২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিড়ম্বনা, নাকি আধুনিকতা?

-

পোশাক যেকোনো জাতির সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের এ উপমহাদেশে বিভিন্ন জাতি, ধর্ম ও গোষ্ঠীর বাস। এ উপমহাদেশে ঔপনিবেশিক শাসক ইংরেজদের আগমনের আগে হাফপ্যান্ট কখনো কোনো জাতি, ধর্ম ও গোষ্ঠীর পোশাক ছিল না।

হাফপ্যান্ট হলো ফুলপ্যান্টের অনুরূপ শরীরের নিম্নভাগ আবৃত করার সুপরিচিত পোশাক। ফুলপ্যান্ট কোমর থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত বিস্তৃত সুপরিচিত পরিধেয়। সাধারণত ফুলপ্যান্টের দু’পাশে দু’টি পকেট ও পেছনের দিকে একটি বা দু’টি পকেট থাকে। একটু মোটা কাপড় দিয়ে ফুলপ্যান্ট প্রস্তুত করা হয়। ফুলপ্যান্ট ইংরেজদের শরীরের নিম্নাংশের পোশাক হিসেবে পরিচিত হলেও আজ সারা বিশ্বে সমাজের এক বিরাট অংশ ঘরের বাইরে ফুলপ্যান্ট পরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

হাফপ্যান্টও সচরাচর ফুলপ্যান্টের অনুরূপ একটু মোটা কাপড় দিয়ে প্রস্তুত হয়ে থাকে। হাফপ্যান্ট তিন ধরনের। যথা- শর্ট, মিডিয়াম ও লং। শর্ট হাফপ্যান্ট কোমর থেকে নিচের দিকে ছয় থেকে আট ইঞ্চি পরিমাণ বিস্তৃত হয়। মিডিয়াম হাফপ্যান্ট কোমর থেকে ঊরুর মাঝামাঝি পর্যন্ত বিস্তৃত। লং হাফপ্যান্ট কোমর থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে থাকে। শর্ট হাফপ্যান্টের ক্ষেত্রে দেখা যায় অনেক সময় পকেট থাকে না। তবে মিডিয়াম ও লং হাফপ্যান্টের ক্ষেত্রে দু’পাশে দু’টি পকেট থাকে। প্রায় ৪০ বছর ধরে ফুলপ্যান্ট ও হাফপ্যান্টে এক ধরনের ধাতব বাঁধন (Zipper) ব্যবহার হয়ে আসছে। এর আগে বোতাম ব্যবহার করা হতো। এখনো চার থেকে ছয় বছরের শিশুদের পরিধেয় হাফপ্যান্টের ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সতর্কতা হিসেবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বোতামের ব্যবহার অধিক নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত।

শীতপ্রধান দেশে গ্রীষ্মকালে এবং উষ্ণ আবহাওয়ার দেশে সারা বছর অনেকে নৈমিত্তিক হাফপ্যান্ট পরতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তবে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে এ চিত্রটি ভিন্ন। ঔপনিবেশিক ইংরেজ শাসকরা অর্থনৈতিক কারণে সেনা ও পুলিশ বাহিনীর সিপাই পদধারীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে শর্তসাপেক্ষে হাফপ্যান্ট পরিধান বাধ্যতামূলক করেছিল। তারা ‘যুক্তি’ হিসেবে দেখাত- হাফপ্যান্ট পরিহিত অবস্থায় চলাফেরা, খেলাধুলা এবং যেকোনো ধরনের মহড়ায় অংশগ্রহণ সুবিধাজনক ও আরামদায়ক। এর পেছনের কারণ ছিল, ব্যয় সঙ্কোচন। ইংরেজ পদস্থ কর্মকর্তারা হিসাব করে দেখলেন, একটি ফুলপ্যান্টের কাপড় দিয়ে দু’টি হাফপ্যান্ট তৈরি করা যায়। তাই এ দেশীয় নিম্নপদস্থ ও নিম্ন বেতনভোগী সিপাইদের কর্মস্থলে হাফপ্যান্টের উপযোগিতার বিষয়ে বলতে যে, হাফপ্যান্ট তাদের কাজের সহায়ক আরামদায়ক ও সুবিধাজনক। হাফপ্যান্টের ওপর সিপাইদের আস্থা যেন অটুট থাকে, সে অভিপ্রায়ে ইংরেজ পদস্থ কর্মকর্তারাও কর্মক্ষেত্রে শখ করে মাঝে মধ্যে হাফপ্যান্ট পরতেন।

ইংরেজ বড় সাহেবদের কর্মক্ষেত্রে হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায় দেখে সিপাইদের অনেকের হাফপ্যান্ট পরিধানের ব্যাপারে মনস্তাত্ত্বিক বাধা দূর হবে, এমন ধারণাই বড় সাহেবরা পোষণ করতেন। ইংরেজ শাসনামলে সিপাইদের পরিধানের জন্য যে ধরনের হাফপ্যান্ট দেয়া হতো তা এখনকার মিডিয়াম হাফপ্যান্টের অনুরূপ। তবে সে সময়কার হাফপ্যান্টের নিম্নভাগ বেশ বিস্তৃত থাকত। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের অভিভাবকদের পক্ষ থেকেও আপত্তি আসত এই হাফপ্যান্টের ব্যাপারে। তাই সিপাইদের অনেকের মধ্যে পরিধানে অনীহাও লক্ষ করা গেছে। কিন্তু না পরে উপায় কী?

আমাদের এ উপমহাদেশে বসবাসরত দু’টি প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠী মুসলমান ও হিন্দু উভয়ের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি হাফপ্যান্টের বিরুদ্ধে হলেও শেষোক্তদের মনোভাব সামগ্রিক বিবেচনায় বেশি কঠোর ছিল না। ইংরেজ শাসনামলে যেকোনো ধরনের উচ্চপদে এ দেশীয়দের কোনো চাকরি লাভ করা দুরূহ ছিল। নি¤œপদের চাকরিও তুলনায় সীমিত ছিল।

সে সময় নিম্নপদেও যারা চাকরি করতেন, তাদের ভাগ্যবানই বলা হতো। এমনই এক ভাগ্যবান ১৮ বছর বয়সের পুলিশবাহিনীতে চাকরি পাওয়া সিপাই দীনেশ। সে সময় পুলিশের একজন সিপাই যে ক্ষমতার দাপট দেখাতেন তা আজকাল থানার দারোগারাও দেখাতে পারেন না। তখন কোনো সিপাইর কোনো গ্রামে প্রবেশ ঘটলে দেখা যেত, মুহূর্তেই গ্রাম পুরুষশূন্য হয়ে গেছে। এখন যেমন চাকরির বেতনভাতার বাইরে পুলিশের দারোগা-সিপাইদের বাড়তি আয়ের সুযোগ অবারিত, তখন এটি অবারিত না হলেও একেবারে সীমিত ছিল না। সিপাই দীনেশ চাকরি পাওয়ার পর প্রশিক্ষণ সমাপনান্তে উপমহাদেশের কোনো এক রাজ্যের জেলাস্থ দুর্গম থানায় বদলির আদেশ পেয়ে কাজে যোগদান করেন। জেলা শহর থেকে ওই দুর্গম থানায় যেতে হেঁটে ও নৌকায় দুই থেকে তিন দিন লেগে যেত। আর তার বাড়ি থেকে কর্মস্থলে যেতে চার-পাঁচ দিন লাগত। চাকরি লাভ করে দীনেশ কোনো মামলা সংশ্লেষে দারোগাসমেত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে দেখা যেত, দারোগার পাশাপাশি সিপাই দীনেশের দুই পকেটেও এক আনা, দুই আনা সর্বোচ্চ চার আনার ধাতব মুদ্রা ঢুকে পড়ছে। দীনেশ বেতনভাতা হিসেবে যে অর্থ পেত তার একা জীবনধারণের জন্য এর পাঁচ ভাগের এক ভাগও খরচ হতো না। সে সময় পুলিশ বিভাগের চাকরিতে বছরে একবারের অধিক নৈমিত্তিক ছুটি ভোগের সুযোগ বিরল ছিল। তাই হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা দুর্গাপূজার সময় বছরে একবার সর্বোচ্চ ১০ দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি যেতেন, যার অধিকাংশ সময় যাতায়াতেই ব্যয় হয়ে যেত। চাকরিতে যোগদানের ১০ মাস পর সিপাই দীনেশ এ কয়েক মাসের সঞ্চিত অর্থ এবং উপরি হিসেবে পাওয়া এর কয়েকগুণ অর্থ নিয়ে পুলিশের সিপাইদের জন্য পরিধেয় হাফপ্যান্ট, শার্ট ও বুটজুতা পরে অনেক গর্বভরে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলেন। তার ধারণা ছিল দীর্ঘ দিন পর তাকে বাড়িতে পেয়ে পরিবারের সবাই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠবে। পরিবারের সবার আনন্দ ও সন্তুষ্টির জন্য পূজা উপলক্ষে নিজে দেখেশুনে সবার পছন্দ হবে এমন কাপড়চোপড় কিনেছিলেন। প্রত্যুষে গাঁয়ের বাড়িতে পৌঁছার পর বাড়ির সম্মুখস্থ চত্বরে সিপাই দীনেশ তার ঠাকুর দাদাকে পায়চারিরত দেখতে পেলেন। দাদাকে প্রণাম করে দীনেশ যখন উঠে দাঁড়ালেন তখন দেখলেন ঠাকুর দাদার মেজাজ অতি চড়া। তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না যে, আদরের নাতি বিজাতীয় পোশাক হাফপ্যান্ট পরে বাড়িতে এসে বুক ফুলিয়ে চলবে। বাড়িতে প্রবেশের পর সিপাই দীনেশ তার দাদীমা, মা-বাবা, জেঠা-জেঠি সবার কাছ থেকে ঠাকুর দাদার মতো হতবাক হওয়ার আচরণই পেলেন। তাদের এক কথা, ‘তুমি চাকরিস্থলে কী পরিধান করো সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়, কিন্তু তুমি কী করে হাফপ্যান্ট পরে বাড়িতে আসার সাহস দেখিয়ে আমাদের জাত-বংশে কালিমা লেপন করে দিলে!’ পরিস্থিতির ‘ভয়াবহতা’ উপলব্ধি করতে পেরে দীনেশ দ্রুত পোশাক পরিবর্তন করে ধুতি ও জামা পরিধান করে পরিবারের সবাইকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন। ‘স্বাভাবিক’ তারা ঠিকই হলেন; তবে শর্ত দিলেন আর কখনো বিজাতীয় হাফপ্যান্ট পরে গায়ের বাড়িতে আসা যাবে না।

সিপাই দীনেশের অনুরূপ হাকিম নামক এক মুসলিম সিপাই পুলিশবাহিনীতে চাকরি পেয়েছিলেন। বয়স, পারিবারিক ঐতিহ্য ও দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে উভয়ের মধ্যে ধর্মীয় বিশ্বাস ব্যতীত অন্য কোনো ক্ষেত্রে ভিন্নতা ছিল না। সিপাই হাকিম সিপাই দীনেশের মতো চাকরি এক বছর প্রায় পূর্ণ হয় হয়, এমন সময় রমজানের ঈদ উপলক্ষে পরিবারের সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পারে এমন অর্থ ও কাপড়চোপড় নিয়ে পুলিশের হাফপ্যান্ট ও জামা পরিহিত অবস্থায় গাঁয়ের বাড়িতে উপস্থিত হলে দেখতে পান, সবে তার দাদা আসরের নামাজ সেরে মসজিদ থেকে বের হয়েছেন। নাতিকে দেখে দাদা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না তার নাতির এ ‘অধঃপতন’। নাতিসমেত দাদা ঘরে ঢোকার পর তার পিতা-মাতাসহ সবাই আনন্দিত হওয়ার পরিবর্তে ব্যথিত ও বিচলিত হলেন। অগত্যা হাকিম দ্রুত পোশাক পরিবর্তন করে লুঙ্গি ও জামা গায়ে দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার প্রয়াস পেলেন। পরিস্থিতি ঠিকই ‘স্বাভাবিক’ হলো? কিন্তু তার ওপর বিধিনিষেধ আরোপিত হলো, হাফপ্যান্ট পরে আর কখনো বাড়িতে আসার ‘দুঃসাহস’ যেন দেখানো না হয়।

৪-১২ বছর বয়সের শিশুরা হাফপ্যান্ট পরলে তা দৃষ্টিকটু বা বেমানান অনুভূত হয় না। পেশার প্রয়োজনে কর্মক্ষেত্রে হাফপ্যান্ট পরার আবশ্যকতা থাকলে তাতেও কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু নিজেকে আবেদনময়ী, আকর্ষণীয় ও আধুনিক হিসেবে উপস্থাপনের মানসে বিশেষত কোনো নারী যদি হাফপ্যান্ট পরে জনসমক্ষে আবির্ভূত হয় তা কোনোভাবেই আমাদের সমাজে গ্রহণীয় হতে পারে না।

প্রাচীনকাল থেকে বাঙালি মুসলমান ও হিন্দুরা নিজ নিজ পোশাক পরিধান করে আসছে। আধুনিকতার ছাপে ঘরের বাইরে অনেকে ফুলপ্যান্ট ও শার্ট পরছে। কিন্তু ঘরে নিজ সংস্কৃতির পোশাকে আবৃত থাকতেই অনেকের পছন্দ। এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, নারীরা বয়সভেদে সালোয়ার-কামিজ ও শাড়ি পরিধান করে থাকেন। বাঙালি মুসলমান পুরুষরা গৃহের অভ্যন্তরে লুঙ্গি, গেঞ্জি বা জামা পরেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, আর হিন্দু পুরুষদের দেখা যায় ধুতি গেঞ্জি বা জামা পরায় স্বাচ্ছন্দ্য।

সাম্প্রতিককালে দেখা যায়, হিন্দি ছবির কিছু নায়িকা নিজেকে যৌন আবেদনময়ী হিসেবে উপস্থাপনের জন্য অনেক সময় চিত্র নির্মাতার ব্যবসায়িক স্বার্থ চরিতার্থ করতে হাফপ্যান্ট পরিহিত অবস্থায় আবির্ভূত হয়। এ হাফপ্যান্ট বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শর্ট হয়ে থাকে। এরূপ হাফপ্যান্ট পরিহিত অবস্থার দৃশ্য আমাদের ঢাকাই ছবিতে যে দেখা যায় না তা নয়। তবে ঢাকাই ছবির ক্ষেত্রে হাফপ্যান্ট মিডিয়াম হতে দেখা যায়। এতে কোনো সন্দেহ নেই, এ ধরনের হাফপ্যান্ট পরিহিত দৃশ্য এবং পাশ্চাত্যের মহিলাদের হাফপ্যান্ট পরিহিত ছবি দেখে আমাদের এক শ্রেণীর নারী বিপথগামী হচ্ছেন। এমনই এক নারী যিনি নারীদের অধিকার নিয়ে সোচ্চার এবং কৃত্যবিদের পেশায় নিয়োজিত, তাকে একটি স্থির ছবিতে দেখা গেল মদের গ্লাস হাতে লং হাফপ্যান্ট পরিহিত অবস্থায় জনৈক বিদেশীর সাথে আরো দু’জন নারীসমেত দাঁড়িয়ে খোশ মেজাজে আলাপ করছেন। এ নেত্রীকে টিভি টকশোতে মদিনা সনদ বাস্তবায়ন নিয়েও কথা বলতে দেখা গেছে। মহানবী সা:-এর মদিনা সনদ ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনার ভিত হিসেবে বিবেচিত। মদিনা সনদ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে কোনো নারীর হাফপ্যান্ট পরাকে অনুমোদন করে না। তাহলে যে নারীর আদর্শিকভাবে মদিনা সনদ হতে বহুদূরে অবস্থান, তিনি যদি এক দিকে মদিনা সনদ নিয়ে কথা বলেন, অপর দিকে ভিনদেশীর সাথে মদের গ্লাস হাতে হাফপ্যান্ট পরে সখ্য গড়ে তোলেন, সেটি মদিনা সনদের নামে প্রহসন নয় কি? আমাদের বাঙালি মুসলমান ও হিন্দু সমাজ কখনো এমন শিথিলতা অনুমোদন করে না, যা একজন নারীকে হাফপ্যান্ট পরিধানে আধুনিক হতে প্রশ্রয় দিয়ে অপর সবার জন্য বিড়ম্বনার কারণ হয়।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail : iktederahmed@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement