২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

সেকুলারিজম মতাদর্শের পর্যালোচনা

-

বিশ্বের ইতিহাসকে পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই- বিজ্ঞানীদের মতে, প্রত্যেক Cell-এর যেমন একটা Nucleus থাকে, তেমনিভাবে একটি আদর্শ হিসেবে সেকুলারিজমের উত্থাপনের আগে পর্যন্ত সভ্যতা, শিক্ষার Nucleus বা কেন্দ্র ছিল ধর্ম। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, নাস্তিকতা ইতিহাসে কোনো সভ্যতার ভিত্তি ছিল না। শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিল একটি নৈতিক ভিত্তি সৃষ্টি করা, নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ সৃষ্টি করা।

১৮০০ শতাব্দীর শেষে যে পরিবর্তন বা যে মুক্তবুদ্ধির আন্দোলন হলো, তার আগে ইউরোপে দু’টি আন্দোলন হয়েছিল। প্রথমটি রেনেসাঁ বা পুনর্জাগরণ। এটা ছিল আর্ট ও লিটারেচারের ক্ষেত্রে; ধর্ম বা রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়। এর পরেরটি হচ্ছে Reformation Movement যার মানে হলো, খ্রিষ্টান চার্চের মধ্যে থেকেই আপত্তি উঠল যে, পাপই কি বাইবেলের একমাত্র ব্যাখ্যাতা? এর কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়ে বলতে চাই, এরই ফলে চার্চ নানাভাবে বিভক্ত হলো। তৃতীয় যে আন্দোলন হলো সেটা হয়েছিল ফ্রান্সে। সেটা শুরু হয় ‘মুক্তবুদ্ধির’ আন্দোলনের নামে। ১৮০০ শতকের শেষে এবং ফরাসি বিপ্লবের আগে ও পরে এর প্রভাব বজায় রইল। যেকোনো কারণেই হোক, এই আন্দোলনের বেশির ভাগ নেতাই ছিলেন নাস্তিক বা গুপ্ত নাস্তিক কিংবা নাস্তিকের মতো। মানব ইতিহাসে এই প্রথম তারা এই দর্শন নিয়ে এলেন যে, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কাজ থেকে ধর্মকে বিদায় করতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক ব্যাপারে ধর্মের কোনো ভূমিকা থাকবে না। ধর্ম থাকতে হলে কারো অন্তরে থাকবে, যদি কেউ রাখতে চায়। অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি, আইনসভা এসব থেকে ধর্মকে দূরে রাখতে হবে। এ আন্দোলনের মূল বক্তব্য ছিল ওয়াহি বা ঐশী প্রত্যাদেশ নয়, যুক্তিই জীবনের ভিত্তি হবে এবং আল্লাহর শাসন কায়েম হবে না। যে কারণেই হোক, এই আন্দোলন ইউরোপের তৎকালীন নেতৃত্বকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়। এটা মোটামুটি গৃহীত হয়ে যায় এবং ক্যাথলিক বা প্রটেস্টান্ট চার্চ এটাকে বাধা দিয়ে কুলাতে পারেনি। তবে এর ফল হলো ভয়াবহ, যা এখন আলোচনা করব।

প্রথম কুফল হলো, এই শিক্ষা থেকে ধর্মকে আলাদা করা হয়। এভাবে যে স্কুল ব্যবস্থা গড়ে উঠল তাতে মানুষ নিতান্ত স্বার্থপর হয়ে উঠল। তারা ভোগবাদী হয়ে পড়ে। ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে গেল। যে ধর্মের দ্বারা কোনো কাজ হয় না, তার প্রতি সম্মানও কমে গেল। নীতিবোধের যে শ্রেষ্ঠত্ব বা প্রাধান্য তাও লোপ পেল। নীতিহীনতা ও স্বার্থপরতা নিয়ে মানুষ গড়ে উঠল।
পুঁজিবাদ যখন সেকুলারিজমের (যার প্রকৃত অর্থ রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে ধর্মবর্জনবাদ) সঙ্গী হলো, তখন ইউরোপে শ্রমিককে এমনভাবে শোষণ করা হলো যে, তাদের শুধু বেঁচে থাকার অবস্থায় রেখে দেয়া হয়েছিল; তাও শুধু উৎপাদনের স্বার্থে। পরে এর প্রতিক্রিয়াতেই কমিউনিজমের জন্ম হয়। সমাজতন্ত্রের উদ্ভব হলো। অর্থনীতির ক্ষেত্রে মুক্তবুদ্ধির মতবাদ বা সেকুলারিজম আরোপের ফল হলো, অর্থনীতির ক্ষেত্রে অমানবিকতা ও নীতিহীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল এবং বলা হলো এটা হচ্ছে পজিটিভ সাইন্স; অর্থনীতি একটি অবমিশ্র বিজ্ঞান; এর মধ্যে নীতিবোধ থাকবে না, নীতি থাকবে না।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, ধর্মকে বাদ দিয়ে যে মুক্তবুদ্ধির আন্দোলন করা হলো তার মাধ্যমে কী ধরনের লোক তৈরি করা হলো। তারা দুনিয়া দখল করে বেড়াল। লুটতরাজ করল। নিজেদের মধ্যে লড়াই করল। কিন্তু শান্তি আনল না। এর ফল হলো, তারা দুনিয়াকে শান্তি দিতে পারেনি। তারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধ করল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ করল। পাশ্চাত্য সভ্যতার গর্ভ থেকে চারটি অত্যন্ত ক্ষতিকর মতবাদের জন্ম হয়েছে। ফ্যাসিজম, কমিউনিজম, ক্যাপিটালিজম ও সেকুলারিজম। এর অর্থ হচ্ছে, কেবল ডেমোক্র্যাসি ছাড়া তারা ভালো কিছু করতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
স্রষ্টাকে যারা কোনো স্থান দিতে রাজি নয়, তারা পরিবার ও জেন্ডার ইস্যুতে পশুর মতো হয়ে গেল। তারা মনে করল, পরিবারের গুরুত্ব নেই। এটি হলো নারীদের দাবিয়ে রাখার একটি প্রতিষ্ঠান তাদের দাস বানানোর জন্য। তারা বরং পশুর মতো থাকাই ভালো মনে করল। মনে করা হলো, পরিবার করার কোনো প্রয়োজন নেই। সুতরাং পরিবারের যে বর্তমান দুর্দশা সেটা অনেকটা সেকুলার মতাদর্শের কারণেই।

এর সমাধান কী? আমাদের জানা মতে, দু’ভাবে এর সমাধান হতে পারে। একটা হলো, মুসলিম হিসেবে আমরা আল্লাহ তায়ালার কাছে, তাঁর নির্দেশের দিকে যাই বা নিজেদের সোপর্দ করি। সব সমস্যার মূল কারণ হচ্ছে ‘মুক্তবুদ্ধি’র মিথ্যা দর্শন। তাদের কথা হচ্ছে, গডকে বাদ দাও। অথচ তাঁকেই সবচেয়ে কাছে রাখতে হবে। তাঁকে সবসময় অবলম্বন করতে হবে। তাঁর ওপর আস্থা রেখেই জীবনযাপন করতে হবে। তাঁর কাছে আমরা সব দিক দিয়ে আবদ্ধ, দায়বদ্ধ। তাঁকে বাদ দেয়া চলবে না কিছুতেই। এটা হলো মুসলিম হিসেবে আমাদের বক্তব্য। হিন্দু হিসেবে যদি কেউ বলেন, তাহলে বলতে হবে স্রষ্টার দিকে যাওয়া, নৈতিকতার দিকে, ধর্মের দিকে ফিরে যাওয়া। তাই সমাধান হিসেবে বলছি, যেভাবেই হোক, মানুষকে নৈতিক শিক্ষা ফিরিয়ে আনতে হবে। নৈতিক শিক্ষার জন্য ধর্ম ছাড়া আর কোনো ভিত্তি নেই।

মুসলিম দেশে ইসলামকে ভিত্তি করতে হবে এবং অমুসলিমদের জন্য এর বিকল্প থাকবে। অমুসলিমদের দেশে তাদের ধর্মকে কেন্দ্র করে এবং তাদের নৈতিকতার ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সেখানে মুসলিমদের জন্য বিকল্প থাকবে বলে আশা করি। এভাবে যদি শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তবে আশা করা যায় যে, ভালো মানুষ তৈরি হওয়া শুরু হবে। ভালো লোক তৈরি হলে সমাজ ও রাষ্ট্রের সবক্ষেত্রে সুফল পাওয়া যাবে; রাজনীতি, অর্থনীতি, পরিবার সব ক্ষেত্রে। কেবল থিওরি দিলেই কিছু হবে না। আর আমার কথাতেই সব কিছু বদলে যাবে না। তবে মানবতাকে পুনরুদ্ধারের কাজ অবশ্যই শুরু করতে হবে। এ কথাও আমরা জানি, অসম্ভব বলে কিছু নেই।

বিজ্ঞানের কারণে যে উন্নয়ন হয়েছে, কোনো ধর্ম তাতে হস্তক্ষেপ করেনি। খ্রিষ্টিয়ান ইউরোপে যে দুই একটা উদাহরণ পাওয়া যায়, সেটাকে তাদের ভুল বলে গণ্য করতে পারি। কিন্তু খ্রিষ্টান নেতৃত্ব বা পোপরা কেউই বিজ্ঞানের বিরোধী নন। আমরা বুঝতে পারি যে, মানবজাতি ছিল মূলত ধার্মিক, সেটাকে সেকুলাররা সেকুলারমনা করে দিলেন। তাদের আবার ধার্মিকমনা করতে হবে; ইসলামীমনা করতে হবে। ধার্মিক মন ও সেকুলার মনের মধ্যে পার্থক্য কী? ইসলামী মন হচ্ছে সে মন যেকোনো সমস্যা সৃষ্টি হলে যা সমাধান খোঁজে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে। তারপর অন্যান্য দিকে। অপর দিকে সেকুলার মন চিন্তা করে না, আল্লাহর কিতাবে কী আছে? সে ভাবে, আমাদের ‘যুক্তিবাদী’ পণ্ডিতরা কী বলেছেন; রাজনৈতিক পণ্ডিতরা কী বলেছেন কিংবা রাশিয়া, চীন, আমেরিকা, কানাডা কী করেছে। তারা দুনিয়াকে ধার্মিকমন থেকে সেকুলার মনে নিয়ে গেল। তাই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে, সারা দুনিয়াকে একটা নৈতিক ছকে নিয়ে আসা; ধার্মিক মনকে ফিরিয়ে আনা।

‘সেকুলার’ শব্দটির ব্যবহার হয়েছে মুক্তবুদ্ধি আন্দোলনের পরে, উনবিংশ শতাব্দী থেকে। মুক্তবুদ্ধির ধারণা গ্রহণ করে পুরো শিক্ষিত সমাজ মোটামুটি সেকুলার হয়ে গেছে। আমাদের অসংখ্য লোক নামাজি, আবার সেকুলার। তারা সমস্যার সমাধান ইসলামে খোঁজেন না। এসব সেকুলার মনকে ইসলামী মনে পরিবর্তন করতে হবে। এ জন্য তাদের কিছু মৌলিক বই পড়াতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। আশা করি, যথাযোগ্য চেষ্টা করলে আমরা সাফল্য লাভ করব ইনশাআল্লাহ।

লেখক : সাবেক সচিব, বাংলাদেশ সরকার


আরো সংবাদ



premium cement