১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
সংবিধান

কাশ্মির প্রশ্নে মুসলিম বিশ্বের ঐক্য জরুরি

কাশ্মির প্রশ্নে মুসলিম বিশ্বের ঐক্য জরুরি - সংগৃহীত

ভারতীয় উপমহাদেশের আঞ্চলিক রাজনীতিতে এই মুহূর্তে ভারতশাসিত কাশ্মির খুবই উত্তপ্ত এক ইস্যু। এই ইস্যুতে বিভিন্ন মুসলিম দেশ দ্বিপক্ষীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নানা অবস্থান নিলেও সম্মিলিতভাবে মুসলমানদের অবস্থান কিন্তু ৫ আগস্ট (২০১৯) নিজের অধিকারে থাকা একমাত্র সংখ্যাগুরু রাজ্য জম্মু-কাশ্মিরের বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার (ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ নং ধারা) প্রেসিডেন্টের ডিক্রির মাধ্যমে রদ করে ভারত। এতে জম্মু-কাশ্মির রাজ্য মর্যাদা হারায়। অঞ্চলটিকে দু’টি ভাগে ভাগ করে (জম্মু-কাশ্মির ও লাদাখ) কেন্দ্রশাসিত ভূখণ্ডে পরিণত করা হয়। মাসাধিককাল ধরে কার্ফুর মতো জরুরি অবস্থা জারি করে অঞ্চলটিকে সারা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়ছে।

৬ আগস্ট অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) নিজস্ব ওয়েবসাইটে পাঠানো এক বিবৃতিতে ‘ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মিরে সৃষ্ট সঙ্কটপূর্ণ পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ এবং ‘অঞ্চলটিতে যেভাবে মানবাধিকার হরণ করা হচ্ছে তার নিন্দা’ করা হয়। ৫৭ জাতি এই সংস্থার মহাসচিব ইউসেফ আল-ওথাইমিনের বিবৃতিতে ‘জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব, ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনের সিদ্ধান্ত এবং সংস্থার কাউন্সিল অব ফরেন মিনিস্টার্সের (সিএফএম) প্রস্তাবগুলোর ভিত্তিতে সঙ্কট নিরসন করতে সব পক্ষের প্রতি’ আহ্বান জানানো হয়। ওআইসির প্রতিষ্ঠাতা ২২ সদস্য দেশের একটি বাংলাদেশ। ওআইসির কোনো সদস্য দেশই সংস্থার বিবৃতির সাথে দ্বিমত করেনি। যদিও আগস্টের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বাংলাদেশে সফরে আসার পর ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশ মনে করে ৩৭০ ধারা রদ ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশ সব সময়ই নীতিগতভাবে আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার নীতিতে বিশ্বাসী। বাংলাদেশ একই সাথে মনে করে যে, সব দেশেরই উচিত উন্নয়নকে গুরুত্ব দেয়া।’

প্রশ্ন হলো, এই একবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম উম্মাহ কি শান্তিময় নতুন বিশ্ব গড়ার জন্য সংগ্রাম করবে, নাকি সঙ্ঘাতকেই তাদের লক্ষ্য হিসেবে বেছে নেবে। এই প্রশ্নের উত্তরে শান্তিময় নতুন বিশ্ব গড়ার জন্য সংগ্রামের পক্ষেই আমাদের মত। পশ্চিমা বস্তুবাদী সভ্যতা শান্তি দিতে পারছে না। তারা শান্তির জন্য কোনো ত্যাগ করতে অক্ষম। কারণ, শান্তির ভার যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার চেয়ে বেশি। পশ্চিমা সভ্যতার অস্তিত্ব নির্ভর করছে স্থানীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক দুর্যোগ, সঙ্ঘাত ও যুদ্ধের ওপর। এই সভ্যতাই বিংশ শতাব্দীতে দু’টি মহাযুদ্ধের জন্ম দিয়েছে। নিষ্ঠুর সত্য হলো যখন কোথাও যুদ্ধ বাধে তখন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু গড় আয় বেড়ে যায়। তবে আশার বিষয় হলো এই সভ্যতা এখন স্বাভাবিক মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে। তাদের জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি দিয়ে প্রজন্ম প্রতিস্থাপিত হচ্ছে না। তার বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতিম্যান জরিপকারী সংস্থা পিউ রিসার্চ হিসাব কষে দেখিয়েছে, অন্তত জনসংখ্যার দিক দিয়ে একবিংশ শতাব্দী হবে মুসলমানদের।

খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত ছিল ইসলামের স্বর্ণযুগ। এ সময়ে মুসলিম দার্শনিক, কবি, শিল্পী, বৈজ্ঞানিক, বাদশাহ-সম্রাট, ধর্মপ্রচারক মিলে এমন এক অতুলনীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলেন যা সব মহাদেশের সব সমাজকে প্রভাবিত করেছে। শত শত বছর ধরে সাম্রাজ্য বিনির্মাণকালে মুসলমানরা গ্রিস, ভারত ও চীনের প্রাচীন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে একত্র করেছে ও প্রসারিত করেছে। এ সময় সৃষ্টিতত্ত্ব, অঙ্কশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যোতিষশাস্ত্র, ভূগোল, চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রাকৃতিকবিজ্ঞান, আলোকবিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্রের বিকাশে অসামান্য অবাদন রেখে মানবজ্ঞানভাণ্ডারের ব্যাপ্তি বাড়িয়েছে।

একবিংশ শতাব্দীতে আবারো ইসলামের সেই স্বর্ণযুগ ফিরে আসতে চলেছে। এর জন্য মোটামুটি নয়টি কারণকে চিহ্নিত করা যায়। সেগুলো হলো : ১. মুসলিম বিশ্বে জনসংখ্যা বেড়ে চলার হার বিশ্বের গড় জনসংখ্যা বেড়ে চলার হারের তুলনায় বেশি, ২. মুসলিম তরুণ সংখ্যা বিশ্বে গড় তরুণ জনসংখ্যার চেয়ে বেশি, ৩. তেলের মূল্য মুসলিম দেশগুলোকেই সুবিধা দেবে, ৪. সস্তা শ্রম ও মজুরি পার্থক্যের কারণে বেশির ভাগ বিনিয়োগ চলে যাবে মুসলিম দেশগুলোতে, ৫. ইতিহাসের অনিবার্য ধারাবাহিকতায় ইসলামিক আর্থ-সামাজিক মূল্যবোধের পুনরুত্থান ঘটবে, ৬. পারিবারিক সম্পদ ও ওয়াক্ফ সম্পত্তির উদ্ভব, ৭. মুসলিম জনসংখ্যা পুনঃস্থাপনের হার বিশ্বের সমগ্র জনসংখ্যা পুনঃস্থাপনের তুলনায় দ্রুত, ৮. পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক মন্দা ও ডলারের অনিবার্য পতন, এবং ৯. পশ্চিমা বিশ্বে পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও পাশ্চাত্য সভ্যতার বিনাশ।

তাই এই মুহূর্তে মুসলিম বিশ্বের করণীয় কী? ঐক্য গড়ে তোলা। বিশ্বের ৫৭টি মুসলিম দেশ যদি এক সুরে কথা বলে তাহলে তারা ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে। এই পরিবর্তন আনার জন্য আমি সামরিক সঙ্ঘাত সৃষ্টির কথা বলছি না। আমি শান্তির বাণী প্রচারের কথা বলছি। ইসলামে যে শান্তির বাণীগুলো রয়েছে তার ব্যাপক প্রচার করতে হবে। আর এই দায়িত্ব ওআইসির ওপর বর্তায়। ইসলামের মূল্যবোধগুলো ‘বিশ্বজনীন মূল্যবোধ’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ইসলাম বৈষম্যহীন সমাজ করার কথা বলেছে। বিশ্বের কেউ এ কথা অস্বীকার করে না। কিন্তু বাস্তবে আমরা দেখটি যে বিশ্বে ক্রমেই বৈষম্য আরো প্রকট হয়ে উঠছে। ধনী-গরিবের ব্যবধান এটাই হয়েছে যে, এখন বিশ্বের ১ শতাংশ মানুষের হাতে প্রায় ৯৯ শতাংশ সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়ে পড়েছে। কোনো দেশই এই পরিস্থিতি থেকে মুক্ত নয়। বৈষম্য যেন চিরন্তন একটি চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা এখন শুধু আরেকজনকে মারার চেষ্টা করছি। সে জন্যই অস্ত্র কেনার পেছনে প্রতি বছর শত শত বিলিয়ন ডলার খরচ হচ্ছে।

মানবসভ্যতা যে বিপন্ন হয়ে পড়েছে সারা দুনিয়ায় তার নজিরের অভাব নেই। পশ্চিমা সভ্যতা কিভাবে একের পর এক যুদ্ধ উন্মাদনা তৈরি করছে, তা আমাদের দৃষ্টির অগোচরে নেই। এই সভ্যতার অবনতি এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে তাদের টিকে থাকতে হলে এখন যুদ্ধ বাধানো ছাড়া উপায় নেই। কাশ্মির নিয়ে আজকে যে সঙ্ঘাত তার জন্যও দায়ি পশ্চিমাদের জাতি রাষ্ট্রের ধারণা। ঔপনিবেশিক ভাগাভাগি। তাদের জন্যই মানব সভ্যতা আজ বিপন্ন হয়ে পড়ছে। পশ্চিমা দেশগুলোই মুসলিম বিশ্বে সঙ্ঘাতের জন্য দায়ী। মধ্যপ্রাচ্যে যে সঙ্ঘাত তার পেছনে কারণ তেল। সবাই এই তেলের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতে চায়।

অন্য দিকে ইসলাম বলেছে, আমাদেরকে ‘এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করার পর বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করা হয়েছে যেন একে অন্যের সাথে পরিচিত হতে পারি।’ এটাই ইসলামের চেতনা-‘ইউনিটি ইন ডাইভারসিটি’। ইসলাম হলো বিশ্বের এমন একটি ধর্ম, যাকে বুঝতে সবচেয়ে বেশি ভুল করা হচ্ছে। এই ভুল বোঝাবুঝি দূর করার জন্য ইসলামের বাণীগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার করা প্রয়োজন। মুসলমানদের জিহাদিস্ট বলছে পশ্চিমারা। কিন্তু জিহাদের সঠিক মানে আমাদের অনেকেই জানে না। তাই শুধু পশ্চিমাদের দোষ দিয়ে লাভ কী। জিহাদ হলো অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। হাদিসে বলা হয়েছে : কোথাও অন্যায় হতে দেখলে প্রথমে শারীরিকভাবে প্রতিরোধ করা। সেটি সম্ভব না হলে মুখে বলার চেষ্টা করো। এটাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে মনে মনে ঘৃণা করো। এটাই জিহাদের মূল কথা। কিন্তু এই কথাগুলোর ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে, ভুল বোঝা হয়েছে। জিহাদ মানে যেন অস্ত্র নিয়ে মরামারি করা আর জঙ্গি তৎপরতা চালানো হিসেবে দেখানো হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে মুসলিম দেশগুলোর করণীয় হলো নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। মানসভ্যতাকে বাঁচানোর জন্য মানুষের কাছে ইসলামের বার্তাগুলো পৌঁছানোর ঐতিহাসিক দায়িত্ব রয়েছে মুসলিম দেশগুলোর। ইসলামের চেতনাগুলো ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগ নিতে পারে ওআইসি। মুসলিম বিশ্বে ৬০০-এর বেশি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। আজ ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) মুসলিম বিশ্বের বাইরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন অমুসলিম দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও শিক্ষা মঞ্জুরি সহায়তা দিচ্ছে। তাহলে কেন মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সব দেশে একটি করে এমন গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে না, যেখান থেকে ইসলামের বাণীগুলো সংশ্লিষ্ট দেশের মানুষের কাছে স্থানীয় ভাষায় সহজবোধ্য করে পৌঁছানো হবে?

বিভিন্ন দেশ ও জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় অনুবাদ করে ইসলামের চেতনাগুলো ছড়িয়ে দিতে হবে। এতে অন্তত দেশে দেশে ইসলামফোবিয়া বা ইসলামের নাম শুনলেই নাক ছিটকানো বন্ধ হবে। হুমকি দিয়ে, যুদ্ধ বাধিয়ে, অস্ত্র বিক্রি করে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না। মুসলিম দেশগুলো তাদের সম্পদের ৭% অস্ত্রশস্ত্রের পেছনে ব্যয় করছে। পশ্চিমারা তাদের পুরনো, বাতিল অস্ত্রগুলো মুসলিম দেশগুলোর কাছে বিক্রি করে মুসলমানদের সম্পদ শুষে নিচ্ছে। আর এসব অস্ত্র দিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে হানাহানি করে নিজেদের ধ্বংস করছি।

ইসলামের বাণী বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব রয়েছে। মানবতাকে শান্তি উপহার দিতে হবে। ওআইসির পক্ষে এটা সম্ভব। আমি বিশ্বাস করি, বিশ্বের ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্র একত্র হলে তা যে অভাবনীয় শক্তি তৈরি হবে তার সামনে পশ্চিমা যেকোনো শক্তি তুচ্ছ। তবে আমি শক্তি প্রয়োগের জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে বলছি না। বলছি, শান্তির বাণী ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীল হতে ইসলামে অত্যন্ত তাগিদ দেয়া হয়েছে। মুসলিম বিশ্বে বিগত প্রায় দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে কখনো ওআইসির মতো প্রতিষ্ঠানের আবির্ভাব ঘটেনি। তাই এই প্রতিষ্ঠানটিকে কাজে লাগাতে হবে।

লেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড; সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক, জেদ্দা
hmct2004@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement