১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনাভাইরাস ও পঙ্গপালের তাণ্ডব

করোনাভাইরাসের সাথে যুক্ত হয়েছে পঙ্গপালের তাণ্ডব। - ছবি : সংগৃহীত

সাম্প্রতিককালে নোভেল করোনাভাইরাস (COVID-19) বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক তৈরি করেছে। চীনের মহাপ্রাচীর পেরিয়ে প্রাণঘাতী এ ভাইরাস এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে বৈশ্বিক মহামারীর রূপ পরিগ্রহ করছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আফ্রিকার পঙ্গপালের তাণ্ডব। করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত তিন হাজার মানুষ মারা গেছে এবং দুই লাখ আক্রান্ত হয়েছে। কোনো ওষুধ ও প্রতিষেধক আবিষ্কৃত না হওয়ায় আরো লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।

এ অবস্থায় চীনকেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক আমদানি ও রফতানি বাণিজ্য চরম ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছে। অর্থনীতির গবেষকদের মতে, চলতি বছরের শেষের দিকে ১.১ ট্রিলিয়ন ডলার বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে (Asia Times, 20 February 2020)। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইতালি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডস, জাপান, ভিয়েতনাম, ইসরাইল, লেবানন, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ ৫৩টি দেশে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটেছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় রেড অ্যালার্ট জারি করেছে সরকার। ইরানের ১৪টি প্রদেশে মাদরাসা, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘এ ভাইরাসের সংক্রমণ দিন দিন বাড়ছে।’

অপর দিকে ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপাল সোমালিয়া, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, জিবুতি, উগান্ডা, দক্ষিণ সুদান এবং জর্দান, মিসর, সৌদি আরব ও পাকিস্তানে হানা দিয়েছে। কোটি কোটি টাকা মূল্যের ধান, গম, যব, ভুট্টা ও তুলা সাবাড় করে দিচ্ছে । এ পরিস্থিতিতে জর্দান, পাকিস্তান ও সোমালিয়া সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। ১০ লাখ পতঙ্গের পাল যদি কোনো ফসলের ক্ষেতে হামলে পড়ে, এক দিনের মধ্যে ৩৫ হাজার মানুষের খাদ্য সাবাড় করে ফেলতে পারে। প্রতি ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার আকাশপথ অতিক্রম করে হানাদার পতঙ্গবাহিনী বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালায়। ঘাসফড়িংয়ের মতো দেখতে এ পতঙ্গের ঝাঁক ৪৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ভূমি আচ্ছাদিত করে রাখে।

জাতিসঙ্ঘের মতে, বিগত ৭০ বছরের মধ্যে পঙ্গপালের এত ভয়ঙ্কর আক্রমণ আর দেখা যায়নি। আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ায় ঝাঁকবদ্ধ মরুপতঙ্গ ৩০টি দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। জিবুতি ও ইরিত্রিয়ায় ৩৬ হাজার কোটি পতঙ্গের আক্রমণে খাদ্যনিরাপত্তা অভূতপূর্ব হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের কর্মকর্তাদের আশঙ্কা, এতে পুরো অঞ্চলে খাদ্য সঙ্কট দেখা দিতে পারে। প্রতি কিলোমিটার ঝাঁকে চার থেকে আট কোটি পতঙ্গ থাকে। স্ট্রিট জার্নালের ভাষ্যকারের মতে, মাঝারি ধরনের একপাল পতঙ্গ নিউইয়র্কের জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য নিঃশেষ করে দিতে পারে। কীটনাশক প্রয়োগ করেও এ মরুপতঙ্গ দমন করা যাচ্ছে না।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং পঙ্গপালের আক্রমণের জাগতিক উৎপত্তি ও বিস্তৃতির বৈজ্ঞানিক কারণ যাই হোক, এটা নিঃসন্দেহে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। এ প্রকৃতির নিয়ন্ত্রকশক্তি একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে যুগে যুগে নানা জাতির ওপর বিপর্যয়, মহামারী, দুর্যোগ-দুর্বিপাক নেমে এসেছে। ঝড়ঝঞ্ঝা, প্লাবন, ভূকম্পন, ভূমিধস, সুনামি, খরা, জলোচ্ছ্বাস, শিলাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, সার্স ও মার্স ভাইরাস, এইডস, দাবানল প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বিচিত্র রূপ। অনৈতিক যৌনকর্ম, পাপাচার, ধর্মীয় মূল্যবোধের বিরোধিতা, অনিয়ন্ত্রিত জীবনধারা ও আল্লাহ তায়ালার বিধিনিষেধের অবাধ্যতার কারণে পৃথিবীতে বিপর্যয় নেমে আসে। অতীতে সীমালঙ্ঘন, নাফরমানি, নবী-রাসূলদের প্রতি ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে অসন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ তায়ালা বহু জাতিগোষ্ঠীকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। তার অনুমতি ব্যতীত কোনো বিপদ আপতিত হয় না (সূরা তাগাবুন : ৪০)। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মানুষের প্রতিটি ক্রিয়াকর্ম ও গতিবিধির ওপর নজর রাখেন এবং প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের জন্য প্রতিদান ও শাস্তি দেন। তাওবা, ক্ষমা প্রার্থনা ও সৎ জীবনযাপনের মাধ্যমে এসব বিপর্যয় থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।

মনে রাখতে হবে, আল্লাহ তায়ালা কোনো জাতি ও সম্প্রদায়ের অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না স্বয়ং তারাই নিজেদের অবস্থা, কাজকর্ম, অনৈতিকতা ও অবাধ্যতায় পরিবর্তিত করে না দেয়। যখন আল্লাহ তায়ালা কোনো ব্যক্তি বা সমষ্টিকে আজাব বা শাস্তি দিতে চান তখন কেউ তা রদ করতে পারে না; আল্লাহর নির্দেশের বিপরীতে তার সাহায্যার্থে কেউ এগিয়ে আসতে পারে না (সূরা রা’দ; মা’আরিফুল কুরআন, পৃষ্ঠা-৭০২)।

পাঁচ হাজার বছর আগে হজরত লুত আ:-এর উম্মতকে সমকামিতার মতো গর্হিত কর্মের জন্য তাদের পাঁচ লাখ অধ্যুষিত জনপদকে আসমানে তুলে আছাড় দিয়েছেন। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে এক নদী, যা ইতিহাসে ‘মৃত সাগর’ নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এ সাগরের দৈর্ঘ্য ৬৭ কিলোমিটার, প্রস্থ ১৮ কিলোমিটার এবং গভীরতা ১.২৪০ ফুট। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪২২ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এ সাগরের পশ্চিমে রয়েছে ইসরাইল ও পূর্বে জর্দান। এখান থেকে জেরুসালেম নগরীর দূরত্ব মাত্র ১৫ মাইল। অন্যান্য মহাসাগরের তুলনায় লবণাক্ততা বেশি হওয়ায় এতে কোনো মাছ জন্ম নেয় না। জর্দান নদী থেকে মাছ এই নদীতে আসার সাথে সাথে মারা যায়। তবে আশ্চর্যজনকভাবে রয়েছে বিপুল ব্যাকটেরিয়া এবং ক্ষুদ্রকায় ছত্রাক (Encyclopadia Encarta)।

পবিত্র কুরআন ও হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী, সমকামিতার মতো জঘন্য পাপকার্যে লিপ্ত হওয়ার কারণে সদোম ও গোমাররাহ নামক লোকালয় মহান আল্লাহর হুকুমে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ঘটনাটি আজ থেকে প্রায় ছয় হাজার বছর আগের। ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থানটি বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের ‘মৃতসাগর’। আল্লাহর নবী হজরত লুত আ:-এর বারবার সাবধান বাণী সত্ত্বেও সে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী অবৈধ যৌন সম্পর্ক ও সমকামিতার অভ্যাস পরিত্যাগ করেনি। পৃথিবীর বুকে একমাত্র তারাই যৌনক্ষুধা চরিতার্থের উদ্দেশ্যে মহিলাদের বাদ দিয়ে পুরুষদের ওপর উপগত হতো (সূরা আরাফ : ৮০-৮১)। ফলে গজব হিসেবে আল্লাহ তায়ালা এ জনপদের জনগোষ্ঠীকে বাস্তুভিটাসহ বিধ্বস্ত করে দিলেন।

অনৈতিক যৌন সম্পর্ক ও সমকামিতার শাস্তি স্বরূপ সাম্প্রতিককালে দেখা দিয়েছে এইডস/এইচআইভি। ‘এইডস’ মানে নিশ্চিত মৃত্যু। আজ পর্যন্ত এর কোনো কার্যকর ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। ২০১৭ সাল পর্যন্ত ‘এইডস’-এ আক্রান্ত হয়ে দুনিয়ায় তিন কোটি ৫০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং এইচআইভিতে আক্রান্ত হয়েছে তিন কোটি ৭০ লাখ মানুষ। বাংলাদেশে এইডস রোগী শনাক্ত হয়েছে সর্বপ্রথম ১৯৮৯ সালে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে এইডস/এইচআইভি ভাইরাস বহনকারী মানুষের সংখ্যা ১৪ হাজার। এর মধ্যে মারা গেছে এক হাজার ২২ জন। এইচআইভি সংক্রমণের প্রধান কারণ হচ্ছে, অবৈধ যৌন মিলন ও সমকামিতা।

হজরত নুহ আ:-এর অধস্তন পুরুষ, প্রাচীন আদ জাতির হিদায়াতের জন্য আল্লাহ তায়ালা হজরত হুদ আ:কে নবী হিসেবে পাঠালেন। জর্দান থেকে হাজরামাউত ও ইয়েমেন পর্যন্ত ছিল তাদের অধিবাস। গৃহনির্মাণ ও স্থাপত্যশৈলীতে তাদের দক্ষতা ছিল অসাধারণ। কিন্তু তারা আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অমান্য করে মূর্তিপূজা শুরু করে। শাদ্দাদ স্বর্ণখচিত একটি কৃত্রিম বেহেশত বানিয়ে ঔদ্ধত্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিল। ‘আদ জাতির অমার্জনীয় পাপের ফলে গজব স্বরূপ তিন বছর বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকে। ফলে ক্ষেতখামার, বাগান ও গাছপালা পানির অভাবে শুকিয়ে যায় এবং প্রচণ্ড খাদ্যাভাব দেখা দেয়। তারপরও তারা পাপাচার ত্যাগ করেনি। অবশেষে চূড়ান্ত শাস্তি নেমে আসে। সাত রাত-আট দিনব্যাপী অনবরত ঘূর্ণিঝড় ও বজ্রপাতে বিধ্বস্ত হয়ে যায় জনপদ ও লোকালয়। মানুষ ও জীবজন্তু শূন্যে উত্থিত হয়ে সজোরে জমিনে পতিত হয়। উৎপাটিত খর্জুর বৃক্ষের কাণ্ডের মতো তাদের নিক্ষেপ করা হয়েছিল’ (সূরা আল কামার : ১৮-২১)।

মাদায়েনের সামুদ জাতিকে আল্লাহ তায়ালা বিধ্বস্ত করে দেন অগ্নিবৃষ্টি দিয়ে। তারা ওজনে কম দিত। দুর্নীতি, ডাকাতি, ধর্ষণ, ছিনতাই ও খাদ্য গুদামজাত করে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করত। আল্লাহ তায়ালা তাদের সতর্ক করার জন্য পাঠালেন হজরত সালেহ আ:কে। তারা নবীর কথা তো শোনেইনি, উপরন্তু আল্লাহর নিদর্শন উষ্ট্রীকে হত্যা করতে দ্বিধা করেনি’ (সূরা আশ শামস : ১২-১৫)। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালার ঘোষণা স্পষ্ট- ‘মানুষের কৃতকর্মের জন্য জলে-স্থলে বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে তাদেরকে কোনো কোনো কর্মের শাস্তি আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে’ (সূরা আর রুম : ৪১)।

পৃথিবীর দেশে দেশে অনাচার, পাপাচার, দুর্বৃত্তপনা ও খোদাদ্রোহিতা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ফলে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির পরিবর্তে অসন্তুষ্টির মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং ইতিহাসের পথ ধরে বিপর্যয় ও গজব নামতে বাধ্য। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের তথ্যানুযায়ী, মানুষ মানুষকে মারার জন্য যে পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি ও মজুদ করেছে, তাতে এ পৃথিবীকে ৩৮ বার ধ্বংস করা যাবে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কাÑ পাপাচার, অমানবিক কর্মকাণ্ড ও আল্লাহর নাফরমানির বিস্তারের ফলে কতিপয় জাতিগোষ্ঠী ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। এমনকি সমগ্র মানবজাতিও বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। আসলে বিপর্যয় ও ধ্বংস মানুষের কৃতকর্মের ফসল। আল্লাহ তায়ালার কাছে তাওবা, ক্ষমা প্রার্থনা, মানবিকতার উজ্জীবন, কল্যাণকর জীবন যাপনের অঙ্গীকার করে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিপর্যয় ও গজব থেকে মানবগোষ্ঠী রক্ষা পেতে পারে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, এমইএস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম।


আরো সংবাদ



premium cement
গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়াল শ্যালকের অপকর্মে দুঃখ প্রকাশ করলেন প্রতিমন্ত্রী পলক রাজশাহীতে ট্রাকচাপায় ৩ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত পাবনায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষে হতাহত ২২ বিল দখলের চেষ্টা, জেলা ছাত্রলীগ নেতাকে গণপিটুনি ‘শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত হয়ে কাজ করলে বিজয় অনিবার্য’ কারাগারে নারী হাজতিকে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন, প্রধান কারারক্ষীসহ ৩ জনের বদলি প্যারিসে ইরানি কনস্যুলেটে ঢুকে আত্মঘাতী হামলার হুমকিদাতা গ্রেফতার প্রেম যমুনার ঘাটে বেড়াতে যেয়ে গণধর্ষণের শিকার, গ্রেফতার ৫ ‘ব্যাংকিং খাতের লুটপাটের সাথে সরকারের এমপি-মন্ত্রী-সুবিধাবাদী আমলারা জড়িত’ ইরানের সাথে ‘উঁচু দরের জুয়া খেলছে’ ইসরাইল!

সকল