির ইন্ডাস্ট্রির প্রায় একচেটিয়া হয়ে গিয়েছে।

ভুলে যাবেন না, প্রথম পারমাণবিক বোমা হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে মেরে তার কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয়েছিল। হয়তো করোনাভাইরাস এর ব্যতিক্রম নয়। মানুষের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। বাংলাদেশের মানুষের ওপর ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা খুবই সহজ। তাই একদিকে বিপর্যয় থেকে সুরক্ষার প্রস্তুতি যেমন দরকার, তেমনি ইরানিদের দাবি ‘প্রপাগান্ডা’ হোক বা না হোক... আমি তা শোনার পক্ষপাতী। এটা সত্যও হতে পারে। করোনাভাইরাস দুনিয়ার প্রধান ও এক নম্বর মারণাস্ত্র উৎপাদক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের একটি জৈব মারণাস্ত্র (Biological Weapon)। ‘প্রপাগান্ডা’ বলে এটাকে উপেক্ষা করতে পারেন, কিন্তু যখন আপনি জানবেন, অনেক দেরি হয়ে যাবে।

আধুনিক পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে বিজ্ঞান ‘নিরপেক্ষ’ নয়। বিজ্ঞানের আবির্ভাব ঘটেছিল বুদ্ধি ও বিচার-বিবেচনা দিয়ে আমাদের পরিদৃশ্যমান জগত বা প্রকৃতির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের দরকারে। কারণ, জানার পিপাসা মানুষের মজ্জাগত। কিন্তু সেই জানা কখনই স্রেফ জানার জন্য জানা ছিল না। সেই জানাকে মঙ্গল বা কল্যাণের দিকে প্রবাহিত করা ও প্রবাহিত রাখা সবচেয়ে কঠিন কাজ। মানুষের জানার পিপাসা এখনো তীব্র, কিন্তু তার ওপর আধিপত্য এসেছে মোটা দাগে দুটো ধাপে। প্রথম ধাপে ঘটেছে জানা ও বোঝার জগতে মানুষের নৈতিক ভূমিকা নির্ণয়ের কর্তব্য ভুলে গিয়ে বিজ্ঞানকে স্বয়ং অধিপতি হয়ে উঠতে দেয়ার মধ্যে। জানা বা বোঝার চেয়ে বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশল হয়ে উঠেছে স্রেফ জগত বা প্রকৃতির ওপর মানুষের আধিপত্য কায়েমের হাতিয়ার। মানুষই সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু, অন্য কোনো প্রাণী, জীব, অণুজীব নয়, মানুষের জন্যই দুনিয়া... এই চিন্তা একটি অসুস্থ জগত তৈরি করেছে। দুনিয়া মানুষের ভোগ্য বস্তু কেবল। দুনিয়ার একমাত্র কাজ মানুষের ভোগে লাগা। তাই মানুষের মধ্যে এই চিন্তা প্রবল হয়েছে যে, প্রকৃতির ওপর মানুষের আধিপত্য কায়েম করতে হবে, যে কোনো মূল্যে। বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশল, বিশেষত ইন্ডাস্ট্রিয়াল সভ্যতা (?) কিভাবে প্রকৃতির প্রাণব্যবস্থার ক্ষয় ঘটাচ্ছে, খোদ প্রকৃতিরই সর্বনাশ ঘটাচ্ছে, সেই দিকে কেউ ফিরেও তাকায়নি। অতি সম্প্রতি প্রকৃতি পরিবেশ নিয়ে কিছুটা হুঁশ তৈরির চেষ্টা চলছে।

দ্বিতীয় ধাপে বিজ্ঞান এসেছে মানুষের দেহ, চেতনা এবং আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে। পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালে বিজ্ঞানের এই রূপ প্রবলভাবে সামনে হাজির হয়েছে। যাকে আমরা মনোবিজ্ঞান বলি, সেটা এখন হয়ে গিয়েছে বিহেভিয়ারাল সায়েন্স। মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞান। এরপর এসেছে ডিজিটাল টেকনোলজি, ইন্টারনেট, স্মার্টফোন, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম ইত্যাদি। আপনি এখন সার্বক্ষণিক নজরদারির অধীন। এরপর রয়েছে বায়োটেকনোলজি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। এসেছে প্রাণকোষ বদলে দেয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং। প্রকৃতি স্বাভাবিকভাবে যে প্রাণ তৈরি করে তার ‘জিন’ বা গঠন সংকেত বিকৃত করে সেই সব অস্বাভাবিক জীব, অণুজীব ও প্রাণ তৈরি করা, যাতে খোদ প্রাণ এখন বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণের বিষয় হয়ে উঠেছে। অল্পকিছু বহুজাতিক কোম্পানি নিজেদের মধ্যে সারা দুনিয়াকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেবার তীব্র প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। জিন বা প্রাণের গঠন সঙ্কেত এখন বহুজাতিক কোম্পানির নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্র। এই নতুন বাস্তবতা মাথায় রেখে কোভিড-১৯ নিয়ে ভাবুন। খামোখা আতঙ্কিত হলে কোনো ফল হবে না।

এই যখন বিশ্বপরিস্থিতি তখন ইরানের ইসলামী রেভুলিউশনারি গার্ড কোরের (Islamic Revolutionary Guard Corps) কমান্ডার হোসেন সালামি ৫ মার্চ বলেছেন, করোনাভাইরাস মার্কিন জৈব মারণাস্ত্র হতে পারে। আমরা তার কথাকে ফেলে দিচ্ছি না। যারা ‘ল্যাকিং এভিডেন্স’ বলে জৈব মারণাস্ত্রের বিতর্ক এড়িয়ে যেতে চাইছেন, সালামির বক্তব্য তাদের বিপরীতে। ইরানের আধা সরকারি সংবাদ সংস্থার (ISNA news agency) খবর অনুযায়ী তিনি বলেছেন : ‘আজ আমাদের দেশ একটি জৈব যুদ্ধে অবতীর্ণ। এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা জিতব, যা মার্কিনিদের তৈরি জৈব হামলা হতে পারে, যা প্রথমে চীনে ছড়িয়েছে, এরপর সারা দুনিয়ায়।’ রাশিয়ার সোস্যাল মিডিয়াও একই অভিযোগ তুলছে। গুজব বলুন কিংবা প্রপাগান্ডা, চীনাদের জৈব মারণাস্ত্র তৈরির ল্যাবরেটরি থেকে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে- এই প্রচারও রয়েছে। এর বিপরীতে করোনাভাইরাসের ‘জেনোম’ বা গঠন সঙ্কেত বিচার করে বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি মানুষের তৈরি করা বলে মনে হয় না। অর্থাৎ ল্যাবরেটরিতে বানানো হয়েছে, সেটা প্রমাণ করা কঠিন।

ইরান গুজব ছড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর। এটা গুজব নয়। একটি সম্ভাবনা। সাইবার পুলিশ কমান্ডার বাহিদ মজিদ লোকজনদের গুজব ছড়ানোর জন্য ধরছেন। অনেককে ওয়ার্নিং দিচ্ছেন। ইরানে ‘সাইবার পুলিশ’ আছে।

আমরাও গুজবের বিরুদ্ধে অবশ্যই। কারণ ‘জৈব মারণাস্ত্র’ হোক বা না হোক, মানুষ বাঁচানোই এখন ফরজ। কিন্তু জৈব মারণাস্ত্রের অভিযোগ ভুলতে আমরা রাজি নই। কারণ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়ার জ্ঞান আমাদের কিছুটা হলেও আছে।

৩.
বাংলাদেশ মারাত্মক করোনাভাইরাস ঝুঁকিতে পড়ে গিয়েছে। আমরা কি এই বিপর্যয় মোকাবেলা করতে পারব? বাংলাদেশের জনগণের ওপর আমাদের আস্থা থাকা উচিত। মোকাবেলা দুঃসাধ্য বটে, কিন্তু মোটেও অসম্ভব নয়। সেটা সম্ভব যদি আমরা আতঙ্কিত না হই। দ্বিতীয়ত সরকারকে বুঝতে হবে আইন করে, মিলিটারি-পুলিশ দিয়ে মহামারী দমন করা করা যায় না। চিনের উহানে অসম্ভব সম্ভব হয়েছে প্রধানত স্বাস্থ্যকর্মী এবং স্থানীয় জনগণ দ্বারা। অর্থাৎ জনগণকেই সম্পৃক্ত করতে হবে। আইন, লাঠি বা বন্দুক দিয়ে পিটিয়ে মহামারী দমন করা যায় না। এতে হিতে বিপরীত হবে। নিপীড়নের মুখে মানুষ তথ্য লুকাবে। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি ঘটবে। ঠাণ্ডা মাথায় আমাদের বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবা দরকার।

প্রথমত কোভিড-১৯ সম্পর্কে আমাদের যারপরনাই অজ্ঞতা রয়েছে। ইনফ্লুয়েঞ্জার মতো উপসর্গ থাকলেও আমাদের বোঝানো হয়নি যে, এটা সাধারণ কোনো অসুখ বা ইনফেকশন নয়। এমন নয় যে, আপনি বেশি অসুস্থ বোধ করলে ডাক্তারের কাছে যাবেন এবং ডাক্তার আপনাকে অ্যান্টিবায়োটিক, সর্দিজ্বরের জন্য প্যারাসিটামল বা ইবপ্রুফেন দেবে আর আপনি বাড়ি চলে এসে বিশ্রাম নিয়ে সুস্থ হয়ে যাবেন। আপনার অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট থাকলে কোভিড-১৯ মারাত্মক হতে পারে, বয়স বেশি হলে শ্বাসকষ্টে মরতে পারেন। এটি একটি সংক্রামক মহামারী। নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি প্রতিবেদনে দেখলাম, একজনের সংক্রমণ যদি ধরা পড়ে তার মানে আরো দশজন ভাইরাস বহন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে এবং অন্যদের সংক্রমিত করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাই বারবার বলছে, যেটা দরকার সেটা হলো পরীক্ষা, পরীক্ষা এবং পরীক্ষা। Test, Test, Test. অর্থাৎ পরীক্ষা করা এবং সংক্রমিত ব্যক্তিকে আলাদা করা, কোয়ারেন্টাইনে রাখা- সংক্রমণ যেন ছড়াতে না পারে তার জন্য কঠোর ব্যবস্থাই হচ্ছে এই মহামারী মোকাবেলার একমাত্র উপায়। এটা স্বেচ্ছায় করতে হবে। মিলিটারি-পুলিশ কিম্বা আমলাদের হুমকি-ধমকি দিয়ে হবে না।

কিন্তু আমাদের দেশে কী ঘটছে? শুরু হয়েছে পরিকল্পিতভাবে তথ্য গোপন করে। করোনাভাইরাস আছে, সরকার তা স্বীকারই করতে চাইল না। ইতোমধ্যে দুই মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছে, যা ছিল বিপর্যয়ের প্রস্তুতির জন্য মহা মূল্যবান সময়। এখনো আসলে বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। পত্রিকায় দেখছি দেশে আক্রান্তের সংখ্যা ১৭ জন। আরেকটি খবর হচ্ছে ‘ঝুঁকিপূর্ণ শিবচর অবরুদ্ধ’। অসমর্থিত সূত্রে চট্টগ্রাম সম্পর্কে যেসব খবর হয়ে ছড়াচ্ছে, তার প্রধান কারণ সরকারের প্রতি জনগণের চরম অনাস্থা। জনগণকে সচেতন করা সরকারের দায়িত্ব, কিন্তু রাজনৈতিক প্রচার প্রপাগান্ডার প্রতি অতি মনোযোগের কারণে এই বিপর্যয় মোকাবেলার দায়িত্ব উপেক্ষা করা হয়েছে। উচ্চ পর্যায়ের একজন সরকারি কর্মকর্তাকে টেলিভিশনে স্বীকার করতে দেখলাম, বাইরে থেকে যারা দেশে ফিরেছেন তারা যদি সংক্রমণ বহন করে আনেন তবে সেটা ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যর্থ হয়েছে।’ এটা মারাত্মক।

সরকারের প্রতি অনাস্থার বড় কারণ হচ্ছে, শুরু থেকেই তথ্য নিয়ন্ত্রণ করবার চেষ্টা। Institute of Epidemiology, Disease Control and Research (IEDCR) ছাড়া আর কেউ কি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলো কি না তা পরীক্ষা করতে পারবেন না? এই দাবির কি আদৌ কোনো ভিত্তি আছে যে, বাংলাদেশে আর কোনো ল্যাবরেটরি নাই যাদের বৈজ্ঞানিক ও কৃৎকৌশলগত মান এবং কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন স্বাস্থ্যকর্মী ও দক্ষতা করোনা সংক্রমণ নির্ণয়ে অনুপযুক্ত? বায়োসেফটি প্রটকল অনুসরণে তারা কি অক্ষম? একটি মাত্র প্রতিষ্ঠানকেই সবকিছুর নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দিয়ে রাখা হয়েছে মূলত তথ্য গোপনের জন্য, এই অভিযোগ রয়েছে যা উপেক্ষা করার মতো নয়। বাংলাদেশ মহা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে চীন অনেক আগেই সাবধান করেছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়েছে কি?

এরপর রয়েছে ডাক্তার, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং সর্বোপরি তাদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাব। এই ছোঁয়াচে রোগ থেকে যদি তাদের আমরা রক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত না করি, তাহলে তারা কিভাবে সেবা দেবেন? বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবীর দরকার হতে পারে। এতদিন হাতে যে সময় ছিল, তাতে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া যেত।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ছাড়াও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক উন্নয়ন সহযোগী বা উন্নয়ন পার্টনার রয়েছে, তারা গত কয়েক মাস কী করেছেন? করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে কি সরকারকে কিছুই বলেননি? কোনো চাপই তারা দেননি? তারা কি বুঝতে অক্ষম যে, দেশের প্রধান বিরোধী দলকে রাজনৈতিক নিপীড়নের অধীনে রাখা হলে মহামারী মোকাবেলায় কোনো ‘জাতীয়’ কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন অসম্ভব।

গণস্বাস্থ্য এক মাসের মধ্যে কোভিড-১৯ নির্ণায়ক গণস্বাস্থ্য র‌্যাপিড ডট ব্লট (G-Rapid Dot Blot) বাজারজাত করবার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানির অনুমতি পেয়েছে। এই অনুমতি দিতে টালবাহানা করা হয়েছে। দেশের বিজ্ঞানীদের পেছনে দাঁড়ানো সরকারের একটা বড় কাজ। গণস্বাস্থ্য চাইছে, আগে কিটটি উৎপাদনে জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী তাদের আনতে দেয়া হোক। এই সামগ্রী ট্যাক্সের কারণে ছাড়তে দেরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অবিলম্বে উৎপাদন শুরু করা হলে তার পর তার কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হবে। অসুবিধা নাই। কিন্তু সরকারের অনুমোদন পাওয়া গেলেও পরবর্তী কাজের জন্যে সহযোগিতা পাওয়া যাবে তো?

এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখেছি, কেউ কেউ ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণার কথা বলছেন। এটা ভুল এবং ভয়ানক গণবিরোধী দাবি। এটা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নয়। জোর করে জনগণকে বল প্রয়োগের ভয় দেখিয়ে দুর্যোগ মোকাবেলার চিন্তা কাণ্ডজ্ঞানবিবর্জিত। দরকার এই বিপদ মোকাবেলার জন্য জনগণকে যে কোনোভাবে সম্পৃক্ত করা। এই মুহূর্তে সর্বপ্রথম কাজ হচ্ছে সকল দল, মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ মোকাবেলায় জাতীয় ঐক্য না হোক নিদেনপক্ষে সমঝোতা গড়ে তোলা। কিংবা সমঝোতার পরিবেশ গড়ে তোলা।

এই সরকারের পক্ষে কি তা সম্ভব?

[বাকি অংশ আগামীকাল]

লেখক : কবি, কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement